মঙ্গলবার, ২৩ মে ২০১৭

চট্টগ্রাম জেলা দক্ষিন

মানবিক দুর্বলতার উর্ধ্বে এক নিষ্কলুষ চরিত্র শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরী

আল্লাহর পথে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না। প্রকৃত পক্ষে তারাই জীবিত তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের চেতনা নেই। (সুরা আল বাকারা- ১৫৪)

সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সৃষ্টির সূচনা থেকে চলে আসছে আলো আঁধারের তীব্র সংঘাত। এই সংঘাতে বারবারই পূর্ণতা পেয়েছে আলো। তারা ত্যাগ ও কুরবানীর মধ্যে সফল হয়েছে। এই কুরবানী ও অমরত্ব নি:সন্দেহে কোন সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটে না। তারা হন এমন মানুষেরা, যারা প্রিয় তার পরিবার পরিজনদের কাছে। প্রিয় তার পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে। প্রিয় তার চারপাশের সকলের কাছে। আর সর্বোপরি প্রিয় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে। আর এই অমরত্বের সিঁড়ি হল শাহাদাত, যা মুমিন জীবনের একান্ত কামনা।

সেই ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় তৎকালিন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। বর্তমান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিথ্যার কবল থেকে মুক্ত করতে ১৯৮২-৮৩ সেশনে পূরকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়ে শাহাদাতের নাজরানা পেশ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালিন সভাপতি শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ হলের (বর্তমান শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ হল) ২২২নং কক্ষটি তার জন্য বরাদ্দ ছিল। প্রকৌশল অঙ্গনের মেধাবী মুখগুলোর কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের বাণী পৌঁছে দিতে মাহফুজ ভাই ছিলেন সদা তৎপর। অসাধারণ মিশুক আর অমায়িক আচরণের কারণে ক্যাম্পাসের ছোট বড় সকলের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। ছোটদের দেখলে তিনি মিষ্টি হেসে সালাম দিতেন। এই অমায়িকতাই কে না মুগ্ধ হবে? এই অমায়িক মানুষটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল শাখার সভাপতি থাকা অবস্থাতেই বামপন্থী বাতিল হায়েনাদের আঘাতে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন; চলে যান আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্যে। ইসলামী আন্দোলনের কাজে আহ্বান করতে গিয়ে মাহফুজুল হক চৌধুরী সেইদিন কলেজের পাশে রওজার হাট অবস্থান করেছিলেন। দিনটি ছিল ২৭ জানুয়ারি ১৯৮৬ সাল। বাতিল হায়েনাদের মাথায় যেন খুন চেপে বসেছিল সেদিন। যে মুখ দিয়ে আল্লাহর প্রশংসার বাণী ঝরে পড়ত। যে মাথায় অংকিত হয়েছিল সিজদার চিহ্ন। ঐ হায়েনার দল আঘাত করল সে মাথায়। প্রিয় মাহফুজ ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তে রঞ্জিত হল তার পবিত্র দেহ।

অনেকক্ষণ এ অবস্থায় পড়ে থাকার পর যখন লোকজন দেখতে পেল। তারা উদ্যোগী হল মাহফুজ ভাইকে হাসপাতালে নেবার জন্য। হাসপাতালে নেয়ার পথে হঠাৎ তার জ্ঞান ফিরে আসে। আকুতি জানাতে থাকেন তাকে আহত স্থানে নেয়ার জন্য অবশেষে ২৮ জানুয়ারি ১৯৮৬ সালে সকাল ৬.১০ মি. আল্লাহর এই প্রিয় বন্ধু তার প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। আর অমর হয়ে বেঁচে রইলেন সবার হৃদয়ের মাঝে যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে।

ব্যক্তিগত পরিচিতি: 
চট্টগ্রাম জেলা দক্ষিণে অবস্থিত সাতকানিয়া থানার ছদাহা ইউনিয়নের খোর্দ্দ কেওচিয়া গ্রামের নুনু চৌধুরীর বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ০২ এপ্রিল ১৯৫৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরী। তার মায়ের নাম মোছাম্মত মনিরা বেগম এবং পিতার নাম মাওলানা আব্দুর রহিম চৌধুরী। শহীদের পিতা স্থানীয় মসজিদের ইমাম। স্বনামধন্য জাতি গড়ার কারিগর এবং টানা চৌদ্দ বছর ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। ৬ ভাই ২ বোনের মধ্যে শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরী ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান।

