শহীদ আজিবুর রহমান

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৭ মে ১৯৯২ | ৪৬

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

অপরূপ এই পৃথিবী ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য ফুলসজ্জা নয় বরং সম্পূর্ণ কন্টকাকীর্ণ এক ময়দান। তাইতো বদর-ওহুদ-খন্দক পেরিয়ে আজ আমরা এখানে...! ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সাহাবা, তাবে-তাবয়ীনদের মতো বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাইতো দ্বীনের সাজে সজ্জিত এই শিবিরের কোলে শহীদি রক্ত জেগে ওঠে।

বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের সর্ববৃহৎ সংগঠন এই শিবিরেরই এক তরুণ পথিক শহীদ আজিবুর রহমান। যেসব শহীদের রক্তের বিনিময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আন্দোলনের বীজ সুগভীরে গ্রথিত হয়েছে, তাদের মাঝে শহীদ আজিবুর রহমান অন্যতম। তিনি নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমের ধারক ছাত্রমৈত্রী ও জাসদ ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায় ৭ জুলাই ১৯৯২ সালে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাত বরণ করেন।

প্রাথমিক পরিচিতি
শহীদ আজিবুর ঐতিহ্যবাহী শহীদি ঈদগাহ রাহশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা বুধপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ আজিবুরের পিতা জনাব মো. আবেদ আলী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আলী হলে একজন সাধারণ কর্মচারী। তিনি তাঁর আদরের সন্তান আজিবুরকে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করে বড় করে তুলেছিলেন। ছেলে উচ্চশিক্ষিত হোক এটাই ছিল তাঁর পিতার কামনা। শহীদ আজিবুর রহমান তাঁর পিতার এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের আদরের সন্তান। শহীদ আজিবরের পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৯ জন। তার ভাই বোন ছিল ৫ জন এবং ভাই বোনদের মাঝে তিনি দ্বিতীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া ছিল তার লক্ষ্য। শহীদ আজিবরের ভাই বোনদের সাথে খুব মধুর ব্যবহার পরিলক্ষিত হত। কেউ তার বিরুদ্ধে কোন খারাপ মন্তব্য করত না।

শিক্ষাজীবন
শহীদ আজিবুর রহমান ছোটকাল থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মাসকাটা দীঘি হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাস করেন। এসএসসিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৯০ সালে এইচ, এসসি পাস করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস (সম্মান) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৯২ সালে ফেব্রুয়ারিতে ১৯৯১-৯২ সেশনে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু ১৯৯২ সালে ৭ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এক মেধাবী ছাত্রকে হারাল।

সাংগঠনিক জীবন
শহীদ আজিবুর রহমান ছিলেন সংগঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিলেন। তিনি সংগঠনকে প্রসারিত করা এবং সংগঠনের মজবুতি অর্জনের সব সময় সচেষ্ট ছিলেন এবং সংগঠনের দাওয়াতি কাজে বেশ তৎপর ছিলেন। মেধাবী ও প্রতিভাবান ছাত্ররা ছিল তার টার্গেট। ছাত্রদেরকে সংগঠনে নিয়ে আসার জন্য কৌশলে বিভিন্ন উপহার দিতেন। ছাত্রদের ইসলামী সাহিত্য পড়ানোর জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখতেন। মোট কথা, ব্যক্তিগত কাজের চাইতে সংগঠনের সামান্য দায়িত্বও অত্যন্ত সুনিপুণভাবে, আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন। সংগঠনের আনুগত্যের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব ও সংগঠন চলতে পারে না। আনুগত্যহীন অসংখ্য কর্মীর চেয়ে আনুগত্যশীল একজন কর্মীই আন্দোলনের জন্য উত্তম। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে এতই যত্নবান ছিলেন যে, সংগঠনের সামান্য কাজ থেকে বড় কোন দায়িত্ব সবই ছিল তার কাছে সমান। বড় কোন দায়িত্ব আসলে সেটাকে তিনি আমানত মনে করতেন।

