وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِيْن مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئاً وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ سورة آل عمرا

“না, মুহাম্মদ, একজন রাসূল ছাড়া আর কিছু নন; তাঁর আগে আরও অনেক রাসূল গত হয়েছেন। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা তাঁকে যদি শহীদ করা হয় তবে কি তোমরা দ্বীন থেকে উল্টো দিকে ফিরে যাবে? সাবধান, তোমাদের যে কেউ জাহেলিয়াতের দিকে আবার ফিরে যাবে সে আল্লাহর দ্বীনের সামান্যতম ক্ষতি সাধনও করতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা অবশ্যই দৃঢ়চেতা ও কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

পটভূমি :
নামকরণ: এ সূরার ৩২ নম্বর আয়াতে উল্লিখিত ‘আলে ইমরান’ থেকে এ সূরার নাম ’آل عمران‘ The family of Imran.
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحاً وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ আলে ইমরান ৩৩

“নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা আদম (আ), নূহ (আ) এবং ইব্রাহীম (আ) এর পরিবার ও ইমরান (আ) এর পরিবারকে নবুয়তের জন্য গ্রহণ করেছেন।
‘The family of Imran- occurs as a generic name for all the Hebrew prophets from Moses to Jesus’.
Mohammad Marmaduke piekthal-

কুরআন শরীফের অন্যতম ভাষ্যকার বলেন, ‘ইমরান পরিবার একটি প্রতীকী শব্দ এখানে হজরত মূসা (আ) পিতার নাম ও মরিয়ম (আ) পিতার নাম ছিল ইমরান, সে ইমরানের নামে বনি ইসরাইল নবীদের বুঝানো হয়েছে। যে বংশকে নবুয়তের মহান দায়িত্বের জন্য বাছাই করা হয়েছে।

শানে নুজুল ও নাজিলের সময় : এটা মাদানী সূরা। আলোচ্য আয়াত ও রুকু ওহুদ যুদ্ধের পরে যুদ্ধে মুসলমানদের দুর্বলতার সমালোচনা ও পর্যালোচনাসহ অবতীর্ণ হয়েছে। ওহুদ যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ও বেদনাদায়ক। তৃতীয় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধের আগুনে ছিল মোশরেকরা প্রজ্বলিত। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩ হাজারের বাহিনীর ডানে ছিল বীর কেশরী খালেদ আর বামে ছিল ইকরামার মত সাহসী যোদ্ধারা।

অপরদিকে স্বয়ং নবী করীম (সা)- এর নেতত্বে ১ হাজার জন মুসলিম বাহিনী। পথিমধ্য হতে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর নেতৃত্বে ৩০০ জন মুনাফিক রাসূল (সা) যুদ্ধের দিকে আগুয়ান অবস্থায় পথ থেকে পিছিয়ে এলেও নবীজি (সা) ৭০০ জানবাজ মুজাহিদ সাথে নিয়ে সামনে এগোতে থাকলেন। এ ভয়াবহ যুদ্ধের বর্ণনা অনেক দীর্ঘ। দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রতিটি কর্মীকে বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে ওহুদ যুদ্ধের বিস্তারিত ঘটনা জানা উচিত। এ পরিবেশে সে আলোচনার সুযোগ নেই। রাসূল (সা) এর যুদ্ধকৌশল, সৈন্য পরিচালনা ও লড়াইয়ের আগে তেজোদীপ্ত বক্তব্য এবং ওহুদের গিরিপথ পাহারাদারিতে নিয়োজিত হজরত আব্দুল্লাহর প্রতি নির্দেশ, প্রতিটি বিষয় সমর ইতিহাসে অম্লান নির্দেশিকা হয়ে থাকবে। নবীজি (সা) যেখানে ৫০ জন তিরন্দাজসহ সেনাপতি আব্দুল্লাহকে বলেছিলেন “সাবধান! যুদ্ধে আমার শাহাদাতের সংবাদ কানে এলেও এ গিরিপথের পাহারাদারী থেকে এক চুল নড়তে পারবে না।”

