শহীদ শেখ আমানুল্লাহ্ আমান

০১ জানুয়ারি ১৯৭৯ - ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ | ৫৭

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“আমার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শহীদ আমান লিখে রেখো।” শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্তে সাথীদের প্রতি এ মহান আহবান ছিল এতিম আমানের। ২০ শে সেপ্টেম্বর’৯৩ দুপুর বেলা। সিটি কলেজে ছাত্রদলের সস্ত্রাসী কতৃর্ক আটকে পড়া শিবির নেতা ওয়াছিয়ার রহমান মন্টুর ও আবুল কাসেম পাঠানকে মুক্ত করে আনা হয়েছে। জামায়াত অফিসে সকলে বসা। হঠাৎ খবর এলো আলীয়া মাদ্রাসায় হামলা হয়েছে, শাহাদাৎ বরণ করেছেন একজন। ছুটে গেলাম আলীয়া মাদ্রাসায়। এতিম ছেলেরা দৌড়িয়ে এলো।

গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, এখন এসে কি হবে এই যে আমানের লাশ। আমান আর বেঁচে নেই। সে শহীদ হয়েছে। কেন তাকে মারা হলো? জবাব দিতে পারিনি সেদিন এতিমদের এ প্রশ্নের। প্রচন্ড বেদনায় হতবাক হলাম। কি বলবো শত-শত এতিম শিশুদের? কি বলে সান্তনা দেব তদের? অফিস কক্ষের সামনে খাটিয়ায় রাখা সাদা কাপড়ে ঢাকা শহীদ আমানের লাশ। তার দেহে রয়েছে চেঙ্গিস ও হালাকুর উত্তসূরি হিটলারের প্রেতাত্মা মানবরূপী হিংস্র হায়নাদের একতরফা আক্রমণের সকরুণ চিহ্ন।

চেহারায় যেন চমকে উঠেছে আল্লাহর নূর। চতুর্দিক আলোকিত হচ্ছে নূরের তাজাল্লিতে। লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চোখে মুখে শোকের ছায়া নিয়ে ছুটে আসা অসংখ্য মানুষ। নির্বাক তাকিয়ে দেখছে শহীদ আমানকে। আর্তচিৎকার করতে করতে শহীদের লাশের নিকট লুটিয়ে পরেছে শহীদের সাথীরা। পিতা-মাতার আদরের ধন আমান বাড়িতে ফিরতে পারিনি আলেম হয়ে, মানুষ হয়ে। পিতা অত্যন্ত আশা করে বলতো আমার আমান বড় আলেম হবে, হাফেজ হবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। আমানের পিতা তার মাতাকে বলতো নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করো।

আমাদের আমান যেন ভালোভাবে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে উঠতে পারে। কিন্তুু সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে লাশ হয়ে ফিরলো আমান বিধবা মায়ের কাছে। সাতক্ষিরা জেলার আশাশুনি থানার অন্তর্গত দরগাহপুর গ্রামে জন্ম নেয় আমান। এ গ্রামে মাদ্রাসার পার্শ্বে একটু ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে গোলপাতার ছাউনি মাটির দেয়াল দিয়ে ছোট এক খানা ঘর। সেখানে বাস করত বিধবা মা, আমান ও তার ছোট ভাই আব্দুর রহমান ও বোন রেশমা। আমান যখন ২য় শ্রেণীর ছাত্র তখন তার পিতা মারা যায়। আশৈশব পিতৃহারা আমান বিধবা মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা ও স্নেহে লালিত হতে লাগলেন নিজ গ্রাম দরগাহপুরেই।

মায়ের কাছে থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। পরে খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। শাহাদাতের সময় ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন আমান। অন্যন্য দিনের মতো সেদিনও বোডিং সুপারের নিকট থেকে ছুটি নিয়েছে। বাড়িতে যাবে মায়ের সাথে দেখা করবে তাই। সবেমাত্র ক্লাশ শেষ হয়েছে। মসজিদে নামাজ আদায় করে রুমে এসেছে। সকলেই খাবার গ্রহণে ব্যস্ত। খাওয়া শেষ করতে পারেনি কেউ। এমন সময় ছাত্রদলের এলোপাথাড়ি গুলি ও বোমার মুর্হূমুহূ শব্দে সকলেই হতবিহবল। ছাত্র, শিক্ষক ও এতিমরা প্রাণের ভয়ে ছুটছুটি করতে লাগলো। মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে নেসে এলো বিভীষিকা। অনেকেরই খাওয়া হয়নি। পানিও খেতে পারেনি অনেকে। আমান দৌড়ে সিঁরি দিয়ে দো’তালায় উঠেছিলেন। আমানকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া হলো কাটা রাইফেল দিয়ে। বুলেটবিদ্ধ হলো আমান। মা বলে এক চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পরলো মাটিতে।

