আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা:) নবী করীম (সা:) থেকে বর্ণনা করেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদম ও স্ব স্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না। ১) তার জীবন কাল কি ভাবে অতিবাহিত করেছে, ২) যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৩) ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪) তা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৫) সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।

রাবির পরিচয়ঃ-
ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কয়জন মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা:) ছিলেন তাদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নবীকরিম (সা:) এর মদিনায় হিজরতের পর মদিনায় চলে আসেন। তিনি সর্বদা রাসূল (সা:) এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন, এবং ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করতেন। হযরত আবু মুসা আশরারী বলেন, “আমরা ইয়েমেন থেকে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসুদ (রা:) কে নবী পরিবারের লোক বলে মনে করতাম।”
হযরত আব্দুল্লাহর ইবনে মাসুদ (রা:) একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদিনার যে কয়জন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম, কোরআন শিক্ষায় তিনি বিশেষ পারদর্শী। নবী করিম (সা:) বলেন: “কুরআন শরীফ যে ভাবে নাজিল হয়েছে হুবহু সে ভাবে যদি কেহ পড়তে চায় সে যেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যায়।”
এই জ্ঞানের বিশাল মহিরুহ হিজরী ৩২ সালে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৮৪৮ টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐক্যমতের হাদিস ৬৪টি, তাছাড়া বুখারী ২৬৪টি এবং মুসলিম ৩৫টি হাদিস বর্ণনা করেছেন।

হাদিসের গুরুত্বঃ-
আলোচ্য হাদিসে মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধন কল্পে আখিরাতের জবাব দিহির অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও পরকালের জবাবদিহি অনুভূতি জাগ্রত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্র সংশোধনের আশা করা বৃথা, কারণ আমাদের এ জীবনের পর অনন্ত কালের এক জীবন আছে এবং সে জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পুর্ণরুপে নির্ভর করে এ জীবনের কর্ম ফলের উপর; আর প্রতিটি কর্মেরই সুক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে একমাত্র এই অনুভূতিই মানুষকে মহৎ হতে বাধ্য করে।
তাছাড়া পার্থিব জীবনের আচার আচরণ সম্বন্ধেও ইংগিত প্রদান করা হয়েছে এ হাদিসের মধ্যে। তাই প্রতিটি মুসলমানের জীবনে এ হাদিসটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

