শহীদ আসগর আলী

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১৮ নভেম্বর ১৯৮৮ | ২৫

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর থানার শাশারপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ আজগর আলী। ছোটবেলা থেকে অনেক শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছিলেন তিনি। কোনো কারণ ছাড়া এদিক-সেদিক ঘুরতে অপছন্দ করতেন। তাঁর মা আকলিমা খাতুন এবং বাবা রমজান আলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন শহীদ।

শিক্ষাজীবন
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস্ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে বিজ্ঞানে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করে উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে বিএসসি (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। শাহাদাতের পূর্বে এমএসসি পরীক্ষার মাত্র দু’টি বিষয় বাকি ছিল তাঁর। শহীদ আসগর স্বপ্ন দেখতেন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার। গ্রামের বাড়ির কাছে সঙ্গীত কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের একজন অস্থায়ী প্রভাষক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

শহীদের ব্যক্তিজীবন
আশপাশের মানুষ শালীন ও কর্তব্যনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবেই জানতেন শহীদকে। অসাধারণ এই মানুষটির ব্যবহার ছিল সবার অনুকরণীয়, আর আমলি জিন্দেগি ছিলো নির্মল ও অতুুলনীয়। আসগর আলী গ্রামের মানুষের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। বাড়িতে গেলে সবার সাথে দেখা করতেন। খোঁজ খবর নিতেন, সালাম বিনিময় করতেন। তাদের পরিবারের সমস্যাগুলো জানতেন এবং সমাধানের পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করতেন। পুরুষদেরকে নামাজের জন্য মসজিদে ডাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালে এলাকায় ছোট ভাই-বোনদের নানা কাজে সহযোগিতা করতেন। সামর্থ্যে কুলালে আর্থিক সহযোগিতাও করতেন। আন্দোলনের সহকর্মীদের অভিজ্ঞতা এ রকম- শহীদ আসলাম কম কথা বলতেন, সবার চেয়ে কম খেতেন। পরিবারের সদস্যরা বলেন, রান্নার সময় তিনি মায়ের চুলার কাছে বসতেন। তার সাথে প্রাণখুলে কথা বলতেন। মাকে শরীরের প্রতি যত্ন নেয়া এবং বেশি কাজ না করার পরামর্শ দিতেন। মাকে ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে।

পারিবারিক জীবন
সম্মান শ্রেণীতে পড়ার সময় দিনাজপুর শহরের পুলহাট গ্রামে বিয়ে করেন শহীদ। আফিফা তাজরেমিন শহীদের একমাত্র সন্তান শাহাদাতের সময় যার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। তার নিভৃত কান্নায় হয়তোবা প্রকৃতিও কেঁদে ওঠে। তার প্রশ্ন কারা কলম ফেলে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল? আমার আব্বুকে হত্যা করেছিল? আমার আব্বু তো কোনোদিন কারো ক্ষতি করেননি। মানুষের জন্য, ইসলামের জন্য তাঁর হৃদয় কাঁদতো, আর তাই তিনি ইসলামকে জীবনের মিশন মনে করেছিলেন। সত্য বলতে কী, এটাই ছিল আমার আব্বুর অপরাধ। কিন্তু কেন বড় অসময়ে আমার আব্বুকে প্রাণ দিতে হল? কে দেবে এই প্রশ্নের জবাব?

শাহাদাতবরণ
আমীর আলী হলের ৩০২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন শহীদ। ১৮ নভেম্বর ১৯৮৮, জুমাবার; নামাজ হল মসজিদে পড়া যেত নিশ্চয়ই। কিন্তু বেশি সওয়াবের উদ্দেশ্যে গোসল করে পাক-পবিত্র হয়ে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে রওয়ানা হলেন তিনি। তবে জুমার নামাজ আর আদায় করা হলো না মসজিদে। খুনিরা রামদা, হকিস্টিক, ছোরা, কুড়াল দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করলো তাঁকে। ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন আলী আসগর ভাই। ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টা ৪৫ মিনিটের ঘরে।

