শনিবার, ২২ এপ্রিল ২০১৭

ড. মোবারক হোসাইন

ইবনুল ইসলাম পারভেজ : সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ

আমরা জানি সকল মানুষই মরণশীল। শহীদেরা অন্যের চাইতে আরও নির্মমভাবে হাত-পা কর্তিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তারাও মৃত্যুর পর আর ফিরে আসেন না। তারা মরে না, তাদেরকে অন্য মৃতদের মধ্যে শামিল করা যায় না। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে একাধিকবার বলেছেন, “আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।” (সূরা বাকারা : ১৫৪)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নিজের দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের পথ চলা নিঃসন্দেহে বর্ণনাতীত কঠিন, এ কাঠিন্যের মাপকাঠি দিয়ে তিনি মহান প্রভু তার অতি প্রিয় বান্দাহদেরকে বাছাই করে নেন। কিছু বান্দার জীবনকে কবুল করে নিয়ে একটি আদর্শের বুনিয়াদ দুনিয়ার মানুষের জন্য তৈরি করে নেন সত্যের সাক্ষ্য রূপে। শহীদ ভাইদের স্মৃতি আল্লাহপ্রিয়তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। পথ চলতে চলতে যখন নানা মোহ, ভীতি ও আশঙ্কা আমাদের পথ আগলে দেয় তখন হৃদয়ের মাঝে অমর হয়ে থাকা শহীদের স্মৃতি আমাদের মনে আশার দ্বীপশিখা জ্বালায়। As the star that are starry in the time of our drakness অর্থাৎ শহীদরা মিল্লাতের জীবন, মিল্লাতের গৌরব দুর্যোগের রাহবার। হতাশাগ্রস্ত মুসাফিরের জন্য তারা দিশাহারা ধ্রুবতারা। শোহাদায়ে কারবালা যুগে যুগে মুজাহিদদের হৃদয়ে সৃষ্টি করে চলছে বিপ্লবের জজবা। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব পৃথিবীর চিরন্তন ইতিহাস। মানুষ যখন অন্যায় অত্যাচার আর অসত্যে নিমজ্জিত, শয়তান তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে পৃথিবীতে শয়তানি শক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত; তখন আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসূল ও তাদের সঙ্গী-সাথী হিসেবে প্রেরণ করেছেন দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মর্দে মুজাহিদ। নবী-রাসূলদের পর তাদের উত্তরাধিকারীরা এ দায়িত্ব পালনে ব্রত হন। তারা শয়তানি শক্তি নির্মূলের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন এমনকি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সাক্ষী হয়ে আছেন।

শহীদ ইবনুল ইসলাম পারভেজ। একটি প্রেরণার নাম। একটি আন্দোলনের নাম। যার অসাধারণ মেধা, অতুলনীয় চরিত্র, অনুপম কথামালা, অমায়িক ব্যবহার, পরোপকারী মনোভাব আর আল্লাহভীরু মানসিকতা আমাদের প্রেরণার উৎস। কিন্তু প্রভুর প্রেমে পাগল দ্বীনের পথে এ মুজাহিদ দুনিয়ার এ ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে ছিলেন অনেক দূরে। বাড়ি গেলেই সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতেন, খোঁজ-খবর নিতেন, সালাম বিনিময় করে তাদের পারিবারিক কুশলাদি জানতেন। নামাজে ডাকতেন, আর দরদভরা মন নিয়ে মানুষকে ইসলামের কথা বোঝাতেন।

শহীদের মিছিলে এক অগ্রসেনানী শহীদ ইবনুল ইসলাম পারভেজ। ১৭ দিন গুম করে রেখে ভয়াবহ নির্যাতন করে পা-ভেঙে দেয়ার পর বর্বর পুলিশ ২ জুলাই রাতে বন্দুকযুদ্ধের নামে গুলি করে হত্যা করে ঝিনাইদহ শহরের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সহকারী সাহিত্য সম্পাদক ইবনুল ইসলাম পারভেজকে।

২০১৬ সালের ২ জুলাই তিনি এই মিছিলে যোগ দেন। সেদিন ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন প্রিয় নামটি শহীদ ইবনুল ইসলাম পারভেজ। চলে গেছেন জান্নাতে তাঁর প্রভুর সন্নিকটে। জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ এবং মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়। আল্লাহ এরশাদ করেন, কোনো আত্মার মৃত্যু হয় না আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া যা তার জন্য লিপিবদ্ধ। (সূরা আলে ইমরান : ১৪৫) আর শহীদ হিসেবে যদি আল্লাহ মৃত্যু নির্ধারণ করে থাকেন; তাহলে কারো সাধ্য নেই মৃত্যুকে ঠেকানোর। আর শাহাদাতের মৃত্যুই শুধু পারে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে। আমি কি ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করব যে, আমাকে জান্নাত থেকে বাঁচাও? মৃত্যকে জয় করল এ সাহসী উচ্চারণ। এ হলো আল্লাহ তায়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আল্লাহ তায়ালার অমিয় বাণী, ‘প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবে- সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে কোনো মতপার্থক্য নেই।

