রবিবার, ০৯ জুলাই ২০১৭

ডক্টর মুহাম্মদ আল-ফাতিহ

ঈদুল ফিতর ও আমাদের সংস্কৃতি

ঈদুল ফিতর একটি আরবি পরিভাষা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষায় এটি একাকার হয়ে গেছে। আরবি ভাষাবিদগণের দৃষ্টিতে ঈদুল ফিতর একটি যৌগিক পরিভাষা যা ঈদ ও ফিতর শব্দের সংমিশ্রণে গঠিত। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈদ অর্থ বারবার ফিরে আসা। তবে শব্দটি উৎসব অর্থে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। এমনকি পবিত্র কুরআনেও শব্দটি আনন্দঘন উৎসব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ঈসা আ.-এর দোয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “মারইয়ামের পুত্র ঈসা বলল, ‘হে আল্লাহ, হে আমাদের রব, আসমান থেকে আমাদের প্রতি খাবারপূর্ণ দস্তরখান নাজিল করুন; এটা আমাদের জন্য ঈদ (আনন্দঘন উৎসব) হবে; আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য। আর আপনার পক্ষ থেকে এক নিদর্শন হবে।” (সূরা আল-মায়িদাহ: ১১৪) অপর দিকে ফিতর শব্দটি ফিতরাত বা স্বাভাবিক অবস্থা অর্থে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য ভাষাবিশারদগণ মূল অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরও অনেক অর্থ উল্লেখ করেছেন। রোজা সমাপ্ত করা বা কোন কিছু থেকে বিরত থাকার মেয়াদ শেষ করা তেমনই একটি অর্থ। অতএব যৌগিকভাবে ঈদুল ফিতরের শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় রোজা সমাপ্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার উৎসব।

মুসলিম উম্মাহর বৈধ আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের প্রবর্তন করা হয় মহানবী সা.-এর হিজরতের পর। আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলেন, তখন তিনি দেখলেন, সেখানকার মানুষ বছরে দু’টি নির্দিষ্ট দিনে খেলাধুলা ও আনন্দ উপভোগ করে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ দু’টি দিন কেমন? তারা বলেন, আমরা ইসলাম আগমনের পূর্বে এ দু’টি দিনে খেলা-তামাশা ও আনন্দ উপভোগ করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহ এ দু’টি দিনের পরিবর্তে দু’টি উৎকৃষ্ট দিন নির্ধারিত করে দিয়েছেন। একটি ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি ঈদুল আজহা। (আবু দাউদ, নাসায়ী) হাদিসের ভাষ্যকার ও ঐতিহাসিকগণ জাহিলি যুগে উৎসব হিসেবে পালিত দিন দু’টিকে ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে অভিহিত করেছেন।

ইসলাম আনন্দের এ উৎসব দু’টিকে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ইবাদত ও মৌলিক স্তম্ভ তথা রোজা ও হজের সাথে সংযুক্ত করেছে। কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে ঈদকে সম্পৃক্ত করতে চাইলে অনেক ঘটনা রয়েছে যা উদযাপনের দিন হিসেবে গণ্য হতে পারত। যেমন কুরআন অবতরণ ও মহানবী সা.-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির দিন, মিরাজ, বদরের বিজয়, মক্কাবিজয় ইত্যাদি। কিন্তু ইসলাম তা করেনি। কেননা এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব কোনো ভূমিকা থাকে না, শুধু ইতিহাসের সাফাই শুনতে হয়; সর্বোচ্চ উক্ত ঘটনা থেকে প্রেরণা লাভ করা যায় মাত্র। ফলে দিবসনির্ভর উৎসব মানবকল্যাণে বিশেষ কোন ভূমিকা রাখে না বা সার্বজনীনতা পায় না। ইসলাম তাই উৎসবে ব্যক্তির নিজস্ব ভূমিকাকে বড় করে দেখে একে ইবাদতের অংশ হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

ইসলামের ঈদ নিছক আনন্দ ভোগ আর উচ্ছলতার জোয়ারে ভেসে যাওয়ার জন্য নয়। বরং এর মধ্যে ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণের নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা অনুধাবন করতে হলে রমজান ও রোজার উদ্দেশ্যের প্রতি ফিরে যেতে হবে। পবিত্র কুরআন স্পষ্টভাবে রোজার উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছে, “যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।” (সূরা আল বাকারাহ : ১৮৩) অন্যদিকে রমযান মাস ছিল কুরআন অবতীর্ণের মাস। একজন প্রকৃত মুসলিম তাই রমযান মাসজুড়ে প্রতিটি মুহূর্তে তাকওয়া অর্জন ও কুরআনের আলোয় জীবন আলোকিত করার সাধনায় ব্রত হয়। ব্যক্তিগত তথা আত্মিক, মানসিক ও পারিবারিক জীবন কুরআনের রঙে রাঙিয়ে মুসলিম ব্যক্তি যখন জীবনের প্রকৃত স্বাদ ও অর্থ খুঁজে পায় তখন সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তবে স্বার্থপরের মত এ স্বাদ একা একা ভোগ করা তার জন্য সমীচীন নয়, বরং তার পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের লোককে জানানো উচিত তার জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার রহস্য। এ কারণে সে স্থানীয় পর্যায়ে ঈদগাহে জড়ো হওয়া মানুষের মধ্যে ঘোষণা করতে চায় আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব এবং দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথনির্দেশ। আল্লাহ বলেন, “যাতে তোমরা রোযার নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পার ও আল্লাহ তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন সেজন্য তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার।” (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫)

এভাবেই ঈদের আনন্দ উৎসব এর অন্তরালে এক শাশ্বত সংস্কৃতির জন্ম দেয়। মহানবী সা. যে সমাজে ঈদুল ফিতরের যাত্রা শুরু করেছিলেন সে সমাজে এর মাধ্যমে নতুন এক সংস্কৃতি উপহার দিয়েছিলেন। কেননা সে সময়ে আনন্দ উৎসব ছিল অশ্লীলতায় ভরপুর ও ধনিক শ্রেণির জন্য পালনীয়। তাদের এ সাংস্কৃতিক উৎসবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকে কোন গুরুত্বই দেয়া হতো না। বরং অপেক্ষাকৃত ধনিক ও বণিক শ্রেণির মনোরঞ্জনকেই প্রাধান্য দেয়া হতো। এ সব সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিত্তশালীরাই লাভবান হতো, গরিবেরা ধনীদের মনোরঞ্জন আর পুঁজি পুঞ্জায়নের ক্ষেত্রে সহায়ক ছিলো মাত্র। মহানবী সা. সাংস্কৃতিক এ ধারাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে একবারেই অপরিচিত এক ধারা নিয়ে এলেন। যাতে মানুষ আনন্দের আতিশয্যে তার প্রতিপালকের নির্দেশ ও মানবতার কল্যাণে প্রণীত দীনের মৌলিক বিধানকে ভুলে যেতে পারে না। এ কারণে আমরা দেখি ঈদের দিনে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উমার রা. কর্তৃক রেশমি কাপড় পরিধানের কৃত আবদার রাসূলুল্লাহ সা. দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। (বুখারি ও মুসলিম) কারণ একজন মুসলিমের দুনিয়ার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তার রবের সন্তুষ্টি কামনা। ঈদের আনন্দ উৎসবেও সে উক্ত সন্তুষ্টি খুঁজে ফেরে। নিজের চিত্তরঞ্জনের চেয়ে অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে সে বেশি আনন্দিত হয়। একটি উৎসবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করার ধারণা ইসলামই সর্বপ্রথম নিয়ে আসে। কোন সভ্যতা, সংস্কৃতি বা সমাজে এ ধারণা ছিল একেবারে অনুপস্থিত। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে এ উৎসবকে সর্বজনীন করার ফর্মুলা একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। এ কারণেই ঈদুল ফিতরের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বা ‘যাকাতুল ফিতর’ এর বিধান। আমাদের সমাজে যা ফিতরা নামে পরিচিত।

