মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০১৭

মো: মোবারক হোসাইন

সুন্দর সমাজ ও আদর্শ জাতি গড়তে প্রয়োজন জনশক্তির টেকশই মানোন্নয়ন

সুন্দর সমাজ ও আদর্শ জাতিগঠনে প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক তৈরি যা ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। Elder L. Tom Perry said, `We live in a world that is crying for righteous leadership based on trustworthy principles..’ সুন্দর সমাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষ নাবিকের। কারণ মাঝি ছাড়া যেমন নৌকা চলে না তেমনি নেতা বা নেতৃত্ব ছাড়া সমাজ, দেশ ও জাতি চলতে পারে না। সংগঠনের সকল পর্যায়েই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোগ্যতার কোনো বিকল্প নেই : বিপ্লবের সফলতার জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদের মত একদল লোক তৈরির মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে মদিনার মতো সোনালি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে।

মানোন্নয়নের জন্য সাধারণত ইংরেজি Progress, Recover, Advance, Get better, Enrich, Improve, Develop, Enhance, Augment এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। আর ‘টেকসই’ শব্দটি একটি অ্যাকাডেমিক শব্দ। এর ইংরেজি হলো Sustainable, Durable, Strong, Long-lasting, Resilient, Heavy-duty, Forceful, Hard-wearing, sturdy ইত্যাদি। অর্থনৈতিক পরিভাষা ‘টেকসই উন্নয়ন’ বলতে বোঝায় Sustainable development (SD) is a pattern of growth in which resource use aims to meet human needs while preserving the environment so that these needs can be met not only in the present, but also for generations to come. (Source : Wikipedia, the free encyclopedi

অর্থনীতির এই সংজ্ঞার আলোকে- ‘জনশক্তির মানোন্নয়ন বলতে আমরা সেই মানোন্নয়নকে বুঝি যা শুধু বর্তমান সময়কেই গুরুত্ব দেবে না বরং ভবিষ্যতেও সেই জনশক্তি তার মান, সেবা ও সক্রিয় কাজ দিয়ে সমাজে নিজের সরব উপস্থিতির মাধ্যমে Potentiality পরিচয় দেবে’।

নবী-রাসূল (সা) ও তাঁর উত্তরসূরিদের মান :
আল্লাহর রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা)-কেও মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে সুন্দরী নারী, বিশাল ধনসম্পদ, বাদশাহি, ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়েও তার মান থেকে সরাতে পারেননি। তখন রাসূল (সা) বলেছিলেন আমার এক হাতে চন্দ্র ও অন্য হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি আমার লক্ষ্য থেকে একচুল পরিমাণও নড়ব না। আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহিম (আ) আগুনে পতিত অবস্থায়ও মান থেকে সরে আসেননি। ফেরাউন তাঁর স্ত্রী আসিয়া (আ)-এর ওপর চরম নির্যাতন করলেও হযরত আসিয়া (আ) বিন্দুমাত্রও তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসেননি। হযরত ইউসুফ (আ) ঘরে আবদ্ধ অবস্থায়ও নিজের নবুওয়তি মান থেকে একচুল বিচলিত না হয়ে বললেন, “হে আমার রব, এরা আমাকে যে (পাপের) দিকে আহবান করছে তার চাইতে কারাগার আমার কাছে অধিক প্রিয়, যদি তুমি আমাকে এদের ছলনা থেকে রক্ষা না করো তাহলে হয়তো আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাবো এবং (এক সময় হয়তো) আমিও জাহেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বো! (সূরা ইউসুফ-৩৩) হযরত ইয়াহইয়া (আ)কে শিরচ্ছেদ করা হয়েছে, আসহাবুল উখদুদকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, বেলাল (রা) কে তপ্ত বালুতে কাঠফাটা দুপুরে চিৎ করে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন, হযরত খুবাইব ইবনে আদির (রা) শরীর থেকে জীবন্ত অবস্থায় একের পর এক অঙ্গ কেটে শহীদ করা হয়েছে, আবদুল কাদের আওদাহ ও সাইয়্যেদ কুতুবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়েছে, তারা জীবন দিয়েছেন কিন্তু নিজেদের মান বা শপথ থেকে একবিন্দু সরে আসেননি। বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়েছে। তারা হাসিমুখে তাদের জীবন দিয়েছেন কিন্তু তাদের মানকে রেখেছেন অটুট।

কুরআন ও হাদিসের পাতায় পাতায় সোনার হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে অতীতের আম্বিয়া (আলায়হিমুস-সালাম) ও তাদের সঙ্গী-সাথীদের ত্যাগ ও কোরবানির কীর্তিগাথা। আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১৪৬ নম্বর আয়াতে সংগ্রামে অবিচল নবী ও তাঁর সাথীদের চমৎকার বর্ণনা পেশ করেছেন। “অনেক নবীই (এখানে এমন) ছিলো, নবী (আল্লাহর পথে) যুদ্ধ করেছে, তার সাথে (আরো যুদ্ধ করেছে) অনেক সাধক ব্যক্তি, আল্লাহর পথে তাদের ওপর যত বিপদ-মুসিবতই এসেছে তাতে (কোনো দিনই) তারা হতাশ হয়ে পড়েনি, তারা দুর্বলও হয়নি (বাতিলের সামনে তারা) মাথাও নত করেনি, আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন ।” তারা আর কিছুই বলেননি শুধু এ কথা ছাড়া: “হে আমাদের রব্ব! আমাদের গুনাহগুলো মাফ কর এবং আমাদের আচরণের বাড়াবাড়িগুলোও। আর আমাদের কদমগুলোকে দৃঢ় করে দাও এবং কাফিরদের ওপর আমাদের বিজয় দান কর।” ইবরাহিম (আ), যাঁর মিল্লাতের আমরা অনুসারী, তাঁকে একের পর এক পরীক্ষা করেছেন আল্লাহ। অসংখ্য কোরবানি তিনি দিয়েছেন, নিজের দেশ, পরিবার, সন্তান ইত্যাদি। তারপর আল্লাহ তাঁকে মানবতার জন্য ইমাম নির্ধারিত করেছেন। “আর স্মরণ করো! ইবরাহিমকে তাঁর প্রভু কয়েকটি নির্দেশ দ্বারা পরীক্ষা করলেন, এবং তিনি সেগুলো সম্পাদন করলেন। তিনি বললেন, আমি নিশ্চয়ই তোমাকে মানবজাতির জন্য ইমাম করতে যাচ্ছি।” (২ : ১২৪) আর আমাদের জন্য প্রেরিত রাসূল ও শিক্ষক মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সাথীদের কোরবানির ইতিহাস আমাদের জানাই আছে। দুনিয়ার ইতিহাসের বর্বরতম আচরণ করা হয়েছে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এবং আপন মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর সাথীদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সাথেও কঠিনতম আচরণ করা হয়েছে।

হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বিভিন্ন সময় সাহাবাগণের সাথে আলোচনায় বসতেন, তারা আলোচনা করতেন কাকে কী ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে, এ রকম একটি আলোচনায় একবার এক সাহাবী কিছু না বলে শুধু নিজের পিঠের কাপড় সরিয়ে দিলেন, আর তাদেরকে দেখালেন। উমার (রা) বলেন, আমি কখনো এ রকম পিঠ দেখিনি, তোমার কী হয়েছিল? তিনি বলেন, মক্কার মুশরিকেরা আমাকে নির্যাতনের সময় আগুনের মাঝে দীর্ঘক্ষণ ধরে পাথর গরম করতো, এরপর আমার পিঠের ওপর সেই পাথরগুলো ছেড়ে দেয়া হতো, আমাকে সেই উত্তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে দেয়া হতো, এতে আমি অনুভব করতাম যে আমার পিঠের মাংস পুড়ে যাচ্ছে আর আমি পোড়া মাংসের ঘ্রাণ পেতাম, আর এ কারণেই আজকে আমার পিঠে এই গর্তগুলো দেখতে পাচ্ছেন।