ছোটবেলা: 
আদর্শবাদী মা-বাবার স্নেহে গ্রামের বাড়ীতে শহীদের বাল্যকাল কাটে। শিশুকাল থেকে তিনি স্বভাবে ছিলেন শান্ত আর মন-মননে ছিলেন সৃজনশীল। গাম্ভীর্য মনোবৃত্তি তাকে বিশেষত্ব দান করেছিলো। ৮/১০ বছর বয়সে শহীদ মাহফুজ রাস্তায় নতুন চলাচলকারী বেবী টেক্সীর অনুকরণে তিন দিন একাধারে পরিশ্রম করে নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে একটি ত্রিচক্র পরিবহন যান তৈরি করেন, যা দীর্ঘদিন পারিবারিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করা হয়। বড় ভাইয়ের বালি লবণের মিশ্রণ পৃথকীকরণ পাঠ শ্রবণ করেই শিশু মাহফুজ ব্যবহারিকভাবে ভাইকে দেখান। এমনিভাবে বিভিন্ন সৃষ্টিধর্মী কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তার প্রতিভার আভাস পাওয়া যায় গোড়া থেকে। শিশুকাল থেকে তিনি ইসলামী আদর্শের প্রেরণায় সমভাবে উজ্জীবিত বড় ভাইয়ের সাক্ষ্য, ‘ছোটকাল থেকে শাহাদাত পর্যন্ত এ ব্যাপারে তাকে একই রকম দেখেছি।’

বিবাহ:
২৪ জানুয়ারি ১৯৮৪ অর্থাৎ শাহাদাতের দেড় বছর পূর্বে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন. তার স্ত্রী নাম হানিয়ারা চৌধুরী। শাহাদাত কালীন সময়ে তিনি ৬ মাসের শিশু সন্তান জিয়াউল হক চৌধুরীকে (জন্ম- ১৮/১২/৮৪) রেখে যান। সে জিয়াউল হককে তার চাচারা আদর করে জুলফিকার নামে ডাকত। সেই জিয়াউল হক চৌধুরী তার বাবা যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হয়েছেন সে হাসপাতালে ইন্টার্ণী করেছে।

শিক্ষাজীবন: 
প্রাথমিক পর্যায়ঃ জঙ্গল পদুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
মাধ্যমিক পর্যায়ঃ দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলামবারী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। ১৯৬৯ সালে এস.এস.সি বিজ্ঞান শাখায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ঃ ১৯৭১ সালে এইচ.এস.সি বিজ্ঞান শাখায় ২য় বিভাগ, সাতকানিয়া ডিগ্রী কলেজ। পাকিস্তান আমলে পরীক্ষা বাতিল ঘোষিত হওয়ায় পূণরায় ১৯৭৩ সালে গাছবাড়িয়া কলেজ চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম থেকে এইচ.এস.সি বিজ্ঞান শাখায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
স্নাতক পর্যায়ঃ ১৯৭৬ সালে সাতকানিয়া সরকারি কলেজ থেকে শারীরিক অসুস্থার কারণে দুই বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর বাকীগুলো দিতে পারেন নি।

পরবর্তীতে পটিয়া সরকারী কলেজ, চট্টগ্রাম ১৯৭৭ সালে বি.এস.সি পরীক্ষায় (১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত) ২য় বিভাগে পাশ করেন।
স্নাতক প্রকৌশলীঃ ১৯৮২-৮৩ সেশনে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ভর্তি হন। শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি পুরকৌশল বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র হিসেবে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষা করছিলেন এবং বিআইটি ২য় বর্ষের এবং সাউথ হলের (বর্তমান শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ হলের ২২২নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন)।

