শহীদ কামাল হোসাইন

০১ মার্চ ১৯৮৩ - ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ | ১০৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

যে হৃদয়ে শাহাদাতের তামান্না সে হৃদয় কি ঘরে বসে থাকতে পারে? বিংশ শতাব্দীর পরিসমাপ্তিতের হৃদয়ে পুঞ্জিভূত সকল আবেগ উজাড় করে শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করে মহান প্রভুর কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি হলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ১০৩ তম শহীদ কামাল হোসেন। মা বাবা যাকে আদর করে ডাকতেন হৃদয়। বিশাল মন আর অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়ে বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, মা-বাবা, শিক্ষক এমনকি সংগঠনের ভাইদের মনকেও সহজে জয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু সকলের হৃদয়ে হাহাকার সৃষ্টি করে কেড়ে নিল ঘাতক বুলেট শহীদ কামাল হোসেনকে ২২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে। লক্ষীপুরস্থ দারুল আমান একাডেমী মসজিদের সামনে তাহাজ্জুদ পড়ার আগে মহান রবের দরবারে পৌঁছে গেলেন তাঁর প্রিয় বান্দা। মনে হচ্ছিল শাহাদাতের জন্য নিজ হাতে সাজিয়ে নিলেন শহীদ কামাল হোসেনকে। আর তিনিও প্রস্তুত ছিলেন আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য। মনে হচ্ছিল এটি প্রভুর পক্ষ থেকে পরিকল্পিত আয়োজন! শাহাদাতের পূর্বে শহীদ কামাল হোসেন ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের লক্ষীপুর শহর শাখার একনিষ্ঠ কর্মী। তার অপর দুই ভাইও শিবির এর সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। আল্লাহ দু’ধরণের চোখকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবেন না, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করে আর এ চোখ যে আল্লাহর পথে পাহারাদারি করে। রাসুল (সাঃ) এর হাদীসটি যার কথাই সাী দিচ্ছে তিনি হচ্ছেন শহীদ কামাল হোসেন। শাহাদাতের মাত্র ৪০ দিন পূর্বে মুজিববাদী খুনী চক্র দারুল আমান একাডেমীতে আক্রমণ করে। এ খবর মিকিরপুর গ্রামে পৌঁছার সাথে সাথে ১৬ আগস্ট ভোরেই ছুটে আসেন শহীদ কামাল হোসেন ও তার বড় ভাই আব্দুর রহিম। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেদিন তারা সামান্য আহতও হন। লক্ষীপুর দারুল আমান একাডেমী বারবার আক্রমণ হওয়া আর শহীদ যায়েদের শাহাদাত শহীদ কামাল হোসেন ও তার বন্ধুদের হৃদয় জ্বালিয়ে দেয়। ফলে প্রতিরোধে একাডেমীর আশেপাশে নারী পুরুষ সকলে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২২ সেপ্টেম্বর একাডেমীতে পুণরায় সন্ত্রাসীদের আক্রমণ হতে পারে এ খবরে ব্যাকুল করে তোলে। চলতে থাকে সারারাত পাহারাদারী। শহীদ কামাল হোসেন একজন কর্মী হয়েও তদারকি করতে থাকেন প্রতিটি গ্রুপকে।

রাত তখন ১টা মসজিদে বসে জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। নিজে সাথী হবেন এবং লক্ষীপুরে থেকে লেখাপড়া করবেন। কন্টাক শেষে অজু করে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য মসজিদে যাবেন ঠিক সে সময়ে ঘাতক বুলেট দূর থেকে এসে শহীদ কামাল হোসেনের স্বপ্নসৌধ শেষ করে দেয়। আহত কামাল হোসেনকে রাতেই হাসপাতাল থেকে নেয়ার পথে তার বড় ভাই আব্দুর রহিমের কোলেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন। শহীদ যায়েদের শাহাদাতের খবর শুনেই দুই ভাই পাহারাদারীর জন্য এলেন বড় ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে ছোট ভাই শাহাদাত বরণ করলেন। এ কোনো এজিদের কারবালা নয়, এটি মুজিববাদী তাহেরের কারবালা লক্ষীপুরের মাটিতে।

