শহীদ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন

০১ জানুয়ারি ১৯৭৬ - ২১ জানুয়ারি ২০০০ | ১০৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

শাহাদাতের মাত্র কয়েকদিন আগে চকবাজারে একটি হোটেলে নিজের বহু প্রত্যাশিত আমেরিকা ডি.বি ভিসা পাওয়ার পরও জীবনের শেষ পরামর্শটুকু চেয়েছিলেন নিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহমাদুল হকের কাছে। সাতকানিয়ার উত্তপ্ত ময়দান ছেড়ে আমেরিকা যাব কিনা? যার শাহাদাতের ভিসা চূড়ান্ত হয়ে গেছে তার আবার আমেরিকা যাওয়ার প্রয়োজন কিসের? শাহাদাতের অমর পেয়ালা পান করে মহান প্রভুর দরবারে পৌঁছে গেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের উর্বর ময়দান আল্লাহর দ্বীনের অগণিত শহীদ, মুজাহিদের পদচারণায় মুখরিত। আপোষহীন যোদ্ধা গাজী সালাহউদ্দীনের উত্তরসূরি মুহাম্মদ সালাহ উদ্দীন। সাতকানিয়া অসংখ্য আলেম ও পীর-মাশায়েখের পদভারে ধন্য। এ এলাকার দু’জন স্বনামধন্য পীর তাদের দু’টি সন্তানকে শহীদ হিসেবে উপহার দিয়ে আলোকিত করেছেন সাতকানিয়ার ইসলামী আন্দোলনের ঘাঁটি। একজন হলেন বায়তুস শরফের পীর শাহ আবদুল জব্বার। তিনি উপহার দিয়েছেন তাঁর প্রিয় সন্তান হাফেজ আবদুর রহিমকে। অপরজন হলেন মাওলানা আলী আহমাদ। তিনি উপহার দিয়েছেন তাঁর প্রিয় সন্তান সালাহউদ্দীনকে।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
সালাহউদ্দীন বন্ধুদের নিয়ে প্যান্টের বেল্ট কিনতে যান চট্টগ্রামের জহুর হকার্স মার্কেটে। পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসী-খুনীচক্র অস্ত্র উঁচিয়ে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায় তাঁকে। বাঁচাও, বাঁচাও বলে শতবার চিৎকার সত্ত্বেও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ততই ব"দ্ধি পেতে থাকে। সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়লো সালাহউদ্দীনের অপহরণের খবর। চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, দারুল উলুম আলীয়াসহ নগরীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সহপাঠীরা ছুটে আসতে লাগলেন দেওয়ানবাজারে জামায়াত কার্যালয়ে। এশার নামাযের পরপরই শুরু হলো নগরীতে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল। রাত যতই বৃদ্ধি পেতে লাগলো ততই খুনীচক্র সালাহউদ্দীনকে নন্দন কানন, জুবীলী রোড, এমইএস কলেজ প্রভৃতি জায়গায় লুকাতে লাগলো। কিন্তু তখনো পুলিশ কার্যত কিচুই করতে পারেনি। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তখন রাত ২টা পেরোয়। জামায়াত নেতা সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, মহানগরী সেক্রেটারি সাইদুল ইসলাম ভাইকে নিয়ে চট্টগ্রামের অলি গলিতে খুঁজতে বেরোলেন। ২.৪০ মিনিটে একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে সম্ভাবনার ক্ষীণ আশাটুকুও হারেিয় যায়। এ কথা আর বুঝতে বাকী রইলো না যে সালাহউদ্দীন আর নেই।

২১ জানুয়ারি হাটহাজারির ইছাপুরে একটি বস্তা বন্দী লাশ পাওয়া যায়। এ খবর পেয়ে মহানগরী শিবির সভাপতি মেজবাহ ভাইসহ শাহজাহান চৌধুরী ছুটে যান হাটহাজারীতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আর হাটহাজারীর কর্মীরা ছুটে যান লাশের সন্ধানে। বস্তার মুখ খুলতে না খুলতে বেরিয়ে আসে রক্তের বন্যা, কান্নায় ভেঙে পড়েন সকলে। কারো বুঝতে বাকী রইলো না। এ সেই সালাহউদ্দীন যাকে খুনী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছিল ১৩ ঘন্টা পূর্বে। আর খুন করে বস্তা হাটহাজারীর ইছাপুরে ফেলে যায়।