শহীদ পারভেজ ভাইয়ের শাহাদাতের এক মাস আগে- আল্লাহর আওয়াজ উচ্চকিত করার জন্য আর যদি কোনো ভাইয়ের রক্তের প্রয়োজন হয়, আল্লাহ যেন আমাকে প্রথমে শহীদ হিসেবে কবুল করেন বলে দোয়া শুরু করলেন। প্রেমিক যেমন প্রেমিকার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করে, ঠিক তেমনি শহীদ পারভেজ ভাই আল্লাহর কাছে তার শাহাদতের জন্য প্রচুর কাঁদলেন। শহীদ পারভেজ সেই দোয়া আমার হৃদয়কে আজো নাড়া দেয়।

কী অপরাধে শহীদ পারভেজকে তাগুতি শক্তির অনুসারী আওয়ামী পুলিশ বাহিনী গুলি করে হত্যা করে! তার অপরাধ তিনি মানুষকে কুরআনের দিকে আহবান করতেন, কুরআনের শিক্ষা দিতেন, হাদিসের কথা বলতেন। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি মানুষকে আহ্বান করতেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখতেন। আর এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণেই ২ জুলাই ২০১৬ সালে সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল পরোপকারী এই তরুণটিকে পুলিশ বাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।

খুনিরা মনে করেছে পারভেজের মতো তেজোদীপ্ত ঈমানের অধিকারী ছাত্রনেতাকে হত্যা করে দ্বীন বিজয়ের আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু পৃথিবীর মানবসভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, যারা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের অমূল্য সম্পদ জীবন বিলিয়ে দেয়, তারা মরেও চির অমর। ঝিনাইদহে দ্বীন কায়েমের অতন্দ্র প্রহরীদের প্রাণে স্পন্দন যতদিন থাকবে ততদিন শহীদ পারভেজের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস স্বর্ণালি অক্ষরে অক্ষুণ্ণ থাকবে। শহীদ পারভেজের প্রতিফোঁটা রক্ত বনানীপাড়ার সবুজ চত্বরে অভিশপ্ত ঘাতকদের প্রতি অভিশাপের তীর প্রতিনিয়ত নিক্ষিপ্ত হবে। সময়ের ব্যবধানে আবারো মানুষের পদভারে মুখরিত হবে বনানীপাড়ার সবুজ চত্বর। ঝিনাইদহের আম্রকাননে পাখিদের কলকাকলিতে উদিত হবে ভোরের সোনালি সূর্য। দিনান্তে বলাকারা ফিরে যাবে নীড়ে, জনমানুষের মুখরিত বনানীপাড়া থেকে ফিরে আসবে স্ব-স্ব স্থানে। শুধু পাওয়া যাবে না শহীদ পারভেজের হাসিমাখা প্রাণের স্পন্দন। জাগতিক নিয়মে বনানীপাড়ার মানুষেরা তাদের চিরচেনা বন্ধুবৎসল শহীদ পারভেজকে আর খুঁজে পাবে না। নশ্বর এই মায়াময় পৃথিবীর জীবনের সমস্ত মায়াজাল ছিন্ন করে শহীদ পারভেজ চলে গেছেন না ফেরার দেশে মহান প্রভুর ডাকে। শহীদ পারভেজ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার গুণে মানবসমাজের নিকট চির অমর হয়ে থাকবেন। যদিও জাগতিক নিয়মে শহীদ পারভেজ আর কখনো ফিরে আসবেন না বনানীপাড়ায়। কিন্তু শহীদ পারভেজ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার নিভৃত পল্লীর জান্নাতের বাগানে শুয়ে প্রতিনিয়ত অনুভব করবেন তাঁর রেখে যাওয়া কালজয়ী আদর্শের সাক্ষী।

পারভেজ ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না কোনো হানাহানি, মারামারি, চলবে না কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি। যে দেশের মানুষ থাকবে না ক্ষুধার্ত, সকলের মনে থাকবে অবিরাম আনন্দ। যে দেশে চলবে না কখনও অর্থনৈতিক মন্দা, থাকবে জাকাতব্যবস্থা। দেশটা পরিচালিত হবে আল-কুরআন এবং আল-হাদিসের আলোকে। শিক্ষার হার হবে ১০০%। অশিক্ষিত বলে কোনো শব্দ থাকবে না। তার সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতেন এবং তিনি যতটুকু পেরেছিলেন তার পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। আজ শহীদ পারভেজভাই আর আমাদের মাঝে নেই, তবে তিনি রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত কাজ। ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে একজন সত্যিকার মুসলমান হিসেবে তার এ অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার দাবিদার কেবল আমরাই।

ছেলে সম্পর্কে বাবার অভিব্যক্তি ছিলো, ‘আমার ছেলে পারভেজ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় শুধু এটুকুই বলতে চাই-একজন বাবা হিসেবে তার দিকে যখন তাকিয়ে দেখতাম তখন পবিত্র ও সুখময় এক আত্মিক অনুভূতিতে হৃদয়টা আমার জুড়িয়ে যেতো। চোখ দুটো ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্নে ভরে উঠতো। কী যে মায়াবী তার ঐ পবিত্র চেহারা। কত যে সম্ভাবনা ছিল তার মাঝে। কিন্তু ওরা বাঁচতে দিল না আমার পারভেজকে। কী অপরাধ ছিল তার? বাবার সবচেয়ে প্রিয়, সচ্চরিত্রবান, খোদাভীরু ও সুযোগ্য সন্তান হাওয়াটাই কি তার অপরাধ? আল-কুরআনের দিকে ছাত্রদেরকে আহ্বান করাই কি তার অপরাধ? কয়জন বাবা এমন সন্তানের বাবা হতে পারেন? কিন্তু সে রকম সৌভাগ্যবান বাবা হয়েও অকালে সেই সন্তানের কফিন কাঁধে নিতে হলো আমাকে! ছোটকাল থেকেই সে পরোপকারে সময় দিতো, মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতো না, সবসময় সত্যকে ভালোবাসতো, বই পড়ার প্রতি তার ছিল নেশা, সময়ের মূল্য দিতে জানত, সময়ের কাজ সময়েই করত।’
যে বাবা-মা তার সন্তানকে হারিয়েছেন, যে বোন তার ভাই হারিয়েছে, তাদের সান্ত¡না দেয়ার ভাষা আমাদের নেই। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন, তার পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনদের ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করেন এবং পারভেজ ভাইকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন।

শহীদ পারভেজ ভাইয়ের স্মরণীয় একটি কথা হলো, ‘আমাদের পায়ের নিচের মাটি থেকে মাথার উপরের আসমান পর্যন্ত সকল ক্ষমতাসীন পদে আজ ইসলামবিরোধীরা অবস্থান করছে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আসমানের ওপর যিনি আছেন তিনি আমাদের পক্ষে।’তার মৃত্যুর পর মাতার প্রতিক্রিয়া ছিলো, ‘আজ আমার পারভেজ যদি থাকত আমার বুকের সমস্ত শূন্যতা পূরণ হয়ে যেত। তোমরা বল কী অপরাধ ছিল আমার পারভেজের? সে কি কোনো মানুষের ক্ষতি করেছিল? কেন তারা আমার বুকের ধনকে নির্মমভাবে হত্যা করল?’

কি অপরাধে শহীদ হলেন শহীদ পারভেজ। এভাবে হত্যা করা হবে তা গোটা দেশবাসী তথা বিশ্ববাসী কখন কল্পনা করতে পারেনি। শহীদ পারভেজ আমাদের প্রেরণা। তার অপরাধ তিনি মানুষকে কুরআন ও হাদিসের কথা বলতেন। ইসলামী আন্দোলন করাই তার বড় অপরাধ।