নিদারুণ কষ্ট ও মুসিবতে পতিত ছিলেন সাইয়্যিদুনা খাব্বাব (রা)। তিনি ছিলেন এক মহিলার দাস ও পেশায় কামার। ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার মুশরিকরা তাঁর দ্বারা কাজ করিয়ে নিয়ে তাঁকে মূল্য দেয়া থেকে বিরত থাকত। তারা এমনকি তাঁকে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখত। আর এ অবস্থায় তাঁর চামড়া, রক্ত, চর্বি ও গোশ্ত গলে গিয়ে আগুন নিভত। এমনকি তাঁর পিঠে এজন্য অনেক গর্তও হয়ে গিয়েছিল। এই দুর্বিষহ অবস্থায় খাব্বাব (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করেন না, আমাদের জন্য দোয়া করেন না?” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “তোমাদের পূর্বে এমন ব্যক্তিরা পার হয়েছেন যাদের মধ্য থেকে কোন এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে এসে একটা গর্তে পুঁতে দেয়া হতো; তারপর করাত এনে তার মাথার ওপর রেখে তা চালিয়ে দিয়ে তাকে দ্বিখন্ডিত করে দেয়া হতো; এবং লোহার চিরুনি দিয়ে তার হাড় থেকে তার গোশ্তগুলো ছাড়িয়ে নেয়া হতো। কিন্তু এটাও তাকে তার দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারত না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ অবশ্যই এই দাওয়াতকে পূর্ণতা দান করবেন। আর একজন সওয়ার সান‘আ থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে যাতে তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না এবং কোনো দুশ্চিন্তাও করতে হবে না শুধু তার পালিত পশুর ব্যাপারে নেকড়ের ভীতি ছাড়া। (সহীহ আল-বুখারী) আর এঁদের পথ ধরেই যুগে যুগে আল্লাহ নিবেদিতপ্রাণ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ত্যাগ ও কোরবানির নমুনা পেশ করেই চলেছেন। আর এই ধারা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।

তিনটি বিষয়ে মানোন্নয়ন :
১. জ্ঞানগত ২. আমলগত ৩. ময়দানগত

জ্ঞানগত দিক
১. কুরআনের ভাষায় কুরআন বোঝা : ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের গুরুত্ব এখানেই। বন্ধু, সমর্থক, কর্মী, সাথী, সদস্য ও উচ্চতর অধ্যয়নের যে সিলেবাস দেয়া আছে তা যদি কোনো কর্মী ১০০% পড়ে ও মেনে মানোন্নয়ন করে তবে সে নিশ্চিভাবে কুরআনের ভাষায় কুরআন বুঝতে পারবে। অর্থসহ কুরআন-হাদিসের সিলেবাস অধ্যয়নের মাধ্যমে একজন কর্মী অধিকাংশ সূরাই অর্থসহ বুঝে বুঝে পড়বে। পাশাপাশি আলোচনা চক্র, পাঠচক্র, কুরআন ক্লাস ও স্টাডি সার্কেলের মাধ্যমে সে কুরআনের ভাষায় কুরআন বুঝতে সক্ষম হবে যদি সে আন্তরিকতা নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। ইসলামী আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো সাহাবাদের (রা) মতো একদল লোক তৈরি করা।

২. ইসলাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান : আল্লাহতাআলা প্রদত্ত এবং রাসূল (সা) নির্দেশিত যে আদর্শ বা বিধানাবলি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে ইসলাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। যে পথে অন্যদেরকে আহবান করব, আন্দোলন সংগ্রাম তথা সর্বোচ্চ কোরবানির মাধ্যমে যা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে সম্পর্কে প্রথমে নিজেকেই পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন করতে হবে। যে সম্পর্কে জানা নেই, তা প্রতিষ্ঠা করা কিভাবে সম্ভব? এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না। কাজেই দায়িত্বশীলকে ইসলামী আকিদা, ইবাদতের পথ ও পদ্ধতি, ইসলামের সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, জীবন চলার পথের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ভাসা ভাসা জ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপথগামী হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আল্লাহতা’আলা ঘোষণা করেছেন, অর্থাৎ নিশ্চয়ই আনুমানিক (ভাসা ভাসা) জ্ঞান সত্যের ক্ষেত্রে কোনো উপকারে আসে না। (সূরা নাজম : ২৮)

৩. নিজ পেশা বা কাজ সংক্রান্ত সার্বিক জ্ঞান : একজন দায়িত্বশীল ছাত্রকে ক্লাসের অন্য দশজনের চেয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে অধিক জ্ঞানার্জন করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক অন্যদের মতো কেবল সাধারণভাবে অধ্যয়ন করলেই চলবে না বরং তার আদর্শের পক্ষে যা কিছু পাওয়া যায় তা যথাযথভাবে আত্মস্থ করা চাই। তার সংগঠনের আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় এ পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানকে সর্বেচ্চ কাজে লাগানোর জন্য এর যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ও মনোযোগসহকারে অধ্যয়ন করতে হবে। দায়িত্বশীল অন্য কোনো পেশার হলে তার সে পেশা যেন দ্বীন বিজয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে সে উদ্দেশ্যকে সামনে রাখতে হবে। সে জন্য স্ব-পেশা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও দক্ষতা তাকে অর্জন করতে হবে। যেমন- নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে সকল আম্বিয়া আ:কে দিয়ে আল্লাহতাআলা মেষ চরিয়েছেন। এলোমেলো চলাফেরায় অভ্যস্ত, প্রচন্ড জিদওয়ালা এসব প্রাণীকে চরাতে গিয়ে তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে শতধাবিভক্ত মানবজাতিকে দ্বীনের পথে পরিচালনার জন্য এ দক্ষতা গুরুত্ব¡পূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অতএব দায়িত্বশীলকে ব্যক্তিগত পেশায় এবং কঠিন থেকে কঠিনতর কাজেও সফল হতে হবে।

৪. ভাষাগত জ্ঞান: বর্তমান প্রতিযোগিতার বিশ্বে ভাষাগত দক্ষতার বিকল্প নেই। এজন্য ইংরেজি এবং আরবি ও অন্যান্য ভাষাগত জ্ঞান অপরিহার্য। পবিত্র কুরআন, হাদিসসহ ইসলামের মৌলিক গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায়। রাসূল সা. এরশাদ করেছেন আরবি ভাষাকে আমি তিন কারণে ভালোবাসি এক. আমি আরবি ভাষাভাষী। দুই. পবিত্র কুরআনের ভাষা আরবি। তিন. জান্নাতবাসীদের ভাষা আরবি। (তবরানি, আল-হাকিম, বায়হাকি)

৫. অন্যান্য বিপ্লবের ইতিহাস: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত নানা বিপ্লবের সামগ্রিক ইতিহাস দায়িত্বশীলকে জানার চেষ্টা করতে হবে। এসব বিপ্লবের লক্ষ্য, টার্গেট ও ফলাফলের সাথে ইসলামের আদৌ কোনো সম্পর্ক থাক চাই না থাক। বৈষয়িক যেকোনো বিপ্লব থেকেও শিক্ষণীয় বিষয়াবলি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- রুশ বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ইরান বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব ও তৎকালীন বিশ্ব/আরব জাহানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি।

৬. বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার সম্পর্কিত জ্ঞান : বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ইসলামের বিজয়ের পথে মুখ্য সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং এর চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবাধ ও সর্বোচ্চ ব্যবহার জানতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মুসলমানদের হারানো নেতৃত্ব পুনঃ উদ্ধারের মানসিকতা নিয়ে দায়িত্বশীলকে কাজ করতে হবে। ইসলাম এ বিষয়টিতে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছে। যেমন- কুরআন পাকে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, “ যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও জমিনের এই সৃষ্টি (নৈপুণ্য) সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করে (এবং এসব দেখে তারা বলে), হে আমাদের রব (সৃষ্টি জগৎ) এর কোনো কিছুই তুমি অযথা পয়দা করোনি, তুমি অনেক পবিত্র, অতঃপর তুমি আমাদের জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে নিষ্কৃতি দাও। (সূরা আলে ইমরান : ১৯১) তবে একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে ইসলামের বিজয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের সকল কাজে আস্থা-বিশ্বাস ও ঈমান একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার ওপর রাখতে হবে।

৭. মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান: মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান দায়িত্বশীলকে অর্জন করতে হবে। কর্মীদের কথার ভঙ্গি, আচার-আচরণ, দৃষ্টি, চেহারার মলিনতা কিংবা হাস্যোজ্জ্বলতা, গতি-প্রকৃতি, শিষ্টাচার ইত্যাদি দেখে দায়িত্বশীলকে রোগ বা সমস্যা নির্ণয় করতে হয়। তাদের প্রত্যাশা ও চাহিদা দেখে তা পূরণ কিংবা তার অযৌক্তিকতা বুঝিয়ে দিতে হয়। মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞান এসব ক্ষেত্রে তাকে ব্যাপক সহযোগিতা করতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলকে প্রচন্ড ধীশক্তি ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। কোনো ক্রমেই তালগোল পাকিয়ে ফেলা যাবে না। মাদ‘উ (যাকে দাওয়াত দেয়া হয়) এর যথাযথ অবস্থা বুঝে সংগঠনের দাওয়াত উপস্থাপনের জন্য দায়ীর এ জ্ঞান অতীব জরুরি। দায়িত্বশীল হিসেবে সংগঠনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মনোবিজ্ঞানের ওপর জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

৮. ইকামতে দ্বীন হচ্ছে জীবনোদ্দেশ্য : সকল নবী-রাসূল (সা)গণই দাওয়াতে দ্বীন ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজ করেছেন। সূরা শুরার ১৩ নম্বর আয়াতের নির্দেশ হচ্ছে, “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে অহির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহিম (আ), মূসা (আ) ও ঈসাকে (আ)। তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, এ দ্বীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ভিন্ন হয়ো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে তুমি তাদের আহবান জানাচ্ছো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান যারা তাঁর প্রতি রুজু করে।” খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাক্সক্ষার পর্যায়ভুক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। (ই.আ.সা.শ. ১২-১৩)। যিনি মানোন্নয়ন করবেন তিনি আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে দ্বীন কায়েমের কাজকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দেন।

৯. গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর ভয় :
আল্লাহর কাছে সেই সম্মানিত যে তাঁকে ভয় করে। (৪৯:১৩)
সুতরাং আল্লাহকে তেমনিভাবে ভয় কর যেমনটি ভয় করা উচিত। (০৩:১০২)
গোপন ও প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করা ঈমানের দাবি।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা) বলেছেন, ছোটখাটো গুনাহের ব্যাপারেও সতর্ক হও কেননা তার জন্যও জবাবদিহি করতে হবে।
হযরত রাসূল (সা) থেকে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে তাকাবেন না, বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে তাকাবেন।

তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম। (হাদিস)
১০. ইসলামের স্বর্ণালি যুগের ইতিহাস
১১. চলমান দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে (রাজনৈতিক ও অন্যান্য):

আমলগত দিক:

১. পরিশুদ্ধ আত্মা ও উন্নত আমলের অধিকারী হওয়া :
ক. সকল কাজের সফলতা-কিংবা বিফলতা নির্ভর করে আত্মার পরিশুদ্ধিতার ওপর : আল্লাহতা’আলা ঘোষণা করেন: অর্থাৎ যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করল সে সফলকাম আর যে আত্মাকে কলুষিত করল সে ব্যর্থ হলো। (সূরা আশ্ শামস : ৯-১০) রাসূল (সা) ঘোষণা করেন: অর্থাৎ মানবদেহে অবধারিতভাবে এক টুকরা গোশত রয়েছে, যখন সেটি পরিশুদ্ধ হয় তার সব কিছুই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন তা কলুষিত হয় তখন তার সব কিছুই কলুষিত, বিপথগামী ও বিনষ্ট হয়ে যায়। (শরহু রিসালাতে কিতাবুল ঈমান, আবু উবায়দুল্লাহ বিন সালাম, ১ম খন্ড, পৃ: ১৫৯)

খ. উন্নত আমল: ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের আমল হতে হবে সর্বোন্নত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতা’আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশনা দিয়ে বলেন: অর্থাৎ আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ডাকাডাকি করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার জিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। (সূরা কাহাফ : ২৮) যে কোন সময় তার দ্বারা দ্বীনের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হতে পারে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহতা’আলা ঘোষণা করেন: অর্থাৎ তোমরা ঐসব ব্যক্তির অনুসরণ কর যারা তোমাদের কাছে প্রতিদান কামনা করে না এবং তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত। (সূরা ইয়াসিন : ২১) এ আয়াতে কারিমার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা দায়িত্বশীলদেরকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এটা অর্জিত হতে পারে ঈমানী মজবুতি ও উন্নত আমলের মাধ্যমে। এ জন্য দায়িত্বশীলদের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নতের পাশাপাশি নফল বা মুস্তাহাবের প্রতিও যত্নবান হতে হবে। আল্লাহতা’আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন : অর্থাৎ (রাতের শেষ ভাগে) তাদের পার্শ্বসমূহ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং পালনকর্তার আজাবের ভয়ে ও রহমতের আশায় তাকে ডাকাডাকি করতে থাকে। (সূরা সেজদাহ :১৬)

২. ইসলামের প্রাথমিক দায়িত্বসমূহ পালন :
যাকে মানোন্নয়ন করব তার কতিপয় মৌলিক বিষয় খেয়াল রাখা দরকার।
কথা-কাজের মিল থাকা। (সূরা আস্ সফ-২-৩)
অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী আমল। (হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর সংক্রান্ত হাদিস-তিরমিজি)
আমানত সচেতনতা। (আয়াতগুলো হচ্ছে ২৩:৮, ০৪:৫৮, ০৮:২৭, ৩৩:৭২)
সত্যবাদিতা ও উন্নত নৈতিকতা
আন্তরিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা
চিন্তা-গবেষণা

জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে আত্মনিয়োগ
যেহেতু আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা-সংগ্রাম চালানো সব ফরজের বড় ফরজ তাই নিজের জান-মাল (৬১:১১) বাজি রেখে এ পথে প্রাণান্তকর পরিশ্রম (২২:৭৮) চালিয়ে যাওয়া।
কয়েকটি খেয়ালযোগ্য অন্তরায়:
নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদিপশু ও কৃষিক্ষেত। (০৩:১৪-১৫)
সূরা তাওবার ২৪ ও ৩৯ নম্বর আয়াতে ৮টি বিষয়ের মধ্যে ৩টি বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় কঠিন শাস্তির ঘোষণা আছে।
সুতরাং যাকে মানোন্নয়ন করব তার দিকে খেয়াল রাখা যে তিনি পেরেশানির সাথে এই দায়িত্ব পালনে মনোযোগী কি-না।

পর্বতসম বিপদ-মুসিবতে টিকে থাকা :
ভয়-ভীতি, আর্থিক ক্ষতি, জীবন নাশ, অপবাদ-অপপ্রচার, অসুস্থতা ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে বাছাই করেন। (আয়াত ০২:১৫৫-১৫৭, ০৩:১৪০-১৪১, ০৩:১৮৬, ০৯:২০-২১) সুতরাং কে সুদিনের সাথী আর দুর্দিনে কেটে পড়ে তা Justify I Observation করে মানোন্নয়ন করানো দরকার। “আমার জন্য তো এ আন্দোলন আমার জীবনের উদ্দেশ্য।

আমার জীবন-মরণ তারই জন্য। কেউ সম্মুখে অগ্রসর না হলে আমি হবো। কেউ সহযোগিতা না করলে আমি একাকীই এ পথে চলবো। গোটা দুনিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধিতা করলে আমি একা তার বিরুদ্ধে লড়তে ভয় করবো না।” (মাওলানা মওদূদী, জা.ই.কা.বি. ১ম খন্ড, ২৪ পৃষ্ঠা)

মানোন্নয়নে করণীয়
১. ব্যক্তির (নিজের) মানোন্নয়ন
# জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে
# চিন্তার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে
# পরিপূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে
# উন্নত ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে
# সর্বোপরি আমল-আখলাক সুন্দর করার মাধ্যমে
# বাহ্যিক আচরণ সুন্দর করার মাধ্যমে

২. জনশক্তির মানোন্নয়ন
# ব্যক্তিগত কন্টাক্টের মাধ্যমে
# সুহবতের প্রদানের মাধ্যমে
# পরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে
# যেমন-দারস, আলোচনা, বিষয়ভিত্তিক নোট দিয়ে সহযোগিতা করে
# পরিকল্পিত প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে
# যেমন-টিএস, শব্বেদারি, সাধারণ সভা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে
# সুন্দর পরিকল্পনা করে দেয়া মাধ্যমে
# যেমন-সাপ্তাহিক, মাসিক, বার্ষিক পরিকল্পনা করে দেয়া
# কাজ দিয়ে কাজের তদারক করা
# জনশক্তির জন্য সর্বদা দোয়া করা
# টার্গেট করে পরিকল্পিত মানোন্নয়ন
# আউট-ভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিরিয়াস হতে হবে।
# যে কোন মূল্যে দাওয়াতি তৎপরতা অব্যাহত রাখা।
# মান নিশ্চিত করে মানোন্নয়ন করা।

৩. সাংগঠনিক মানোন্নয়ন
# উপশাখাগুলোকে যথার্থ মানে উন্নীত করা
# উপশাখার উদ্যোগে নিয়মিত প্রোগ্রাম হাতে নেয়া
# পর্যাপ্ত পরিমাণ বই নিয়ে চাহিদা অনুযায়ী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা
# মাসের শুরুতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও জনশক্তির মাঝে কর্ম বণ্টন করা
# উপশাখার উদ্যোগে নিয়মিত দাওয়াতি কাজ করা
# উপশাখার উদ্যোগে নিয়মিত মানোন্ননের চেষ্টা করা
# জনশক্তির মধ্যে টিমস্পিরিট তৈরি করা
# আনুগত্য ও আন্তরিক পরিবেশ তৈরি করা
# রুহানি পরিবেশ সংরক্ষণ করা
# সাংগঠনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা

লেখক : পিএইচডি গবেষক

সংশ্লিষ্ট