শহীদ কামাল হোসেন মিরিকপুর বাসীর হৃদয় জয় করেছিলেন অনেক আগে থেকে। তার শাহাদাতের খবর শুনে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি আবাল বৃদ্ধ-বণিতা নিজেদেরকে, হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে শহীদের বাড়িতে। কর্দমাক্ত রাস্তা হাজার হাজার মানুষের পদভারে তলিয়ে যায়। দিনের আলো যখন অন্ধকারে হাতছানি দিয়ে ডাকছে ঠিক সে সময়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে নিজস্ব পুকুর পাড়ের গোরস্থানে চিরদিনের জন্য শায়িত করা হয় শহীদ কামাল হোসেনকে। যে শহীদ কামাল পাহারাদারী অবস্থায় তাহাজ্জুদের পূর্বে শাহাদাত বরণ করেছেন, পুকুর পাড়ে ফেরেশতারা জান্নাতের জ্যোতি দিয়ে পাহারাদারী করছেন। শাহাদাতের তিনদিন পর শহীদের নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখি তখনো শহীদের পিতামাতা পাড়া প্রতিবেশি শোকের মাতম আমাদের জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না শুরু করেছেন। মনে হচ্ছিল সে কান্না আল্লাহর আরশকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছে। তিন ভাই শিবির করেন সে জন্য সন্ত্রাসী মুজিব বাহিনী বেশ আগে থেকে তাদের টার্গেট করেছে। কান্নাকণ্ঠে তখনো জড়িয়ে আছেন শহীদের পিতা। মনে হচ্ছিল তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। আবেগ জড়িত কণ্ঠে শহীদের পিতা জানালেন, তার ছোট ছেলে মাত্র দাখিলে পড়ে। তিনবার তাকে অপহরণ করে ৪০ হাজার টাকা জোর করে আদায় করে। শেষ বার তাকে বেদম মারপিট করে। প্রতিশোধ স্পৃহায় তার ছোট ছেলেটি বাড়িঘর ছেড়েছে। কান্না তখনো থামেনি, শহীদ পিতা আবেগজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন,‘আমার ছোট ছেলেটি ঘর ছেড়েছে, কামাল শহীদ হয়েছে, আমি কাকে নিয়ে বাঁচব। তোমরা আমার কামালকে এনে দাও। এসময় শহীদ যায়েদের ভগ্নিপতি আবুল খায়ের এবং ফেনী জেলা সভাপতি মিজানুল হক মামুন শহীদের পিতাকে কিছুটা শান্ত করেন। আমাদের আগমনে পাড়ার বন্ধুরা জড়ো হতে থাকে।

চোখে মুখে তাদের প্রতিশোধ স্পৃহা। সারাদেশে দোয়া আর প্রতিবাদ মিছিল সংগ্রামের কথা জানতে পেরে শহীদ পিতা শান্ত হয়ে বলেন, ‘সত্যি আমার কামাল অমর থাকবে। শহীদ পিতা তার সার্টিফিকেট ও ছবি এনে বলেন, কামাল আমার সাধারণ ছেলে নয়, সে আমার রত্ন, ১৯৯৭ সালে মকরধ্বজ সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে দাখিল এবং ১৯৯৯ সালে লক্ষীপুর আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আলিম পাশ করে।’ প্রবেশ পত্রের ছবি দেখিয়ে শহীদের পিতা আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, ‘তোমরা দেখ আমার কামাল কত সুন্দর,আল্লাহ এত সুন্দর ছেলে কেন আমাকে দিলেন আবার কেন নিয়ে গেলেন?’ শহীদের স্বপ্ন ইসলামী বিপ্লবের প্রত্যয় ব্যক্ত করে সুর্য ঠিক সোজা হওয়ার আগে আমরা মিরিকপুর ত্যাগ করি। কর্দমাক্ত মিরিকপুরের রাস্তা দিয়ে চলার সময় এলাকার ছাত্র যুবকদের সহযোগিতায় আমরা বুঝতে পেরেছি শহীদ কামাল হোসেনকে মিরিকপুরবাসী কত ভালাবাসত।

শহীদ কামাল হোসেন ছাত্র শিক্ষক, বন্ধু মহলের সবার প্রিয়। শাহাদাতের পর লক্ষীপুর আলিয়া মাদ্রাসায় শোক সভায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ্য বলেন, আমার মাদ্রাসা আজ থেকে অন্ধকার হেয় যাবে। তার বিনয়ী , একনিষ্ঠতা আর সংগঠনের প্রতি আনুগত্যশীল কর্মী হয়েও সংগঠনের সর্বপর্যায়ে জনশক্তির মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিল, কর্মী হয়েও দায়িত্বশীলতা তাকে করেছে অধিক সম্মানিত। জামায়াত নেতা হাসান সাহেব বলেন, এমন ছেলেকে ভুলবার নয়, সে আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে। শহীদ কামাল হোসেন ছিলেন জিহাদী কাফেলার নিবেদিত প্রাণ সৈনিক। মনে হচ্ছিল বদর ওহুদ জিহাদের মত প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শাহাদাতের মাত্র কয়েক দিন পূর্বের ঘটনা। সংগঠন সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাজারে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু কামাল ভাইয়ের চুল কাটা প্রয়োজন। কি করা সংগঠন নিষেধ করেছেন বাজারে যেতে। তাই একজন সাথী ভাইয়ের সাথে চুক্তি করেছেন, আমি তোমার চুল কাটি, তুমি আমার চুল কাটবে। অবশেষে তাই হল। সুন্দর গঠন, সুঠাম দেহের অধিকারী শহীদ কামাল হোসেন একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড়ও ছিলেন।


