হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা:) বলেছেন: সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তায়ালা (কিয়ামতের দিন) তার আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন। সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না। ১. ন্যায় পরায়ন নেতা। ২. ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন। ৩. এমন (মুসলিম) ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে। ৪. এমন দু’ব্যক্তি যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়। ৫. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ফেলে। ৬. যে ব্যক্তিকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমনী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে। ৭. যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে তার ডান হাত কি দান করলো বাম হাতও জানলো না। (বুখারী-মুসলিম)

রাবী’র পরিচয়ঃ 

নাম: তার নাম সম্পর্কে ৩৫টি অভিমত পাওয়া যায়। বিশুদ্ধতম অভিমত হলো ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নাম ছিল।
১. আবদুস শাসছ
২. আবদু আমর
৩. আবদুল ওযযা
ইসলাম গ্রহণ করার পর -
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে সাখর।
৫. আবদুর রহমান ইবনে সাখর
৬. ওমায়েক ইবনে আমের

উপনাম: আবু হুরায়রা।
পিতার নাম: সাখর
পিতার নাম: উম্মিয়া বিনতে সাফীহ। অথবা মাইমুনা।

আবু হুরায়রা নামে প্রসিদ্ধির কারণঃ
আবু হুরায়রা শব্দের অর্থ বিড়াল ছানার পিতা। (আবু=পিতা; হুরায়রা=বিড়াল ছানা) একদা তিনি তার জামার আস্তিনের নিচে একটা বিড়াল ছানা নিয়ে রাসূল (সা:) এর দরবারে হাজির হন। হঠাৎ বিড়ালটি সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ে। তখন রাসূল (সা:) রসিকতা করে বলে উঠলেন- “হে বিড়ালের পিতা” তখন থেকে তিনি নিজের জন্য এ নামটি পছন্দ করে নেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

ইসলাম গ্রহণঃ তিন ৭ম হিজরী মোতবেক ৬২৯ খৃস্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল বিন আমর আদ-দাওসীর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন।
হাদীস বর্ণনাঃ সর্বপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনাকারী। বর্ণিত হাদীস ৫৩৭৪ টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৪১৮টি।
মৃত্যুঃ ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে কাসবা নামক স্থানে।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ
গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মুসলিম যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুওে ২০৪ হিজরী ২৪ শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। ১৫ বছর সহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০। ছাড়া ৪,০০০ মাত্র। এ মনীষী ২১৬ হিজরী সনে ৫৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

ব্যাখ্যাঃ এখানে কিয়ামতের এক ভীষণ চিত্রের কথা তুলে মানুষের মনে প্রথমে ভীতি জাগানো হয়েছে। এরপর সেই ভীতি বা শাস্তি থেকে যে শ্রেণীর লোক রক্ষা পাবে তার বর্ণনা দিয়ে মূলত মানুষকে সেইসব গুনে গুনান্বিত হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছে।

১. ন্যায় পরায়ন নেতাঃ মূলত এখানে নেতা বলতে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বোঝানে হয়েছে। তা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা কোন দলের নেতা যাই হোক না কেন। নেতৃত্বের ব্যাপারে ন্যায় ও ইনসাফ।
হাদীস:- “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী-মুসলিম)
ইনসাফ ভিত্তিক নেতৃত্ব না হলে তা অধিনস্তদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের প্রতি অনীহা সৃষ্টির ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিশৃংখলা দেখা দেয়।
রাসূল (সা:) বলেন “যে ব্যক্তি মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেবেন।” (বুখারী-মুসলিম)
আল কোরআনের বিচারে ন্যায় পরায়ন নেতার বা রাষ্ট্র প্রধানের ৪ দফা কাজ-
১. নামাজ কায়েম করা
২. যাকাত আদায় করা
৩. সৎ কাজের আদেশ করা
৪. অসৎ কাজে নিষেধ/বাধা দেয়া
আয়াতঃ
অর্থ: “তারা এমন লোক যাদেরকে আমি যমিনে ক্ষমতা দান করলে নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দেবে। আর সব বিষয়ের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে।” (সুরা হজ্জ-৪১)
অর্থঃ “আমি তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছিলাম তারা আমার বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে পথ প্রদর্শন করে। আমি ওহীর মাধ্যমে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করা আদেশ করেছি, তারা খাটিভাবে আমার ইবাদত করত।” (সুরা আম্বিয়া-৭৩)

