শহীদ সাইফুল ইসলাম মামুন

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২৫ নভেম্বর ১৯৯২ | ৫০

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

সন্ত্রাসের নিষ্ঠুর ছোবল থেকে দেশের একমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টিও মুক্ত থাকেনি। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিকে দমিয়ে দেয়ার জন্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়েও বিস্তার করা হয়েছে সন্ত্রাসের নৃশংস থাবা। ২৫ নভেম্বর ১৯৯২ কথিত ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের হামলায় মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হয় শিবিরকর্মী সাইফুল ইসলাম মামুনকে। শহীদ মামুন ছিলেন সাহসী ও সৎ। আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দেবার মাধ্যমে তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক উজ্জ্বল প্রেরণার দৃষ্টান্ত।

পরিচিতি
শহীদ সাইফুল ইসলাম মামুন বগুড়া জেলা ঠনঠনিয়া হাজীপাড়ার বটতলা গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ মোহাম্মদ আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার। শহীদ মামুনরা দুইভাই। বড় ভাই মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
শহীদ সাইফুল ইসলাম মামুন ছোটবেলা হতেই প্রচন্ড মেধার অধিকারী ছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায়।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
২৫ নভেম্বর ’৯২ কথিত ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কাপুরুষোচিত হামলায় মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হয়েছে শিবিরকর্মী সাইফুল ইসলাম মামুনকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে একটি মেসে রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমন্ত সাইফুল ও তার তিনবন্ধুর উপর হঠাৎ আক্রমণ চালায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। তাদের ছুরিকাঘাতে ১ম বর্ষের ছাত্র মামুন ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)।

কয়েকদিন ধর্মঘটের পর শিক্ষকরা ২৫ নভেম্বর থেকে পুনরায় ক্লাস নিতে শুরু করেন। ঐদিন মুজিববাদী ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ও ছাত্র ইউনিয়নের সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অস্ত্রের মহড়া দেয়। এক পর্যায়ে সকাল ১০টার দিকে ‘শিবিরের আস্তানা-জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’, ‘একটা একটা শিবির ধর-সকাল বিকাল নাস্তা কর’ ইত্যাদি উত্তেজনাকর শ্লোগান দিয়ে সশস্ত্র মিছিল বের করে। এক পর্যায়ে তারা শিবিরকর্মীদের উপর হিংস্র হায়েনার মত ছোবল মারে। ইবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবদুল হাই ক্লাস শেষে বের হলে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে। আল্লাহর ইচ্ছায় গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন। এরপর সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে শিবিরকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে গুণ্ডারা পালিয়ে যায়। কিন্তু দুপুর ১২টার দিকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় তারা আবার হামলে পড়ে শিবিরকর্মীদের উপর।

এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমা ছুঁড়লে ক্যাম্পাসে বিভীষিকাময় মুহূর্তের অবতারণা হয়। এবারও সাধারণ ছাত্রদের ‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার’ শ্লোগানে ভয় পেয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পালিয়ে যাবার সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে যায়। পরে ছাত্রদলের গুণ্ডাদের নিয়ে তৃতীয় দফায় হামলা চালায়। তাদের এই হামলায় ১০/১২ জন ছাত্র আহত হয়। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে ছাত্রদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপকক্ষ। ঝিনাইদহগামী ৪টি বাস ছাত্রদের নিয়ে গাড়াগঞ্জ নামক স্থানে পৌঁছলে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পথিমধ্যেই হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে গাড়ির চালককে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে। এখানে তাদের বর্বর হামলায় ১৫ জন সাধারণ ছাত্র ও শিবিরকর্মী আহত হয়। কুষ্টিয়াগামী ২টি বাসেও সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।

ঐদিন সন্ধ্যায় প্রাক্তন শিবির নেতা ওয়ালিউল্লাহ ও মঞ্জুর হোসাইন মোটরসাইকেলে ঝিনাইদহ যাবার পথে সন্ত্রাসীরা পথ রোধ করে তাদের উপর কাপুরুষোচিত হামলা চালায়। পাষণ্ডরা তাদের বেদম প্রহার করে এবং দু’জনেরই পায়ের গোড়ালি ধারালো কিরিচ দিয়ে কেটে দেয়। তাদের গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সারাদিনে খুনের নেশায় মত্ত হয়েও খুনের নেশা কমেনি সন্ত্রাসীদের। গভীর রাতে যখন গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন তখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুর গ্রামে ‘পাঞ্জেরী’ নামের একটি মেসে বর্বর হামলা চালায়। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কারণে সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিলেন শুধু মামুন ও অন্য ৩জন ছাত্র মেসে অবস্থান করছিলেন। হামলার সময় তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হামলা থেকে বাঁচতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও রক্ষা পাননি তারা। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে মামুনের সুঠামদেহ নিস্তেজ হয়ে যায়। অপর দু’জন শিবির কর্মীও পশুদের হামলায় গুরুতর আহত হন। হামলার পর এলাকার লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখেন মামুন আর বেঁচে নেই। ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

জানাযা ও দাফন
২৬ নভেম্বর বিকেল ৪টায় কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠ এবং এর আগে হরিনারায়নপুরে শহীদের দু’দফা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাত ১০টায় শহীদ মামুনের লাশ বগুড়া শহরে তাদের বাড়ি এসে পৌঁছলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এতে সহস্র মানুষ গভীর রাত পর্যন্ত শহীদের পবিত্র চেহারা একনজর দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ
মামুন হত্যার পর ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান ও নায়েবে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ এক বিবৃতিতে মামুন হত্যা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারকীয় সন্ত্রাস সৃষ্টির তীব্র নিন্দা জানান এবং সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। হত্যার জন্যে চিহ্নিত খুনিদের দায়ী করে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে গ্রের্ফতার করেনি।

একনজরে শহীদ সাইফুল ইসলাম মামুন

নাম : মু. সাইফুল ইসলাম মামুন
পিতা : শেখ মোহাম্মদ আলী
মাতা : মরহুমা মুসাম্মাৎ জোহরা খাতুন
ঠিকানা : গ্রাম- ঠনঠনিয়া হাজিপাড়া, পোস্ট- বগুড়া, থানা- বগুড়া সদর, জেলা-বগুড়া
ভাইবোন : ২ ভাই এর মধ্যে ছোট, 
শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স ১ম বর্ষ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ইবি।
সাংগঠনিক মান : সাথী
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রদলের সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী
কবর স্থান : দক্ষিণ বগুড়া গোরস্থান
শখ : খেলাধুলা ও দাওয়াতি কাজ করা।

মা-বাবার প্রতিক্রিয়া
মামুন খুবই মেধাবী ও মিশুক ছিলো। সে অল্প লেখাপড়া করেও মেধার গুণে ভালো ফলাফল করতো। আল্লাহ তার শাহাদাতকে কবুল করুন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ সাইফুল ইসলাম মামুন

পিতা

শেখ মুহাম্মদ আলী

মাতা

মোছাম্মৎ জোহরা খাতুন

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

২ ভাই

স্থায়ী ঠিকানা

ঠনঠনিয়া হাজিপাড়া, সদর, বগুড়া

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ১ম বর্ষ, ইবি।

শাহাদাতের স্থান

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়