লক্ষীপুর ইসলামী আন্দোলনের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র। ১৭ আগস্ট’৯৯ সালে স্কুল ছাত্র যায়েদকে খুন করে তার ৪০ দিনের মাথায় শহীদ হলেন কামাল হোসেন। টার্গেট ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দুর্বল করে লক্ষীপুরে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত করা। খুনীরা জানে না শহীদের রক্ত কোনদিন বৃথা যায় না। যেখানে শহীদের রক্ত ঝরে সে ময়দানকে আল্লাহ অবশ্যই উর্বর করবেন। শহীদ ফজলে এলাহী, আহমাদ যায়েদের খুনরাঙ্গা পথে শহীদ কামাল হোসেন যে ত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনাদিকাল ধরে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দ্বীনের পথে পাহারাদারী, আল্লাহর জন্য কান্নাকাটি এবং আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার যে গৌরব শহীদ কামাল হোসেন অর্জন করলেন, তার জন্য শুধু শাহাদাতের উত্তম মর্যাদাই নয় তার এ শাহাদাত বাংলার জমিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথকে প্রশস্থ করবে ইনশাআল্লাহ।

এক নজরে শহীদ কামাল হোসাইন
নাম : শহীদ কামাল হোসাইন
পিতা : মো. রহমত উল্লাহ
জন্ম তারিখ : ১ লা মার্চ ১৯৯৮৩ ইং
গ্রাম : মিরিকপুর (৭ নং বাঙা খাঁ ইউনিয়ন) সদর, লক্ষ্মীপুর 
সাংগঠনিক মান : কর্মী
শাহাদাতের তারিখ : ২২.০৯.১৯৯৯ ইং
আহত হওয়ার স্থান : দারুল আমান একাডেমীর মসজিদের সামনে
শহীদ হওয়ার স্থান : লক্ষীপুর সদর হাসপাতাল
আঘাতের ধরণ : গুলি
যাদের আঘাতে নিহত : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
কোন শাখার শহীদ : লক্ষীপুর শহর
ভাইবোন : ৩ ভাই ২ বোন
ভাইদের মধ্যে অবস্থান : ২য়
ভাইবোনদের মধ্যে অবস্থান: ৩য়
পরিবারে মোট সদস্য : ৭ জন
পিতা : জীবিত, পেশা : ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত
মাতা: জীবিত, পেশা : গৃহিনী
সর্বশেষ পড়াশোনা : আলিম পাশ
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : লক্ষীপুর আলিয়া মাদরাসা
শিক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব : দাখিল ১ম বিভাগ
জীবনের লক্ষ্য : শিক্ষকতা

শহীদ কামাল ভাইয়ের গর্বিত পিতার অনুভূতি।
আমার ছেলে কামাল হোসেন ছোট বেলা হতে আদর্শ মানের ছেলে ছিল। সে সব সময় হাসি মুখে কথা বলতো। তার হাসিটা মধুর মতন ছিল। রূপে গুণে ভাল হওয়ার কারণে সবাই তাকে ভালবাসতো। ছোট্ট থাকতে আমার সাথে নামাজ পড়ত,মুনাজাত দিয়া তার আব্বা আম্মার জন্য দোয়া করত। বড় ছোট সকলবে সম্মান দিত। আল্লাহ ও রাসূল (সা) এর প্রতি তার খুব ভালবাসা ছিল। তার মুখ দিয়ে খারাপ কথা বের হতো না। কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না। তার চলাফেরা ছিল খুব পরিষ্কার। তাকে কখনো কিছু শিখাতে হয়নি। আমার মনে হয জন্ম হতেই আল্লাহ পাক তাকে বেছে নিয়েছেন। তা নাহলে তার ভেতরে এত গুণ কি করে ছিল।

আমি তার পিতা হয়ে তার নিকট থেকে অনেক কিছু শিা নিতাম। তাকে দিয়ে যে কাজই করাতাম সেই কাজে সুফল পাওয়া যেত। তার যেমন সুন্দর ব্যবহার ছিল, আজ পর্যন্ত হিন্দু মুসলমান কেহ তার কথা ভুলতে পারে না। আমার প্রিয় সন্তান কামলের হাসিমুখের কথা, সুন্দর চেহারা, সুন্দর ব্যবহার আমার সবসময় মনে পড়ে। কামাল হোসেন শাহাদাত বরণ করেছে শুনে আমি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছি। আল্লাহ তার শাহাদাত কবুল করে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমীন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ কামাল হোসাইন

পিতা

মো. রহমত উল্লাহ

জন্ম তারিখ

মার্চ ১, ১৯৮৩

ভাই বোন

৩ ভাই ২ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

মিরিকপুর (৭ নং বাঙা খাঁ ইউনিয়ন) সদর, লক্ষ্মীপুর

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

আলিম, লক্ষীপুর আলিয়া মাদরাসা

শাহাদাতের স্থান

লক্ষীপুর সদর হাসপাতাল


শহীদ কামাল হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ কামাল হোসাইন


শহীদ কামাল হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ কামাল হোসাইন