শহীদ মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু

১৯ জানুয়ারি ১৯৭২ - ০১ জানুয়ারি ১৯৯৯ | ৯৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি বালাগঞ্জ (বর্তমানে ওসমানী নগর) থানার তাজপুর ইউনিয়নের খাশিপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এনামুল হক দুদু। পিতা আবদুল ওহাবের দুই ছেলে আর তিনি মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বালাগঞ্জের চান্দারই পাড়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করে সেখান থেকে তিনি ১৯৯২ সালে কৃতিত্বের সাথে দাখিল পাস করেন। ভর্তি হন বিশ্বনাথ আলিয়া মাদ্রাসার আলিম ক্লাসে। সেখান থেকে ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে দাখিল পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৎপুর আলীয়া মাদরাসায়। সেখান থেকে যথাক্রমে ফাজিল ও কামিল পাস করেন যথাক্রমে ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে। শাহাদাতকালীন তিনি তাজপুর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

নিখোঁজ এনাম ৩০ ডিসেম্বর ’৯৮ বাড়ি থেকে বের হন কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে। ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে যথারীতি সকলের সাথে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেদিন রাতে সকলে সিলেটের উদ্দেশ্যে চলে গেলেও ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক কাজে দায়িত্বশীলের কাছে ছুটি নিয়ে ঢাকায় থেকে যান। পর দিন তিনি সিলেটগামী বাস এন.পি. পরিবহনের টিকিট করেন। ঢাকার রাস্তায় যানজটে পড়ে বিলম্ব হওয়ার কারণে যথাসময়ে বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত হতে পারেননি। যার কারণে এনপি পরিবহনের গাড়ি ফেল করেন। ঠিক এমনি মুহূর্তে দেখতে পেলেন তাঁর একটি পরিচিত মাইক্রোবাস সিলেট যাওয়ার জন্য প্যাসেঞ্জার ডাকছে। তিনি সরল বিশ্বাসে এই মাইক্রোবাসে উঠেন সিলেটের উদ্দেশ্যে। তিনি জানতেন না মানব নামের হিংস্র এসব দানব তাকে অনুসরণ করে আসছে পরিকল্পিতভাবে। মাইক্রোবাস ঢাকা ছেড়ে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার এক নির্জন স্থানে পৌঁছলে রাতের অন্ধকারে ইসলাম বিরোধী কোন দলের হায়েনারা তাকে নৃশংসভাবে খুন করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উপর ফেলে দেয়। টহল পুলিশ এনামের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে কোন দাবিদার না পেয়ে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করে।

এদিকে ৫ জানুয়ারি ’৯৯ পর্যন্ত এনাম বাড়িনে না ফেরায় মা-বাবা আত্মীয় স্বজন এবং বালাগঞ্জ শিবিরের নেতাকর্মীদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। তারা টেলিফোন করে জানালেন এনাম ভাই এখনো বাড়িতে ফেরেননি। সংগঠনের নেতৃবৃন্দ টেলিফোন পেয়ে চিন্তায় পড়ে যান। আসলে এনাম ভাই মাঝে মধ্যে ছুটি নিয়ে ঢাকায় যেতেন আবার যথা সময়ে চলে আসতেন। কিন্তু এবার এখনো আসেননি, তাহলে গেলেন কোথায়? চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। থানায় সাধারণ ডায়েরি হল। পত্রিকায় ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদ দেয়া হল। শিবিরের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা তার খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়ান দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু তারপরও এনাম ভাইয়ের সন্ধান পাওয়া গেল না। অবশেষে নিখোঁজ হওয়ার ২৭ দির পর দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত হয় ১লা জানুয়ারি ’৯৯, রাত ১১ টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চুনারুঘাট থানার চাঁদভাঙ্গা নামক স্থান থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার। এ সংবাদ শহীদের বড় ভাই এবং শিবির নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দিন-তারিখ মিল দেখে শিবির নেতা কামরুল ইসলাম এবং শহীদের বড় ভাই ফারুক আহমদ, শাজিদ মুহাম্মদ, জামিল ভাই, আনোয়ার ভাই ও আনছার ভাইসহ আরও কয়েকজন ছুটে যান চুনারুঘাট থানায়। সেখানে গিয়ে থানায় রক্ষিত লাশের ছবি ও জামা-কাপড় দেখে সবাই নিশ্চিত হন যে, এটিই এনামুল হক দুদুর লাশ। পুলিশের ভাষ্য মতে, এনামকে হত্যা করে তার লাশ রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল।