ক্রসফায়ারের ধারাবাহিক নাটকের অংশ হিশেবে গত ১৬ জুন রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির ৯ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসার ৬ তলা থেকে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায় পারভেজ ভাইকে। তার সাথে এনামুল হক, শহীদ আল মাহমুদ ও আনিছুর রহমানসহ তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সবাইকে ঝিনাইদহে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্মম নির্যাতন করে। এর মধ্যে শহর শাখার ছাত্রকল্যাণ সম্পাদককে ৫ দিন গুম করে রাখার পর ২১ তারিখে তাকে ১৬৪ ধারায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতে হাজির করে। তার ওপর অকথ্য নির্যাতন করে ১৬৪ ধারা মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। তার শরীরে এমন কোনো জায়গা নেই যা নির্যাতন করা হয়নি। হাত-পায়ের নখ উপড়ানো হয়েছে। কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে গেড়ে দিয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো ব্যতিক্রম করলে রিমান্ডে নিয়ে কী করা হবে তা তো বুঝতে পারছিস। তা না হলে আগে যেভাবে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে তোকেও তাই করা হবে। এভাবে একই কায়দায় সবাইকে বর্বর এবং নির্মম নির্যাতন করা হয়। শহীদ আল মাহমুদ ও আনিছুর রহমানকে ১ জুলাই ভোরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের মাঠে ও পারভেজ ভাইকে ২ জুলাই রাতে সদর উপজেলার পোড়াহাটী ইউনিয়নের মধুপুর কবরস্থানের পাশে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। তাদেরকে শুধু পরিকল্পিত হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদেরকে দিয়ে আবার উল্টা ১টি পিস্তল, ৩ রাউন্ড গুলি, একটি ছোরা, ৩টি রামদা ও একটি চাপাতি উদ্ধারের নাটক সাজিয়েছে। একইভাবে বর্বর পুলিশ প্রশাসন ৮ জনকে দিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়েছে।

যেভাবে পারভেজ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় তা হলো, আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি, পারভেজ ভাই তখন ঝিনাইদহ শহর সভাপতি, তখন আমাকে একটা জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের অনুষ্ঠানে সংবর্ধনায় দাওয়াত দেয়। আমি প্রোগ্রামে না আসতে চাইলেও তার বার বার অনুরোধে প্রোগ্রামে আসার জন্য রাজি হই এবং আমি প্রোগ্রামে রওনা হওয়া থেকে শুরু করে ঝিনাইদহ পৌঁছা পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ বার আমার সাথে যোগাযোগ করে সার্বিক খবর নিতেন এমনকি গাড়ির টিকিটও ছিল না। পারভেজ ভাইয়ের সাথে ঝিনাইদহের অনেক গাড়ির মালিকের ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে ভালো একটা সিটের ব্যবস্থা করে দেন। রাজশাহী থেকে ঝিনাইদহে নামার পর আমাকে নিজেই রিসিভ করেন। ওনার বেডে থাকার ব্যবস্থা করেন। সকালে নাস্তা শেষে নিজেই আমাকে নিয়ে প্রোগ্রামে যান। প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনা, অতিথিপরায়ণতা আমার কাছে অনেক চমৎকার মনে হয়েছিল। তখন থেকেই ওনার দায়িত্বানুভূতি ও আন্তরিকতা দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল তিনি অনেক ভালো মানের দায়িত্বশীল।

তারপর থেকে ওনার সাথে নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ হয়। তার পর জানতে পারলাম পারভেজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ইমাজ উদ্দিন ভাইয়ের আপন ভাগিনা। পারভেজ ভাইয়ের আচরণ ও ব্যবহার, মিষ্টি হাসি আমার কাছে খুবই ভালো লাগত। তারপর ভাগ্যক্রমে আমাকে ইবি অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ইবি অঞ্চলের প্রোগ্রামের সব কিছু তিনি ব্যবস্থা করতেন। প্রোগ্রামের ব্যাপারে, মেহমানদারির ব্যাপারে সর্বদা আন্তরিক থাকতেন, এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা করতে হতো না। তখন থেকেই আমি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি জেলে থাকায় সেক্রেটারি জেনারেলকে পরামর্শ দেই পারভেজ ভাইকে সাহিত্য বিভাগে নিয়ে আসার জন্য। তার কিছু দিন পর ওনাকে সাহিত্য বিভাগে নিয়ে আসা হয়। তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক জেলে থাকায় সাহিত্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব আমার ওপর ছিল।

তারপর ২০১৫ সালে সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব আমার ওপর দেয়া হয়, তখন পারভেজ ভাই সহকারী সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। আমি সাহিত্য সম্পাদক হওয়ার পর আমাকে বিভাগের সমস্ত কিছু সুন্দরভাবে অবহিত করলেন। আমাকে সর্বদা দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতেন। কোনো কাজ দিলে তা আন্তরিকতার সাথে করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। বিভাগের ব্যাপারে সর্বদা পেরেশানি ছিল। কী করা লাগবে আমার বলার আগেই উনি পরামর্শ দিতেন। পারভেজ ভাই ছিলেন পুরোপুরিই ভিন্ন এক মানুষ। পুরো জান্নাতি এক মানুষ। বিভাগের সবার সাথে ছিল এক আত্মিক সম্পর্ক..! মিষ্টি হাসির পারভেজ ভাইয়ের সাথে প্রতিটি ক্ষণ খুব মনে পড়ছে। ইবি অঞ্চল থেকে আসা আসাদুল্লাহ ভাই, আতিকুল্লাহ ভাই, গোলাম সারোয়ার মুজাহিদ ভাই এবং পারভেজ ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা একটু বেশিই ছিল। তার মধ্যে পারভেজ ভাইয়ের সাথে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। তার কাছ থেকে ঝিনাইদহ শহরের ইতিহাস ও কাজের অবস্থা সম্পর্কে অনেক কথা মনোযোগ সহকারে শুনতাম। ঝিনাইদহের প্রতিটি মানুষের সাথে তার যোগাযোগ ছিল অন্যরকম। ঝিনাইদহে কোনো প্রকার সমস্যা বা প্রয়োজন হলেই পারভেজ ভাইকে সবাই ফোন দিতেন। আর তিনিও সবার ডাকে সাড়া দিতেন। সকাল, বিকেল, রাত যেকোনো সময়ই এলাকার কোনো প্রয়োজনে পারভেজ ভাই ছিলেন সর্বাধিক আন্তরিক। বিশেষ করে ঝিনাইদহের কোনো ভাই গ্রেফতার, আহত বা কেউ অসুস্থ হলে সর্বাধিক খোঁজখবর নিতেন এবং সার্বিক সহযোগিতায় তৎপর ছিলেন এবং মামলা পরিচালনার ব্যাপারে আইনজীবীদের সাথে সর্বদা যোগাযোগ করতেন। ছাত্রজীবন শেষ করার পর যে বাসায় থাকতেন ঝিনাইদহের যেকোনো ভাই ঢাকায় এলে তাকে রাখা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।

সত্যিই এমন একজন ভালো মানুষকে হারিয়ে খুব খারাপ লাগছে। মেনে নিতে পারছি না। পুলিশ বাহিনীর এই অত্যাচার আর সরকারের এই জুলুম কবে শেষ হবে জানি না..! কিন্তু একদিন এ হত্যাকান্ডগুলোর চরম জবাব তাদের সবাইকেই দিতে হবে। আল্লাহ রহম করো, প্রিয় পারভেজ ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করো। হে আল্লাহ! তুমি ইবনুল ইসলাম পারভেজ ভাইয়ের শাহাদাতকে কবুল কর এবং তার হত্যাকারী জালিমদের নিজ হাতে বিচার করো। শহীদ ইবনুল ইসলাম পারভেজ ভাইয়ের আদর্শের কাছে চিরদিনের জন্য হেরে গেল জালিমেরা। নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হাত-পা ভেঙে, নখ উপড়ে ফেলেও সংগঠনের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি।

ইতালির কবি দান্তে বলেছিলেন, The hottest place in hell are reserved for those who, in time of moral crisis maintain their neutrality অর্থাৎ নৈতিক সঙ্কটের সময় যারা নিরপেক্ষ থাকে তাদের জন্য দোজখের সবচেয়ে উত্তপ্ত জায়গাটি সংরক্ষিত আছে। কাজেই গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বোধসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে এখন নীরব থাকা সম্ভব নয়, একটি কঙ্কর নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের পক্ষে আজ দাঁড়াতে হবে। থমাস জেফারসনের কথামতো When injustice becomes law, resistance becomes duty. অর্থাৎ অবিচার যখন আইন হয়ে পড়ে প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই সামনে উদ্ভূত পরিস্থিতির সব দায়টুকু এই নব্য বাকশালকেই নিতে হবে। হত্যা, নিপীড়ন, জিম্মি করে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখে ভয়-হুমকি-ধামকি দিয়ে রক্তপিচ্ছিল করেছে এই অকুতোভয় সংগ্রামী কাফেলার পথ চলাকে। নির্যাতন, হত্যা ও সন্ত্রাসের শিকার এই সংগঠনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মিডিয়া আগ্রাসন চালিয়েছে যৌথভাবে। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আর মিথ্যাকে সত্য দিয়ে ঢাকার অপপ্রয়াস চালিয়েছে হরদম। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্তে ভাসছে দেশ। এই রক্তের বদলা অবশ্যই আল্লাহ দেবেন। আমরা মোটেই বিচলিত নই। হে আল্লাহ পারভেজ ভাইয়ের শাহাদাতকে কবুল কর। প্রিয় পারভেজ ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করো। আমিন।

লেখক : কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল

সংশ্লিষ্ট