শহীদ আমিনুল ইসলাম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২৮ এপ্রিল ১৯৮৮ | ২২

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে অনিবার্য সংঘাত ঈমানদারদের দেয় আল্লাহর দরবারে মর্যাদার আসন নিশ্চিত করার এক মহাসুযোগ 'শাহাদাত'। কুফরের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তির নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় মজলুম জনতা, শহীদের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। এমনই এক মজলুম শহীদের নাম শহীদ আমিনুল ইসলাম।

শহীদের পরিচয়
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার সুয়াগাজার কমলপুর গ্রামের আব্দুল হামিদের জ্যেষ্ঠ সন্তান আমিনুল ইসলাম এলাকায় আদর্শ ছাত্র হিসেবে খ্যাত ছিলেন। পরিবারে তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।

শিক্ষাজীবন
ছোটবেলা থেকেই শহীদের জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। তাঁর বাবা বলেন, ‘সে অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা ছিল। সে বেশি বেশি প্রশ্ন করত।’ প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন। নবম শ্রেণীতে শুভগাজী তোফাজ্জল আহমদ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিন বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন। শহীদ হওয়ার সময় প্রথম বর্ষ পরীক্ষা শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠেন। তাঁর শাহাদাতের কয়েকদিন পর ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় ডিপার্টমেন্টে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
উগ্র সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন মুজিববাদী ছাত্রলীগ তার জন্মের পর থেকে রাজনীতির নামে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে আসছে। স্বাধীনতার পর তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়ন, এই সংগঠনটি বামপন্থার নামে দেশে ইহজাগতিকতাবাদ (সেক্যুলারিজম) এবং সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক অদ্ভুত খিচুড়ি নিয়ে রাজনীতিতে অগ্রসর হয় প্রধানত সন্ত্রাসকে পুঁজি করে। আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্র ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির মজবুত অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছিল সাধারণ শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের অকুণ্ঠ সমর্থনে। মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন স্বভাবতই তা সহ্য করতে পারেনি। বারবার তারা মানুষের মুক্তি আর অধিকারের আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

২৮ এপ্রিল ১৯৮৮, বৃহস্পতিবার, সকাল দশটা, শিক্ষার্থীদের ১৩ দফা দাবিতে শিবির ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে। মিছিলটি যখন কলাভবন অতিক্রম করছিল তখন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে কথিত ছাত্রঐক্য নামধারী কিছু বহিরাগত সশস্ত্র সন্ত্রাসী অতর্কিত হামলা চালায়। তাতে বেশ কয়েকজন শিবিরনেতা ও কর্মী আহত হন। সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে বিনষ্ট করা এবং হলগুলোকে বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু ছাত্রশিবির ও সাধারণ ছাত্রদের সহনশীলতার কারণে তাদের সেই হীন পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী মদনহাট ও চৌধুরীহাটে সংগঠিত হতে থাকে এবং শহরগামী বিভিন্ন বাস ও ট্রেনে তল্লাশি চালিয়ে শিবিরকর্মীদের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালাতে থাকে। একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে সশস্ত্র হামলা চালানোর অভিযোগে বিভিন্ন সংগঠনের ১৬ জন দুষ্কৃতিকারী ছাত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারাদেশের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। সেই সিদ্ধান্তকে ঠেকানোর জন্য শিবিরের সাথে পরিকল্পিতভাবে সংঘর্ষ বাধানো হয়।

শাহাদাত
আমিনুল ইসলাম ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমানত হল শাখার একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ঘটনার দিন বাড়ি যাবার উদ্দেশে আমিনুল ইসলাম বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে শহরে রওয়ানা করেন। তাঁর সাথে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য দু’জন ছাত্র আলী রেজা ও ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী। ট্রেন ৫টা ৩৫ মিনিটে চৌধুরীহাট স্টেশনে পৌঁছলে কথিত সংগ্রামী ছাত্রঐক্য নামধারী ১০/১২ জন সন্ত্রাসীরা টুপি-দাড়িওয়ালা সব সাধারণ যাত্রীর ওপর চড়াও হয়। মারধর ও অমর্যাদাকর আচরণ করতে থাকে। ট্রেন পলিটেকনিক এলাকা অতিক্রম করার পর দুর্বৃত্তদের চোখে পড়ে যান আমিনুল। ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো আমিনুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইহজাগতিকতাবাদী ও সমাজতন্ত্রী দুবৃর্ত্তরা। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর জখম করে তাঁকে। আমিনুল সংজ্ঞাহীন হয়ে ট্রেনের মেঝেতে পড়ে যান। চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছলে দুর্বৃত্তরা সংজ্ঞাহীন আমিনুলকে ট্রেন থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ১ম শ্রেণীর বিশ্রামাগারে নিয়ে যায় এবং ধারালো ছোরার আঘাতে সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে।