যুদ্ধের প্রথমে মুসলমানদের বিজয়ে গনিমতের মাল হাসিলের লোভে ৪০ জন্যই আবদুল্লাহর নিষেধ অমান্য করে। খালেদ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ঐ ১০ জনকে খুন করে মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে ও যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সামনে ও পেছনের দিক থেকে মুসলমানরা ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে গেল। মাত্র ৯-১০ জন সাহাবী রাসূল (সা)-কে ঘেরাও করে তীর বর্শা ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন। ইবনে কমিয়ার তীরের আঘাতে রাসূল (সা) কসওয়া থেকে পড়ে গেলেন। হজরত আবু দোজানা রাসূল (সা)-কে বুকে জড়িয়ে পড়ে রইলেন। যুদ্ধের মাঠে আওয়াজ উঠল ‘মুহাম্মদ (সা) নিহত হয়ে গেছে’। রাসূল (সা) কে রক্ষা করতে জীবনপণ করে যে নয়জন, তার মধ্য হতে সাতজনই শহীদ হয়ে গেলেন। সকলেই ছিলেন আনসার। শুধু হজরত তালহা (রা) রাসূল (সা) এর দিকে নিক্ষিপ্ত তীর একাই প্রতিহত করছিলেন। আর নিজে ঢাল হয়ে গিয়েছিলেন, শত শত তীর তার দেহ ক্ষত বিক্ষত করেছে। রাসূল (সা) বলেছিলেন তোমরা যদি কোনো শহীদকে ভূপৃষ্ঠে চলাফেরা করছে দেখতে চাও তবে তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহকে দেখ।” (তিরমিযি)

দৌড়ে এগিয়ে গেলেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও আবু বকর ও হজরত আলী (রাা)সহ অন্যরা। হজরত আবু ওবায়দা রাসূল (সা)- এর মাথা মোবারক থেকে লোহার কোড়া বের করতে গিয়ে দু’টি দাঁত ভেঙেছিল। নবী করীমের দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছে। ৭০ জন সাহাবী এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। যাদের জন্য রাসূল (সা) ক্রন্দন করেছেন তাদের লাশ বিনা গোসলে দাফনের নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেন, “আমি সাক্ষ্য দেবো কিয়ামতের দিন তোমরা আল্লাহর দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছ। এমতাবস্থায় তোমাদের উঠানো হবে রোজ হাশরে, যখন তোমাদের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বের হতে থাকবে।” (ইবনে হিসাম)

এমনি একটি ভয়াবহ যুদ্ধে নবী করীম (সা)-এর শাহাদাতের দুঃসংবাদে মুসলমানরা অনেকে ভেঙে পড়েছিল, ভাবছিল আর কিসের জন্য, কার জন্য যুদ্ধ করবে? অনেকে যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পালিয়েছিল। ওহুদের পরে আল্লাহতায়ালা যুদ্ধের ওপর যে কঠিন পর্যালোচনার আয়াত নাজিল করেছেন তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য আয়াতটি।

বিষয়বস্তু : এর মধ্যে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যে কত বড়, যার জন্য প্রতিটি নবী-রাসূলকে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন  হতে হবে আল্লাহর সামনে, যে দায়িত্ব পালন থেকে কোন কঠিন পরিস্থিতি আমাদেরকে অব্যাহতি দেবে না বরং এ দায়িত্ব আনজাম দেয়ার সাথে জান্নাত ও জাহান্নামের ফয়সালা অবধারিত।
তাফসির
১. Mohammad is lest a messenger- وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُولٌ

মুহাম্মদ (সা) রাসূল ছাড়া আর কিছু নন।
وَمَا: না, এ শব্দটি মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে মূর্খদের, অজ্ঞদের মিথ্যা, কল্পিত সন্দেহ সংশয় মিশ্রিত সকল প্রকার চিন্তা ও চেতনা ধারণাকে কঠিনভাবে নাকচ করে দিয়েছে।
আল্লাহতায়ালা এখানে মুহাম্মদ (সা)-এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন “মুহাম্মদ (সা) রাসূল ছাড়া আর কিছু নন।” রাসূল স্বীকার না করে মুহাম্মদ (সা) এর যত প্রশংসাসূচক শব্দ বলা হোক তার ওপর যত কাব্য, কছিদা, জীবনগ্রন্থ রচিত হোক এর কোন মূল্য নেই। উহা মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর ঈমান আনার বিকল্প নয়। রাসূল বলে পরিচয় দিলে আর কোন পরিচিতির প্রয়োজন নেই। কারণ সাধনা করে কবি, সাহিত্যিক, পণ্ডিত দার্শনিক অলি-আবদাল হওয়া যায় কিন্তু সাধনা করে রাসূল হওয়া যাবে না। রাসূল ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত খোদ আল্লাহতায়ালার। তাঁরা আল্লাহতায়ালার একক সিদ্ধান্তে মনোনীত।
মুহাম্মদ (সা) কার ছেলে, আর কার পিতা উহা তার আসল পরিচয় নয়। ঐ পরিচয় নিয়ে দুনিয়ার কোন কাফিরেরও কোন বিতর্ক নেই। তার চরিত্রের কোন সুন্দর বৈশিষ্ট্য দিয়ে যে পরিচয়-তিনি আলআমিন, আস সাদেক তা নিয়ে কারো কোন সংশয় নেই। যে পরিচয় নিয়ে পৃথিবীর জনপদে এত সংঘাত, সংঘর্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ, সে পরিচয় হলো তিনি আল্লাহর রাসূল। কুরআন বলছে-
আহসাব-৪০ مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ
“মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও নবীগণের শেষ সমাপ্তি।”
যে পরিচয় দিয়ে সকল নবী দায়িত্ব পালন শুরু করেন- তাহলো তারা রাসূল হয়ে আসছেন- যেমন মুহাম্মদ (সা)-কে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন-
আরাফ- ১৫৮ قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعاً
“বল, হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের সকলের জন্যে রাসূল হয়ে এসেছি, যেমন ঈসা (আ) তার কওমের কাছে নিজের পরিচয় প্রদান করে বলেন-
সূরা সাফ- ০৬ وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ
“হে বনি ঈসরাইলগণ, আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে রাসূল হয়ে এসেছি।
অনুরূপভাবে মূসা (আ) বলেন, “হে আমার জাতির জনগণ, তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, তোমরা জান যে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল হয়ে আসছি।”
সূরা সাফ- ০৫ وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ لِمَ تُؤْذُونَنِي وَقَدْ تَعْلَمُونَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ
মুহাম্মদ (সা) রাসূল ছাড়া আর কিছু নন।
তিনি জীবনের প্রতিটি বিষয়ে প্রতিটি মুহূর্তে যা বলেছেন ও করেছেন তা নিজের ইচ্ছায় করেননি। সবটাই ছিল রিসালতের জিম্মাদারী। নবুয়ত ঘোষণা দেয়ার পর জীবনের কোন সময় এমন ছিল না যখন তিনি রাসূল ছিলেন না। তিনি সকালেও রাসূল, বিকেলেও রাসূল, দিন-দুপুরে রাসূল আর রাত-দুপুরেও রাসূল। সালাতের ইমামতের সময় রাসূল, পরিবার পরিচালনায়ও রাসূল, সমাজের যখন বিচার ফায়সালা করেন তখনও রাসূল, যুদ্ধে যখন সেনাপতি তখনও রাসূল, মদিনার যখন রাষ্ট্রপ্রধান তখনও রাসূল।

২. Many messengers have passed away before him- - قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ
“মুহাম্মদ (সা)-এর আগেও অনেক নবী-রাসূল অতীত হয়েছেন।” তাদের সকলের ওপর ছিল নবুয়তের কঠিন দায়িত্ব।

রাসূলদের দায়িত্ব :
মানবজাতির কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দেয়া নবী ও রাসূলদের প্রথম দায়িত্ব। আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানকে মানবসমাজের প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত সমস্ত মিথ্যা ও বাতিল ব্যবস্থার ওপর বিজয় করে দেয়ার সংগ্রাম ও লড়াই করা তাঁদের মূল দায়িত্ব। যে কঠিন দায়িত্ব পালনে তাঁরা অকথ্য নির্যাতন বরদাশত করেছেন, সহায় সম্পদ হারা অবস্থায় জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েছেন, কারার প্রকোষ্ঠবন্দী হয়ে, অসামাজিকভাবে বয়কটের সীমাহীন যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন, এমনকি অনেক নবী-রাসূল নির্মমভাবে শহীদও হয়েছেন এত কিছুর পরও ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব পালনে তাঁরা ময়দানে ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আপসহীন।

ওহুদের রণপ্রান্তরে মাথার মধ্যে লোহার কোড়ার মধ্যে আটকে পড়া, দন্ত মোবারক তীরের আঘাতে ভেঙে পড়েছে, মুহাম্মদ (সা) রক্তাক্ত অবস্থায় কসওয়ার পৃষ্ঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলেন। হুঁশ ফিরে আসার পর নবীজি (সা) বলেন, “আমি কোন মিথ্যা নবী নই, আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান মুহাম্মদ। তোমরা আমাকে ফেলে পালাচ্ছ কেন?”