শিক্ষকতা: 
ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি যে সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন তার মধ্যে উল্লে-খযোগ্য:
# সাতকানিয়া মাহমুদুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা
# আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়, পটিয়া
# দৌলতপুর উচ্চ বিদ্যালয়, কর্ণফুলী
# চট্টগ্রাম ইমাম গাজ্জালী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনেস্ট্রেটর ছিলেন।
# চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ উচ্চ বিদ্যালয়
# শাহাদাতের পূর্বেও তিনি চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

সাংগঠনিক জীবন ও দায়িত্ব পালন: 
ছোট বেলা থেকে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি দুর্বলতা থাকলেও বড় ভাই শামসুল হক চৌধুরীর অনুপ্রেরণার।
১৯৬৭ সালে সংগঠনের সালে যুক্ত হন।
১৯৬৮ সালের সংগঠনের কর্মী হন।
১৯৭০ সালে সাতকানিয়া কলেজের সভাপতি হন।
১৯৭১ সালে সাতকানিয়া শহর শাখার সেক্রেটারী হন।
১৯৭২-৭৩ আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট কৌশলগত দিক কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কাজ করেন। অধ্যাপক মীর কামাল চৌধুরীর সহযোগিতায় ক্লাব ভিত্তিক কাজ (কেওচিয়া ও ছদাহা মিতালী সংঘ, পদুয়ায় অগ্রণী সংঘ, বৈয়ানগরে সবুজ সংঘ ইত্যাদি) করেন।
১৯৭৩-৭৪ পুরো সাতকানিয়া থানায় কাজ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৬-৭৭ সাতকানিয়া থানা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সদস্য প্রার্থী হন।
১৯৭৯ সালে জামায়াতে যোগদান করেন।
১৯৭৯-৮০ জামায়াতের মনসার টেক নাযেমের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০-৮২ রাউজানে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর নাযেমের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩- আবার ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন।
১৯৮৩-৮৪ সেশনে সংগঠনের চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অফিস সম্পাদক ছিলেন।
১৯৮৪-৮৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন (শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত)।

অতুলনীয় দাওয়াতী চরিত্র:
শহীদ মাহফুজের জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল ইসলামের সৌন্দর্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। শহীদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত লেখনিতে তার স্ত্রী হানিয়ারা চৌধুরী জানিয়েছেন অনুভূতির কথা। ১৯৮৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হয়ে ১৯৮৬ সালে তার বিধাতার পছন্দ মত তাকে বিদায় নিতে হল। কিন্তু খুবই অল্প সময়ে তিনি বহু স্মৃতি রেখে গেছেন। রেখে গেছেন একমাত্র কচি শিশু জিয়াউল হক (জুলফিকার)। গ্রামের বর্তমান সমাজের মেয়েদের মত আমিও ইসলামী সংগঠনকে ভয় পেতাম। কিন্তু সাহচর্যে এসে ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে তার উপস্থাপনায় সংগঠনের আদর্শ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হলাম, তিনি আমাকে কুরআন-হাদীস দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বুঝাতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয় শহীদ মাহফুজ তার দাওয়াতী চরিত্রের মাধ্যমে আমার বাবার মনকে জয় করেন। আমাদের বিয়ের আলোচনার প্রাক্কালে আমার বড় ভাই ব্যতিত বাবাসহ পরিবারের কেউ এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। আমার বড় ভাই শহীদ মাহফুজের উজ্জল চরিত্রের কারণে ছোট বোনকে তার সংগে বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। বিয়ের পর যে বাবা শহীদ মাহফুজকে তার মেয়ের জন্য অপছন্দ করছিলেন, তার আদর্শের কাছে তিনি হার মানেন এবং তাকে তার নিজ পুত্রের চেয়ে অধিক ভালবাসতে শুরু করেন। শহীদ মাহফুজের মৃত্যুর সংবাদ শুনে বাবা এত বেশি শোকাহত হয়ে পড়েন যে তিন মাস অসুস্থ থেকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

