বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল ২০১৭

ড. মোবারক হোসাইন

কালজয়ী নেতৃত্বের মডেল! রাষ্ট পরিচালনায় মুহাম্মদ (সা.) 

মহানবী (সা) মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় উপহার। মানব সভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ পর্যায়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা)-এর অতুলনীয় মহত্ত্ব ও গুণের ছাপ স্পষ্ট।সূরা আহজাবের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়ক ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।”পবিত্র কুরআনে সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা)-কে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বা মহাকরুণা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই পাঠিয়েছি।”সূর্য যেমন বিশ্বকে আলোকিত করে তেমনি নবী-রাসূলরা আলোকিত করেন মানুষের মন, চিন্তা ও আচরণ।

ইসলাম কেবল আধ্যাত্মিক বিধান অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের নাম নয়। বরং একটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যার মধ্যে মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনবিধান ধর্মীয় সামাজিক দেওয়ানী ফৌজদারী ব্যবসায় সংক্রান্ত, সামরিক বিচার বিভাগীয় এবং দন্ডবিধি বিষয়ক আইন কানুন রয়েছে।এ ধর্মের প্রবর্তক হলেন হযরত মুহাম্মদ। তিনি হলেন বিশ্বের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। যার ছিল না কোন নিয়মিত সৈন্যবাহিনী, না ছিল কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কর্মসূচী। অথচ তিনি এমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করলেন, যার নিদর্শন আজও ইতিহাসে বিরল। প্রখ্যাত বৃটিশ মনীষী বার্নার্ডশ বলেন f all the world was under one leader then Mohammad (sm) would have been the best fitted man to lead the peoples of various creed dogmas and ideas to peace and happiness. অর্থাৎ গোটা বিশ্বর বিভিন্ন ধর্মের সম্প্রদায় আদর্শ ও মতবাদ সম্পন্ন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক নায়কের শাসনাধীনে আনা হতো তবে একমাত্র মুহাম্মদ (সা.)ই সবর্ াপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পরেথ পরিচালিত করতে পারতেন।

লিও টলস্টয় ও মার্কিন তরুণীর দৃষ্টিতেঃসর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় যখন নি:সঙ্গ অবস্থায় রাস্তার ধারে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলেন, সে সময় তার কোটের পকেট থেকে তার নিত্য সময়ের সঙ্গী যে বইটি পাওয়া যায়,সেটি ছিল আবদুল্লাহ সোহরাওয়াদী লিখিত‘দ্য সেয়িংস অব প্রফেট মহাম্মদ (সাঃ) । বাংলায় যার শিরোনাম ‘মহানবী (সাঃ)বাণী’ বইটির একটি হাদিছে উল্লেখ রয়েছে,রাসুল (সাঃ) বলেছেন ‘তুমি নিজের জন্য যেটা ভালো মনে করবে ,অন্যের জন্য ও তা ভাববে । আর যেটা নিজের জন্য মন্দ মনে করবে অন্যের জন্য ও তাই মনে করবে।(বুখারী ও মুসলিম)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর আবদুর নূর ‘আয যিকর ওয়াল ফালাহ গ্রন্থে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেনঃ ‘এক মার্কিন তরুণী দীর্ঘ দু‘বছর মেলামেশার পর, তার বাংলাদেশী পুরুষ বন্ধুকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। বন্ধুটি বলে যে, সে রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান।তাই তাকে বিয়ে করতে মেয়েটিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মসলিম হতে হবে। মার্কিন তরুণীটি ইসলাম ধর্ম কি, তা বুঝতে চাইলো। ছেলেটি তাকে আল্লামা আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী কতৃক ইংরেজী অনূুদিত পবিত্র কুরআন শরিফের একটি কপি দিয়ে বললো যে , এটি পড়লে ইসলাম সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারবে। দু‘মাস কুরআন অধ্যয়নের পর মার্কিন তরুণীটি এসে জানালো,আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে যে ,আমি ইসলাম গ্রহন করবো । ইসলামের সৌন্দর্য ও সমন্নিত নীতিমালা আমাকে আর্কষণ করছে।এ ব্যাপারে আমার মা-বাবার আপত্তি নেই।কিন্তু তোমাকে আর বিয়ে করতে পারব না ।কারণ তোমার আচার আচরণ লক্ষ্য করছি সম্পূর্ণ কুরআন পরিপন্থী।রুশ দেশীয় লিও টলস্টয় ওমার্কিন তরুণী যা বুঝতে ও অনুধান করতে পারছে,মুসলমানরা সেটা কতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে?

রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্বঃ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত পয়গাম নিয়ে এ দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর ২৩ বছরের নবুওয়তি জিন্দেগির মধ্যেই তিনি মানবজাতি, মানবসভ্যতা এবং মানুষের অগ্রগতির কাফেলা যাতে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে চলতে পারে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে গিয়ে সাফল্যের সঙ্গে তাঁর রেজামন্দি ও মাগফেরাত পাওয়ার অধিকারী হয়, তারই একটা পরপূর্ণ রূপরেখা রেখে গেছেন।

হুজুর আকরামের (সা) অনুপম সে সিরাতে পাকের বিভিন্ন দিক নিয়ে যদি আলোচনার সূত্রপাত করতে হয়, তবে প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা) কোন সময়, ইতিহাসের কোন প্রেক্ষাপটে এবং মানবসভ্যতার কোন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর দ্বারা মানুষের এ সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে কতটুক কাজ হয়েছিল এবং মানুষ কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছিল। আমরা যদি সিরাতে পাককে (সা) যথাযথ মূল্যায়ন করতে চাই, তবে যেমন আমাদের দেখতে হবে যে, মাত্র দশ বছর সময়কালের মধ্যে, দশ বছর কেন? মাত্র সাড়ে সাত থেকে আট বছর সময়কালের মধ্যে হুজুর আকরাম (সা) এমন একটি বিশাল রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন, যার আয়তন ছিল আমাদের বাংলাদেশের মতো অন্তত ১৬টি দেশের সমান। তাঁর ইন্তেকালের সময় মুসলমানদের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া রাষ্ট্রটির আয়তন ছিল পৌনে আট লাখ বর্গমাইল। অথচ বাংলাদেশের আয়তন মাত্র পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল। প্রায় ১৬টির সমান একটি বিশাল রাষ্ট্র হুজুর আকরাম (সা) সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে রেখে গিয়েছিলেন। মাত্র ২০ বছর সময়ের মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রা) এই রাষ্ট্রের আয়তন ২৬ লাখ বর্গমাইলে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হজরত ওসমানের (রা) খেলাফতকালে দাঁড়িয়েছিল ইসলামী খেলাফতের আয়তন ২৬ লাখ বর্গমাইলে। এটা কোনো কল্পকাহিনী নয়। ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে এবং এ প্রমাণ মানচিত্র রয়েছে। প্রতিটি মানচিত্রে এই রেকর্ড লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) একদা মক্কা মোয়াজ্জমায় ঘোষণা করেছিলেন, দেখ আজকের যুগে তোমরা এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছ যে, একজন মানুষ তার বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যথেষ্টসংখ্যক লোকলস্কর সঙ্গে নিয়েও এক শহর থেকে অন্য শহরে নিরাপদে পৌঁছতে পার না, পথে ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে লুটরো এবং তস্করের দল। অথচ শুধু কালেমা ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ প্রতিষ্ঠা করলে দেখবে, এমন এক সময় আসবে সুদূর ইয়েমেন থেকে কোনো যুবতী নিঃসঙ্গ অবস্থায় মাথার ওপর সোনা-চাঁদির বোঝা নিয়ে মক্কা মোয়াজ্জমা পর্যন্ত সফর করবে, তার দিকে চোখ তুলে দেখার মতো কোনো দুষ্কৃতকারীর অস্তিত্ব আর থাকবে না। সাহাবায়ে কেরামের সময়কার শাসনব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাই, হজরত ওমর (রা) তার খেলাফতকালে তৃতীয় বর্ষে মদিনা মুনাওয়ারায় ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন এলাকার প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের এক মহাসম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। সে মহাসম্মেলনে তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মনে রেখ, এখান থেকে সাড়ে সাতাশ মাইল দূরের ফোরাত নদীর তীরেও যদি একটি কুকুর না খেয়ে মারা যায়, তার জন্য কিয়ামতের ময়দানে ওমরকেই জবাবদিহি করতে হবে।

অমুসলিমদের চোখে মহানবী (সাঃ) : ঐতিহাসিক, গবেষক ও জৌতিবিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট একদল গবেষক নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর তিনি বিশ্ব ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী একশত ব্যক্তিত্বকে বাছাই করে ইসলাম ধর্মের স্থপতি হযরত মোহাম্মদ সা. কে সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে নির্বাচিত করে বিশ্বে সাড়া জাগানো তার দি হান্ড্রেড গ্রন্থে প্রথম স্থান দান করেন। মজার ব্যাপার হলো উক্ত গ্রন্থের লেখক ও প্রকাশক উভয়েই খৃষ্টান ধর্মালম্বী। তিনি তার গ্রন্থের শুরুতে উল্লেখ করেন, দি হান্ড্রেড গ্রন্থে দুনিয়ার সব চাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় মোহাম্মদ সা. এর নাম প্রথমে রেখেছি বলে অনেক পাঠকই আশ্চর্য হতে পারেন, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক সফল ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম সাধারণ পরিবারে, অথচ তিনি বিশ্বের প্রধান ধর্মের প্রবর্তক এবং পরবর্তীতে হয়ে উঠেন পৃথিবীর সর্বাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর তের শত শতাব্দীর পরে আজও তাঁর প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী ও ব্যাপক। মাইকেল এইচ হার্ট শুধু হযরত মোহাম্মদ সা. কেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেননি। ইসলাম ধর্মকেও প্রধান ধর্ম বলে স্বীকৃতি দান করেছেন।

ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে বিশ্বনবী (সা) নেতৃত্ব : ঊনবিংশ শতকের বিশিষ্ট জার্মান লেখক, কবি ও রাজনীতিবিদ গ্যাটে বিশ্বনবীর (সা) অসাধারণ নানা সাফল্য ও মর্যাদার প্রাচুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমরা ইউরোপীয়রা আমাদের সব ধ্যান-ধারণা নিয়েও এখনও সেইসব বিষয় অর্জন করতে পারিনি যা অর্জন করেছেন মুহাম্মদ এবং কেউই তাঁকে কখনও অতিক্রম করতে পারবে না। আমি ইতিহাসে অনুকরণীয় মানুষের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত খুঁজতে গিয়ে এ ক্ষেত্রে কেবল নবী মুহাম্মদকেই খুঁজে পেয়েছি; আর এভাবেই সত্য অবশ্যই বিজয়ী হবে ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করবে, কারণ, মুহাম্মদ সারা বিশ্বকে বশ করেছেন স্বর্গীয় বা ঐশী একত্ববাদের বাণীর মাধ্যমে।’

স্যার উইলিয়াম মূর বলেছেন, ‘সর্বশ্রেণীর ঐতিহাসিকরা একবাক্যে হজরত মুহাম্মদের যৌবনকালীন স্বভাবের শিষ্টতা ও আচার ব্যবহারের পবিত্রতা স্বীকার করেছেন। এরকম গুণাবলি সে সময় মক্কাবাসীর মাঝে বিরল ছিল। এই সরল প্রকৃতির যুবকের সুন্দর চরিত্র, সদাচরণ তার স্বদেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করে এবং তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধি পান।’

বিশ্বখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ : যদি আগামী একশ বছরের মধ্যে শুধু ইংল্যান্ড নয়, সারা ইউরোপকে শাসন করার সম্ভাবনা কোনো ধর্মের থেকে থাকে, তাহলে সে ধর্ম হবে শুধু ইসলাম। আমি সবসময় মুহাম্মাদ (সা.)-এর ধর্ম সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছি এর আশ্চর্য জীবনীশক্তির জন্য।

নেতা নির্বাচন মুহাম্মদ (সা.) :  মুহাদ্দিছ ও আনসার সাহাবীদের নিয়ে যে পরামর্শ সভা গঠন করেন তা মজলিসে সূরা নামে পরিচিতি রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান রাষ্ট্রীয় পরিচালনার বিভিন্নপন্থা প্রভৃতি বিষয় এ সূরায় নির্ণয় করত। মদীনার মসজিদে এ পরামর্শ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হত।মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুষ্ঠু, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপরই জনগণের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একান্তভাবে নির্ভর করে। এ কারণে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই রাসূলে কারীম সা. রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ করেন। তিনি নেতৃত্ব নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেবলমাত্র যিনি যোগ্য ও বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষভাবে তাকেই কেবলমাত্র তিনি মনোনীত করতেন। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা ক্ষমতা বা পদের জন্য লালায়িত ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচন করতেন না। তিনি যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে সকল যুগে সকল মানুষের জন্য এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। এ মর্মে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, ‘‘আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি এই দায়িত্বপূর্ণ কাজে এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করব না, যে তা পাওয়ার জন্য প্রার্থী হবে, অথবা এমন কাউকেও নয়, যে তা পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে।’’

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিচারব্যবস্থার নেতৃত্ব : একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার যতগুলো দিক ও বিভাগ প্রয়োজন সেই সব দিক ও বিভাগ দিয়েই মানব সম্প্রদায়ের জন্য দ্বীন ইসলাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সেই সব বিভাগের একজন দক্ষ মহামানব। একজন পূর্ণাঙ্গ মহামানব হিসেবে তিনি ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক, সাথে সাথে তিনি ন্যায়পরায়ণ প্রধান বিচারপতিও ছিলেন। দক্ষতার সাথে তিনি যেমন প্রশাসন পরিচালনা করেছেন, তেমনি তিনি ন্যায় ও ইনসাফের সাথে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। তিনি তার জীবদ্দশায় আল্লাহর বিধান অনুযায়ী অনেক বিচার ফয়সালা করেছেন। পক্ষপাতিত্ব, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন এমন একটি ছোট্ট ঘটনাও তার বিচারপতি জীবনের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। তিনি ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে কোনদিন নিজের আহাল, আত্মীয়-পরিজন ও জলিল-কদর কোন সাহাবীর পক্ষও অবলম্বন করেননি। তিনি বলতেন, যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করে, তবে আমি তার বেলায়ও হাত কাটার নির্দেশ দিবো।’ এ জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠতর মহামানবের সাথে সাথে একজন শ্রেষ্ঠ প্রধান বিচারপতিও বটে। তাঁর এ ন্যায়বিচারের কারণেই হাজরা থেকে সান’আ মাউত পর্যন্ত সুন্দরী তনয়া, মূল্যবান অলঙ্কার পরিহিতা, একাকিনী দিনে রাতে পথ চলছে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে তো দূরের কথা তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করতো না।

বুখারী-মুসলিমে আছে একবার মাখজুমী গোত্রের এক কুরাইশী মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। নবী করীম (সা) তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ শুনে লোকজন খুব পেরেশান হয়ে পড়লো। কারণ সেই মহিলা ছিল সম্ভ্রান্ত গোত্রের। তারা বলাবলি করতে লাগলো, উসামা ইবনু যায়িদ ছাড়া আর কে আছে, যাকে আল্লাহর রাসূল (সা) অত্যধিক ভালোবাসতেন। তারা উসামা (রা)-কে সুপারিশের জন্য রাসূল (সা) এর কাছে পাঠালেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর সাথে কথা বললেন, তখন নবী করীম (সা) বললেন, ‘‘হে উসামা! তুমি কি আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করার সুপারিশ করতে এসেছো?’’ তখন উসামা ইবনু যায়িদ ভয় পেয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়েছে। অতঃপর নবী আকরাম (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও সানা পেশের পর বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকজন এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। যখন তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী লোক চুরি করতো তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল লোক চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত। ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আজ যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করতো তবে আমি তার বেলায়ও হাত কাটার নির্দেশ দিতাম।

শিক্ষা ব্যবস্থার নেতৃত্ব : শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) এর অবদান অতুলনীয়। মহানবী (সা.) জাতিকে শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করেছেন। কারণ শিক্ষা বিপ্লব হচ্ছে সংগঠনের একমাত্র উপায়। তিনি ছিলেন মহান আল্লাহর তৈরি একজন আদর্শ শিক্ষক। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে উৎকৃষ্ট জ্ঞান শিক্ষা দান করার উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ মানবতার শিক্ষক দিশারী রাসূল (সা.)কে করণীতে পাঠান। রাসূল (সা.) মানুষকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেন। কুরআনে বলা হয়েছে- এই হচ্ছে গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য উপদেশ।

ইসলামের শিক্ষার আদি কেন্দ্র হলো মসজিদ। বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) নবুওয়ত লাভের পরে ক্বাবা শরীফকে প্রথমে শিক্ষাকেন্দ্র রূপে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, মক্কা নগরীতে তিনি ‘দারুল আরকাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। পরে তিনি মদিনায় হিজরত করলে প্রথমে কুবা নামক স্থানে সর্বপ্রথম একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে তিনি মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আসরের নামাজের পরে অধিকাংশ সময় এই মসজিদে শিক্ষাদানে রত থাকতেন। এও জানা যায়, সপ্তাহে একটি দিন তিনি মহিলাদের জন্য নির্ধারিত করেন। তা ছাড়া, হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, দ্বিতীয় হিজরিতে মকরামহ ইবনে নাওফেল নামক আনসারের গৃহে দারুল কাররাহ নামে একটি আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ছিল। সাহাবীগণ সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। রাসূলে করিম (সা) এর জীবদ্দশায় মদিনায় ৯টি মসজিদ ছিল। এসব মসজিদে মদিনা ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে ছেলেমেয়ে, মহিলা-পুরুষ সকলেই শিক্ষা লাভের সুযোগ পেতেন। মুসলিম বিশ্বের শিক্ষালয় ছিল অবাধ, মুক্ত, সম্মানীবিহীন, সবার ওপরে জীবনমুখী। রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন এর প্রবর্তক। সৈয়দ আমীর আলী লিখিত গ্রন্থের ১৮৭ পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছে, মদিনার মসজিদে হযরত আলী (রা) এবং তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ (হজরত আব্বাসের পুত্র) দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আইন অলঙ্কারশাস্ত্রে ওপর প্রতি সপ্তাহে বক্তৃতা করতেন এবং অন্য শিক্ষকরা শেখাতেন অন্য বিষয়।’ হযরত মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সর্বজনীন। এই শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন দুই অর্থে : এক. গ্রিক প-িত এরিস্টটলের কথায়, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীবনের প্রয়োজন এবং টিকে রয়েছে উন্নত জীবনের লক্ষ্যে। রাসূলুল্লাহ (সা) উন্নত জীবনকে যে আলোকে দেখেছেন, শিক্ষব্যবস্থাকে সেই নিরিখে সাজিয়ে গুছিয়ে সুস্থ দেহে বিশুদ্ধ মনের বিকাশ ঘটাতে এবং শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের জন্য নয়, আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রস্ফুটিত করতে এবং শুধু ইহলৌকিক নয়, পারলৌকিক জীবনের সৌষ্ঠব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করেন যাতে কেবল ব্যক্তিজীবন নয়, সামাজিক জীবনও উন্নততর হতে পারে। এ দিক থেকে বলা যায়, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক।বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো পথিকৃৎ, এখনো দিশারিতুল্য, উজ্জ্বল দীপশিখার মতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ক্ষেত্রকে নৈতিকতার আবরণমুক্ত করে অগ্রসরমান মানবগোষ্ঠী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তা যে কোনো মুহূর্তে সমগ্র মানবসমাজকে বিপর্যয়ে ফেলে দিতে পারে। তখন কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে একমাত্র উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।ঐতিহাসিক ইয়াকুবের মতে বাগদাদে ৩০ হাজার মসজিদ শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহৃত হতো; বড় বড় মসজিদগুলোতে পাঠ্য তালিকা ভাগ করা ছিল। শিক্ষকগণ সে পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী বিশেষ পাঠ্যসূচির উপর বক্তৃতা দিতেন। পরিব্রাজক নাসির খসরুর মতে (একাদশ শতাব্দীতে) মিসরের রাজধানী কায়রোর মসজিদে প্রত্যহ প্রায় ৫ হাজার লোক দীন ইলম হাসিল করার জন্য সমবেত হতো। সাম্প্রতিককালের মিসরের ‘জামে আযহার’, দিল্লীর ‘জামেয়া মিল্লিয়া’ এবং ‘দেওবন্দ মাদ্রাসা’ মসজিদভিত্তিক শিক্ষারই উত্তর ফসল।