২১ জানুয়ারির আছরের নামাজ শেষ না হতেই হাজারো জনতা সমবেত হতে থাকে লালদীঘির ময়দানে। শহীদের জানাযায় যোগ দিতে ছুটে আসেন কেন্দ্রীয় সভাপতি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা আবু তাহের, বিএনপি চট্টগ্রাম মহানগরী সভাপতি মীর নাছির উদ্দীন, জাতীয় পার্টির জাহাঙ্গীর আলমসহ অসংখ্য নেতৃবৃন্দ। শহীদ সালাহ উদ্দীনের বড়ভাই চট্টগ্রামে আফগান মসজিদের ইমাম মাওলানা ইয়াহিয়া জানাযাপূর্ব সমাবেশে যখন বক্তব্য রাখছিলেন, হাজারো মানুষ যেন কান্নায় ভেঙে পড়বে এমন হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো। সেখানকার জানাযা শেষে শহীদের সাথীরা শহীদের কফিন নিয়ে ট্রাক, মাইক্রোবাস যোগে শহীদের গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা দেয়।


রাত প্রায় ১০ টায় শহীদের কফিন যখন সাতকানিয়া হাইস্কুল মাঠে পৌঁছে, তখন সহস্র জনতা শহীদকে শ্রদ্ধা জানাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। এখানেও শহীদের দায়িত্বশীলগণ বক্তব্য রাখেন। এখানে দ্বিতীয় দফা জানাযায় ইমামতি করেন শহীদের বড় ভাই। এ সময় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অদূরে সতীনপাড়ায় বিকট আওয়াজে বোমা ফাটিয়ে উল্লাস করতে থাকে। জানাযা শেষে শহীদের কফিন নিয়ে হাজারো জনতা যখন ওচিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তখন সাতকানিয়ার সতীনপাড়া থেকে লাশের মিছিলে পুনরায় গুলি করে ঘৃণ্য খুনীচক্র। এখানেও ৬/৭ জন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী আহত হন। রাত ১২ টার দিকে শহীদের কফিন যখন শহীদের নিজবাড়িতে পৌঁছে সেখানেও হাজারো জনতা হিম ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে শহীদকে একনজর দেখার জন্য ভীড় জমান। স্থানীয় চেয়ারম্যান আহমাদুল হক বক্তব্য দেয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি শহীদ সালাহউদ্দীনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে পুরো সাতকানিয়াকে ইসলামী আন্দোলনের দুর্বার ঘাঁটিতে পরিণত করার দীপ্ত শপথ ব্যক্ত করেন। তিনি একটি সড়ককে শহীদ সালাহউদ্দীন সড়ক হিসেবে নামকরণের ঘোষণা দেন। মসজিদের পাশে কবরস্থানে দাফন শেষ হলে শহীদ পরিবারের সদস্যগণ শহীদের মা-বোন আর আত্মীয় স্বজনদের আহাজারি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। শাহজাহান চৌধুরী মা-বোনদের সান্তনা দিয়ে তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঘরের ভিতর থেকে শহীদ সালাহউদ্দীনের ছোট বোনের আকুতি প্রকাশ হচ্ছিল এভাবে, ‘শহীদ সালাহউদ্দীন ভাইয়ের স্বপ্ন এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, আমরা দেখে যেতে পারবো কি তা?’

এক নজরে শহীদ মুহাম্মাদ সালাহউদ্দীন
নাম : মুহাম্মাদ সালাহউদ্দীন
পিতা : মাওলানা আলী আহমেদ
মাতা : ওম্মে হাফছা
ঠিকানা : ওচিয়া, দেওদীঘি, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম
ভাই বোনদের সংখ্যা : ৭ ভাই ৪ বোন (তিনি ৫ম)
জন্ম তারিখ : ১৯৭৬
শিক্ষাগত যোগ্যতা : ডিগ্রী ফলপ্রার্থী
সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ
সাংগঠনিক মান : কর্মী, আবাসিক শাখা সভাপতি (বাকলিয়া)
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ
আহত হওয়ার তারিখ : ২০ জানুয়ারি ২০০০ সার অপরেশন /২১ জানুয়ারি সকাল হাটহাজারীতে লাশ পাওয়া যায়
কবর যেখানে : পারিবারিক করবস্থান
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন

পিতা

মাওলানা আলী আহমেদ

মাতা

ওম্মে হাফছা

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১, ১৯৭৬

ভাই বোন

৭ ভাই ৪ বোন (তিনি ৫ম)

স্থায়ী ঠিকানা

ওচিয়া, দেওদীঘি, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ডিগ্রী ফলপ্রার্থী, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ

শাহাদাতের স্থান

২১ জানুয়ারি সকাল হাটহাজারীতে লাশ পাওয়া যায়


শহীদ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন


শহীদ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন