শহীদ মো: ইয়াহিয়া

১৫ জানুয়ারি ১৯৭৩ - ১৪ জানুয়ারি ১৯৯৩ | ৫৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

শহীদ ইয়াহিয়াও জান্নাতের আশায় তার পূর্বসূরি কাজী মোশাররফের যোগ্য উত্তরসূরী। কুরআনের ভাষায় 'মুমিনদের মাঝে সম্পর্ক সীসা ঢালা প্রাচীরে ন্যায়।’ আর তাই তো দেখা যায় শহীদ কাজী মোশররফের হত্যার প্রতিবাদে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের অকুতোভয় এক সৈনিক শহীদ ইয়াহিয়া।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
দিনটি ছিল ১৪ জানুয়ারি ১৯৯৩ সাল। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল কাজী মোশাররফের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে। চট্টগ্রামে ১২ জানুয়ারি শিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্মম ব্রাশফায়ার করে ফেরাউনের দোসররা শহীদ করে চট্টগ্রাম কলেজের মেধাবী ছাত্র কাজী মোশাররফ হোসেনকে। প্রতিবাদে দেশের অন্যান্য স্থানের মত রাজশাহী মহানগরীতেও শিবির বিক্ষোভ মিছিল করে। বেলা ১১টার দিকে মিছিল শুরু হয়ে রাজশাহী কলেজের সামনে আসতেই শিবিরের মিছিলে হামলা করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল। তারা রাইফেল, কাটা রাইফেল, পিস্তলসহ ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের হামলার ২০/২৫ জন শিবিরকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়।

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। শুধু তাই নয় পুলিশের পরোক্ষ সহায়তার ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা পেছন থেকে শিবিরে উপর হামলা চালায়। সামনে পুলিশ পেছনে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা। ফলে শিবির কর্মীদের সরে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত বাহিনী সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়নি বরং নিরীহ শিবির কর্মীদের ধাওয়া করে। তাই শিবির কর্মীরা সদর হাসপাতাল ও হেতেমখাঁয় অবস্থান নেয়। অন্যান্যদের মত শিবির নেতা ইয়াহিয়াও সদর হাসপাতালে অবস্থান নেন।

ময়দান ছেড়ে যাওয়ার পরও ফেরাউন বাহিনীর রক্ত পিপাসা থামেনি। নিরীহ শিবির কর্মীদের রক্তই যেন তাদের পিপাসা থামাতে পারে শুধু। রক্তপিপাসু হায়েনারা রক্তের নেশায় হাসপাতালে প্রবেশ করে শিবির কর্মীদের খুঁজতে থাকে। শহীদ ইয়াহিয়াকে পেয়ে যেন তাদের খুনের নেশা আরো বেড়ে যায়। তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। এলোপাতাড়ি চাইনিজ কুড়াল, হকিস্টিক ও রড দিয়ে শহীদ ইয়াহিয়ার উপর হামলা করতে থাকে। তারা ইয়াহিয়াকে মারতে মারতে হাসপাতালে দোতলা থেকে নিচে নিয়ে আসে পুলিশের সামনে ইয়াহিয়াকে কোপাতে থাকে। হাসপাতালে রোগী ও ডাক্তারদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে অথচ পুলিশ মাত্র ২০ হাত দূরে দাঁড়িয়ে মূর্তির মতো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

রডের আঘাতে চাইনিজ কুড়ালের কোপে ইয়াহিয়ার মাথা থেঁতলে যায়। চেহারা বিকৃত হয়ে যায় মুমূর্যু অবস্থায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার বেলা ১.৪৫ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন।

অগ্রপথিক ইয়াহিয়া
শহীদ ইয়াহিয়া দাওয়াতি কাজকে নিজের জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছিলেন। তেরখাদিয়ার ছাত্র জনতার মাঝে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আলোর পথে আহ্বান জানাতেন। আর তাই সকলের প্রিয়মুখ ছিলেন ইয়াহিয়া। শহীদ ইয়াহিয়াকে হারিয়ে সেদিন সাধারণ মানুষ যেভাবে কান্নাকাটি করেছেন, তাতে মনে হয়েছে প্রতিটি পরিবার যেন তাদের একজন সদস্যকে হারিয়েছে। প্রিয় মানুষের হারানোর বেদনায় হাহাকার করছিল সেদিনের পরিবেশ। মনে হয যেন সূর্য উঠেনি তার স্নিগ্ধ হাসিতে, পাখি কিচির মিচির শব্দ করেনি। প্রকৃতিতে ছিল থমথমে ভাব।

শহীদের স্মরণীয় বাণী
সুন্দর ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যশায় অস্থির ছিলেন শহীদ ইয়াহিয়া। সেজন্য নিজের জীবন দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন অনেক আগে থেকেই। তিনি প্রায়ই পিতা মাতা ভাইবোনদের মাঝে বলতেন, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবো। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমেই এদেশে শান্তি আসতে পারে। আর ছাত্রশিবির বাংলাদেশ শান্তির অন্বেষণায় তৎপর।

একনজরে শহীদ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া
নাম : মুহাম্মদ ইয়াহিয়া
পিতার নাম : মো. আমজাদ হোসাইন
মাতার নাম : মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম
জন্মতারিখ : ১৫ জানুয়ারি ১৯৭৩ ইং
ভাইবোন : ৩ ভাই ৩ বোন ।
ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : ১ম
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: হরিদাগাছি, ডাক-কেমারহাট, থানা মেনেপুর, জেলা : রাজশাহী।
সাংগঠনিক মান : কর্মী
সর্বশেষ পড়াশোনা : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (আরবি ১ম বর্ষ)
অন্যান্য কৃতিত্ব : ভালো খেলোয়াড় ছিলেন
আহত হওয়ার স্থান : সদর হাসপাতাল মোড়ে, রাজশাহী
আঘাতের ধরন : ছোরা, লাঠির উপর্যুপরি আঘাত
যাদের হাতে শহীদ : ছাত্রদলের সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৪.০১.১৯৯৩ সাল
কবরস্থান : হরিদাগাছী পারিবারিক কবরস্থান
যে শাখার শহীদ : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মা-বাবার প্রতিক্রিয়া
ইয়াহিয়া পরোপকারী ছেলে ছিল। সে অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, ও মেধাবী ছিল। পরিশ্রমীও ছিল যথেষ্ট। লেখা-পড়া সংগঠনের পাশাপাশি পরিবারের জন্য ছিল নিবেদিতপ্রাণ। আগামী মাসের ১৫ তারিখ পিঠা খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিল, কিন্তু সে পিঠা না খেয়ে চলে গেছে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে। ১৪ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে। ১৫ তারিখ ইয়াহিয়া বাসায় এসেছিল, তবে শহীদ হয়ে।

শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া
তার প্রিয় শিক্ষক প্রিন্সিপাল আবদুল কাদের বলেন; তার মতো ছাত্র আমি প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থায় আর দেখিনি। আল্লাহ হয়তো তাকে কবুল করবেন এজন্য এমন গুণাবলী তার মধ্যে দিয়েছিলেন। অন্যান্য ছাত্রদের থেকে আসলে সে চারিত্রিক-আচরণগতভাবে ভিন্ন ছিল।

প্রতিবেশীর প্রতিক্রিয়া
চাচী সম্পর্কে মোসাম্মৎ রহীমা বেগম বলেন; আমি তাকে নিজের পেটের ছেলের মতো স্নেহ করতাম। কারণ তার ব্যবহার, আচার-আচরণ, শ্রদ্ধাবোধ, সবকিছু আমাদেরকে মুগ্ধ করতো। একদিন স্বপ্নে দেখছি সে আমার কাছে মাংস দিয়ে ভাত খেতে চাইলো, আমি তাকে মাংস দিয়ে খাবার খেতে দিলাম।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মো: ইয়াহিয়া

পিতা

মোঃ আমজাদ হোসাইন

মাতা

মোছাম্মৎ ফাতেমা বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১৫, ১৯৭৩

ভাই বোন

৩ ভাই ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রামঃ হারিদাগাছি, ডাক- কেমারহাট, থানা- মেনেপুর, জিলা- রাজশাহী

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

আরবি, ১ম বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

সদর হাসপাতাল মোড়, রাজশাহী