কেন হত্যা করা হল এনামুল হক দুদুকে
এনাম ছিলেন দৃঢ়চেতা এক মুজাহিদ। আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করা ছিল তার স্বভাবজাত আচরণ। তিনি ছিলেন বিপদগ্রস্ত দুঃখী মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু। আল্লাহর দ্বীনের মহান দাওয়াতকে তিনি পৌঁছে দিতেন প্রতিটি মানুষের কাছে। কারো সাথে তার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না বরং সবার সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। তিনি আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং তাদের হক আদায় করতেন। তার আকর্ষণীয় ও সৃষ্টিধর্মী অনুপম চরিত্রের কারণেই স্বল্প সময়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এলাকায়। কিশোর তরুণেরা তাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতো। মেধা ও মননে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ধৈর্যশীল। আল্লাহর একনিষ্ঠ গোলাম হিসেবে এবং রাসূলের আদর্শকে সমাজে বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন আপসহীন। ছাত্রদের চরিত্র গঠনের শিক্ষা দিতেন। অন্ধকারে আলোর শিখা প্রজ্বলন করতেন। রমজান মাসে ছাত্রদেরকে কুরআনা প্রশিক্ষণ দিতেন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কেন তাকে হত্যা করা হল? কী ছিল তার অপরাধ? কী জন্যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে পৈশাচিক কায়দায় খুন করা হল? ব্যক্তি স্বার্থ, জায়গা-সম্পত্তি কিংবা পার্থিব কোন লেনদেন নিয়েতো কারো সাথে তার বিবাদ ছিল না।

তার অপরাধ ছিল একটাই ‘ওয়ামা নাকামু মিনহুম ইল্লা আইয়্যুমিনুুবিল্লাহির আযিযিল হামিদ।’ তিনি মহামহীয়ান গরীয়ান স্বপ্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিলেন। তিনি কুরআনের কথা বলতেন। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বাতিলের শিকড় উপড়ে ফেলার একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। তাকে গ্রহণ করেছিল বালাগঞ্জের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।

তিনি নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবারের শ্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন প্রথম তাজপুর ডিগ্রি কলেজে। তার মোহনীয় চরিত্রের মোকাবেলা আদর্শিকভাবে করা যাবে না বলেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। শহীদ এনাম ছিলেন এমন একটি নিষ্পাপ অবয়ব যার গোটা দেহাকৃতি ছিল চমৎকার, সুদর্শন। পোশাক পরিচ্ছদে আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠতো। তার মুখের মিষ্টি হাসি ও চোখের চাউনি যে কোন মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করতো। আন্দোলনের কর্মীদের তিনি আপন করে নিতেন হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে। কর্মীদের সুখে দুঃখে ছুটে যেতেন সবার আগে। মিষ্টি সুরের ইসলামী সংগীত অতিঅল্প সময়েই যে কোন শ্রোতার হৃদয়কে দোলা দিত। ফজরের পূর্বে নামাজের জন্য ডেকে নিতে প্রিয় কর্মীদৈর। তার পরিকল্পনা ছিল একটাই, বালাগঞ্জে ইসলামী আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করা। তিনি সবসময় আফসোস করে বলতেন, ‘অন্যান্য থানার মত আমাদের থানায় কবে সংগঠন শক্তিশালী হবে? আল্লাহ যেন অতি তাড়াতাড়ি আমাদের থানাকে কবুল করেন।’

