শহীদ মুহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২৮ আগস্ট ১৯৯৫ | ৭৫

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

কুল্লু নাফসিন যায়েকাতুল মউত, প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এ বাস্তবতাকে কেউ এড়িয়ে চলতে পারবে না। মানুষ এ নিয়মের অধীনে। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রতিটি মৃত্যুই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রতিটি মৃত্যুকে মানুষ স্মরণ করে না। আবার কিছু কিছু মৃত্যু অনাদিকাল পর্যন্ত সত্য পথের পথিকদের জন্য অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকে। বিশেষ করে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য যারা জীবনকে তাঁর পথে বিলিয়ে দেয়, বাতিলদের সাথে যারা আপোষ করে না, তাদের এই অমূল্য ত্যাগ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সাহস শক্তি উৎসের তারাই হয় কেন্দ্রবিন্দু।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
২৮ আগস্ট ১৯৯৫ সন্ধ্যা ৬টা। পশ্চিম আকাশে যেন অসংখ্য শহীদের রক্তের লালিমায় রঙিন বর্ণময় হয়ে উঠেছে। এমনি এক পবিত্রলগ্নে রংপুর টাউন হলের সিরাত মাহফিল শেষে বাসায় আসার উদ্দেশ্যে ফিরছিলেন ইসলামের এক সিপাহসালার শহীদ মঈনুল ইসলাম। বন্ধুদের সাথে নিয়ে যখন কারমাইকেল কলেজ রোড, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশনের সমানে আসেন তখন বর্বরোচিত হামলা শুরু করে পূর্ব থেকে ওঁৎপেতে থাকা জাসদ ছাত্রলীগের চিহ্নিত সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো দা, কিরিচ, কুড়াল এবং বোমা নিয়ে তারা ছিল সুসজ্জিত উপর্যুপরি বোমার আঘাতে এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো শহীদ মঈনুলসহ তার সঙ্গী শিবির কর্মীরা। ৮/১০ জনকে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় ভর্তি করা হলো বিভিন্ন ক্লিনিক হাসপাতালে।

কিন্তু যে জীবন শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত সে জীবনতো ধাবিত হবেই শাহাদাতের পথ ধরে। কোন বাধাই তাকে আটকাতে পারবে না। ঘটনাস্থল থেকে পাড়ি জমালেন জান্নাতের পথে। শহীদ হবার কয়েকদিন পূর্বে মায়ের কাছ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে শহীদি মৃত্যুর ফযিলত বর্ণনা করেছিলেন। আল্লাহ যেন তার মৃত্যুকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন এজন্যে দোয়া করতো বলেছিলেন। মাকে শহীদের তামান্না বুকে লালন করে অত্যন্ত অবেগ প্লাবিত হয়ে বলেছিলেন, মা, বাতিলের হাতে যদি আমি কোন দিন শহীদ হই, তাহলে বল মা, তুমি কাঁদবে না। তুমি যদি কাঁদ তাহলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব।

শহীদ মঈনুল ইসলাম ছিলেন শিবিরের সাথী এবং উপশাখা সেক্রেটারি, শাহাদাতের ২ ঘণ্টা পূর্বে তার উপশাখা সভাপতির কাছে সংগঠন থেকে চিরতরে ছুটি নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন এবং শাহাদাতের দিন সকালে সকল বকেয়া টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করেছিলেন।

বিভাগীয় পরিচিতি 
শহীদ মঈনুল ভাই এবং আমি ছিলাম একই বিভাগের ছাত্র। তিনি আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। একই বিভাগে হওয়ার কারণে হিসাব বিজ্ঞান নিয়ে তার সংগে অনেক কথাও হয়েছে। বিশেষ করে অংকের নিয়ম-কানুন এবং পরীক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন দিতেন আমাকে। হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের এমন কোন ছাত্র-ছাত্রী বা স্যার নেই যিনি চিনতেন না মঈনুল ভাইকে। চেনার পিছনে অন্যতম কারণও ছিল। আমাদের বিভাগে কোন অনুষ্ঠান হলে কে কুরআন তেলাওয়াত করবে এক সাথে সবার প্রস্তাব আসত মঈনুল ভাই-এর নাম। এরপর হামদ ও নাত কে গাইবেন তখনও প্রস্তাব আসত মঈনুল ভাইয়ের নাম। তিনি অবশ্য সুন্দর ইসলামী গান গাইতে পারতেন। এভাবেই ডিপার্টমেন্টের সবার কাছে পরিচিত এবং প্রিয় ছিলেন।

ক্যাম্পাসে পরিচিতি
কলেজে শিবিরের টেন্টে গেলেই যে ব্যক্তি সবার আগেই হাসি মুখে সালাম দিতেন এবং জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতেন, তিনি ছিলেন শহীদ মঈনুল ভাই। আমার একটি কথা তার শাহাদাতের পর মনে পড়ে আমি ছোট হলেও কোনদিনই মঈনুল ভাইকে আগে সালাম দিতে পারিনি। তিনি শুধু সালাম দিয়েই চুপ ছিলেন না সাথে সাথে আমার যে এলাকার দায়িত্ব ছিল অর্থাৎ আশরতপুর এলাকার খোঁজ খবরের পাশাপাশি আমার পড়াশুনারও খোঁজ খবর নিতেন।

দায়িত্ব পালনরত এলাকার পরিচিতি
শহীদ মঈনুল ভাইয়ের দায়িত্ব ছিল কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সূত্রাপুর আবাসিক এলাকায়। তখনকার কলেজ সভাপতি শাফি ভাইয়ের এলাকা। ঐ এলাকায় এমন কোন বাড়ি নাই, এমন কোন ব্যক্তি নেই যেখানে মঈনুল ভাই যাননি বা তাকে কেউ চিনেন না। তিনি সর্বদা হাসিমুখে এবং রসিকতা সহকারে সবার মন জয় করতে পারতেন। তার শাহাদাতের সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে মানুষগুলো হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছিলেন লাশ দেখতে। অথচ ঐ মানুষগুলোর সাথে মঈনুল ভাইয়ের কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই তিনি সবার নিকট পরিচিতি এবং সকলের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সেবক হিসেবে পরিচিতি
১৯৯৫ সালে নাস্তিক কবি শামসুর রাহমানের রংপুরে আসাকে কেন্দ্র করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। এতে আমাদের অনেক ভাই আহত হন। বিশেষ করে শাফি ভাই, মুকুল ভাই, রাজ্জাক ভাই, হারেছ ভাই, রায়হান ভাই সহ আরো অনেকে। কিন্তু শাফি ভাই গুরুতর আহত হওয়ার কারণে তাকে দীর্ঘদিন থাকতে হয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার দেখাশুনা করার জন্য পালাক্রমে কয়েক জন ভাইকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ভাগ্যক্রমে সেই দায়িত্ব আমারও উপর এসে যায়। সব থেকে বেশি সময় যিনি সেই অসুস্থ ভাইদের পাশে ছিলেন, তিনিই হচ্ছেন শহীদ মঈনুল ইসলাম ভাই। আমি প্রায় হাসপাতালে গিয়ে দেখতাম মঈনুল ভাই অসুস্থ ভাইদেরকে ভাত কিংবা ঔষধ খাওয়াচ্ছেন অথবা মাথা মালিশ করছেন এবং অসুস্থ ভাইয়েরা ঘুমিয়ে গেলে তিনি পাশে বসে পেপার বা ইসলামী সাহিত্য পড়ছেন। আমি তার কাছে গেলে তিনি এত সুন্দরভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিতেন কখন ভাইদের ঘুম থেকে ডাকতে হবে, কখন ঔষধ খাওয়াতে হবে এবং বারবার বলতেন, অসুস্থ ভাইদেরকে একা রেখে কখনও বাহিরে যাওয়া যাবেনা। সত্যিই সেই দিন বুঝতে পারিনি তিনি এত সুন্দর সেবক এবং দায়িত্বশীল।

সাংগঠনিক দায়ি হিসেবে পরিচিতি
শহীদ মঈনুল ভাইয়ের সংগে ঘনিষ্ট হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে আগেই বলেছি যে একই সাবজেক্টে পড়াশুনা করতাম এবং সব থেকে মজার ব্যাপার হলো একই সাথে সাথী প্রার্থী হয়েছি এবং দশজন ভাইকে ১৩ এপ্রিল ১৯৯৪ইং তারিখে রংপুর শহর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য মোঃ আসলাম হাকিম ভাই সাথী শপথ দেন। এই দশজনের মধ্যে আমি এবং মঈনুল ভাইও ছিলাম। মাঝে মাঝে পড়ার ফাঁকে রসিকতা করে আমাকে বলতেন, লিডার তো আগামীতে আপনারাই হবেন। আমরাতো সামনে বিদায় নিবো। আবার বলতেন, লিটন ভাই সাথী শপথ নিয়ে কি শপথের হক সঠিকভাবে আদায় করতে পারবে? তিনি যে কেমন দায়ী ইলাল্লাহ ছিলেন তা আল্লাহর পথে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন।