জানাজা ও দাফন
বাড়িতে খবর পৌঁছায় রাতেই। পরের দিন সকাল দশটায় লাশ বাড়ি পৌঁছায়। পাড়া প্রতিবেশীরা সেদিন শাশালপুরের আকাশ-বাতাসের সাথে কেঁদেছে, চোখের পানিতে বুক ভিজিয়েছে। তাদের প্রিয় মানুষটিকে শুধু একনজর দেখার জন্য আকুতি করেছে। ভিড় ভেঙেছে হাজারো মানুষের, মিছিল নিয়ে হাজির হয়েছেন তাঁর প্রিয় সাথীরা শহীদকে সম্মানের সাথে দাফন করার জন্য। শাশালপুর এর আগে একসাথে এত বড় জানাজার নামাজ দেখেনি।

স্মরণীয় বাণী
“সুন্দর এ মতিহার সবুজ চত্বরকে ভালোবেসেছি, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইসলামের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবেসে যাব।”

মা-বাবার প্রতিক্রিয়া
শহীদ আসগর আলীর শাহাদাতের খবর যখন তাঁর পিতা-মাতার নিকট পৌঁছে তখন তারা উভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে শহীদের মা বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তাঁকে নিয়ে গেছেন, ভালোভাবে রাখুন, এই প্রার্থনা করি। আর আমি আশা করি কিয়ামতের দিন কঠিন মুসিবতের সময় সে যেন আমাদের জান্নাতে যাবার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে, তাঁর উছিলায় আমরা যেন জান্নাতে যেতে পারি। আসগরের উত্তরসূরিদের নিকট প্রত্যাশা করি এই আন্দোলনের জনশক্তিরা আসগরের লক্ষ্যকে সামনে রেখে যেন কাজ করে যায়।’

শহীদের স্ত্রীর কথা
শহীদের স্ত্রী দিলরুবা বেগম বলেন, ‘নিজেকে সান্ত্বনা দিই এভাবে যে, আমি একজন শহীদের স্ত্রী।’ তিনি শহীদ আসগরের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের দাওয়াতি কাজে আরো বেশি মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান যাতে করে শহীদ আসগরের রক্তঝরা জমিনে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ করা যায়।

শহীদের কন্যার কথা
শহীদের কন্যা আফিফা তাজরিমিন (পপি) বলেন, ‘বাবাকে খুব মনে পড়ে। বাবা থাকলে শ্বশুরবাড়ি আসতেন, আমার খোঁজ-খবর নিতে পারতেন। আজ বাবা না থাকায় এই বেদনা সয়ে যাচ্ছি। তবুও একজন শহীদের সন্তান হতে পেরে আমি খুব গর্বিত।

একনজরে শহীদ আসগর আলী
নাম : আসগর আলী
মায়ের নাম : আকলিমা খাতুন
বাবার নাম : মো: রমজান আলী (সাবেক ইউপি মেম্বার)
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- শাশালপুর, ডাক- ভিয়াইল, থানা- চিরিরবন্দর, জেলা- দিনাজপুর
জন্মতারিখ : ১৯৬৩ সাল
ভাই-বোন : ৩ ভাই, ১ বোন
ভাই-বোনদের মধ্যে অবস্থান : সবার বড়
সাংগঠনিক মান : কর্মী
জীবনের লক্ষ্য : শিক্ষক হওয়া
কৃতিত্ব : এসএসসি প্রথম বিভাগ (বিজ্ঞান), ১৯৭৯; এইচএসসি দ্বিতীয় বিভাগ (বিজ্ঞান), ১৯৮১; বিএসসি (সম্মান) পদার্থ, ১৯৮৮; শাহাদাতবরণকালে এমএসসি (রা.বি) অধ্যয়নরত ছিলেন
শহীদ হওয়ার স্থান : শাহ মাখদুম হলের সামনে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
আঘাতের ধরন : হকিস্টিক, কিরিচ, ছোরা, কুড়াল দিয়ে সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রমৈত্রী
শাহাদাতের তারিখ : ১৮ নভেম্বর, ১৯৮৮; দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আসগর আলী

পিতা

মোঃ রমজান আলী

মাতা

আকলিমা খাতুন

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৩ ভাই, ১ বোন , তিনি সবার বড়

স্থায়ী ঠিকানা

দিনাজপুরের হিলিবন্দর থানার শাশালপুর গ্রাম

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

এম.এস.সি শেষ বর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

শাহ মাখদুম হলের সামনে ( রাবি)