প্রেরণার উৎস শহীদ এনাম
শহীদ এনাম অল্প সময়েই স্থান করে নিয়েছিলেন সবার মাঝে। শহীদি বাসনায় উদ্বেলিত হয়ে এনাম ভাই সেদিন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে লিখেছিলেন-

মুহতারাম কেন্দ্রীয় সভাপতি,
আসসালামু আলাইকুম!
আপনার সাথে সেদিন সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার মনে বারবার শহীদ রবিউলের মত মৃত্যুবরণের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হচ্ছে। দোয়া করবেন, আমার মনের আকাঙ্ক্ষা যেন পূরণ হয়।
ইতি
আপনার স্নেহের ছোট ভাই
এনামুল হক দুদু


একনজরে শহীদ এনামুল হক দুদু
নাম : মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু
পিতা : মরহুম মুহাম্মদ ওয়াহাব
সাংগঠনিক মান : সদস্য
সর্বশেষ দায়িত্ব : বালাগঞ্জ উপজেলা সভাপতি, সিলেট
জন্মতারিখ : ১৯.০১.১৯৭২ ইং
স্থায়ী ঠিকানা : খাসিপাড়া, তাজপুর, বালাগঞ্জ, সিলেট
শিক্ষা জীবন : কামিল পাস ও স্নাতক ২য় বর্ষ, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ।
শহীদ হওয়ার তারিখ : ০১.০১.১৯৯৯ ইং
শহীদ হওয়ার ধরন : ইসলামের দুশমনদের দ্বারা অপহৃত হয়ে হবিগঞ্জের চুুনারুঘাট থানার চাঁদভাঙ্গা নামক স্থানে শহীদ হন।
আঘাতের ধরন : ছোরা, রডের আঘাত
ভাই বোন : ২ ভাই, ৩ বোন
মাতা : গৃহিনী
যে শাখার শহীদ : সিলেট জেলা

আম্মুর স্মৃতিচারণ
বর্তমান অবস্থা : দু’পা অবশ, হাঁটতে পারেন না। কানেও কম শোনেন। উনাকে এনাম ভাইয়ের কথা বললে তিনি বলেন, সে সদস্য সম্মেলনে যাওয়ার আগে আমাকে ও তার বাবাকে সালাম করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া এরপর আর জীবিত হয়ে ফিরে আসেনি। এই কথা বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাকরুদ্ধ হয়ে যান। আর কথা বলতে পারে নি।
এনাম ভাইয়ের চাচাতো ভাই শামছুল হক বলেন (এনাম ভাইয়ের ছোট), এনাম ভাই ছিল আমার শিক্ষক। পড়ালেখার ব্যাপারে তিনি বাড়ির সকল ছোট ভাই বোনদের শাসন করতেন। একেকদিন একে ঘরে গিয়ে সবার পড়া লেখার খোঁজ খবর নিতেন। আমরা সবাই তাকে ভয় পেতাম। কিন্তু তিনি সবাইকে খুব আদরও করতেন।
তিনি ফজরের সময় আজান হওয়ার সাথে সাথে উঠে বাড়ির সবাইকে ডেকে সাথে করে নামাজে নিয়ে যেতেন এবং এলাকার ছাত্রদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নামাজের জন্য জানিয়ে দিতেন।
তিনি অনেক মেধাবী ছাত্রকে দাওয়াত দিয়ে শিবিরে যোগ দান করিয়েছেন। এলাকার ছাত্ররা সহজেই তার কাছে ভিড়ত।
তার শাহাদাতের ফলে আমি আমার একজন বড় অভিভাবককে হারাই।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু

পিতা

মরহুম মুহাম্মদ ওয়াহাব

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১৯, ১৯৭২

ভাই বোন

২ ভাই, ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

খাসিপাড়া, তাজপুর, বালাগঞ্জ, সিলেট

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

স্নাতক ২য় বর্ষ, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ।

শাহাদাতের স্থান

হবিগঞ্জের চুুনারুঘাট থানার চাঁদভাঙ্গা নামক স্থানে


শহীদ মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু


শহীদ মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ এনামুল হক দুদু