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের একটি বিশেষ গুণ হল আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজকে পর্যায়ক্রমে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়া। আত্মসমালোচনার কঠিন সাধনার মাধ্যমে শহীদ আজিবুর রহমান নিজের চরিত্রকে আরো উন্নত করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। শহীদ আজিবুর রহমান একদিকে কোমল মেজাজের অধিকারী এবং অপরদিকে ছিলেন কঠোর। তিনি সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। তার সুন্দর কথার মাধ্যমে মানুষকে অতি সহজে আকৃষ্ট করা সম্ভব হত। অপরদিকে সংগঠনের কাজে অলসতা ও দায়িত্বনুভূতির অভাব তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে অতি ভালবাসতেন। শহীদ আজিবুর রহমান ছিলেন তাদের দুঃখ বেদনার সাথী। তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মত। কর্মীদের সাথে দেখা হলেই কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন এবং পড়াশুনার খোঁজ খবর নিতেন। শহীদ আজিবুর রহমান কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন। অনুপ্রেরণা যোগাতেন প্রতিভা বিকাশে। এ কারণেই তিনি কর্মীদের কাছে দায়িত্বশীলের পাশাপাশি অভিভাবকও ছিলেন।

খেলার মাঠে শহীদ আজিবুর
শহীদ আজিবুর রহমানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মো. শোয়াইব রুমি। শোয়াইব রুমিই খেলার মাঠে আজিবুর কেমন ছিলেন তার বর্ণনা দেন; ‘১৯৯১ সাল। অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্র আমি। ২৬১ সোহরাওয়ার্দী হলে থাকতাম। সোহরাওয়ার্দী এবং জোহা হলের শিবিরকর্মীরা আমীর আলী হলের মাঠে প্রায় প্রত্যেক সকালেই ফুটবল খেলতো। সেখানে বুধপাড়ার মোজাম্মেল ভাইসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে যে মুখটির সমাগম হত তিনিই হলেন-শহীদ আজিবুর রহমান। মাঠে ফুটবল খেলা নিয়ে একটু রাগারাগি হলে তিনি মিটমাট করে দিতেন। বল ঠিকমতো না খেললে দলীয় লোকেরা রাগারাগি করতো। সে রাগারাগি কত ভালোবাসায় ভরা তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরাই জানেন। কারণ এ বন্ধন রক্তের নয়, এ বন্ধন সম্পদের নয়, এ বন্ধন দ্বীনের বন্ধন-আত্মার বন্ধন। তার বন্ধু বলেন; আমি ছোট কাল থেকেই ফুটবল কমবেশি খেলতাম। কিন্তু শহীদ আজিবুরের মতো নয়। আমি যেদিন ওনার দলে পড়তাম সেদিন বলতাম আমি আপনার মতো এত সুন্দর খেলতে পারবো না, রাগ করবেন আজিবুর ভাই? তিনি মিষ্টি হেসে বলতেন; চেষ্টা করেন, পারবেন। সে মিষ্টি হাসি কত সুন্দর, কত স্নিগ্ধময়, কত ভালবাসার। তার বন্ধু আরো বলেন; আমাকে অনেক সময় ভালো পরামর্শ দিতেন। কত আপন ভেবে, ভালোবেসে। তিনি আমার কত কাছের- কেমন আত্মার আত্মীয় ছিলেন বলে বোঝানো যাবে না।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
১৯৯২ সালের ৭ জুলাই রাত ৮টা। আজিবুর রহমান আন্দোলনের দায়িত্ব পালন শেষে যথারীতি বাসায় ফিরে আসেন। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য মোজাম্মেল হকের বুধপাড়াস্থ বাসায় থাকতেন। তিনি বাসায় নিজে পড়ছিলেন এবং ছোট একটি ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন। তখন জাসদ-ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রীর পাষণ্ড-বর্বর সন্ত্রাসীরা বাড়ির বাইর থেকে তার উপর শক্তিশালী বোমা হামলা করে। পাষণ্ডরা এভাবে হামলা করবে কেউ কল্পনা করতে পারিনি। ঐদিনই আজিবুর রহমান শাহাদত বরণ করেন যে বাড়িতে হামলা করেছিল সে বাড়িটিও বিধ্বস্ত হয়েছিল শহীদ আজিবুর রহমানের জানাজার নামাজ হয়েছিল রাজশহী বিশ্ববিদ্যালয়েল কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে।
সেখানে হাজার হাজার লোক জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিল এবং সকলের মাঝেই কান্নার রোল পড়েছিল তারপর দ্বিতীয় জানাজার নামাজ হয়েছিল তাঁর নিজ জন্মস্থান বুধপাড়াস্থ গ্রামে। আজিবুরের লাশ দেখার জন্য এত মানুষের সমাগম ঘটেছিল, যা ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। সেদিন এলাকাবাসীর মুখে শোনা গিয়েছিল আজকে আমরা একজন প্রতিভাবান ছাত্রকে হারালাম, আমাদের এ ক্ষতি পূরণীয় নয়।

