সোমবার, ০৩ এপ্রিল ২০১৭

ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব

মধ্যযুগের বর্বরতা ও ইসলামের স্বর্ণযুগ

শ্রীমানবেন্দ্রনাথ রায় তার বিখ্যাত গ্রন্থ Historical Role of Islam-এ বলেন, মুসলিম শিক্ষার প্রভাবেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার নেতা হতে পেরেছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, পাশ্চাত্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র (ইসলাম) এবং আর্ত পৃথিবীকে তা দিলো আলো ও স্বস্তি। বিগত ৪ জুন ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিসরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, As a student of history, I also know civilizations debt to Islam. It was Islam-at places like Al-Azhar-that carried the light of learning through so many centuries paving the way for European Renaissance and Enlightment. It was innovations in Muslim communities that developed the order of Algebra, our magnetic compass and tools of navigation; our mastery of pens and printing; our understanding of how disease spread and how it can be healed.

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ এবং ঢাকার মহাসমাবেশে তাদের উপস্থাপিত ১৩ দফা দাবিকে কোনো কোনো মহল ‘মধ্যযুগের চিন্তাচেতনার সাথে তুলনা করে বক্তব্য দেয়া শুরু করেছেন। হেফাজতে ইসলামের শীর্ষনেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, তাদের দাবিগুলো অরাজনৈতিক এবং যেকোনো মুসলিমের উচিত তা সমর্থন করা। কারণ ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্যই দাবিগুলো পেশ করা হয়েছে। তাদের দাবির মধ্যে প্রধান দুটি দাবি হচ্ছে : সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর দৃঢ়বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা’ পুনঃস্থাপন ও ইসলামের অবমাননার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করে আইন প্রণয়ন। তাদের আরো দু’টি দাবিও গুরুত্বপূর্ণ, একটি হচ্ছে বর্তমান সরকারের প্রণীত নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিল করা। সেকুলার ঘরানার কিছু নারী-পুরুষ হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোকে নারীস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ বলে অপপ্রচার শুরু করেছেন। আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী আরো বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা দাবিকে মধ্যযুগীয় বলার মানে পুরো ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের নিয়ে বিদ্রুপ করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

বস্তুত পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শনের অনুসারী কিছু লোক ‘মধ্যযুগ’ সম্পর্কে কোনো লেখাপড়া না করে তথাকথিত আধুনিকতার মোড়কে নিজেদের মূর্খতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। বিশ্বের প্রখ্যাত মনীষীরা প্রকৃত ইতিহাস জেনে ইসলাম সম্পর্কে তাদের ইতিবাচক মতামত দিলেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছু লোকের মূর্খতার মাত্রা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এরা এতটাই অন্ধ যে ইউরোপের কালো ইতিহাসকে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। এসব অর্বাচীন ব্যক্তিদের জন্য কিছু ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরা প্রয়োজন বোধ করছি।

ইউরোপের ইতিহাসে চতুর্থ থেকে পঞ্চদশ শতককে ‘মধ্যযুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয় (ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপেডিয়া)। কেউ কেউ এ সময়টাকে ইউরোপের ‘অন্ধকার যুগ’ বলে থাকেন। অষ্টম শতকে ইউরোপে সামন্ত ভ‚স্বামী, গোত্র অধিপতি ও যাজকদের প্রাধান্য ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে তেমন কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্ব ছিল না। আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি’ দ্বারা সমাজ পরিচালিত হতো। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না বললেই চলে। মধ্যযুগের শুরুতে ইউরোপে খ্রিষ্টধর্ম যাজকেরাই জ্ঞানের আলো ছড়াতে কিছু অবদান রাখেন। তারা এ সময় রোমান সাম্রাজ্যের অনেক ভালো জিনিস গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এ সময় রোমান সাম্রাজ্য জ্ঞানবিজ্ঞানে অনেক এগিয়েছিল এবং সেখানে আইনের শাসন ছিল। স্থানীয় শাসকেরা কলহ-বিবাদে দুর্বল হয়ে পড়লে যাজকরা রাজ্যশাসনে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তারা কর আদায় থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করে। নবম ও দশম শতকে সামন্ত-প্রভুরা তাদের অবস্থান সংহত করে। বিশাল এলাকার ভূমি দখল করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত সরকার গড়ে ওঠে। এ সময় চার্চ ও সামন্ত-প্রভুদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। যে যার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সমাজের তৃতীয় শ্রেণীটি ছিল অসহায় কৃষক। তারা চার্চ ও সামন্ত-প্রভুদের স্বার্থে কৃষিকাজ করত।