যেভাবে শহীদ হলেন
রংপুর শহর শাখার উদ্যোগে ২৮ আগস্ট ১৯৯৫ ইং রংপুর টাউন হলে সিরাতুন্নবী (সা) উপলক্ষে আলোচনা এবং কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বিকেল তিনটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে আসরের নামাজের পরপরই শেষ হয়ে যায়। অনুষ্ঠান যখন চলছিল আমরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে হলরুমের বাহিরে বসে বাদাম খাচ্ছি আর মনের সুখে ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে কথা বলছি। কে জানতো এই মাঠে বসে সিরাতুন্নবী (সা) এর আলোচনা শুনা হচ্ছে ঠিক পরের দিনই ঐ মাঠেই জানাজার নামায অনুষ্ঠিত হবে। ঐ জানাজার হৃদয় বিদারক দৃশ্য যা আজ ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। অনুষ্ঠান শেষে সকলেই আমরা এরশাদ মোড় শিবির অফিসে চলে আসি। মাগরিবের নামাজের পূর্বেই কারমাইকেল কলেজ সেক্রেটারি হারুন ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কলেজের দিকে রওনা দিব। 

তখন শহরে জাসদ ছাত্রলীগের সাথে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরপরে হারুন ভাইয়ের নেতৃত্বে রায়হান ভাই, হারেছ ভাই সহ আমরা প্রায় চল্লিশ জন ভাই কলেজের উদ্দেশ্যে হেঁটেই রওনা দিলাম। মঈনুল ভাই, আলিম ভাই এবং আমি গল্প করতে করতে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি। আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি জাসদ ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খামারের একটি গলিতে ওঁৎ পেতে বসেছিল।

সবাই চারতলা মোড় গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশনের নিকট (কারমাইকেল কলেজ রোড) পৌঁছলে পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে বসে থাকা জাসদ ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ককটেল নিক্ষেপ করে। তারা ককটেলসহ সশস্ত্র অবস্থায় অতর্কিতভাবে হামলা করে। আকস্মিক হামলায় আমাদের অনেক ভাই আহত হন। সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র, চাইনিজ রামদা, কিরিচ, রডসহ সশস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন ভাইকে বেদমভাবে আঘাত করে। মঈনুল ভাই, হাবীব ভাই সহ সবাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। স¤পূর্ণ অসহায় ও নিরুপায় হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মঈনুল ভাইয়ের সাথীরা এই বর্বর নির্যাতন দেখতে বাধ্য হন। রাংগা ও হান্নান রড দ্বারা মঈনুল ভাইয়ের মাথায় আঘাত করে, আঘাতে তার মাথা ফেটে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। হান্নান-খুররমরা রামদা দ্বারা তার ঘাড়ে কোপায়। এরপর পেট কোপায়। পা-দুটি খাড়া করে পায়ে কোপায়। আঘাতে পায়ের হাড়গুলো ঝুলে পড়ে। কুড়াল দ্বারা হাতের নিচে আঘাত করে। উপুর্যপুরি আঘাতে যখন মৃত্যু নিশ্চিত তখন তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। রক্তাক্ত এবং গুরুতর অবস্থায় আমিসহ কয়েকজন হাবিব ভাই ও মঈনুল ভাইসহ অন্যান্যদেরকে মেডিক্যালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা মঈনুল ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যান্য আহতরা সুস্থ হলেন, হাবিব ভাইয়ের জ্ঞান ফিরল কিন্তু শতশত ভাইদের শোকাভুত করে শহীদি মিছিলে শামিল হয়ে জান্নাতে চলে যান মঈনুল ভাই। মৃত্যু সংবাদ শুনার পরেই আমার মাথা এমনভাবে চক্কর দিচ্ছিল এবং শরীর কেন যেন কাঁপছিল। মুখের ভাষা মনে হয় হারিয়ে গিয়েছিল। আজও সেই কথা মনে হলে হৃদয়টা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। গোটা শিবির অফিসে ভাই হারা কান্নার রোল পড়ে যায়। কে কাকে সান্ত্বনা দিবে এমন কেউ সেদিন ছিল না। মঈনুল ভাইয়ের শহীদ হওয়ার তীব্র বাসনা ছিল। শহীদ হওয়ার কয়েকদিন পুর্বে মায়ের কাছে বিদায়ের প্রাক্কালে বলেছিলেন, বল মা, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে তুমি কাঁদবে না, তুমি কাঁদলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব মা।

শহীদের জানাযা
পরের দিন ২৯ আগস্ট লাশ রিলিজ নেয়ার পর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জানাযা শেষে রংপুর শহরে র‌্যালি সহ লাশ নিয়ে কারমাইকেল কলেজে রওনা দেই। কলেজে পৌঁছলে জানাযার পূর্বে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন শহীদের বড় ভাই, কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ আব্দুল কুদ্দুস বিশ্বাসসহ অনেক শিক্ষকই এবং সবশেষে বক্তব্য রাখেন শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ রফিকুল ইসলাম খাঁন। তিনি তার বক্তব্যে জাসদ ছাত্রলীগের খুনি সন্ত্রাসী খুররম, আজিজুল, সাব্বির, হান্নান, গৌতম, রাজ্জাক-সহ সকল খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, যারা কারমাইকেল কলেজের ছাত্রকে খুন করেছে তাদের ছাত্ররাজনীতি করার অধিকার ক্যাম্পাসে নেই। তাদেরকে এই পবিত্র মাটিতে প্রবেশ করতে দেয়া যেতে পারে না। অবশ্য এরপর থেকে ক্যাম্পাসে তাদেরকে আর বিচরণ করতে দেখা যায়নি। এরপর জানাযা শেষে লাশের কফিন নিয়ে শহীদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মনে হয় সমস্ত গ্রাম শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন।


ছাত্র গণজমায়েত
পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে খুনিদের শাস্তির দাবিতে ছাত্র-গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে শহীদ মঈনুল ভাইয়ের আব্বা যে কথাটি বলেছিলেন তা হচ্ছে-আমার পাঁচ ছেলের মধ্যে সবচেয়ে যে ভাল ছিল সে হচ্ছে শহীদ মঈনুল ইসলাম। বাকি ছেলেরা আমার জন্য দুনিয়ায় সামান্য কিছু করতে পারবে কিন্তু মঈনুল ইসলামী আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন তাই আল্লাহর দরবারে আমরা সকলেই দোয়া করবো আল্লাহ যেন তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন এবং কাল কিয়ামতের মাঠে শহীদেরা তার পিতা-মাতা সহ নিকট আত্মীয়দের জান্নাতে নেয়ার জন্য যে সুপারিশ করতে পারবেন। ঐ সুপারিশকারীর পিতা-মাতা হিসেবে যেন আমরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারি। শহীদ মঈনুলের কাছে এটিই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া যা আমার অন্য কোন ছেলেরা দিতে পারবে না। আপনারাও যেন ইসলামী আন্দোলন করে যেতে পারেন সে জন্য দোয়া করছি।

শহীদের খুনিদের বিচার
হায়রে স্বাধীন বাংলার বিচারব্যবস্থা। শহীদ মঈনুল ভাইসহ অসংখ্য শহীদ ভাইয়ের খুনিদের বিচার আজও আমরা পাইনি। আমরা সত্যিকারের বিচার আল্লাহর কাছে চাই। সর্বোচ্চ ১০ মাস জেল খেটেছে খুনিরা। পরে টাকার জোরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শহীদের বাড়ি
রংপুর শহর শাখার সভাপতি মোঃ মাজেদুর রহমান ভাইসহ অসংখ্যবার শহীদ মঈনুল ও আবু সাঈদ মোঃ সায়েম ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। শহীদ মঈনুল ভাইয়ের কবর বাড়ির গেটের কাছে ঘরের সঙ্গেই লাগা। শাহাদাতবার্ষিকীতে তার বাড়িতে গিয়ে দেখি কবরটা কত সুন্দর, কত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, পার্শ্বে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ লাগানো, ফুল দেখে মনে হয় আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে শহীদ মঈনুল ভাইয়ের আত্মা এই ফুলের মত নিষ্পাপ। শহীদ মঈনুল ভাইয়ের পিতা প্রতিদিন তার কবর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। শহীদ মঈনুল ভাইয়ের আকার আকৃতি ও গঠন যেমন, ঠিক তার আব্বার প্রতিফলন হয়েছিল। তার পিতাকে দেখলেই শহীদ মঈনুল ভাইয়ের কথা মনে হয়। মাজেদ ভাই ও আমি শহীদের আব্বা-আম্মা ভাইবোনদের খোঁজ খবর নিয়ে তার আম্মার সাথে কথা বলে যখন চলে আসি তখন মনে হয় আমাদের বাকশক্তি নাই। আমাদেরকে দেখলেই তারা ছেলের মত আদর করেন। শহীদ মঈনুল ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে, আমরা কোন উত্তর দিতে পারতাম না। আসলে উত্তর দিবই বা কি? আল্লাহ তার পছন্দের বান্দাদেরকে এভাবেই বাছাই করেন। ঈমানের পরীক্ষায় সত্যি মঈনুল ভাই সফল হয়েছেন গোটা রংপুর শহরের রাজপথ শহীদের রক্তে আজ রঞ্জিত হয়েছে।
শহীদের রক্তে ভেজা এই শহরের এক ইঞ্চি মাটিও বাতিলের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ জন্য শহীদের উত্তরসূরি হিসেবে আরও ত্যাগের নজরানা পেশ করতে হবে। রংপুর শহরের মাটি ইসলামী আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন।

