রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারী জেনারেল ইয়াছিন আরাফাত বলেন, দূষণ ও বিকৃতিতে বাংলা ভাষা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চারদিকে চলছে ভাষা বিকৃতির উৎসব। আর ভাষার বিকৃতি ক্রমশ যেন বাড়ছেই। সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের নিদের্শনা আজো কাগজেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। অপর দিকে, ভিনদেশী ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরকারের ভূমিকা রহস্যজনক। কার্যত বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

তিনি আজ রাজধানীর শহীদ আব্দুল মালেক মিলনায়তনে আন্তর্জতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্রশিবির আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও দোআ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মোবারক হোসেনের পরিচালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় দাওয়া কার্যক্রম সম্পাদক আনিছুর রহমান বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দায়ীত্বশীলবৃন্দ।

সেক্রেটারী জেনারেল বলেন, ভাষার বিকৃতি ক্রমশ বাড়ছেই। আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিসহ আরও অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া কিছু নাটকে বিকৃত ভাষার ব্যবহার, রেডিও জকির ভাষা এবং সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত কিছু বিজ্ঞাপনের সংলাপ ভাষা বিকৃতির কারণ সমূহের অন্যতম। পার্শবর্তী দেশের টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচারের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালালেও সরকার এ ব্যাপারে রহস্যজনক ভাবে নীরব। জাতীয় সংসদেও কথা বলার সময় অনেকেই শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে কথা বলেন না। এভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে বিকৃতির ফলে বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার কার্যকর কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ জন্য উচ্চ আদালতের নিদের্শনা থাকলেও সরকার তা মানছে না। স্বপ্রণোদিতভাবে (সুয়োমটো) দেয়া ওই আদেশে আদালত বলেন, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে হবে।

স্বাধীনতার এতো বছর পর সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলন এখনও উপেক্ষিত। মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েও আমরা মাতৃভাষাকে যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এখনো বাংলাকে রাষ্ট্রের সকল বিভাগে চালু করা সম্ভব হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষা এখনো উপেক্ষিত। রাষ্ট্রের সকল স্তরে মাতৃভাষা চালুর জন্য বার বার গণদাবি উঠলেও স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারই তা অবহেলা করে আসছে। ভাষার মাস এলে ক্ষমতাসীনরা বাংলার মর্যাদা নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেও রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও দীর্ঘকালের পরিক্রমায় মহান একুশের চেতনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে শাসক গোষ্ঠী।

ইউনিভার্সাল ভাষায় রূপান্তরিত না হওয়ায় ভাষার বিশ্বায়নে পিছিয়ে পড়ছে বাংলা। বিশ্বের ১৫২টি ভাষা ইউনিভার্সাল ভাষায় রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেও বাংলা তাতে নেই। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ বাংলা ভাষাকে ইউনিভার্সাল ভাষায় রূপান্তরের উদ্যোগ নিলেও অর্থ সংকটে তা থেমে গেছে। ফলে বাংলা ভাষার তথ্য ও সাহিত্যভাণ্ডার বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বিশ্বসাহিত্যে বাংলাকে সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার পরিবর্তে যুগে যুগে ক্ষমতাসীনরা ভাষা আন্দোলন নিয়ে কেবল অপরাজনীতি করেছে। এ জন্য মাতৃভাষার অবহেলা রোধ, সর্বস্তরে বাংলা চালু এবং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলা ভাষার বিকাশ সাধনে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে।

১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। তমদ্দুন মজলিস এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম এ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। অধ্যাপক গোলাম আযমও ছিলেন এ আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। তিনি ভাষার দাবিতে মানপত্রও পাঠ করেছিলেন। এ জন্য তাকে তিন তিন বার কারাবরণও করতে হয়েছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে তার অবদানকে অস্বীকার করে হীনমন্যতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে। তিনি ভাষা আন্দোলনকালীন সময়ে ডাকসুর নির্বাচিত জি এস থাকলেও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে ডাকসুর জিএসদের নাম ফলক থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম মুছে ফেলা হয়েছে। তিনি ডাকসুর নির্বাচিত জিএস হিসেবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্বারকলিপি পাঠ করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি তাকে সম্মানিত করার পরিবর্তে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখার পর সেখানেই ভাষা আন্দোলনের এই অগ্রসেনানী মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সার্বজনীন হলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই আওয়ামী লীগ এ আন্দোলনকে দলীয়করণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে তারা দলীয় ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন তারা আজ উপেক্ষিত।

এসময় তিনি রাষ্ট্রের সকল পর্যয়ে বাংলা ভাষার প্রচলনের জোর দাবী জানান। সেই সাথে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দাবী জানিয়ে বলেন, উচ্চতর শিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং তার পাশাপাশি সকল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গুলোতে বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। একুশের চেতনায় উদ্বদ্ধ হয়ে সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের পাশাপাশি ভাষার স্বকীয়তা সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সংশ্লিষ্ট