এ সময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য, মহামারী ছিল নৈমিত্তিক চিত্র। জনগণের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩০ বছর। দশম শতকের আগ পর্যন্ত ইউরোপের লোকেরা বহির্বিশ্বের সাথে তেমন পরিচিত ছিল না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু হলে তারা রোমান ও বাইজেন্টাইনদের সংস্পর্শে আসে। এর পর তারা মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত শুরু করে। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ইউরোপে সামন্তশাসনের পতন ঘটে এবং গিল্ড ও জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হতে থাকে। এ সময় চার্চের প্রভাবও বৃদ্ধি পায়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদীক্ষা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মধ্যযুগের শেষদিকে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে ইউরোপ আধুনিকতার পথে পা বাড়াতে থাকে; যদিও যুদ্ধ আর মহামারী তাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছিল। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ লোক মারা যায় প্লেগ, বন্যা ও দুর্ভিক্ষে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স শতবর্ষের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

মধ্যযুগের শেষে রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠলেও চার্চের সাথে তাদের বিরোধ শুরু হয়। তারা একে অপরের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকে। এ সময়ের বিরোধে খ্রিষ্টধর্ম ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট- এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি শ্রেণী ধর্মীয় বিবাদে না জড়িয়ে ‘মানবতাবাদী’ (হিউম্যানিজম) মতবাদ অনুসরণ করেন। তারা ধর্মীয় বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে বস্তুগত মানবিক বিষয়ে মনোযোগ দেন। এর পর ইতালি থেকে শুরু হয় ‘রেনেসাঁর যুগ’। এ সময় খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব কমতে থাকে এবং চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও সেক্যুলার দর্শন বিকশিত হতে থাকে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ‘যুক্তিবাদের যুগ’ বা ‘আলোকিত যুগের’ সূচনার মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের অবসান ঘটে। এর পর থেকেই আধুনিক ইউরোপের যাত্রা শুরু।

পক্ষান্তরে, ইসলামের ইতিহাসে সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতককে ‘স্বর্ণযুগ’ বা ‘ইসলামি রেনেসাঁর যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। এ সময়কালে মুসলিম পণ্ডিত, গবেষক, প্রকৌশলী, কবি, দার্শনিক, ভূগোলবেত্তা, চিত্রশিল্পী ও বণিকেরা তাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দ্বারা কৃষি, অর্থনীতি, শিল্প, চিত্রকলা, আইন, সাহিত্য, দর্শনী, নৌবিদ্যা, সমাজতত্ত¡, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রাখেন, যা মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। খোলাফায়ে রাশিদিনের আমলের পর মুসলিম শাসকেরা সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অষ্টম শতকের মাঝামাঝি আব্বাসীয় শাসনামলে খিলাফতের রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে স্থানান্তরের পর জ্ঞানবিজ্ঞানে মুসলমানদের বিরাট উৎকর্ষসাধিত হতে থাকে। অবশ্য শাসকদের ক্ষমতার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরআন ও সুন্নাহর মূলনীতি অনুসরণ করতেন।

‘শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালি পবিত্রতর’ হাদিসের এ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলিম জ্ঞানসাধকেরা জ্ঞানবিজ্ঞানের সমুদ্র মন্থনে ব্রতী হন। এ সময় আব্বাসীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাগদাদে গড়ে তোলা হয় ‘বায়তুল হিকমা’ বা জ্ঞানের ভবন, যেখানে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই বিশ্ব জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ করে তারা তা আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র ও শিক্ষা বিষয়ের প্রাধান্য ছিল। বহু নান্দনিক বিখ্যাত গ্রন্থ হারিয়ে যেত যদি না সেগুলো প্রথমে আরবি এবং পরে তুর্কি, ফার্সি, হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হতো। মুসলিম পণ্ডিতেরা প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, রোমান, চীনা, ভারতীয়, পারসি, মিসরীয়, উত্তর আফ্রিকীয়, গ্রিক ও বাইজেন্টাইনীয় সভ্যতা থেকে বহু মূল্যবান জ্ঞান-ভাণ্ডার সংগ্রহ ও সঙ্কলন করেন। অপর দিকে বাগদাদের বাইরেও মিসরের কায়রো ও আন্দালুসিয়ার কর্ডোভা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও জ্ঞানচর্চার সুযোগ পেত।