সাম্য ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা) : বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর আগমনের পূর্বযুগটি ছিল দলাদলি, হানাহানি ও রক্তারক্তির। মানুষে মানুষে ছিল রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও আভিজাত্যের দুর্লঙ্ঘনীয় প্রাচীর। সমাজ ছিল তখন পশুত্ব ও পৌত্তলিকতার নিবিড় অন্ধকারে আচ্ছাদিত। মানুষ ছিল তখন শান্তিহারা, অধিকারহারা, নির্মমভাবে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত। ঠিক সেই মুহূর্তে জাহেলি যুগের অবসানকল্পে মহানবী (সা)-এর আগমনই ছিল মানবকুলের জন্য অপূর্ব নিয়ামত, রহমত ও চিরন্তন শান্তির মহান সওগাত। তাঁর আবির্ভাবে প্রবাহিত হলো মানবসমাজে শান্তি, সততা ও মমতার শীতল হাওয়া। গড়ে উঠল মানুষে মানুষে সাম্য, মৈত্রী, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের মহান বন্ধন। স্বীকৃতি পেল মহান আল্লাহর প্রভুত্ব।

প্রিয় নবী (সা) মানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য তাগিদ করে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেনÑ ‘হে লোক সকল! নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। অনারবির ওপর আরবির প্রাধান্য নেই এবং আরবির ওপর অনারবির কোনো ধরনের প্রাধান্য নেই। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি।’ (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল)।

মহানবীর সাম্য ও ইনসাফ : প্রকৃতপক্ষে সাম্য ও ইনসাফ যে নবী আনীত ধর্ম ইসলামেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এর অসংখ্য প্রমাণ ও উদাহরণ থেকে নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো

১.সাম্য প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা)-এর নীতিমালা : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, ‘ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে (আরোহীর অভাবে) বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা), হজরত আলী (রা), হজরত আবু লুবাবা (রা) তিনজনই পালাক্রমে একটি উটের ওপর আরোহণ করে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে যখন রাসূল (সা)-এর উট টানার পালা আসত, তখন রাসূল (সা)-এর হুকুমে সাহাবি হজরত আলী ও আবু লুবাবা উটে আরোহণ করতেন। অতঃপর হজরত আলী ও আবু লুবাবা উট টানলে রাসূল (সা) উটে আরোহণ করতেন।’ (তাবকাতে ইবনে সা’দ-২/২১)

২. মুসলমানদের পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা)-এর নির্দেশ : হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা) বর্ণনা করেন, ‘একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য ইমারতের মতো, যার একটি অংশ অপর অংশটিকে শক্তিশালী করে।’ (সহি বুখারি ও মুসলিম; মেশকাত ৪২২ পৃষ্ঠা)

৩. মাতা-পিতার অধিকার সম্পর্কে প্রিয় নবীর নির্দেশ : ‘এক ব্যক্তি রাসূল (সা)’কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ভালো ব্যবহারের সবচেয়ে বড় হকদার কে? তিনি ইরশাদ করলেন, তোমার মা। লোকটি আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি পুনরায় বললেন, মা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? রাসূল (সা) উত্তরে বললেন, মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? রাসূল (সা) জবাবে বললেন, তোমার পিতা।’ (রিয়াদুস সালেহিন ১৫৩ পৃষ্ঠা)রাসূল (সা) ইরশাদ করেন, ‘সে ব্যক্তি অপমানিত হোক, সে ব্যক্তি অপমানিত হোক, সে ব্যক্তি অপমানিত হোক, যে তার পিতামাতা উভয়কে অথবা তাদের কোনো একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েছে, অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাতে প্রবেশের ব্যবস্থা করেনি।’ (রিয়াদুস সালেহিন ১৫৩ পৃষ্ঠা)

মানব-জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ : মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব-জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে সর্বোত্তম আদর্শের উপর অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর সকল কাজ, কথা, আচার-আচরণ ও উপদেশ মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। রাসূলুল্লাহর (সা.) মাধ্যমে আল্লাহ মানবতার এ সুউচ্চ আদর্শ ফুটিয়ে তুলেছেন। মহানবী (সা.) বলেন ঃ “আল্লাহ আমাকে তাঁর রাসূল করে পাঠিয়েছেন যাতে আমি সর্বোত্তম চরিত্র, সর্বোৎকৃষ্ট আচরণ ও সুমহৎ আখলাকের নজির স্থাপন করতে পারি।” (মুয়াত্তা-ই মালিক)।স্বভাবগতভাবে মহানবী (সা.) ছিলেন অতিশয় ভদ্র, সহানুভূতিপ্রবণ ও দয়াশীল। নম্রতা, সৌজন্য, দয়া, মহানুভবতা, উদারতা, মাশীলতা, কোমলতা, বিনয়, পরোপকারিতা, সারল্য, ধৈর্য, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি যাবতীয় মানবীয় সদগুণাবলীর সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর চরিত্র ও আচরণে। তাঁর অতুলনীয় আচার-আচরণে সকলেই মুগ্ধ হতো। আপনজনেরা তো বটেই, এমনকি শক্ররা পর্যন্ত তা দেখে অভিভূত হতো। তিনি কখনো কাউকে ছোট মনে করতেন না, সবাইকে সম্মান ও মর্যাদা দিতেন। নারী-পুরুষ, শিশু-যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব সকলকেই তিনি যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতেন।

মহানবীর (সা.) সাথে যারাই দেখা করতে এসেছে তিনি অত্যন্ত সৌজন্যের সাথে তাদের গ্রহণ করেছেন। বয়ঃবৃদ্ধদের প্রতি তিনি অধিক সম্মান দেখাতেন। বৃদ্ধাদেরকে তিনি নানাভাবে সাহায্য করতেন। পথ চলতে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাদের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন, এমন কি, অনেক সময় তাদের বোঝা নিজে বহন করে তাদেরকে পথ চলতে সাহায্য করতেন। একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন রাসূলের প্রিয় সাহাবী আবু আউয়ুব আনসারী (রা.)। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) একদিন যখন উটে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে অকস্মাৎ এক বেদুঈন তাঁর উটের রশি টেনে ধরে জিজ্ঞাসা করলো “হে মুহম্মদ! আমাকে বলে দাও কোন জিনিসটি আমাকে জান্নাতের নিকট পৌঁছে দেবে আর কোনটা আমাকে দোজখ থেকে অধিক দূরে সরিয়ে রাখবে।” মহানবী (সা.) অত্যন্ত নম্রভাবে উপদেশ দিলেন ঃ “আল্লাহর ইবাদত কর এবং আল্লাহর বান্দা হিসেবে তোমার দায়িত্ব পালন কর। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিয়মিত নামাজ আদায় করো, জাকাত দাও এবং আত্মীয়-স্বজনদের হক আদায় করো।”

মহানবী (সা.) গরিব, দুঃখী, রোগগ্রস্ত সবার সাথে দেখা-সাাৎ করতেন। দরিদ্রতম রোগীকেও তিনি তার বাড়িতে দেখা করতে যেতেন এবং তার সেবা-শুশ্রুষা করতেন এবং অন্যদেরকেও এরূপ করার উপদেশ দিতেন। মক্কার সে বুড়ির কথা আমাদের সকলেরই জানা আছে, যে প্রতিদিন মহানবীর (সা.) চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। একদিন রাস্তায় কাঁটা দেখতে না পেয়ে তাঁর সন্দেহ হলো, হয়ত বুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির বাড়িতে গিয়ে তাকে অসুস্থ দেখলেন। বুড়ির পাশে বসে তাকে অনেক সান্ত¡না দিলেন, সেবা-শুশ্রুষা করলেন। মদীনায় প্রতিবেশী ইহুদিদের বাড়িতে গিয়েও তিনি দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, তাদের হাল-হকিকত জিজ্ঞাসা করতেন, গরিব ইহুদিদেরকে দান-খয়রাত করতেন।