ইসলাম মানবতার কল্যাণমুখী যে ঈদ সংস্কৃতি উপহার দিয়েছে তা থেকে মুসলিম উম্মাহকে দূরে রাখার আয়োজন চলছে চারিদিকে। ঈদের ধর্মীয় আবহ ধ্বংস করে একে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন এক স্রেফ আনন্দ উৎসব করাই এ আয়োজনের মূল টার্গেট। ঈদুল ফিতর যে দীর্ঘ রমজান, রোজা, ইফতার, ইতিকাফ, বিশেষ ইবাদত-বন্দেগির সমাপ্তিতে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও আগামী এগারো মাস রমজানের শিক্ষায় পথ চলার অঙ্গীকার শাণিত করার দিন, তা ভুলিয়ে দেয়া হয় ঢোল-তবলা-বাঁশি বাজিয়ে, নাচে-গানে মাতোয়ারার মাধ্যমে। নতুন পোশাকের ফ্যাশন শো-তে নেমে পড়ে জাতির কর্ণধার যুবসমাজ। রমজানের মর্মবাণী ত্যাগের শিক্ষা, সংযম, শ্লীলতা ও মানবতার কল্যাণ সাধনের মনেবৃত্তি দূরে ঠেলে দিয়ে চটুল আমোদ-প্রমোদের নানা পসরা সাজানো হয়। বরং কত দ্রুত রমজানের বার্তাকে পরিহার করা যায়, তারই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ধর্মীয় বিধানের গন্ডিতে আবদ্ধ ঈদুল ফিতর পরিণত হয় ঈদ কার্ড বিতরণ, এসএমএস বিনিময় ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস প্রদান ও মেলা উদযাপনে।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী তাঁর ‘অভিঘাতের মুখে ঈদ সংস্কৃতি : চাই নবজাগরণ’ শীর্ষক নিবন্ধে ঈদের নামে প্রচলিত অপসংস্কৃতির এক সুনিপুণ চিত্র এঁকেছেন, “এখন শোনা যাচ্ছে ঈদের নাটক, ঈদের নাচ, ঈদের গান, ঈদের কনসার্ট, ঈদের ফ্যাশন শো, ঈদের রেসিপি, ইত্যাকার বিচিত্র সব বিষয়ের কথা। ঈদের সাথে এসবের আদৌও কোন যোগসূত্র নেই। তবুও ঈদ উপলক্ষে এসব হাজির হয় কোটি দর্শকের সামনে। ঈদকে তার আপন মহিমা থেকে হটিয়ে ভিন্নতর এক মাত্রায় উপস্থাপন করা হয়। বিশেষভাবে নবীন প্রজন্মের সামনে ঈদকে একটা হৈ-হুল্লোড়, রঙ-তামাশা, গান-বাজনা, গলাগলি, ঢলাঢলির উপলক্ষ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত কতক মিডিয়া। তাদের বিবেচনায় ‘ঈদ মানে জোছনা রাতে হাস্নাহেনার গন্ধে’ ফষ্টিনষ্টি করার মাহেন্দ্র সুযোগ। ঈদ যে রমজানের শিক্ষা- সংযম, ত্যাগ ও তৌহিদী চেতনার পরিসীমার মধ্যে সম্পাদ্য একটি ধর্মীয় আচার ও ইবাদতের অংশ তা ভুলিয়ে দিয়ে নবীন প্রজন্মকে ভিন্নদিকে ধাবিত করানো হচ্ছে।”

সংস্কৃতির এই আগ্রাসন থেকে ঈদকে তার আপন মহিমায় ফিরিয়ে আনা সময়ের অনিবার্য দাবি। ঈদের মূল চেতনা জাগ্রত করে শরিয়ত নির্ধারিত বিধি-বিধান পালন ও এ সম্পর্কিত সব কুসংস্কার দূর করতে হবে। ঈদের প্রকৃত শিক্ষা তথা কুরআনের আলোকে জীবন আলোকিত করে মানব কল্যাণমুখী সমাজ নির্মাণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঈদ ও এর আনন্দ উপভোগ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। যারা রোজা পালন করেনি, রোজার শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়ন করেনি, কুরআন অধ্যয়ন করেনি, কুরআনের আয়নায় নিজের জীবনকে অবলোকন করেনি ঈদ যে তাদের জন্য আনন্দের কিছু নয় বরং তাদের জন্য কষ্টের কারণ এ অনুভূতি জাগ্রত করতে পারলে আমাদের ঈদগুলো সার্থক হবে। এ কারণেই দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমার রা. ঈদের দিন সকালে ঈদের খুতবাহ প্রদান না করে হু হু করে কান্না করতেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, আসলেই কি আমার জন্য ঈদ? আমি কি রোজার হক্ক আদায় করতে পেরেছি? আল্লাহ কি আমাকে রমজানে ক্ষমা করেছেন?

অতএব আমরা যদি রমজান, রোজা ও কুরআনের হক যথাযথ পালন করতে পারি, তথাকথিত অনুষ্ঠান সর্বস্বতা থেকে আমাদের ঈদ সংস্কৃতিকে মুক্ত করে শরিয়তের নির্দেশিত মানবকল্যাণে জীবন পরিচালনা করতে পারি তবেই ঈদ তার নিজ প্রকৃতিতে ভাস্বর হয়ে উঠবে, বয়ে আনবে শান্তি সমৃদ্ধির স্পন্দন। আমাদের জাতীয় চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানের মাধ্যমে এ আলোচনার পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে:

“আল্লাহর রাহে দিতে পারে যারা
আপনারে কোরবান
নির্লোভ নিরহঙ্কার যারা
যাহারা নিরাভিমান,
দানব-দৈত্য কতল করিতে
আসে তলোয়ার লয়ে,
ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা
ধরায় মানুষ হয়ে,
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে
বিনাশ করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চির নির্ভীক
যৌবন-মাতোয়ারা
তাহাদেরই শুধু আছে অধিকার
ঈদগাহে ময়দানে।”

সংশ্লিষ্ট