শাহাদাতের ঘটনা: 
২৭ জানুয়ারি ১৯৮৬। পশ্চিমের সূর্যটা আকাশের সাথে মিশে গেছে। দিনের আলো নিভু নিভু। একটু পরে আধার ঘনিয়ে আসবে। শহীদ মাহফুজুল হক তখনো ব্যস্ত সাংগঠনিক কাজে। আরো দু’একজন শিবিরকর্মীসহ সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন শিবিরের আসন্ন ৯ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দাওয়াত প্রদানে। একদল উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী দাওয়াতী কাজে বাধা দিচ্ছিল। সবকিছু উপেক্ষা করে শহীদ মাহফুজ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছিলেন। মাগরিবের নামাজের আজান হল। শহীদ মাহফুজ তার সঙ্গীদের নিয়ে রাঙ্গুনীয়া থানা মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে কলেজ হোস্টেলে ফিরবেন, এমনটি ভেবে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন রাঙ্গুনিয়া রওজার হাটে। কিন্তু মার্কসবাদ আর সমাজতন্ত্রের নামে সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধ্বজাধারী ছাত্র ইউনিয়ন সন্ত্রাসীরা তাকে ফিরতে দেয়নি। কিরিচ, রামদা, হকিস্টিক, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে মাহফুজুল হক ও তার সঙ্গীদের ওপর অতর্কিত ঝাপিয়ে পড়ে সন্ত্রাসীরা। তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন মাহফুজুল হক চৌধুরী। সন্ত্রাসীরা তাকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। কিরিচের আঘাতে মাথা কেটে যায় এবং হকিস্টিক ও লাঠির আঘাতে মাথাসহ সমস্ত শরীর থেঁতলে যায়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান মাহফুজ। তার পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয় সবুজ জমিন।

হামলাকারীরা চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তাকে নিকটস্থ ইছাখালী হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গজের মধ্যে থানা কিন্তু পুলিশ এগিয়ে আসেনি। পরিস্থিতির অবনতি হলে মাহফুজুল হককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখনো মাহফুজুল হক ছিলেন সঙ্গাহীন। কর্তব্যরত ডাক্তার সাধ্যানুসারে চেষ্টা করলেন সারা রাত, কিন্তু অবস্থা অপরিবর্তিত রইল।

২৮ জানুয়ারি ভোর ৫টা ফজরের আজানের সুর ধ্বনি ভেসে আসছে মসজিদ থেকে। ডাক্তার শেষ বারের মত ঘোষণা করলেন। মাজফুজ আর নেই। সূর্য উদয়ের পূর্বেই মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন শহীদ মাহফুজ। মূহুর্তের মধ্যে শহীদের সাথীদের আহজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল মাহফুজের শাহাদাতের খরব। শোকের ছায়া নেমে এলো বন্দর নগর চট্টগ্রামে শহীদের শোকাহত সাথীরা হাসপাতালে ভিড় জমাতে থাকে তাকে একনজর দেখার জন্য।

শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরীর সেক্রেটারী হাফিজ আব্দুর রহমানের প্রতিক্রিয়া:
মানুষ হিসেবে শহীদ মাহফুজ ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সাদাসিধা, পরিচ্ছন্ন ও নম্র রুচির অধিকারী। জামায়াতে নামাজের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। নামাজের জন্য তার ছিল ভিন্ন একটি পোশাক। নামাজ পড়ার আগে খুবই পরিপাটি হয়ে মসজিদে যেতেন। কেউ রুমে এলে তাকে কোঁটায় রাখা বিস্কুট খেতে দিতেন। বিবাহিত হওয়ার পরও শত ব্যস্ততার মাঝে যথাসাধ্য পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতেন। কেউ টাকা পয়সা পেলে নোট করে রাখতেন এবং কথামত যথাসময়ে পরিশোধ করতেন। আমানতদারীতে ছিলেন অতুলনীয়। একদিন প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন মাহফুজ ভাই আপনি এত বয়সে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসলেন কেন? তিনি বলেন ক্যাম্পাস স্কুলের শিক্ষকতা করার সময় আমার বার বার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের মাঝে ইসলামের কাজ করার ইচ্ছা জাগছে। আল্লাহ তায়ালা আমার সেই ইচ্ছা কবুল করেছেন। হৃদয়ের গভীরে লালিত এ আকাংখা কতইনা ইসলামিক আমাদের শিক্ষাপ্রদ। শহীদের সম্মান প্রদানের জন্য আল্লাহ তার যথার্থ বান্দাকেই বাছাই করেছেন।

জানাজা ও দাফন:
২৮ জানুয়ারি বিকাল লালদীঘি ময়দানে শহীদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় হাজারো ছাত্র-জনতার ঢল নামে। জানাজা শেষে লাশের কফিন নিয়ে ছাত্র-জনতা চন্দনপুরাস্থ ইসলামী ছাত্রশিবিরের অফিসে যায়। অফিসে লাশ কিছুক্ষণ রাখা হয় এবং তার আন্দোলনের সাথীদের দেখার সুযোগ দেয়া হয়।

অতপর শহীদের লাশ গাড়ি যোগে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৪ কি.মি. দূরে সাতকানিয়া থানার ছদাহা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। শহীদ মাহফুজ এর লাশ গ্রামে পৌঁছলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয় এবং পুনরায় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে রাতেই শহীদের লাশ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

শহীদের মায়ের প্রতিক্রিয়া:
আমার ছেলে শহীদ হয়েছে আর আমি শহীদের মা এর চেয়ে পরম সৌভাগ্য আর কি হতে পারে।

বড় ভাই মাষ্টার শামসুল হক চৌধুরী’র ভাষ্য: 
আমার ভাই শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরী সকল ধরনের মানবিক দুর্বলতার উর্ধ্বে এক নিস্কলুষ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। সে আন্দোলনের ব্যাপারে ছিল আপোষহীন। আনুগত্যের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।

শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: 
“ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলে জীবন দিতে আমি কুণ্ঠিত নই। ইসলামি আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতি ঘরে ইসলামী পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য আমি আমার চেষ্টা করে যাবে।”

কলেজের প্রতিক্রিয়া: 
কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক কর্মচারী মাহফুজ ভাইয়ের শাহাদাতের খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কলেজের অপরাপর ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাও এই অমানবিক হত্যার প্রতিবাদ জানায়। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করে।

অন্যান্য প্রতিক্রিয়া:
শাহাদাতের অল্প কিছুদিন পরই একমাত্র জামাতার শাহাদাতে শোকাহত শ্বশুরের ইন্তেকাল।

শহীদের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া:
নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নিয়েও তিনি অত্যান্ত মেধাবী ছিলেন। পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করার পরেও তিনি ছিলেন ইসলামি আন্দোলনের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তিনি বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী ছেলে ও পরিজনের জন্য খুবই দায়িত্ববান ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা, শহীদের রক্তের বিনিময়ে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক এটাই আমার প্রত্যাশা।

শহীদের একমাত্র ছেলের বক্তব্য:
আমার পিতা সকল ভয়-ভীতির উর্ধ্বে উঠে ইসলামী আন্দোলনের জন্য কাজ করেছেন। সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের সকল কর্মীর নিকট প্রত্যাশা, তারা যেন নির্ভয়ে কাজ করে তার বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। সংগঠন যেন তার বাবার আদর্শ থেকে হারিয়ে না যায়। কারণ সংগঠন হারিয়ে গেলে তার বাবাও হারিয়ে যাবেন। আমি একজন শহীদের গর্বিত সন্তান হতে পেরে গর্ববোধ করি।

গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া:
তিনি অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। সদালাপী শহীদ মাহফুজ। গ্রামবাসী ও আত্মীয় স্বজন সবার খোঁজখবর নিতেন এবং সবাইকে ভালো পরামর্শ দিতেন। ইসলামী আন্দোলনের সাথে শহীদ মাহফুজের আত্মার সম্পর্ক ছিলেন। তাই তিনি তার সাথীদের বলতেন, ইসলামী আন্দোলনের ডিগ্রী নিয়ে অবশ্যই ইসলামী আন্দোলন করব। কিন্তু তার সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেয়া হল না। তার আগে চলে গেলেন পৃথিবী থেকে। শাহাদাতের মৃত্যু ছিল তার কাম্য। আর তিনি সংগঠনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রায় বলতেন আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমাকে শাহাদাতের মাউত দেন। সে কারণেই হয়ত আল্লাহ তাকে কবুল করেন প্রিয় বান্দা হিসেবে।

সংশ্লিষ্ট