মহানবী (সা.) অতি উদারভাবে অতিথি মেহমানদের আপ্যায়ন করতেন। ঘরে পর্যাপ্ত খাবার না থাকলে তিনি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন অভুক্ত থেকে মেহমানদের খাওয়াতেন। একবার আবিসিনিয়ার শাসকের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল আসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তাদেরকে তাঁর খাস মেহমান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং স্বহস্তে তাদের আদর-আপ্যায়ন করেন। সাহাবাদের কেউ কেউ তাদের মেহমানদারী করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি এ বলে তাঁদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন যে, “এসব লোক আমার আত্মীয়-বন্ধুদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেছে অতএব আমি নিজে তাদের সেবা-যতœ করতে চাই।”

সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) নেতৃত্ব : মহানবী (সা.) তার সততা অনুপম চরিত্র মাধুর্য এবং অসাধারণ দেশপ্রেমিক সময়ের চাহিদানুসারে মানবতার কল্যাণে যথার্থ কর্মসূচী বিশ্বের ইতিহাসে প্রদীপ্ত ভাস্কর হয়ে রয়েছেন। তার এ মহৎ গুণাবলীর দ্বারা আরব জাতিকে একটি সুশৃঙ্খল নীতিবান ও সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিল। কায়েম করেছিলেন সুন্দর ও চিরসুখী সমাজব্যবস্থা। তার আঙ্গুলি স্পর্শে পৌত্তলিকতার সীমাহীন প্রসারতা, মদ, জুয়া, সুদ, দাসত্ব প্রথা, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যা ইত্যাদি সমাজ বিধ্বংসী আচরণ চিরতরে হলো বন্ধ। মহানবী (সা.) এ গঠনমূলক জীবনের উন্নততর আদর্শ মানব জাতির জন্য মাইল স্টোন হিসেবে কাজ করলো। মহানবীর গৃহীত কর্মসূচির (মানব কল্যাণে) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একটি সুসভ্য ও সুসংহত জাতি এবং আদশ সমাজ পদ্ধতি। আর এটাই ছিল তার জীবনের মানব কল্যাণে ভারসাম্য কর্মসূচি। যার ফলে সময়ের অনিবার্য ভাবনায় মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করলেন- ‘‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, আমার নেয়ামত তোমাদের উপর সম্পন্ন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (মায়েদা)

সামাজিক সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব : (১) দুর্নীতি ও প্রতিরোধ (২) মাদকতা প্রতিরোধ (৩) সন্ত্রাস বিরোধী প্রতিরোধে মহানবী (সা.) (৪) জানসাধনা অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরীভূত (৫) নারীর অধিকার আদায় (৬) দোষপ্রথার উচ্ছেদ (৭) সামাজিক বৈষম্যের অবসান (৮) সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা : (৮) প্রতিবেশীর প্রতি সৌহার্দ্যতা (৯) প্রতিশ্রম্নতি আমানতদারী রক্ষায় (১০) সমাজ হিতৈষ (১১) ব্যভিচার ও সমকামিতা রোধ। 

অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব : মানব জাতির কাছে অর্থনৈতিক সমস্যাই বড় সমস্যা। এ সমস্যার কারণেই পৃথিবীর মানুষ যুগ যুগ ধরে অশান্তি ভোগ করে। রাষ্ট্রনায়ক ও মানবতার মহান নির্দেশক মহানবী (সা.) এ সমস্যাটির স্পষ্ট সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান দিয়ে এ ধরায় মানবতার কল্যাণ সাধন করেছেন।প্রিয়নবী তথা হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ছিলেন। একজন যোগ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে একটি সুন্দর ভারসাম্য অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়ন করে গেছেন তিনি। তিনি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক উন্নয়ন তথা ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূর করার লক্ষক্ষ্য একটি উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে গেছেন।(১) সম্পদের মালিক আল্লাহ  (২) বিধিবদ্ধ ব্যক্তি মালিকানা (৩) অপব্যয় নিষিদ্ধকরণ (৪) সুদ প্রথার বিলোপ সাধন (৫) যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা (৬) শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা (৭) বেকার সমস্যার সমাধান (৮) সম্পদ বণ্টনের জীবিকার্জন ও ব্যবসা বাণিজ্যে প্রেরণ (৯) ভিক্ষাবৃত্তির উচ্ছেদ সাধন (১০) ভারসাম্যপূর্ণ ভাতা (১১) মূল্যবৃদ্ধির আশায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য আটকিয়ে না রাখা (১২) ওজনে ফাঁকি না দেয়া (১৩) অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্মসাৎ না করা।  

রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব : রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে রাসূল (সা.) প্রাক ইসলামী যুগে আরবের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। আরবরা তাদের ইতিহাস লিখেনি। তবুও আমরা যা জানতে পারি, তা অতীব নৈরাশ্যজনক বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। কেন্দ্রীয় কোন সরকার বা শাসন না থাকায় যা হবার হয়েছে। অধ্যাপক জাওয়াদ আলী বলেন, ‘‘কখন তিন ধরনের নেতৃত্ব ছিল বা পারিবারিক প্রধানত্ব গোত্রীয় প্রধানত্ব, রাষ্ট্র প্রধানত্ব। কি রাসূল (সা.) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর আরবে এমন কোন নেতৃত্বের অবস্থা রাখেননি। তিনি নব ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ শুরু করেন।মহানবী মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য যে সমস্ত কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন তারমধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচী অন্যতম প্রধান। নিম্নে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো-(১) গণতন্ত্রের সমন্বয় (২) রাষ্ট্রনীতি (৩) সমরনীতি (৪) স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা (৫) পররাষ্ট্রনীতি (৬) কূটনীতি (৭) অমুসলিমদের প্রতি আচরণ (৯) শাসন ব্যবস্থার মূলভিত্তি

মানবজাতির মহান শিক্ষক : মানবজাতির শিক্ষকরূপে বিশ্বনবীর অবদান সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে সর্বপ্রথম ইসলামে জীবনের স্বরূপ ও জীবনদর্শন সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কে মুহাম্মদ আসাদ যা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।অস্ট্রিয়ার এক ইহুদি পরিবারের লিওপোল্ড উইস পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত হয়েও ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ১৯২৬ সালে হয়েছিলেন মুহাম্মদ আসাদ। বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মহান ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করে এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থার গভীরে প্রবেশ করে সেই জ্ঞানসমুদ্রের অভ্যন্তর থেকে তিনি তুলে আনলেন এক রাশি মণিমুক্তা। ইসলামের কোন দিক তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এখনো জানি না ইসলামের কোন দিক আমার নিকট সবচেয়ে বেশি আবেদনপূর্ণ ছিল। আমার মনে হয়েছে ইসলাম এক পরিপূর্ণ স্থাপত্য শিল্পের মতো। এর এক অংশ অন্য অংশের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার সূত্রে এমন দৃঢ়ভাবে সুবিন্যস্ত যে, এর কোনো একটি প্রয়োজনাতিরিক্ত নয় এবং কোনো একটিরও নেই স্বল্পতা। ফলে তা হয়েছে সুসমন্বিত এবং সুঠাম, সুশাস্ত।’

উপসংহার : সত্যের মহানায়ক এবং আদর্শ চরিত্রবান বিশ্বনবীর জীবনকে আমরা নানাদিক পর্যালোচনা করলে। আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, জগতে যদি কোন পূর্ণাঙ্গ সুন্দর সার্থক মহামানব এসে থাকেন তবে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)। মহানবী সা. এর জীবন ছিল এক মহা সমুদ্রের মত। অনন্তকাল আহরণ করলেও সমুদ্রের মনিমুক্তা শেষ হবার নয়। মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ধারায় তিনি পরিপূর্ণ আদর্শ। তিনি শুধু একটি মানবিক সত্ত্বা নয়, তিনি তাওহীদ রেসালত ও আখেরাতের দিকে আহবানকারী জীবন্ত সংবিধান। মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল পৃথিবীর মানুষকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনা এবং পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার রেসালতের চুড়ান্ত মিশন। মদিনায় রাষ্ট্রের সামাজিক সু-বিচার ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা মহানবী এর রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা এবং তার মিশনের সফলতার এক মহান নেতৃত্বের নিদর্শন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের খ্যাতনামা দার্শনিক জন লক যে তত্ত্বের ভিত্তিতে বলেছিলেন, সেই রাষ্ট্রই সর্বশ্রেষ্ঠ যা শাসিতদের সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’ [That government is the best on which is based on the consent of the governed সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে মদিনায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে এবং এই অনবদ্য সৃষ্টির মূলে ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মনীষী হজরত মুহাম্মদ সা.। এই নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবীর নেতৃত্বে মসজিদে নববী। এই মসজিদই ছিল গণতান্ত্রিক মদিনা রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রাণকেন্দ্র। আইন প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং ন্যায়নীতির শীর্ষস্থান, বিচার বিভাগের শীর্ষস্থান।


সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

সংশ্লিষ্ট