শহীদ আজিবুরের চরিত্র
শহীদ আজিবুর রহমান ছিলেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী। অত্যন্ত বিনয়ী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। তার উন্নত চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। শহীদ আজিবরে সবকিছু ছিল পরিচ্ছন্ন। কাজ ছিল নিয়ম বাঁধা। তার হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। ভারসাম্যপূর্ণ জীবন কাটিয়েছেন। যদিও শহীদ আজিবরে থাকার রুমটি উন্নতমানের ছিল না, তবু রুমটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতেন। বই পুস্তকগুলি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতেন। ব্যবহারে জামা কাপড় ভালভাবে গুছিয়ে রাখতেন। কাউকে কোন কথা দিলে কথা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন গীবত ও চোগলখোরি করাকে একবারেই অপছন্দ করতেন। আত্মপূজা ও অহংকার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন।

তার হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি
শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৪৬ তম শহীদ হলেন শহীদ আজিবুর রহমান। ১৯৯২ সালে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তখনকার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে কেন্দ্রীয় সভাপতি আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ও সেক্রেটারি জেনারেল হামিদ হোসাইন আজাদ হত্যাকণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন এবং দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানান।

একনজরে শহীদ মো. আজিবুর রহমান
পূর্ণ নাম : মো. আজিবুর রহমান
পিতার নাম : মো: আবেদ আলী
মাতার নাম : মুসাম্মাৎ ফাতেমা বেগম
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম বুধপাড়া, ডাকঘর : হরিয়ান চিনিকল, থানা: মতিহার, জেলা: রাজশাহী।
পারিবারের মোট সদস্য : ৯ জন।
ভাইবোনদের সংখ্যা : ৫ জন
ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : দ্বিতীয়
সাংগঠনিক মান : সাথী
সর্বশেষ লেখাপড়া : ১ম বর্ষ সম্মান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের লক্ষ্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া
আহত হওয়ার স্থান : বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা, বুধপাড়া।
আঘাতের ধরন : শক্তিশালী বোমার আঘাতে ঝলসে যায় শহীদের গোটা শরীর ।
যাদের আঘাতে শহীদ : জাসদ, ছাত্রমৈত্রীর সন্ত্রাসীদের আঘাতে
শহীদ হওয়ার তারিখ : ৭ জুলাই ১৯৯২ ইং
শহীদ হওয়ার স্থান : রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
পিতার অবস্থা : জীবিত, চাকুরীজীবী
মাতার অবস্থা: জীবিত, গৃহিনী

শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী : ইসলামী বিপ্লব ছাড়া এ সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়।
শাহাদাতের পর পিতামাতার প্রতিক্রিয়া : ‘‘আজিবুর ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।”

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আজিবুর রহমান

পিতা

মোঃ আবেদ আলী

মাতা

মোছাম্মৎ ফাতেমা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৯ জন

স্থায়ী ঠিকানা

বুধপাড়া, হরিয়ানা চিনিকল, মতিহার, রাজশাহী

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ১ম বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

শাহাদাতের স্থান

বুধপাড়া