আমিনুলের দুই সঙ্গী সহপাঠীকে মারধর করে বেঁধে রাখে সন্ত্রাসীরা। অল্পক্ষণ পরেই নরপিশাচরা রক্তমাখা ছোরা হাতে বিশ্রামাগারের কামরা থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের পুরো শরীর আমিনুলের রক্তে মাখা। দুর্বৃত্তরা নিচে নেমেই আগে থেকে প্রস্তুত একটি মাইক্রোবাসে করে আমিনুলের সঙ্গী দু’জন ছাত্রসহ দারুল ফজল মার্কেটস্থ ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে চলে যায় এবং তাদের রাত ১টা পর্যন্ত আটকে রাখে। ঘটনা ফাঁস করলে খুন করা হবে বলে হুমকি দিয়ে তারপর তাদের ছেড়ে দেয়। ওদিকে রেলওয়ে পুলিশ রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত আমিনুলকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু ইতোমধ্যেই ক্রমাগত রক্তক্ষণের ফলে আমিনুল ইসলামের দেহ নিস্তেজ হয়ে আসে। হাসপাতালে পৌঁছলে কর্তব্যরত ডাক্তার জানান, আমিনুল আর নেই। আমিনুল ইসলাম শাহাদাতবরণ করেছেন।

খোদাদ্রোহী শক্তির নৃশংস আঘাতে আঘাতে এমনিভাবে মৃত্যুহীন জীবন লাভ করলেন আমিনুল ইসলাম। খালি হয়ে গেল মায়ের বুক, হারিয়ে গেল বাবার আশা, স্নেহবঞ্চিত হলো ছোট ভাই-বোনেরা। সেই সাথে গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন শহীদের জানা-অজানা অনেক সাথী, যাদের সাথে আল্লাহর দ্বীনকে ভালোবাসার কারণে ছিল শহীদের হৃদয়ের সম্পর্ক।

বাবার প্রতিক্রিয়া
শহীদের পিতা মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমি বড় আশা করে মানুষের মত মানুষ করতে বড় ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার সেই আশা সন্ত্রাসীরা পূরণ করতে দিল না। সে ছোটবেলা থেকে খুবই মেধাবী ছিল। যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের বিচার এই দুনিয়ার কাঠগড়ায় হয়নি কিন্তু আল্লাহ যেন তাঁর কাঠগড়ায় তাদের উপযুক্ত বিচার করেন। যে পথে আমার ছেলে শহীদ হয়েছে সে পথে যেন সবাই এগিয়ে আসে।’

প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া
শহীদ আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে প্রতিবেশী সরাফত আলী বলেন, ‘সে তো ছিল খুব অমায়িক। শিক্ষা-দীক্ষা, চাল-চলনে তাঁর কোনো তুলনা ছিল না। কুমিল্লাতে আমার দেখা অমন ছেলে আর নেই। আর শুধু তাঁর স্বভাব-চরিত্র নয় তাঁর চেহারাও ছিল খুব সুন্দর। শুরু থেকেই আমরা তাঁকে পড়াশোনায় প্রথম হতে দেখেছি।’

একনজরে শহীদ আমিনুল ইসলাম
নাম : মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
বাবার নাম : মোহাম্মদ আবদুল হামিদ
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- কমলপুর, পোস্ট- কমলপুর, থানা- সদর দক্ষিণ, জেলা- কুমিল্লা
ভাই-বোন : ৩ ভাই, ৩ বোন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : দ্বিতীয়
সাংগঠনিক মান : কর্মী
সর্বশেষ পড়াশোনা : পরিসংখ্যান দ্বিতীয় বর্ষ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের লক্ষ্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া
আহত হওয়ার স্থান : বটতলী রেলস্টেশন, চট্টগ্রাম
আঘাতের ধরন : ধারালো অস্ত্রের আঘাত
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সন্ত্রাসী
শাহাদাতের তারিখ : ২৮ এপ্রিল, ১৯৮৮
শাহাদাতের স্থান : ঘটনাস্থল

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আমিনুল ইসলাম

পিতা

মোহাম্মদ আবদুল হামিদ

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৩ ভাই, ৩ বোন এর মধ্যে দ্বিতীয়

স্থায়ী ঠিকানা

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার কমলপুর গ্রাম

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

বটতলী রেলস্টেশন, চট্টগ্রাম