একনজরে শহীদ পরিচিতি
নাম : মঈনুল ইসলাম
পিতার নাম : মুহাম্মদ দারাজ উদ্দিন মাস্টার
সাংগঠনিক মান : সাথী, দায়িত্ব : উপশাখা সেক্রেটারি
সর্বশেষ পড়াশুনা : বিকম অনার্স ৩য় বর্ষ পরীক্ষার্থী, হিসাবে বিজ্ঞান বিভাগ
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : রংপুর কারমাইকেল কলেজ
অন্যান্য কৃতিত্ব : পত্রপত্রিকায় নিয়ীমত লেখালেখি করতেন
জীবনে লক্ষ্য কি ছিল : অধ্যাপনা ও সাংবাদিকতা
আহত হওয়ার স্থান : কলেজ রোড, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশনের সামনে, রংপুর
শহীদ হওয়ার স্থান : রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আঘাতে ধরন : রড. রামদা
যাদের আঘাতে নিহত : জাসদ ছাত্রলীগ
শহীদ হওয়ার তারিখ : ২৮.০৮.১৯৯৫
যে শাখার শহীদ : রংপুর মহানগরী শাখা
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: খাতাপাড়া, পো: লালমনিরহাট . জেলা ; লালমনিরহাট
ভাইবোন : ৬ ভাই ৩ বোন
ভাইদের মাঝে অবস্থান : ৪র্থ
ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : ৫ম
পরিবারে মোট সদস্য : ১২ জন
পিতা : জীবিত, পেশা : প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক (অবসরপ্রাপ্ত)
মাতা : জীবিত, পেশা গৃহিণী

শহীদের স্মরণীয় বাণী
শহীদ হবার কয়েকদিন পূর্বে মায়ের সঙ্গে বিদায়ের প্রাক্কালে শহীদি মৃত্যুর ফজিলত সংক্রান্ত আলোচনা করেছিলেন। আল্লাহ যেন তার মৃত্যুকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন এজন্য দোয়া করতে বলেছিলেন। শাহাদাতের ২ ঘণ্টা পূর্বে তার উপশাখা সভাপতির কাছ থেকে সংগঠন থেকে চিরতরে ছুটি নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন এবং সেদিন সকালে সকল বকেয়া টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।

শাহাদাতের শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া
মঈনুল শহীদ হওয়ায় আমি সাময়িকভাবে শোকাহত হলেও শহীদ মঈনুলের পিতা হওয়ায় গর্ববোধ করছি। শহীদ মঈনুলের রক্তের বিনিময়ে যাতে এদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম হয় সেই দোয়া করছি। আজ আমি এক মঈনুলকে হারিয়ে শত সহস্র মঈনুলকে পেয়েছি। আল্লাহ কাছে কামনা করি আল্লাহ যেন তার মৃত্যুকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

পিতা

মুহাম্মদ দারাজ উদ্দিন মাস্টার

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৬ ভাই ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

খাতাপাড়া, লালমনির হাট

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

অনার্স ৩য় বর্ষ, হিসাববিজ্ঞান, রংপুর কারমাইকেল কলেজ

শাহাদাতের স্থান

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল