শহীদ ফরিদ আহম্মেদ মন্ডল

০১ জানুয়ারি ১৯৮৮ - ১১ মার্চ ২০১৭ | ২২১

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

১১ মার্চ ২০১৫। পরোউপকারী সাহসী ও চরম আনুগত্য পরায়ন মোঃ ফরিদ আহমেদ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে শাহাদাত বরন করেন। তিনি আজিম ঊদ্দিন কলেজের মেধাবী ছাত্র ও সংগঠনের সাথী ছিলেন। তার বাড়ি গাজিপুর জেলার সদর উপজেলার যুগীতলা গ্রামে।

গাজীপুরের অলংকার:
আলহামদুলিল্লাহ, গাজীপুর মহানগরে আজ ইসলামী আন্দোলনের মজবুত অবস্থান। এর পেছনে রয়েছে কিছু দরদী মানুষের সীমাহীন ত্যাগ ও কুরবানি। কিছু সুনিপুণ কারিগর তাদের শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরিয়ে তৈরি করেছেন তাওহীদের এই সুরম্য প্রাসাদ । আর এই শহীদী প্রাসাদের অলংকার হলো নির্ভিক সাহসী দুইজন মানুষ। এই প্রাসাদের প্রেরণা হলো তাদের দেহের বিন্দু বিন্দু রক্ত। একজন গাজীপুর মহানগর বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ রুহুল আমিন, অন্যজন মহানগরী ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ ফরিদ আহমেদ মন্ডল।

রুহুল অমিন ভাইয়ের সাথে এক যুগেরও বেশি সময় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছি। আমি ১৯৯৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১৩ বছর কাপাসিয়া উপজেলা জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর বড় একটা সময় তিনি তৎকালিন জেলা জামায়াতের পক্ষ থেকে কাপাসিয়ার তত্বাবধায়ক ছিলেন। প্রায় অর্ধযুগ তিনি আমার সাথে দিবানিশি সমগ্র কাপাসিয়া চষে বেড়িয়েছেন। এই চষে বেড়ানোর পেছনে তার প্রেরণাই বেশি কাজ করেছে। '৯১ ও '৯৬ এর জাতীয় নির্বাচনে কাপাসিয়ায় জামায়াত প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রম তিনিই পরিচালনা করেছেন। দাঁড়িপাল্লার মিছিলে কাপাসিয়ার রাজপথ মুখরিত রেখেছেন। আমার সাংগঠনিক জীবনে তার মত অকুতোভয় দায়িত্বশীল কমই দেখেছি। সবসময় দোয়া করতেন, "আমার মৃত্যু যেন বিছানায় না হয়ে রাজপথে হয়।" মহান আল্লাহ তার এই দোয়া কবুল করেছেন। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহরে বিআইডিসি রোডে অবস্থিত গাজীপুর জেলা জামায়াত কার্যালয় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে স্থির থাকতে পারেননি আল্লাহর দ্বীনের এই নির্ভিক সৈনিক। বায়তুন নূর মসজিদ থেকে নারায়ে তাকবীর শ্লোগান তুলে হামলা প্রতিরোধে একাই ছুটে গেছেন এই সাহসী বীর। তার অন্য সাথীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই আওয়ামী খুনিদের সাথে বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে একপর্যায়ে তাদের সম্মিলিত আক্রমণে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন তৎকালীন জেলা জামায়াতের অফিস ও প্রচার সেক্রেটারি প্রিয় ভাই রুহুল আমিন। হা, তার আজীবনের লালিত তামান্নার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে রাজপথেই শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দেন তিনি। রাজপথেই নিজের নিথর দেহটি রেখে তিনি চলে যান প্রিয় রবের সান্নিধ্যে।

আর বাইশ বছরের টগবগে তাজা তরুণ ফরিদ আহমেদ মন্ডলের কথা তার সাথীরা আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবে। বাতিলের বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াই-সংগ্রামে সামনের কাতার ছাড়া কখনো পেছনে দেখা যায়নি তাকে। অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে ওঠা ছিলো তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। নিজের আগামী জীবনের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের চেয়ে প্রিয় সংগঠনের কর্মসুচি বাস্তবায়নের গুরুত্ব ছিল তার কাছে অধিক প্রিয়। বিশেষকরে অান্দোলন-সংগ্রামের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মুহুর্তগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। জানাযার নামাযে তার দায়িত্বশীল ও সাথীদের বুকফাটা কান্নার রোল দেখে কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারি, তাদের হৃদয় কতটা জয় করে নিয়েছিল শহীদ ফরিদ। পাগলপ্রায় পিতা-মাতার নির্বাক দৃষ্টি, স্বজনদের করুণ আহাজারি বলে দিচ্ছিল পরিবার পরিজনের কত প্রিয় ছিল এই তরুণ। আসলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই তার জন্য কাল হলো। তার প্রতিবাদী কন্ঠকে সৈহ্য করতে পারেনি অপশক্তি। তাই মানব সমাজের কীট এই কাপুরুষগুলো ফরিদ আহমেদের প্রতিবাদী কন্ঠকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে তাকে হত্যার মত জঘণ্য পথই বেছে নেয়। এই আহমকগুলো জানে না একজন ফরিদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই সত্যের মশাল নিভে যায় না, প্রতিবাদের মিছিল থেমে যায় না। বরং শহীদের প্রতি ফোটা রক্ত প্রেরণার বাতিঘর হয়ে দ্বীন কায়েমের কাফেলাকে আরো বেশি উজ্জীবিত ও বেগবান করে। শহীদ ফরিদের সাথীরাও দৃপ্ত শপথ নিয়েছে, তার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ গাজীপুরের মাটিতে ইনশায়াল্লাহ সুসম্পন্ন করবেই তারা। শহীদ রুহুল আমিন এবং শহীদ ফরিদ আহমেদের রক্ত কিয়ামত পর্যন্ত গাজীপুর মহানগরের ইসলামী আন্দোলনকে সাহস, শক্তি ও প্রেরণা যোগাবে।

শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না:
শহীদী মৃত্যুর খোশ নসীব সবার হয় না। এই সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ তাঁর কিছু প্রিয় বান্দাকে বাছাই করে নেন। যারা থাকে দ্বীন কায়েমের আন্দোলনের জন্য নিবেদিত প্রাণ। যারা হয় রুহুল আমিন ও ফরিদ আহমেদের মত অকুতোভয় নির্ভিক। যাদের হিম্মত ধ্বসিয়ে দেয় তাগুতের প্রাসাদ। আল্লাহ আমাদের মাঝ থেকে এরকম দুইজন যোগ্য মানুষকেই বাছাই করেছেন। যাদের রক্তাক্ত দেহ কিয়ামতের ময়দানে তাদের ত্যাগ ও কুরবানির সাক্ষ্য বহন করবে। বিনা হিসেবে প্রভু তাদের ডেকে নিবেন জান্নাতের মেহমান বানিয়ে।

এখানে মহানগরের বাইরে গাজীপুর জেলায় শাহাদাত বরণকারী আরো দুইজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করছি। ৩ মার্চ, ২০১৩ প্রত্যুষে শ্রীপুরে শাহাদাত বরণকারী উপজেলা শিবিরের সভাপতি শহীদ মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক ভাই এবং ৫ মে ২০১৩ দিবাগত গভীর রাতে ভয়াল শাপলা হত্যাকান্ডের শিকার কালিয়াকৈরের শহীদ জামায়াত কর্মী শামসুল আলম ভাই। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক ভাই ঘুমিয়ে আছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় পারিবারিক কবরস্তানে। শহীদ শামসুল আলম ভাই শুয়ে আছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পারিবারিক কবরস্তানে। এই শহীদ ভাইদের খুন ঝরা গাজীপুরে কালিমার পতাকা উড়বেই ইনশায়াল্লাহ।

আসলে যে কোন বড় কিছু নির্মাণের জন্য ত্যাগ ও কুরবানির বিকল্প নেই। বড় বড় পাথর বহন করতে যেয়ে এর নীচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের গণকবরের পাশেই তাদের বয়ে আনা পাথর দিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবির বিস্ময় সুরম্য পিরামিড। পিরামিডের অনেক কারিগর শুয়ে আছে ঐ গণকবরে। ইরান বিপ্লবের অন্যতম চিন্তানায়ক শহীদ ড. আলী শরিয়তি এই গণকবরের পাশে দাড়িয়ে মন্তব্য করেছিলেন:
We are carrying loads to build a new civilization.

ড. শরিয়তির মন্তব্য অনুযায়ী আমরাও একটি নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের ভারী পাথর বহন করছি। সুতরাং পিরামিডের কারিগরদের মতো জীবন দেয়ার জন্য আমাদেরও প্রস্তুতি থাকতে হবে। আসলে প্রত্যেক জাতির ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তাদের শহীদেরাই। শাহাদাতের রক্তঝরানো পথেই গড়ে উঠেছে নতুন দেশ, নতুন পতাকা। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকাও মুক্ত আকাশে পত পত করে উড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের বুকের তাজা খুনের বিনিময়ে। সুতরাং আমরা পৃথিবির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাড়িয়ে নতুন করে আবার ইসলামী সভ্যতার গোড়া পত্তনের যে স্বপ্ন লালন করি এর বাস্তবায়নও সম্ভব হতে পারে শুধুমাত্র শাহাদাতের পথ ধরে।

আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশে আমরা শাহাদাতের সেই রাজপথ ধরে এগিয়ে চলেছি। পাশাপাশি চলছে তাগুতি শক্তিও। ফিরাউন-নমরুদ, আবু জাহেল-আবু লাহাব এবং শাহ-সিসিদের পথ ধরে আমাদের লেডি হিটলারও চলছেন সমান তালে। ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় আমাদের আর কি পরিমাণ ত্যাগ ও কুরবানি করতে হবে জানি না, তবে এতটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, রাতের নিকোষ কালো আধার দুর হয়ে সুবহে সাদিকের আলো ফুটবেই, শাহাদাতের রক্তপিচ্ছিল পথ ধরে নতুন সূর্য উঠবেই। সত্যের আগমনে মিথ্যার বিদায় সুনিশ্চিত।

লেখকঃ আমীর, গাজীপুর মহানগর জামায়াত।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ ফরিদ আহম্মেদ মন্ডল

পিতা

নাসির উদ্দীন

মাতা

ফুলমতি বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১, ১৯৮৮

ভাই বোন

৪ ভাই

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রামঃ যৌগিতলা, থানাঃ গাজিপুর সদর, জেলাঃ গাজিপুর

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

এইচ এস সি

শাহাদাতের স্থান

ব্রাক অফিসের পাশে


শহীদ ফরিদ আহম্মেদ মন্ডল

ছবি অ্যালবাম: শহীদ ফরিদ আহম্মেদ মন্ডল


শহীদ ফরিদ আহম্মেদ মন্ডল

ছবি অ্যালবাম: শহীদ ফরিদ আহম্মেদ মন্ডল