মুসলমানরা চীন থেকে গোপনে প্রযুক্তি সংগ্রহ করে সমরকন্দ ও বাগদাদ নগরীতে কাগজের কল প্রতিষ্ঠা করে। চীনারাই প্রথমে কাগজের সূত্রপাত করলেও তাতে কলম ব্যবহার করা যেত না। মুসলমানরা প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে তা কলম দিয়ে লেখার উপযুক্ত করে। এর ফলে বাগদাদে শত শত দোকান গড়ে ওঠে যারা বই প্রস্তুত করত এবং তা সুন্দরভাবে বাঁধাই করে লাইব্রেরি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় লাইব্রেরি থেকে বই ধার দেয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। বাগদাদে পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনের পর তা উত্তর আফ্রিকার ফেজ নগরীতে ও আন্দালুশিয়ার কর্ডোভাতেও গড়ে ওঠে। এখান থেকে ত্রয়োদশ শতকে তা ইউরোপে স¤প্রসারিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এক একটি নগরী তখন জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে আরব মুসলমানদের বিশাল বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।

মধ্যযুগের বহু মুসলিম পণ্ডিত জ্ঞান ও মূল্যবোধচর্চার ক্ষেত্রে মানবিক, যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। এ সময়ের অনেক রচনায় প্রেম, ভালবাসা, কবিতা, ইতিহাস ও দর্শন, ধর্মতত্ত¡ বিষয়ের যে আলোচনা রয়েছে তাতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও উদারনৈতিক চিন্তাধারা লক্ষ করা যায়। ইসলামী সাম্রাজ্যে প্রধানত ইসলামি বিধিবিধানের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রের জীবন নিয়ন্ত্রিত হতো, তবু সেখানে খ্রিষ্টান ও ইহুদি পণ্ডিতদেরও সমানভাবে উৎসাহ ও মর্যাদা দেয়া হতো জ্ঞানচর্চার জন্য এবং এর ফলে অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত মুসলমানেরা বুদ্ধিবৃত্তি ও সৃজনশীল দার্শনিকতার উচ্চমার্গে আরোহণ করেছিল। এর মাধ্যমে তারা অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল। মুসলিম শাসকরা বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রেও বিরাট উদারতার পরিচয় দেন।

আরব পণ্ডিতরা সে যুগে পরিবেশ ও পরিবেশ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরা পরিবেশদূষণ, বিশেষ করে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মৃত্তিকার বিষাক্ততা, পৌরবর্জ্য অব্যবস্থাপনা, পরিবেশের প্রভাব মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয় মূল্যবান গবেষণা পরিচালনা ও গ্রন্থ রচনা করেন। কর্ডোভা নগরীতে সর্বপ্রথম বর্জ্য সংগ্রহের জন্য কনটেইনার স্থাপন ও তার সুব্যবস্থাপনা করা হয়।

মধ্যযুগের মুসলমানরা এমন কিছু বিজ্ঞান ও শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যা পূর্বেকার বিশ্বে অপরিচিত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাবলিক হসপিটাল, মানসিক রোগ নিরাময় হাসপাতাল, পাবলিক লাইব্রেরি, ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মহাকাশ দূরনিরীক্ষণ/পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণাকেন্দ্র ইত্যাদি। মধ্যযুগে বিমারিস্তান মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে সর্বপ্রথম চিকিৎসাবিষয়ক ছাত্রদের ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট দেয়া হয় চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার জন্য। এটা নবম শতকের ঘটনা। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে উল্লেখ রয়েছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মরক্কোর ফেজ নগরীর ইউনিভার্সিটি অব আল কারাউইন, যা ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি স্বীকৃত। ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের প্রথম সূচনা হয় মধ্যযুগের মাদরাসাগুলোতে।