ব্যাখ্যাঃ-
১. মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে
অর্থ: “আমি মানুষ ও জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।”
ইবাদত করতে প্রতিটি মানুষ অথবা জ্বীনকে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। কারণ ইয়াবুদুন শব্দটি আবদুন শব্দ হতে নির্গত আর আব্দুন শব্দের অর্থ হলো গোলাম বা দাস। কাজেই দাসত্ব বা গোলামী জীবনের কোন একটি সময় বা মুহুর্ত পর্যন্ত সীমিত নয় বরং সমস্ত জীবন ব্যাপী এ দায়িত্ব।
অন্যত্র বলা হয়েছে
অর্থ: “তোমরা কি মনে করেছ আমরা তোমরাদেরকে অকারনেই সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে কখনই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে না। (মুমিনুন-১১৫)
তাই দেখা যায় পৃথিবীর প্রতিটি চাকচিক্য ময় বস্তু মানুষের পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষার সফলতা বা ব্যর্থতার কেন্দ্র করেই শুরু হবে পরকালের জীবন। সত্যি কথা বলতে কি ছোট্র একটি প্রশ্নের উত্তর সমস্ত জীবন ব্যাপী বিস্তৃত।
২. প্রতিটি বস্তুরই একটি উৎকৃষ্ট অংশ থাকে আর জীবনের উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে যৌবন কাল। নিম্নে চারটি গুণের পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটে এই যৌবনে।
১. চিন্তা শক্তি
২. ইচ্ছা শক্তি
৩. মনন শক্তি
৪. কর্ম শক্তি
অতএব দেখা যাচ্ছে ভাল অথবা মন্দ যে কাজই করা হোকনা কেন যৌবন ই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কারন মানুষ চুরি, ডাকাতি, জুলুম, নির্যাতন, অহংকার ইত্যাদি সব কিছুই করে যৌবন কালে দেখা যায়। যৌবনের দুধর্ষ এক লোক বার্ধক্যের কষাঘাতে নেহায়েত গোবেচারায় রুপান্তরিত হয়। কারন বার্ধক্য মানুষকে নিরীহ করে দেয়। তাই বার্ধক্য যেমন অন্যায় অত্যাচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় তদ্রুপ যতো সৎ নিয়ত এবং প্রচেষ্টাই থাকে না কেন বার্ধক্য আসার পর কোন একটি ভাল কাজ ও সুচারু রুপে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, এখানে বার্ধক্য তার প্রধান অন্তরায়। এজন্য যৌবন এত গুরুত্বপূর্ণ।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে
“পাঁচটি বস্তুকে গণিমতের মাল বলে মনে করতে হবে। তার একটি হলো বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনের।” (মিশকাত)
অনেকেই মনে করে যৌবন যা কিছু মনে চায় করে বার্ধক্য আসার পর আল্লাহর নিকট তওবা করে সৎকাজে মনোনিবেশ করবো। এই ধারনাই মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। তাই হাদিসে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ জন্যই পরকালের প্রশ্নাবলীর মধ্যে যৌবন সংক্রান্ত প্রশ্নটি অন্যতম।
৩. মানুষ পৃথিবীতে ভোগের জন্য সর্বদা পাগল পারা। তার একটা লক্ষ্য ধন সম্পদের স্তুপে সুখের সন্ধান করা। এ জন্য চুরি, ডাকাতি, অপরের সম্পদ হরণ অথবা ধোকাবাজী যা কিছু হোকনা কেন তাতে পরওয়া নেই। আর এভাবে যদি কোন সমাজ চলে তবে সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। তাই বিশ্ব প্রভু সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি সুখী সমৃদ্ধশীল সমাজ কায়েমের লক্ষে ধন-সম্পদ আয় এবং তার ব্যয়ের মধ্যেও শর্তারোপ করেছেন। যাতে সমাজের কারো কোন অধিকার ভোগ করতে পারে। নিম্নে সম্পদ অর্জনের মৌলিক বিধি নিষেধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. কারও অধিকার নষ্ট করে সম্পদ অর্জন করা যাবে না। যেমন মিরাসের অংশ না দিয়ে অথবা মহরের প্রাপ্ত টাকা না দিয়ে ভোগ করা এতিমের মাল ভোগ করা ইত্যাদি।
২. ব্যভিচার বা কোন প্রকার দেহ ব্যবসার মাধ্যমে ও সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৩. চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুন্ঠন, ইত্যাদির মাধ্যমেও জীবিকা বা সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৪. কাউকে ধোকা দিয়ে বা ঠকিয়ে ধন সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৫. গান, বাজনা, অভিনয় ইত্যাদিকেও জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না।
৬. হারাম মালের দ্বারা ব্যবসার মাধ্যমে
৭. মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্রব্য সামগ্রী ৪০ দিনের অধিক জমা রেখে ঐ মুনাফা লব্ধ টাকার মাধ্যমে।
৮. সুদ অথবা ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ আহরন বা বর্ধিত করা যাবে না।
৯. জুয়া, হাউজি, ভাগ্যগণনা, লটারী ইত্যাদির মাধ্যমেও সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
১০. ওজনে কম দেওয়া।

উপরের বিধি গুলি সামনে রেখে উপার্জন করতে হবে। ব্যয়ের মৌলিক খাত সমূহ নিম্নে দেওয়া হলো।
১. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু শর্তারোপ করা হয়েছে অপচয় না করার।
২. নেছাবের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে।
৩. ছাদকা
৪. নিকট আত্মীয়ের হক
৫. ইয়াতিমের হক
৬. মিসকীনের হক, ভিক্ষুকের হক
৭. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ
৮. বিভিন্ন ধরনের কাফ্ফারা আদায়
৯. পথিক বা পর্যটকের হক।

বস্তুত প্রত্যেকটি বনী আদমকেই প্রশ্ন করা হবে যে উপরোক্ত শর্তাবলীই পালন করেই সে সম্পদ আয় ও ব্যয় করেছে কি না?

৪. বিশ্ব বাসীকে লক্ষ্য করে রাসূল (সা:) এর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রথম ফরমান-
“পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন।”
এই আয়াতের তাৎপর্য হলো রবকে জানা বা বুঝার উদ্দেশ্য পড়তে হবে, অন্য কথায় দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মহানবী (সা:) বলেছেন:
“মুসলমান প্রতিটি নরনারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ”
স্রষ্টা-সৃষ্টি ও বিশ্ব জাহান সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই প্রতিটি লোক তার নিজের এবং স্রষ্টার সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে এবং সেই সাথে আরও বুঝতে পারে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি আর তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি? এমনিভাবে মানুষ যখন তার স্রষ্টাক জানতে ও বুঝতে পারে তখন স্রষ্টার দেওয়া দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন
“আল্লাহ ঈমানদারের বন্ধু। তিনি মানুষকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে পথ দেখান।”
তবে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হবে তাগুতকে অস্বীকার করে। সুরা বাকারার অন্যত্র বলা হয়েছে
“যে তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর পথে ঈমান আনল সে এমন একটি মজবুত রশি ধারণ করল যা কখনও ছিড়বে না।”

সংশ্লিষ্ট