২. যৌবন কালঃ ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে।
হাদীসঃ
ক. পাচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা (জীবনকাল কোন পথে ব্যয়/ যৌবন কাল কোন পথে ব্যয়)
খ. পাচটি বিষয়ের পূর্বে পাচটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া।
পূর্বের হাদীস দুটির ব্যাখ্যায় এ বিষয় আলোচিত হয়েছে।

৩. এমন মুসল্লী যার অন্তরকরণ মসজিদের সাথেঃ অন্তকরণ মসজিদের সাথে ঝুলানো থাকে এর অর্থ আল্লাহর সাথে সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারে তার ব্যাকুলতা। দৈনিক পাচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে পড়ার জন্য ব্যাকুলতা।
হাদীসঃ নামায মূমিনদের জন্য মেরাজ স্বরুপ। মসজিদে জামায়াতে নামায পড়ার গুরুত্ব। এর ফলাফল লোক দেখানো হয় না।

৪. পরস্পর মিলিত হওয়া ও পৃথক হওয়াঃ মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্যই হওয়া উচিত। কোন কিছুকে ভালবাসলে তা আল্লাহর জন্য এবং পরিত্যাগ করলে তাও আল্লাহর জন্য হতে হবে।
কোরআনঃ “বলুন আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরন সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য। (আন আম-১৩২)
হাদীস: আবু উমামা (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেছেন যে ব্যক্তির কাউকে ভালবাসা, ঘৃণা করা, দান করা ও দান না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার। (বুখারী)
ইসলামের জন্যই যুদ্ধের ময়দানে একজন সাহাবীর হাতে তারই কাফের পিতার মৃত্যুর ঘটনা।

৫. আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলাঃ নির্জনে আল্লাহর ভয়ে দু’কারণে অশ্রু বিসর্জনে-
ক. আল্লাহর আজমত-জালালাত বা শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের জন্য।
খ. নিজের অপরাধ স্মরণ করে মুক্তিলাভের জন্য।
রাসূল (সা:) বলেছেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করেছে তার জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব যেমনি অসম্ভব দোহন করা দুধকে পুনরায় ওলানে প্রবেশ করোনো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার পথে জিহাদ করেছে সে ব্যক্তি আর জাহান্নামের ধোয়া একত্র হবে না।” (তিরমিযী)
রাসূল (সা:) বলেন- “দু’ধরনের চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।
১. ঐ চোখ যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়।
২. ঐ চোখ যা আল্লাহর পথে পাহারাদারীতে রাত জাগে।” (বুখারী)

৬. চরিত্রের হেফাজতঃ যৌবনকালে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্য চায়। সৃষ্টিগতভাবে এটা একটা স্বাভাবিক তাড়না। এ সময় কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী কোন রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হবার প্রস্তাব করলে শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়েই তা থেকে বিরত থাকা যায়।
এভাবে চরিত্রের হেফাজত করলে তবেই আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করা যাবে।
কোরআনঃ
অর্থঃ “আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।” (বনী ইসরাঈল-৩২)
অর্থঃ “লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার নিকটেও যেওনা, তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (আনআম-১৫২)
বিবাহের মাধ্যমে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটানো ইসলামের নির্দেশ।
অর্থ: এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (মুমিনুন-৫-৬)

৭. গোপনে দান করাঃ দান করতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। মুনাফিকুনের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
“আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করো মৃত্যু আমার আগেই।”
“তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষন না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করবে।” (আল ইমরান-৯২)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হবে দান করার মূল লক্ষ্য। মনে অহংকার আসতে পারে এ ধরনের ভীতির কারণই হলো দানের এ পদ্ধতি উল্ল্যেখ করার কারণ।”
হাদীসঃ “আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেননা বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।”
শিক্ষাঃ-
১. সর্ব পর্যায়ে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোরআনে বর্ণিত নেতার কাজ প্রতিষ্ঠার যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের হাতে নেতৃত্ব দিতে হবে।
২. যৌবনের সকল চেষ্টা সামর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করতে হবে।
৩. সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায কায়েম করতে হবে ও নামাযের পূর্ণ পাবন্দী করতে হবে।
৪. সমস্ত তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
যাবতীয় চেষ্টার পর জ্ঞাত বা অজ্ঞাত দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

সংশ্লিষ্ট