দশম শতাব্দীতে শুধু কর্ডোভাতেই ছিল ৭০০ মসজিদ, ৬০ হাজার প্রাসাদ এবং ৭০টি লাইব্রেরি। সর্ববৃহৎ লাইব্রেরিটিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ। শুধু আন্দালুসিয়া থেকে প্রতি বছর কবিতা, যুক্তিবিদ্যা, সঙ্কলন ও বিভিন্ন প্রকার ৬০ হাজার পুস্তক প্রকাশিত হতো। কায়রো লাইব্রেরিতে গ্রন্থের সংখ্যা ছিল ২০ লাখ। অপর দিকে ক্রুসেডের সময় ধ্বংস হওয়ার আগে ত্রিপলির লাইব্রেরিতে ৩০ লাখ গ্রন্থের সংগ্রহ ছিল। মধ্যযুগে কেবল আরবি ভাষায় প্রকাশিত অঙ্কশাস্ত্রের গ্রন্থের সংখ্যা গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় মধ্যযুগে প্রকাশিত গ্রন্থের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আধুনিক যুগে ওই সব আরবি গ্রন্থের খুব সামান্যই এখন পঠিত হয়। ওই সময় মুসলমানরা যে গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিল সেগুলো শুধু ওই বইয়ের সংগ্রহশালা ছিল না; বরং সেগুলো একাধারে পাবলিক লাইব্রেরি, লেন্ডিং লাইব্রেরি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কেন্দ্র, আলোচনা ও সভা-সমিতির স্থান, শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগেই লাইব্রেরিতে বইগুলো সুবিন্যস্ত আকারে সংরক্ষণের জন্য ক্যাটালগ পদ্ধতি চালু করা হয়। ইসলামিক আইন ও আইনশাস্ত্র (জুরিসপ্রুডেন্স) সংক্রান্ত বেশ কিছু মৌলিক আইনগত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে সমন্বিত সাধারণ আইন রচিত হয়েছিল ইসলামি আইনের প্রভাবে।

ইসলামের স্বর্ণযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমভাবে পারদর্শী এক পণ্ডিতশ্রেণী গড়ে উঠেছিলেন যারা ‘হাকিম’ বলে পরিচিত ছিলেন। এসব পণ্ডিত ব্যক্তি বিভিন্ন মৌলিক অবদান রেখে গেছেন। সে যুগের মুসলিম পণ্ডিতরা আধুনিককালের বিশেষায়িত বিষয়ের মধ্যে সীমিত ছিলেন না। তারা এক একজন বহু বিষয়ের প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ বিদ্বান ছিলেন। ইসলামের স্বর্ণালি দিনগুলোতে মুসলিম সাম্রাজ্য বিশ্বায়নে বিরাট অবদান রাখে। এ সময় মুসলিম দিগ্বিজয়ী, নাবিক, পণ্ডিত, বণিক ও পরিব্রাজকেরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহু অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেন। কেউ কেউ এ সময়টাকে ‘আফ্রো-এশীয় যুগের আবিষ্কার’ বলে অভিহিত করেন। মুসলমানরা তাদের পুরনো বাণিজ্যিক সংযোগকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর ও পূর্বে দক্ষিণ এলাকায় তাদের ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণ করে। এর ফলে খোলাফায়ে রাশিদিনের আমল থেকে শুরু করে, উমাইয়া, আববাসীয় ও ফাতেমী শাসকেরা এয়োদশ শতক পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক শক্তি বলয় গঠন করেছিল। এটা ছিল তখনকার যুগে সবচেয়ে শক্তিশালী এক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শক্তি। মধ্যযুগের সমসাময়িক আরবি দলিল থেকে জানা যায়, আন্দালুস ও মাসরেবের মুসলিম অভিযাত্রীরা নবম থেকে চতুর্দশ শতকে আটলান্টিকের ওপারেও অভিযান চালিয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, কলম্বাসের আগেই মুসলিম নাবিকেরা আমেরিকা পৌঁছে, গিয়েছিল আমেরিকার কোনো এক অঞ্চল প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনও এর সাক্ষ্য দেয়। বিশেষ করে মুসলমানদের কবরের এপিটাফ থেকে এর প্রমাণ মেলে। আমেরিকার একটি ছোট শহরের নাম মদিনা, যা মুসলমানেরা পত্তন করেছিল।