পিতৃহীন এই ইয়াতিমের একমাত্র সম্বল ও ভরসা ছিলো তার মা। কিন্তুু মা বলে চিৎকার হায়নাদের রক্ত পিপাসু মনকে নরম করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার গুলি করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয় শহীদ আমানকে। শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিল আমান। লাশ বাড়িতে পৌঁছালে শহীদের শোকাহত সাথীরা ভীড় জমাতে থাকে শহীদের বাড়িতে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পড়শিরা। মুষড়ে পড়েন শহীদের বিধবা মা, বোন রেশমা ও ছোট ভাই আব্দুর রহমানের গগনবিদারি কান্নায় পুরো পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলো। মানুষ, পশু, গাছপালা সকলেই যেন শোকে মুহ্যমান। বিধবা মা র্দীঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলেন- “আমানের পিতা বড় আশা করতো আমান বড় আলেম হবে।
আমিও আশা করতাম আনেক কিছু। ওর পিতার মৃত্যুর পর ওর দিকে তাকিয়েই আমি বেঁচে আছি। ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতাম।

শহীদ আমান উল্লাহর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা মোনাওয়ার হোসাইন বললেন, আমান আর আমাদের মাঝে নেই। বুলেটের নির্মম আঘাতে শাহাদাতের অমিয়সুধা পান করে আমান। হোষ্টেল সুপার মাওলানা ইকরামুল হক বললেন, আমান ছিল সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। খুব শান্তশিষ্ট ও অনুগত। দীর্ঘ ৬ বছরের মধ্যে তাকে মাদ্রাসার সকল শিক্ষক ও হল সুপার একজন ভালো ছাত্র হিসাবে পেয়েছিলেন। তার চেহারার স্বর্গীয় আভা প্রস্ফুটিত হতো। বিবেকবান ঈমানদার প্রতিটি মানুষ এধরনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে ব্যাথিত মর্মাহত না হয়ে পারে না।

একনজরে শহীদ আমান উল্লাহ আমান

নাম : শেখ আমানুল্লাহ আমান
পিতা : মরহুম শেখ শহীদুল্লাহ
মাতা : মোসাম্মৎ মনোয়ারা খাতুন
ভাই বোন : ২ ভাই ৪ বোন, ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন।
জন্ম তারিখ : ১৯৭৯ ইং
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম+ডাক: দরগাহপুর, থানা : আশাশুনি, জেলা : সাতক্ষীরা।
শিক্ষাজীবন : শাহাদাতের সময় তিনি খুলনা আলিয়া মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন এবং মাদ্রাসার হোষ্টেলে এতিমখানায় অবস্থান করতেন।
সাংগঠনিক জীবন : শাহাদাতের সময় তিনি সংগঠনের কর্মী ছিলেন।
আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে খুলনা আলীয়া মাদ্রাসার এতিমখানার ডাইনিংয়ে খাবারত অবস্থায়।
শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ঐ দিন দুপুরেই ঘটনাস্থলে শাহাদাত বরণ করেন।
আঘাতের ধরন : গুলি করে হত্যা।
হত্যাকারী : জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
শহীদক্রম : ৫৭ তম।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ শেখ আমানুল্লাহ্ আমান

পিতা

শেখ শহীদুল্লাহ

মাতা

মোছাম্মৎ মনোয়ারা খাতুন

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১, ১৯৭৯

ভাই বোন

২ ভাই ৪ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানার দরগাপুর গ্রামে

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

নবম শ্রেনী, খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা

শাহাদাতের স্থান

খুলনা আলিয়া মাদ্রাসার ডাইনিং