রাসূলের সাথে উম্মতের দায়িত্ব : 
যে পয়গাম নিয়ে আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে জমিনে পাঠিয়েছেন আর দ্বীনে হককে প্রতিষ্ঠা করার যে কঠিন দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করেছেন, উম্মতকেও সে কাজে সাহায্যকারী হতে হবে। এ বিষয়ে উম্মাতি মুহাম্মদী (সা)-এর দায়িত্ব সম্পর্কে কুরআন বলছে
সূরা আরাফ ১৫৭- فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَهُ أُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ
“অতএব তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর ঈমান আনবে, তাকে সম্মান করবে, তাঁকে নবুয়তের ময়দানে সাহায্য করবে এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ নুরের অনুসরণ করবে তারাই সফল হবে।”

ক. ঈমান
মুহাম্মদ (সা)-এর রিসালাতের ওপর পূর্ণ ঈমান।
তিনি নবীগণের শ্রেষ্ঠ, তারপর আর নবী আসবে না।
তিনি সকল শ্রেণী, পেশার মানুষের জন্যে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত রাসূল।
তার রিসালতের কোন চিহ্নিত সীমানা নেই।

খ. ভালোবাসা
মুহাম্মদ (সা) প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা উম্মতের দায়িত্ব।
সকল প্রিয় ব্যক্তির চেয়ে মুহাম্মদ (সা) বেশী প্রিয়।
মুমিনদের জীবনের চেয়েও তিনি বেশি প্রিয় হতে হবে।
তার নাম মোবারক উচ্চারণ করলে বা শুনলে দরুদ পৌঁছাতে হবে।

গ. সাহায্য করা
তিনি নবুয়তের যে বিশ্বব্যাপী দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন সে মহান দায়িত্বের ময়দানে তাঁকে নুসরাত করা উম্মতের ফরজ দায়িত্ব।
এ ব্যাপারে যে কোন ত্যাগ ও কুরবানির জন্য তৈরি থাকা
এ বিষয়ে কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
উম্মতের জীবন, সম্পদ, সুযোগ ও যোগ্যতা সব কিছুকে এর জন্য নিবেদন করতে প্রস্তুত হতে হবে।

ঘ. ইত্বেবা করা
মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর অবতীর্ণ নুর তথা কুরআনকে পূর্ণরূপে অনুসরণ করা, আর তার বাস্তব নমুনা নবীজি (সা)-এর জীবনী, যা কুরআনেরই রূপায়ণ।
তার সামনে তাঁর মুকাবেলায় আর কোন মহামানব তো দূরের কথা অতীতের কোন নবী-রাসূলকে ইত্বেবা করাও হারাম। তাঁর সামনে সকল নবীর নবুয়ত, রিসালাত কিতাব সবকিছু মানসুখ ও রহিত করে দেয়া হয়েছে।

৩. If he died or slain- أَفَإِيْن مَاتَ أَوْ قُتِلَ
‘যদি মুহাম্মদ (সা) ইন্তেকাল করেন বা শহীদ হন’
এ আয়াত স্পষ্ট করে বলেছে যে নবীগণ মানুষ ছিলেন মুহাম্মদ (সা) মানুষ তবে ঐ পরিপূর্ণ নিষ্পাপ ও নিদাগ মানুষ যার ওপর আল্লাহর অহি ও কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। তাকেও একদিন ইন্তেকাল করতে হবে অথবা অন্যান্য বহু নবী-রাসূলের মতো শাহাদাতের রক্তাক্ত পথে এ জীবনের ইতি হবে। যদিও তিনি ইন্তেকাল করবেন। সৃষ্টির জন্য অবধারিত মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করবেন কিন্তু তাঁর রিসালাতের কোন মৃত্যু নেই। তাঁর নবুয়ত বেঁচে থাকবে পৃথিবীর প্রলয়েরও পরে। মুমিনদের নিত্যদিনের প্রতিটি কর্মে মুহাম্মদ (সা) জীবন্ত হয়ে রয়েছেন। প্রতিদিন কবর জগতে তাঁর রিসালত সম্পর্কে কবরবাসীকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, হাশর মাঠেও তিনি ছাড়া আর সকল নবী-রাসূল আল্লাহপাকের সামনে বাকরুদ্ধ থাকবেন। সকল নবীও থাকবেন তাঁর ঝাণ্ডার নিচে। সে জমিনে শুধু আখেরি রাসূলের রিসালাতই চলবে।

৪. Do you turn back on your heels- انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ
“তোমরা কি দ্বীন থেকে উল্টো দিকে ফিরে যাবে?”
যে দ্বীনের জন্য পৃথিবীতে আগমন করলেন লাখ লাখ নবী-রাসূল। যে দ্বীনের জন্য অগণিত নবী-রাসূল মজলুম হয়েছেন, অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, শত শত নবী শহীদ হয়েছেন। সেই দ্বীনের ময়দানে রক্তাক্ত ও সংজ্ঞাহীন মুহাম্মদ (সা) নিহত হওয়ার সংবাদে যারা ওহুদের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন- তাদের ঘরে ফেরার আগে আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কঠিন এক জিজ্ঞাসা নিয়ে। মুহাম্মদ (সা) যে দ্বীনের জন্য শহীদ হয়েছেন বলে তোমরা শুনেছ, সেই রাসূল (সা) কে আহত অবস্থায় যুদ্ধের মাঠে রেখে দ্বীনের পথ থেকে উল্টো দিকে মানে কুফুরির দিকে কেন ফিরে গেলে? ওহুদের মাঠের পলায়নপর সৈন্যদের লক্ষ্য করে অবতীর্ণ আয়াতের আবেদন এখানে শেষ নয়। বরং কুরআনে কারিমের আয়াতের আবেদন চিরন্তন ও সার্বজনীন অনাগত কালের বিপ্লবীদের জন্য সময়ের যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে বিপদের যে কোন ঘনঘোর অন্ধকার, নেতৃত্বস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের- শাহাদাতের দুঃসংবাদে দিশেহারা, নিরাশ, হতাশ, ভীত, বিহবল ও পলায়নপর ব্যক্তিদের সামনে কুরআনে কারিমের এ আয়াত চিরন্তন ও জীবন্ত হয়ে বলবে “তবে কি তোমরা দ্বীন থেকে অন্য দিকে ফিরে যাবে?”

৫. He who turns back does no harm to Allah- وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئاً
“যারা উল্টো দিকে ফিরে যাবে তাদের জন্য আল্লাহর দ্বীনের কোন ক্ষতি হবে না।”
আল্লাহতায়ালার জন্য কারো সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই।
তিনি মুখাপেক্ষী নন। তিনি শুধু দেখে নেবেন কারা আল্লাহতায়ালার জন্য এগিয়ে আসবে আর কারা পিছিয়ে থাকবে।
দ্বীনের জমিন কারো জন্য চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়নি।
দায়িত্ব পালনে যারা অযোগ্য হবে তাদেরকে ছাঁটাই করা হবে আর যোগ্য ও সাহসীদেরকে বাছাই করে আনা হবে।
কুরআন এ বিষয়ে আপসহীন বক্তব্য দিয়ে বলে-
সূরা তাওবা- ৩৯ : إِلاَّ تَنفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَاباً أَلِيماً وَيَسْتَبْدِلْ قَوْماً غَيْرَكُمْ وَلا تَضُرُّوهُ شَيْئاً
অর্থাৎ ‘তোমরা যদি আল্লাহর পথে বের না হও তবে পীড়াদায়ক শাস্তির জন্য তৈরি থাক, আল্লাহ তোমাদেরকে ছাঁটাই করে অন্যদেরকে বাছাই করবেন। তোমাদের চলে যাওয়ায় কোন ক্ষতি হবে না।”

