রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০১৪

এক হৃদয়বিদারক কলঙ্কিত ইতিহাস ও আওয়ামী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ

রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা মানুষের হৃদয়কে খান খান করে দেয় তার একটি হলো ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এর সেই লগি-বৈঠার তাণ্ডবের অমানবিক দৃশ্যটি। সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ এ দিন সংঘটিত হয়েছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে তরতাজা তরুণদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে নারকীয় উল্লাস চালানো হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সেদিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর যে পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। লগি, বৈঠা, লাঠি, পিস্তল ও বোমা হামলা চালিয়ে যেভাবে মানুষ খুন করা হয়েছে তা মনে হলে আজও শিউরে ওঠে সভ্যসমাজের মানুষ। একটি মানুষকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার পর তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে উল্লাস করার ঘটনা মানুষ নামের কোনো প্রাণী সমর্থন করতে পারে না। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ মেরে লাশের ওপর নৃত্য উল্লাস করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। দিনে দুপুরে শত শত ক্যামেরা আর হাজার হাজার মানুষের সামনে দেখা গেল প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ছে। গুলির আঘাতে কয়েকজনের মাথা, বুক, হাত-পা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মাথা কয়েক খণ্ড করা হয়েছে, এমনকি মাথার একাংশ ঝুলে গেছে, মাথা ফেটে মগজ পর্যন্ত বেরিয়ে গেছে। সমস্ত শরীরে মারাত্মক জখম এবং হাত-পায়ের হাড় ভেঙে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। নির্মম আঘাতে অনেকের চেহারাও বিকৃত হয়ে গেছে। অনেকের দাঁত পড়ে গেছে। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেলেও হায়েনাদের হৃদয় একটুও গলেনি। খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেছে শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করিমের বাম পায়ের হাঁড়। আঘাতের কারণে অনেকটা স্থায়ী রোগী হয়ে গেলেন আরেক ত্যাগী নেতা সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মন্জুু। গোলাম কিবরিয়া শিপনকে হাত ধরে পাল্স পরীক্ষা করে মুখ নড়ে ওঠায় বাঁশের মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দাঁতগুলোকে মাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। কোনো মানুষ নামের জীবের পক্ষে এ কী করে সম্ভব? মাসুমকে ইটের আঘাতে মাথার ভেতর ইটের টুকরা ঢুকিয়ে তার মগজকে এবড়ো থেবড়ো করে দিলে জ্ঞান হারানো অবস্থায় তিন দিন পর পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। মুজাহিদ এবং জসিমকে বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে রাস্তার সাথে মিশিয়ে দেয়, আধমরা করে আবার দাঁড় করানো হয়, আবার পেটাতে পেটাতে মাটিতে শুইয়ে দেয় হয়, আবার ওঠায় আবার পেটায়।
সিদ্ধিরগঞ্জে লগি-বৈঠার আঘাত থেকে ভাইকে বাঁচাতে ভাইয়ের গায়ের ওপর শুয়ে পড়লে হায়েনাদের আঘাতে আঘাতে সবাইকে ছেড়ে চলে যায় বাবা হারা পরিবারের দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল। যারা মাত্র ২ দিনে ২৬ জন জীবন্ত মানুষকে এমন নির্মমভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করলো তারা কি মানুষ নাকি পশু? আর যারা এহেন কাজের নির্দেশ দিয়েছিল এবং পক্ষ নিয়েছিল তারা কী? ওরা আসলে মানুষের চেহারায় হিংস্র জানোয়ার, ওরা খুনি, ওরা হায়েনা, ওরা রক্তপিপাসু। এরাই প্রকৃত মানবতাবিরোধী।
এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়েছে। তবে সেদিন বাংলাদেশের ডান বাম সকল বড় বড় সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ আইনজীবীরা ঐ ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিলেন এবং বিচারও দাবি করেন। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো পৃথিবীতে সেদিনের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের জননেত্রী কর্মসূচি সফল করায় কর্মীবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সেদিনের টিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায় সেদিনের সেই গুলিবর্ষণ ও লগি-বৈঠার তাণ্ডবের নেতৃত্বে ছিলেন ডা: ইকবাল ও হাজী সেলিম। আসলে আওয়ামীদের চরিত্রই এমন। তারা ক্ষমতায় থাকলেও হত্যা সন্ত্রাস করে আর না থাকলেও সন্ত্রাসই তাদের চরিত্র। ২০০১ সালে ডা: ইকবালের উপস্থিতি ও নির্দেশে চারজনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করার সেই ঘটনা আজও দেশবাসীর মনে আছে। এ ছাড়া তাদের ১৯৭১-৭৪ আমলে ৩৭ হাজার নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, লুট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে হাজার হাজার বাড়ি ঘর। সেই বাকশালী চরিত্র যখন মানুষ ভুলতে বসেছে তখনই ১৯৯৬-২০০১ আমলে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে হত্যাসহ ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে চরম কষ্ট দিয়েছিল। ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তা আওয়ামী লীগের চরিত্রেরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা এই আহ্বানে সাড়া দিয়েই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সে দিনও মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের সভাস্থল থেকে বারবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, “জামায়াত শিবিরের ওপর হামলা কর, ওদের খতম কর”। ১৪ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন বারবার উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলার জন্য তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীকে উৎসাহিত করে।
বিলবোর্ড রাজনীতি
দৈনিক প্রথম আলো লিখেছেÑ ‘নজিরবিহীনভাবে রাতারাতি ঢাকা শহরের বিলবোর্ডগুলো দখল হয়ে গেছে। এসব বিলবোর্ড ভাড়া নিয়ে এত দিন যেসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়ে আসছিল, সেগুলো ঢেকে ফেলে এখন শোভা পাচ্ছে সরকারের সাড়ে চার বছরের উন্নয়নচিত্র। বাংলাদেশ আউটডোর অ্যাডভার্টাইজিং এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও বিলবোর্ড মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, প্রায় ২০০ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার বিলবোর্ড দখল হয়ে গেছে। বিলবোর্ডগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো। এ বিলবোর্ড প্রচারণায় খরচ হয় ৬০ কোটি টাকা। সমালোচকেরা বলছেন, এই বিপুল অর্থ খরচ সরকারের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে বিন্দুমাত্র কাজে আসবে না; বরং জনমনে এমন ধারণাই পাকাপোক্ত হবে, যারা এভাবে বিলবোর্ড দখল করে দলীয় প্রচারণায় নামতে পারে, তাদের অধীনে নির্বাচন হলে বিলবোর্ড দখলের মতো ব্যালটবাক্স দখলের কাজটি এরা চালাবে মরিয়া হয়ে। আসলে এ সরকার আইনি শাসন প্রতিষ্ঠার কথা জোর গলায় বললেও নিজেরা আইন মেনে চলায় বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল নয়। অনিয়মই তাদের কাছে নিয়ম। এ সরকারের আমলের সাড়ে চারটি বছর কেটেছে এই প্রবণতাকেই জোরালো করে তোলেÑ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মামলাবাজি, হামলাবাজি, দখলবাজি, দলবাজি, দমনবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ হেন অনিয়ম নেই যা এ সরকারের লোকজন করেনি। সে জন্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘দেশটা চলে গেছে বাজিকরদের হাতে।’ কার্যত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বেলায় তাই এ জনগণ তো দেখছে, এ সরকারের আমলে দেশে মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে, বিরোধী দল-মতের লেখকদের ওপর দমনপীড়ন কী মাত্রায় চলছে, দেশকে রাজনৈতিকভাবে বিভাজন করা হয়েছে, ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর কিভাবে একের পর এক আঘাত এসেছে, শেয়ারবাজার, সরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে কতটা প্রবলভাবে, সব খাতে সরকারি নেতাকর্মীদের দুর্নীতি কিভাবে চলেছে অবাধে, কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে এবং কিভাবে নানা কূটকৌশল চালিয়ে আজ আগামী নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে দেশবাসীকে রক্তারক্তির একটি আশঙ্কার মুখোমুখি এনে দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু সরকার রাতারাতি চর দখলের মতো বিলবোর্ডগুলো অবৈধভাবে দখল করে নিয়ে যেভাবে উন্নয়নের মহড়া প্রদর্শন করতে শুরু করেছে তাতে অভিজ্ঞমহলে এমন ধারণা বিলবোর্ডের মাধ্যমে যে উন্নয়ন ও সাফল্যের প্রচারণা চালোনো হচ্ছে, তা রীতিমতো বায়বীয়। এর মাধ্যমে সরকার তাদের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা ঢাকার কসরত করছে মাত্র। সরকার বাস্তবিকই দেশের উন্নয়ন করত তাহলে তা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হতো, বিলবোর্ড প্রচারণার প্রয়োজন হতো না।
হত্যা ও ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতি
হাসিনা যে কতটা যুদ্ধমুখী ও হত্যাপাগল একজন নারী, তা ইতোমধ্যে তিনি প্রমাণ করে ছেড়েছেন। ভয়ঙ্করভাবে প্রমাণ করেছেন শাপলা চত্বরে গণহত্যার মধ্য দিয়ে। বন্যপশুরা শিকার ধরে নিছক বাঁচার স্বার্থে। এখানে ক্ষমতায় থাকা বা আধিপত্য স্থাপনের কোনো রাজনীতি থাকে না। ফলে পশু হামলায় এক সাথে একটির বেশি প্রাণনাশ হয় না। তাই বনজঙ্গলে রক্তের বন্যা সৃষ্টি হয় না। কিন্তু প্রতিটি গণহত্যার পেছনে থাকে স্বৈরাচারী শাসকের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। তাই তাদের হাতে রক্তের বন্যা সৃষ্টি হয়। সেটি যেমন হালাকু চেঙ্গিসের হাতে হয়েছে, তেমনি মুজিব ও হাসিনার হাতেও হয়েছে ও হচ্ছে। গণহত্যার কাজটি সুচারুরূপে করার তাগিদেই মতিঝিলের শাপলা চত্বরের আধা মাইল বর্গমাইল এলাকায় শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির সদস্যদের নিয়ে ৭ হাজার ৫৮৮ জনকে পাঠিয়েছিল। (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর ১২ মে, ২০১৩)। একাত্তরের যুদ্ধে কোনো পক্ষই সীমান্তের সমপরিমাণ কোনো স্থানে এতবড় বাহিনী নিয়ে কখনোই যুদ্ধ করেনি। ব্রিটিশ তার ১৯০ বছরের শাসনেও জনগণের বিরুদ্ধে কখনোই এতবড় বাহিনী ময়দানে নামায়নি। রাজনৈতিক বিরোধীদের শেখ হাসিনা যে কতটা হত্যাযোগ্য মনে করে এ হলো তার নমুনা। এমনই একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই তিনি তার দলীয় সরকারের অধীনে এক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মিথ্যাচার রাজনীতি
শেখ হাসিনা বার বার বলে থাকেন, ‘পিতার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য রাজনীতিতে আসা।’ তিনি আরো বলেন, ‘তার আর চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নেই। জনগণের মুখে হাসি ফুটানোর জন্যই তার রাজনীতি।’ এ কথাও বলেন, ‘প্রয়োজনে তিনিও তার পিতার ন্যায় জীবনের শেষ রক্তবিন্দুটি দেশের জন্য দিয়ে যাবেন।’ প্রশ্ন হলো, তার পিতার অপূর্ণ ইচ্ছাটি কী ছিল? সেটি নিশ্চয়ই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল না। বরং মুজিবের রাজনীতির মূল লক্ষ্যটি সেটি ছিল যেকোনো প্রকারে আজীবন ক্ষমতায় থাকা। এবং সে জন্যই তিনি একদলীয় বাকশালের পথটি বেছে নেন। নিজে রক্ত দেয়ার বদলে তিনি ৩০-৪০ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছেন। সেটি নিছক নিজের ক্ষমতায় থাকাটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
মুজিবের রাজনীতির লক্ষ্য জনগণের মুখে হাসি ফুটানোও ছিল না। তিনি বরং ডেকে আনেন বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যাতে মৃত্যু ঘটে বহু লক্ষ মানুষের। সৃষ্টি হয় হাজার হাজার জালপরা বাসন্তী। তার দলীয় নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শায়েস্তা খানের সোনার বাংলা পরিচিতি পায় ভিক্ষার তলাহীন পাত্র রূপে। হাসিনা জনসভায় বার বার বলেন, ‘জনগণ থেকে তার আর চাওয়া-পাওয়ার নেই।’ অথচ পরক্ষণেই তিনি ভোট চান ভোট পাওয়ার অর্থ যে দেশ-শাসনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাওয়া সেটি কি তিনি বুঝেন না? সে ক্ষমতাটি ফিরে পেলে তার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু বাকি থাকে কি? বরং তার কাছে তখন জনগণকে ভিখারি হতে হয়। গুলির খাদ্যও হতে হয়। তিনি মুখে বলেন একটা, কাজ করেন আরেকটা। যেমনটি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন দেশবাসীকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াবেন, ঘরে ঘরে সরকারি চাকরি দেবেন। আর এখন তা বেমালুম ভুলে গেছেন বরং অস্বীকার করে চলেছেন।
সঙ্ঘাতের পথে দেশ
জনগণের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী সরকারের যুদ্ধটি সর্বক্ষণের। সে যুদ্ধে বিজয়ের লক্ষ্যেই শেখ মুজিব রক্ষীবাহিনী, লাল বাহিনী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এ নামের নানা বাহিনী রণাঙ্গনে নামিয়েছিল। একই লক্ষ্যে শেখ হাসিনাও ময়দানে নামিয়েছে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। এটিকে নাম দিয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুজিবের শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ জনগণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বৈরাচারী সরকার বিজয়ী হতে পারে না। হাসিনার পিতার বড় অপরাধ, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে তিনি নিষ্ঠুর খেলা খেলেছেন। সেগুলোকে ব্যবহার করেছেন ক্ষমতার শিখরে পৌঁছার সিঁড়ি রূপে। দেরিতে হলেও মানুষ তার ছলচাতুরী বুঝে ফেলে। স্বাধীনতা, সোনার বাংলা, বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতার বড় বড় বুলি শুনিয়ে তিনি নিজেই জনগণের বুকের ওপরে চেপে বসেছিলেন আমৃত্যু এক নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসক রূপে।
অথচ দলগড়া, আন্দোলন করা, মিছিল করা, ধর্মঘট করা ও লেখালেখি করার কাজে কোনো সভ্য দেশেই আইনগণ বৈধতা লাগে না। কারো অনুমতিও নেয়া লাগে না। পানাহারের ন্যায় সেগুলোও মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষ কখন কী খাবে সেটি কি কারো অনুমতি নিয়ে খায়? সে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়াই বড় ডাকাতি, মানব সমাজের সেটিই সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ অধিকার কেড়ে নিলে সভ্যদেশে সরকারকে আদালতের কাটগড়ায় দাঁড়াতে হয়। নমরূদ, ফেরাউনগণ তো সে অপরাধেই অপরাধী। শেখ মুজিবের ন্যায় হাসিনাও সে অপরাধকর্মে লিপ্ত ।
সত্য প্রচারে বাধা
আজ যখন সত্য-ন্যায়, স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের অপরাধে এই শাসকদের রোষ কষায়িত ক্রোধের শিকার হয়ে আমার দেশসহ ডজন ডজন পত্রিকা প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে, যখন দিগন্ত, ইসলামিক টিভিসহ অনেক চ্যানেল চাপা পড়েছে শাসকদের ক্রুরতার নিচে, যখন বিরোধী মতপ্রকাশের সব দরজায় ঝুলছে তালা, নিষিদ্ধ হয়েছে সভা-সমাবেশ, হাজার হাজার মামলায় জর্জরিত রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের হাতে-পায়ে পরানো হচ্ছে ডাণ্ডাবেড়ি, জেলখানাগুলো উপচে পড়ছে উৎপীড়িত মানুষের হাহাকারে, যখন বেপরোয়া গণহত্যায় মেতে উঠেছে এই সরকার, যখন শুধু ‘এক নেতা, এক দেশ’ কর্মসূচি নিয়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গণদাবিকে শুকনো বাদাম খোসার মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে নিজেরা মগ্ন হয়ে উঠেছে ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী করার জন্য, যখন সিংহভাগ গণমাধ্যমকে কবজা করে অষ্টপ্রহর চলছে নিজেদের মহিমা কীর্তন, আর নির্বিচারে নিঃশেষ করা হচ্ছে ভিন্নমতাবলম্বীদের, যখন ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না, গ্রেফতার করা হচ্ছে নেতা-কর্মীদের, যখন গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য টিউবের শেষ প্রান্তেও দেখা যাচ্ছে না কোনো আলোর আভাস সেই রকম মুহূর্তে ‘নবরূপে বাকশাল’ দেখা যাচ্ছে।
সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতি
আওয়ামী লীগই প্রথম বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও হত্যার সূচনা করেছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র গলাটিপে হত্যা করে বাকশাল কায়েম করেছিল। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। শিল্প, কল-কারখানা বন্ধ করে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার করেছিল। লাল বাহিনী, রক্ষীবাহিনী, মুজিব বাহিনী সৃষ্টি করে লুটপাট, অত্যাচার নির্যাতনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এরাই জাসদের হাজার হাজার প্রতিবাদী কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে খুন করেছিল। জাতীয় সংসদের পবিত্র স্থানে স্পিকার হত্যার ভয়াল অপরাধ সংঘটিত করেছিল তারাই। দেশের অগণিত প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের ও পারিবারীকরণের নির্লজ্জ ঘটনার সূত্রপাত তাদেরই আমলে। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করে হাজার হাজার বাঙালি হত্যাকারী ভারতীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে দেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করেছিল তারাই। সৃষ্টি করেছিল ২৮ অক্টোবর ২০০৬ লোমহর্ষক, বর্বর, পৈশাচিক ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। পল্টনের হত্যাকাণ্ড মানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্য অপরাধের জ্বলন্ত দলিল। পৃথিবীর যত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে পল্টনের হত্যাকাণ্ড তার থেকে একটু ভিন্ন। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। খুনিরা লাশের উপরে উঠে নৃত্য প্রদর্শন করে গোটা জাতির বিবেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। হত্যা করার পর হাতের স্পন্দন দেখে মৃত নিশ্চিত করার মত জঘন্য স্পর্ধা দেখাতেও কোন দ্বিধা ছিল না আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীদের। ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা তাদেরকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করেনি বরং জনগণের বিবেকের আদালতে তারা আজ আসামির কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান। নাটোরে প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু হত্যাকাণ্ডের নির্মম দৃশ্য আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের নতুন উপহার। বিশ্বজিৎ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। জয়নাল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশ বাহিনীর নির্লজ্জ হামলা জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম, প্রচার সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলমকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো শুধু বিস্ময়কর ঘটনা নয় রীতিমত বিশ্ববাসীর জন্য এটি একটি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ব্যাপারও বটে। ২১ জন নারীকে কয়েকশ বীরপুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশিন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। পুলিশের বুটের নিচে যে গণতন্ত্র জাতি প্রত্যক্ষ করেছে তা এই আওয়ামী লীগের মত সরকারের পক্ষেই কেবল মানানসই।
১৯৭১ সালে বর্বর, হানাদার পাক বাহিনীর গণহত্যার ৪২ বছর পর আওয়ামী বাহিনী বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো গণহত্যা চালাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেরুয়ারিতে শুরু হওয়া সেই গণহত্যায় এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, যুবক সবাই আছেন। বিরোধীদলীয় নেতা জাতির উদ্দেশে

সংশ্লিষ্ট