মধ্যযুগে কৃষি খাতে মুসলমানেরা এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল মুসলিম কৃষি বিপ্লব যা আরব কৃষি বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানেরা বিশ্বায়ন করেছিল এবং এর পাশাপাশি তারা বিভিন্ন শস্য ও বৃক্ষের বীজ ও চারা সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে কৃষিপদ্ধতির ক্ষেত্রে অগ্রসর প্রযুক্তি প্রবর্তন করেছিল। তারা শস্যের চক্রাকার সেচের উন্নত পদ্ধতি ও শস্যের বহুমুখীকরণ এ তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে সক্ষম হন। এসব বিষয়ে তারা বিশ্বকোষ পর্যন্ত রচনা করেন। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতি, জনসংখ্যা বিকেন্দ্রীকরণ ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায়। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের আয় বৃদ্ধি পায়, নগরায়ন ত্বরান্বিত হয়, শ্রমশক্তি গঠনে উন্নতি ঘটে, শিল্পায়ন বৃদ্ধি পায়। এর সার্বিক প্রভাব পড়ে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে, রন্ধনপদ্ধতি ও পোশাক পরিচ্ছদসহ সর্বত্র।

ইসলামি খিলাফতের শুরু থেকেই মুক্তবাজার ব্যবস্থা চালু ছিল। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে মুক্ত বাজারব্যবস্থা আরো বিকশিত হয়। কোনো কোনো পাশ্চাত্য বিশ্লেষক একে ‘ইসলামী পুঁজিবাদ’ বলে অভিহিত করেন। যদিও ইসলামি শরিয়াহ আইন কার্যকর থাকলে পূর্ণাঙ্গ মুক্তবাজার বা পাশ্চাত্য ধারণার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠা সম্ভব হয় না। কারণ ইসলামী আইনে সুদ যেমন নিষিদ্ধ; তেমনি বাজারব্যবস্থার বিকৃতি দেখা দিলে রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। ইসলামে মজুদদারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার জাকাত, ওশের পদ্ধতিও পুঁজিবাদের লাগাম টেনে ধরে।

মুসলিম শাসকেরা এক উন্নত মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং উচ্চমানের মুদ্রা দিনার সর্বত্র চালু করেন, যা অর্থব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল ও গতিশীল করে তোলে। মুসলিম অর্থনীতিবিদ, বণিক ও ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন বাণিজ্যকৌশল ও বণিক সংস্থা গড়ে তোলে। বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রকাঠামোর বাইরে করপোরেশন আকারে গঠনের ধারণা মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান ছিল। করপোরেশনের ধারণা ইউরোপে গেছে মাত্র ত্রয়োদশ শতকে। দূরবর্তী বাণিজ্যিক লেনদেনব্যবস্থাও চালু হয়েছিল। একজন ব্যবসায়ী বাগদাদেও ব্যাংক মুদ্রা জমা দিয়ে তা চেকের মাধ্যমে স্পেনে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। বর্তমান ব্যাংকের চেকপদ্ধতি সূচনা সেখান থেকেই। কোনো শহরের পণ্য বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে পাঠাতে প্রত্যেক শহরে ট্যাক্স দিতে হতো, ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতো। মুসলমান ও ইহুদিদের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী এ পদ্ধতি চালু করে।

ইসলামি খিলাফতে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নির্বিশেষে সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতো। এমনকি নারীরাও বিভিন্ন পেশা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল। নারীরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক পেশায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিত যেমন- প্রাথমিক খাত (কৃষি), মাধ্যমিক খাত (নির্মাণশ্রমিক, রঙের কাজ, সুতার কারখানা) এবং টারশিয়ারি খাত (বিনিয়োগ, ডাক্তার, নার্স, দালালি, মহাজনী, শিক্ষকতা ইত্যাদি)। টেক্সটাইল শিল্পের বিভিন্ন খাতে মুসলিম নারীদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল।

মধ্যযুগে মুসলিম প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করেন। নগরায়ন প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির ফলে মুসলিম খিলাফতের নগরগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে ওঠে। অবশ্য নগরগুলোতে কতগুলো অভিন্ন নাগরিক সুবিধা ও অবকাঠামো পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে পণ্যবাহী বাহন সহজেই নগরীতে প্রবেশ করতে পারত। আবার আবাসিক এলাকাগুলো ছিল আলাদা এবং সেখানে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনের ঐতিহ্য রক্ষা করা হতো। নগরীর বর্জ্য ফেলা বা কবরস্থান আলাদাভাবে সংরক্ষিত হতো। নগরীর প্রধান ফটকের কাছেই থাকত মসজিদ, ধর্মীয় অনুশীলনের জন্য খোলা চত্বর এবং দণ্ড কার্যকর করার স্থান। এ ছাড়া থাকত সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুসলিম নগরীগুলোতে উন্নত পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল। পাবলিক টয়লেট ও বায়ু সুবিধার পাশাপাশি পাইপের সাহায্যে ব্যবহার্য ও পানীয়জল সরবরাহ করা হতো।

মধ্যযুগে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। কৃষিবিপ্লব ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা সৃষ্টির ফলে জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রিক রোমান সাম্রাজ্যে মধ্যযুগে গড় আয়ু ছিল মাত্র ২৮ বছর এবং সপ্তম-অষ্টম শতকে ইসলামী খিলাফতে ছিল ৩৫ বছর। দশম ও একাদশ শতকে ইরাক ও পারস্যের মুসলিম পণ্ডিতদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পায় ৮৪ বছরে। প্রায় একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে গড় আয়ু ছিল প্রায় ৭৩ বছর এবং মুসলিম স্পেনে ৬৯-৭৫ বছর। দ্বাদশ শতকে পারস্যে সাধারণ গড় আয়ু ছিল ৭৫ বছর এবং ত্রয়োদশ শতকে ৫৯-৭২ বছর। ইসলামি সাম্রাজ্যে মধ্যযুগের শিক্ষার হার ছিল এথেন্সের শিক্ষার হারের চেয়ে অনেক বেশি। ইসলামের বিষয়ে অভিযোগের একটি হলো, ইসলাম বিজ্ঞানচর্চা সমর্থন করে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অভিযোগটি আদৌ সঠিক নয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই স্বীকার করেন যে, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে অনেকাংশে ঋণী।

মধ্যযুগে ইসলামের মহান আদর্শ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাফল্য এতটাই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল যে, গ্রিক দর্শন ও ইউরোপীয় সমাজ আধুনিকতার পথে ধাবিত হয়। ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিট্টি বলেন : It is to the eternal glory of the medieval Muslim thinkers of Baghdad and Andalusia that they reconciled these two currents of thoughts and passed them on harmonized into Europe. Their contribution was one of the first magnitudes considering its effect upon scientific and philosophic thought and upon the theology of later times. ঐতিহাসিক হিট্টির মতে, মধ্যযুগে ইসলামী বিশ্ব থেকে যে নতুন ধ্যানধারণা বিশেষত দার্শনিক চিন্তাধারা ইউরোপে স¤প্রসারিত হয় তা ইউরোপের অন্ধকার যুগের অবসান ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুগের নতুন প্রভাতের সূচনা করে। জন ডবিøউ ক্যাম্পবেল জুনিয়র মন্তব্য করেন যে, মজার বিষয় হলো, রেনেসাঁর সময় ইউরোপ গ্রিস ও রোমের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাচর্চায় নিয়োজিত হলো; অথচ তারা যে অগ্রগতি সাধন করেছিল তা কিন্তু পেয়েছিল তাদের শত্রæ মুসলমানদের কাছ থেকে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ভ্রান্তশিক্ষায় শিক্ষিত বাংলাদেশের কিছু গলাবাজের অপপ্রচার ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও ঐতিহ্যের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

সংশ্লিষ্ট