৬. Allah will reward the thankful- وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ
“দৃঢ় কৃতজ্ঞ বান্দাদের জন্য আল্লাহর নিকট রয়েছে পুরস্কার।”
পরিস্থিতি নাজুকতা যতই ভয়ানক হোক, অত্যাচার জুলুমের মাত্রা যতই তীব্র হোক, নিরাশার অন্ধকার যতই ঘনীভূত হোক, বাধার হিমালয় যতই উঁচু ও অগম্য হোক, শত্রুর হাতের মরণাস্ত্র যতই শাণিত ও মারত্মক হোক এক দল দৃঢ়চেতা ও কৃতজ্ঞ বান্দাহ সবকিছু উপেক্ষা করে দ্বীনের ওপর সব যুগে দাঁড়িয়েছিল অবিচলভাবে। আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আল্লাহতায়ালার এ কৃতজ্ঞ ও দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন ক্ষুদ্র দলটিকে সাহায্য করেছেন যুগের প্রতিটি ক্রান্তিকালে। তাদের জন্য আল্লাহতায়ালার সাহায্যের হাত সর্বদা থাকবে প্রসারিত। একটি হাদিসে নবীজি (সা) বলেন : “যে নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত অবস্থায় ইসলাম তাঁর যাত্রা শুরু করেছিল আবার সে অবস্থায় ফিরে যাবে তবে গোরাবাদের জন্য সুসংবাদ। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন গোরাবা কারা? নবীজি (সা) বললেন : “ঐ অল্পসংখ্যক ও অপরিচিত মানুষ যারা দ্বীনের কঠিন ও দুঃসময় আমার আদর্শ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকবে।”

শিক্ষণীয় বিষয় : 
১) মুহাম্মদ (সা)-এর আসল পরিচয় তিনি আল্লাহর রাসূল।
২) গোটা নবুয়তের হায়াতের প্রতিটি মুহূর্তে ও কর্মে তিনি রাসূল- কোন বিশেষ কাজে ও বিশেষ সময়ের রাসূল নন।
৩) নবীদের জীবনের পরিণতি- ‘শাহাদাত অথবা ইন্তেকাল’ তারা অনন্তকালের জীবন নিয়ে আসেননি।
৪) দ্বীনের বিজয় সংগ্রাম নিয়ে নবীগণ এসেছেন পৃথিবীতে- তাদের সংখ্যা অনেক তবে সর্ব শেষ এসেছেন মুহাম্মদ (সা)- পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে এ দ্বীনের পয়গাম পৌঁছে দিতে আর পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চি জমিনে এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিয়ে।
৫) ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করাই প্রকৃতপক্ষে নবীদের ইত্বেবা বা অনুসরণ করা।
৬) কোন কঠিন পরিস্থিতি এমনকি মুহাম্মদ (সা) শাহাদাতের ভয়াবহ সংবাদে, ভাইদের লাশ যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকার কঠিন ও নাজুক পরিস্থিতিতেও দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থেকে কারো অব্যাহতি নেই। সেই অবস্থায়ও অবহেলা প্রদর্শনকারীদের জন্য রয়েছে কুরআনে পাকের ভয়াবহ হুঁশিয়ারি।
৭) যারা এ দ্বীনের দায়িত্ব পালন থেকে সরে দাঁড়াবে তারা আল্লাহর  দ্বীনের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
৮) সকল যুগে সালেহিনদের একটি ছোট দল  দ্বীনের ওপর অবিচল ছিল ও আগামী দিনেও থাকবে।
৯) ঐ ক্ষুদ্র ও অপরিচিত ‘গোরাবাদের’ জন্য জান্নাতের সুসংবাদ।
১০) ইসলামী আন্দোলনের রক্তপিচ্ছিল পথে চলার পাথেয়- ধৈর্য, ধৈর্য এবং ধৈর্য।

উপসংহার :
উল্লিখিত আয়াতের মধ্যে যেন এক সাগরের জ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে। সময় ও সার্বিক বিষয়ের বিবেচনায় দীর্ঘ কথা বলার সুযোগ নেই। পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে আজ মজলুমদের আহাজারি- মুসলিম ও ঈমানদারদের উপর ঈমানের কারণে চলছে অত্যাচার ও নিপীড়নের লোমহর্ষক পরিস্থিতি। এমনি ভয়াল পরিস্থিতিতেও মুসলমানদেরকে ছড়িয়ে দিতে হবে ঈমানের পয়গাম। জুলুম, নিপীড়ন, খুন ও আহাজারি তথা মানবতার বিপর্যয় যেন ইসলামের বিজয়কে অনিবার্য করে তুলছে। মুসলিম যুবকদেরকে আজ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। পরাশক্তির অস্ত্রের হুমকি ও বিস্ফোরিত বোমার লেলিহান আগুন দেখে ভড়কে গেলে চলবে না। কোন ভয়াল পরিস্থিতি, উপায় হীনতার অজুহাত, পরাশক্তির নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা আমাদেরকে মানবতার মুক্তি ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে অব্যাহতি দেবে না।