বুধবার, ২৮ আগস্ট ২০২৪

শিক্ষার আদর্শ - অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান

আফ্রিকার ঘানার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং পণ্ডিত যিনি এক সময় ঘানার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই ডক্টর কুফি বুসিয়া আফ্রিকান দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “বিদেশী শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে স্বাধীন অবস্থায় আমরা যদি অগ্রসর হই তাহলে আমাদের সমূহ ক্ষতি হবে। এই কারণে ক্ষতি হবে যে আমরা স্বাধীনতার তাৎপর্য অনুভব করতে পারব না এবং পূর্বতন শিক্ষাধারার অনুসরণে আমরা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবো। তার ফলে জীবনের যথার্থ পরিস্ফুটন ঘটবে না।” তিনি সেজন্য চেয়েছিলেন যে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অর্থাৎ আফ্রিকার মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতে তাদের ইচ্ছার ভিত্তিতে এবং তাদের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে তাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাগুলো গড়ে উঠুক। তিনি এ জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সফলকাম হতে পেরেছিলেন এটা বলা যায় না ।


কুফি বুসিয়ার এই মন্তব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিদেশীরা বিশেষ করে ইংরেজরা পৃথিবীর যে সব দেশ অধিকার করেছিল সে সমস্ত দেশে তারা তাদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। ভারতবর্ষেও তেমনি ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। সেখানে কতকগুলো প্রয়োজন ছিল। একটি হচ্ছে প্রশাসনের জন্য কর্মচারী তৈরি করা, দ্বিতীয় হচ্ছে দেশের পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং পুলিশ ব্যবস্থাকে একটি ধারায় গতিমান করার জন্য পুলিশি প্রশিক্ষণের একটি বিশেষ ব্যবস্থা করা, যে ব্যবস্থাটি এদেশে ছিল না। তেমনি আবার সাধারণভাবে কতকগুলো নৈতিক শিক্ষা এবং কতকগুলো বিশ্বাসের প্রতিফলন তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আরোপ করেছিল। এভাবে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ইংল্যান্ড ভারতের জন্য কী করেছে সেই রকম একটা গ্রন্থ ছিল স্কুলের পাঠ্যসূচিতে। তাছাড়া খ্রিস্টানদের যে বাইবেল সেই বাইবেলও পাঠ করার ব্যবস্থা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে। বাইবেল পাঠের ব্যবস্থা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভাল ইংরেজি শিখবার জন্য। যেভাবেই হোক অর্থাৎ সেই শিক্ষার বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল খ্রিস্টান এবং দ্বিতীয়ত সেই শিক্ষার প্রয়োজনের ভিত্তিও ছিল ভারতে ইংরেজ শাসনকে দৃঢ়ও স্থায়ী করা। এই ইংরেজ শাসনের সময় এখানকার মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল, হিন্দুদের জন্য টোল শিক্ষা ছিল কিন্তু এই মাদ্রাসা অথবা টোল সাধারণ শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। অর্থাৎ, মাদ্রাসা থেকে যারা বেরিয়ে আসত অথবা টোল থেকে যারা বেরিয়ে আসত তারা প্রশাসনিক কর্মের জন্য উপযুক্ত হতো না। তারা দেশের ধর্মীয় কর্মের জন্য উপযুক্ত হতো। বলা যেতে পারে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল এক রকমের থিয়োলজিক্যাল স্কুল। অর্থাৎ দ্বীনি শিক্ষা। মুসলমানরা তাদের ধর্ম আচরণের জন্য যে সমস্ত শিক্ষার প্রয়োজনবোধ করেছিল মাদ্রাসার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে যারা আসত, সেই সময় তারা সাধারণ জীবনের উপযোগী হতে পারতো না। এই ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষাটা মোগল আমল থেকেই চালু হয়েছিল। মোগলরাও সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার মধ্যে টেনে আনতে চাননি এবং শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চৈতন্যোদয় হোক এটাও তারা চাননি। সেই কারণে সাধারণ মানুষকে তারা একটি বদ্ধকূপের মধ্যে নিমজ্জিত রাখতে চেয়েছিলেন। তাই অগণিত হিন্দু জনসাধারণ ও মুসলমান জন- সাধারণ তাদের ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। রবীন্দ্রনাথ তার একটি প্রবন্ধের মধ্যে একটি সুন্দর কথা বলেছেন। বলেছেন, “আমাদের দেশের রাজার পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তন হয় না এবং তারা জানেও না কোথা দিয়ে কোন পরিবর্তন হচ্ছে।” অর্থাৎ দেশের প্রশাসনের যে মূলধারা, সেই মুলধারার চৈতন্য থেকে সাধারণ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেই বিচ্ছিন্নতা সংরক্ষিত হয়েছিল বৃটিশ আমলেও ।


শামসুল উলামা আবু নসর ওহীদ নামক একজন প্রাজ্ঞ বিবেচক পণ্ডিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন, একটা নতুন কাঠামো নির্মাণ করেন এবং সেই কাঠামোকে নিউ স্কিম আখ্যা দেন। এই নিউ স্কিমের মধ্যে তিনি ইংরজি শিক্ষা আনেন; বিজ্ঞান শিক্ষা আনেন আবার আরবি শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষাও রাখেন। ধর্মীয় শিক্ষা এবং ইংরেজী শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তিনি একটি স্কিম তৈরী করেছিলেন, সেই স্কিম এক সময় এদেশে বেশ সুন্দরভাবে চালু ছিল। এর ফলে এই শিক্ষার মাধ্যমে যারা তখন বেরিয়ে এসেছিলেন তারা প্রত্যেকেই জীবন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, কর্মকাণ্ডে তারা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং খ্যাতিও পেয়েছিলেন প্রচুর। অর্থাৎ এই শিক্ষাটা একদিন থেকে সেই সময় একটা সুন্দর সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা হিসাবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান যখন হলো, পাকিস্তান আমলে সর্ব প্রথম আক্রান্ত হলো মাদ্রাসার নিউ স্কিম শিক্ষা ব্যবস্থা।


নিউ স্কিম শিক্ষাব্যবস্থাকে বন্ধ করে দেয়া হল। প্রথমে এ শিক্ষাব্যবস্থাকে বন্ধ করে মাদ্রাসার পুরাতন শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত রাখা হল এবং ইংরেজি শিক্ষাকে মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হল। আবু নসর ওহীদ সাহেবের চেষ্টা ছিল নিউ স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে দ্বৈততা বিদ্যমান অর্থাৎ, একদিকে ইংরেজি শিক্ষা আরেক দিকে আরবি শিক্ষা- এই দ্বৈততা দূর করার জন্য একটি মধ্যবর্তী পথ নির্মাণ করা। তাতে সেই পথে মাদ্রাসার ধারায় ছাত্ররা এসেছে, সাধারণ শিক্ষার ধারা থেকেও ছাত্ররা এসেছে। এই সমন্বিত ধারাটা একক ধারা হিসাবে যখন গড়ে উঠতে যাচ্ছিল; সেই সময় পাকিস্তান আমলে এই শিক্ষা ধারাটকে বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দিয়ে আবার শিক্ষাব্যবস্থার দ্বৈততা বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় অর্থাৎ এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা আরেক দিকে আধুনিক শিক্ষা-এই দুই শিক্ষার মধ্যে তারা কোন সমন্বয় সাধন করেননি। আরেকটা জিনিস এই পাকিস্তান আমলে ঘটে তা হচ্ছে-এই শিক্ষার যে মূল ভিত্তি নেই ভিত্তিটা কী হবে সেটা তারা গুরুত্বভাবে চিন্তা করেননি। শুধু সাধারণভাবে একথা বলা হয়েছে শিক্ষার মূল ভিত্তি হবে জাতীয় ঐক্য সম্পাদন। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন তারা গঠন করেছিলেন তাতে জাতীয় পুনর্গঠন, অর্থাৎ পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জাতি আছে সেই সমস্ত জাতি সম্মিলিত হয়ে একক পাকিস্তানি জাতি নির্মাণ করবে এদিকেই তাদের লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা সাধারণ শিক্ষার যে পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করলেন এবং সিলেবাস পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করলেন সেগুলো কিন্তু আমাদের নৈতিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়নি, সেগুলো মূলত ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থারই একটু পরিবর্তন মাত্র ।


সেই সময় আমেরিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে এবং আমেরিকার কিছু শিক্ষাপদ্ধতি আমরা আমাদের দেশে গ্রহণ করি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সোস্যাল ওয়েলফেয়ার, আরেকটি হচ্ছে হোম ইকোনমিকস, আরেকটি হচ্ছে বিজনেস অ্যাডমিনস্ট্রেশন। এই প্রধান প্রধান তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে নতুন করে আনা হয়। এই তিনটি শিক্ষাব্যবস্থাই কিন্তু কর্মসংস্থানের জন্য। বিজনেস অ্যাডমিনস্ট্রেশনের মাধ্যমে একজন ছাত্র দক্ষতা অর্জন করে জীবনে কর্মসম্পাদনের জন্য উপযুক্ত হবে। হোম ইকনমিকস ও কর্মসংস্থানের জন্য তেমনি সোস্যাল ওয়েলফেয়ারও কর্ম সংস্থানের জন্যই। এই তিনটি কর্মসংস্থানগত শিক্ষাব্যবস্থা এই দেশে আসে কিন্তু এর কোন আদর্শগত ভিত্তি ছিল না। এই আদর্শগত ভিত্তি বলতে আমি বুঝেছি এর পেছনে মানুষের ঐতিহ্যের কোন সাড়া ছিল না, মানুষের ধর্মের কোন সাড়া ছিল না, ধর্ম চিন্তার, ধর্ম বিশ্বাসের কোন ভিত্তি ছিল না। এগুলো ছিল কর্মসংস্থানগত শিক্ষা। অর্থাৎ এক কথায় এগুলো ছিল এক অর্থে ধর্মবিহীন শিক্ষাধারা। সুতরাং এই পাকিস্তান আমলে কর্মসংস্থানগত শিক্ষাধারা প্রবর্তন করতে গিয়ে ধর্মবিহীন একপ্রকার শিক্ষাধারা গড়ে ওঠে এবং মূল শিক্ষার মধ্যে একটি নতুন সংযোজন হিসাবে এই শিক্ষাটা এসে উপস্থিত হয়। এই শিক্ষাটা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত নয়। লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে, সে সময় একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা পাকিস্তান অনুভব করেছিল যে উদ্দেশ্য হচ্ছে; আধুনিক জগতে আধুনিক মানুষের সমতুল্য মানুষ আমরা আমাদের দেশে তৈরি করবো। সুতরাং ইউরোপের আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের শিক্ষাকে সমন্বিত করে গড়ে তুলতে হবে। তার ফলে বিদেশী শিক্ষার ধারাক্রম এখানে এসে উপস্থিত হয় আরো প্রবল পরিমাণে। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে যে বিদেশী শিক্ষার ধারা আমাদের ছিল এই শিক্ষাই একটু নতুন করে নতুন পটভূমিতে নতুন প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হতে লাগলো। পাকিস্তান আমলে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় শিক্ষা কমিশনের মধ্যেও শিক্ষার ভিত্তি হিসাবে কোন আদর্শের কথা বলা হয়নি এবং সেটা বোঝা গেছে সেই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে সেটা হচ্ছে ছাত্রদেরকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু একটি কথা মনে রাখা দরকার মানুষকে সময়ের উপযোগী করে গড়ে তোলা তখনই সম্ভব যখন সে মানুষের একটা নৈতিক চরিত্র থাকে, একটা নৈতিক আদর্শ থাকে । সে নৈতিক আদর্শ তার জন্য নির্মাণ না করে সময়ের উপযোগী করে তুলবার যদি চেষ্টা করি তাহলে সে মানুষ ধর্মচ্যুত হবে, ধর্মকে অস্বীকার করবে। একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মের বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরিপূর্ণ করা, মানুষকে জীবন সম্পর্কে সচকিত করা এবং মানুষকে এই পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করা। ধর্ম তার সংস্কার নিয়ে নয় বরং ধর্ম হচ্ছে বিশেষ বিশ্বাস এবং আদর্শকে নিয়ে। এই আদর্শের ভিত্তি আমাদের শিক্ষার মধ্যে ছিল না, অতীতে এটা ছিল না এবং পাকিস্তান আমলেও শিক্ষার এই ভিত্তিটা আমরা নির্মাণ করার চেষ্টা করিনি এবং সক্ষমও হইনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে আন্দোলনের ইতিহাস আমরা জানি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই এই বিরোধভাবটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। অর্থাৎ আমরা একটা কলোনিতে পরিণত হয়েছিলাম প্রায় এবং সেই কারণে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, আমাদের দেশের জন- সাধারণ বিক্ষুদ্ধ হয়েছিল এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের একটা সংঘর্ষ বেধেছিল। সে সংঘর্ষের ফলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং ১৯৭২ সাল থেকে আমরা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে উল্লেখিত হতে থাকি।


কিন্তু এই সূত্রপাতে অর্থাৎ বাংলাদেশ হওয়ার সূত্রপাতে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করা হয়েছিল। এই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষ জানতো না এবং নেতৃবৃন্দও যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলেন তারাও জানতেন কি না-এ নিয়ে সন্দেহ আছে। তার কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেতে লাগলো ধর্মবিরোধিতায় রূপান্তরিত হলো এবং মুসলমান শব্দটিও তারা সব স্থান থেকে মুছে ফেলতে লাগলেন। যেমন- ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল' হয়ে গেল ‘সলিমুল্লাহ হল', জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মোহামেডান স্পোর্টিংকেও ব্যান্ড করে দেয়া হলো; কেননা সেখানে মোহামেডান শব্দটা আছে। অর্থাৎ কী ধরনের বিফল চিন্তা, বিফল মানসিকতায় এরা ভুগছিল এর দ্বারাই বোঝা যায়। অর্থাৎ দেখা গেলো ধর্মনিরপেক্ষতার ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হলো সে অবস্থা হচ্ছে ধর্মবিরোধী অবস্থা। প্রত্যেক দেশেই সব সময় কিছু লোক থাকে, থাকতে পারে যারা ধর্মকে মান্য করে না বরঞ্চ ধর্মবিরোধী চৈতন্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ থাকে। তারা সকলেই একটি সাড়া পেয়ে গেলো, আনন্দিত হলো, উৎসাহিত হলো এবং এই উৎসাহের জোগান আমরা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে তখন পেয়েছিলাম। এর ফলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হলো সে পরিবর্তন হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা।


ড. কুদরত-এ-খুদাকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এই শিক্ষা কমিশন শুধুমাত্র শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন অবিকল সেই ধরনের। এখানেও শিক্ষার কোন ভিত্তি হিসাবে ধর্মবিশ্বাসকে আনা হয়নি, ধর্মীয় চৈতন্যকে আনা হয়নি। ধর্মকে পুরোপুরি শিক্ষা থেকে বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। আমি বারবার এই বিচ্ছিন্নকরণের কথা বলছি এই জন্য যে বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত । একজন মানুষ একটি ধর্মের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে তার পরিবেশে তার পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে, তার সামাজিক চৈতন্যের মধ্যে কাজ করে সুতরাং তার সাহিত্য ও অন্যবিধ শিক্ষার মধ্যেও এই ধর্মীয় চৈতন্য কোন না কোনভাবে আসবেই, একে বাদ দিলে চলে না।


একটি ইংরেজ শিশু যখন বড় হয় সে কিন্তু তার ধর্মীয় শিক্ষা দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়। সে বাইবেলের সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত হয়, বাইবেলের গল্প কাহিনীর সঙ্গে সে পরিচিত হয় এবং খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন সংগ্রাম, বিভিন্ন ইতিহাস, বিভিন্ন ঘটনা তার সঙ্গে পরিচিত হয়। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের একটি ছেলে মূলত খ্রিস্টান হিসাবে কিন্তু গড়ে ওঠে। খ্রিস্টান হিসাবে গড়ে ওঠে তার অর্থ ধর্মান্ধ হয়ে গড়ে ওঠে না, তার উপলব্ধির মধ্যে ধর্মীয় একটা চেতনা সব সময় কাজ করে কিন্তু আমাদের সেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সে ধর্মীয় চেতনাকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হলো। পূর্বেও বাদ দেয়া হয়েছিল, পাকিস্তান আমলেও বাদ দেয়া হয়েছিল এবারও বাদ দেয়া হলো। আমরা যে চিন্তা করে বাদ দিয়েছি সে কথা আমি বলব না। ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মকে অস্বীকার করে যে শিক্ষা সিলেবাস পাঠক্রম তৈরি হয়েছিল তাও আমি বলব না। আমি বলব এদিকে তারা চিন্তাই করেননি। চিন্তা না করে তারা প্রথাগত যে পাঠ্যক্ৰম আছে তাকেই বজায় রেখেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য যেটার প্রয়োজন সেই বইগুলোই থাকবে, বাংলা ভাষার জন্য, সাহিত্য শিক্ষার জন্য সে ধরনের পাঠ্যসূচি তারা তৈরি করেছেন কিন্তু এই পাঠ্যসূচির বিষয় বলে একটা বস্তু আছে, সেই বিষয়টা কি শূকর নিয়ে আলোচনা না ডারউইন নিয়ে আলোচনা? সেই বিষয়টাতো আনতে হবে সেই বিষয়টাতো জীবনের বিষয় হবে সেই বিষয়ের বিশেষ একটা ভিত্তি থাকবে কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিষয়ের মধ্যে সেই ধরনের কোন ভিত্তি ছিল না। তার ফলে কুদরাত-এ-খোদা কমিশন একটা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের শিক্ষা কমিশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ ধরনের একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাক্রম হিসাবে এটা যে তৈরি হয়েছিল তা বলবো না।


বর্তমানে আমাদের সামনে এই কুদরত-এ-খোদা কমিশন আছে, তারপরে আরেকটি স্বল্পকালীন কমিশন গঠিত হয়েছিল, জাফর কমিশন বলা যেতে পারে, সে কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে আমরা জানি না। সম্প্রতি আরেকটি কমিশন গঠিত হয়েছে তারাও যে কী করেছেন তাও আমরা জানি না । অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কোন সময়েই শিক্ষা কমিশনের উদ্দেশ্য এদেশের অতীত, এদেশের বিশ্বাস এদেশের মানসিকতা, এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। কেননা এই শিক্ষা কমিশনের সদস্যবর্গ তারা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, বিদেশ ভ্রমণ করে বিদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেশের সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সাধারণ মানুষের সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করে, সাধারণ মানুষে বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করে তারা কিন্তু এটা করেননি। কারণ যখনই কোন শিক্ষা কমিশন হয়েছে দেখা গেছে শিক্ষা কমিশনের সদস্যরা বিদেশে যাওয়ার জন্য আগ্রহী, ব্যাকুল হয়ে যান। একজন জাপানে যান, একজন রাশিয়া যান, একজন আমেরিকায় যান এবং পাঁচদিন, পনের দিন থেকে এসে তাঁরা শিক্ষাব্যবস্থার একটা পরিবর্তন আনবার চেষ্টা করেন কিন্তু একথাও শুনিনি কখনো যে শিক্ষা কমিশনের সদস্যরা গ্রামের ভেতরে গেছেন গ্রামের মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন, তাদের পারিবারিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করেছেন, তাদের বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন, তারা কিভাবে গড়ে উঠছেন সেটা চিন্তা করেছেন। তাতো করেনা। চীন দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা আছে সে শিক্ষাব্যবস্থা তাদের দেশের মানসিকতার সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে যুক্ত। চীন দেশে সে শিক্ষাব্যবস্থা এককভাবে চীন দেশের জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক দেশ, তাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের যে শ্রেণী চৈতন্য সেই শ্রেণী চৈতন্যের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গড়ে উঠেছে। সুতরাং এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক আমাদের বিশ্বাসের, আমাদের জীবন যাপনের, আমাদের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেনি। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এমন একটা সময় এসেছে, যখন আমাদের কর্তব্য হবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশের চৈতন্যের সঙ্গে যুক্ত করা, দেশের মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করা, দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা, দেশের মানুষের প্রতিদিনের জীবন যাপন প্রণালির সাথে যুক্ত করা। যে পর্যন্ত তা আমরা করতে সক্ষম না হচ্ছি সে পর্যন্ত কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ ঠিক আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত হবে না। অর্থাৎ আমাদের দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষের পাশাপাশি দাঁড়ালে অন্য দেশের মানুষের চিন্তা চৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হয়েই কাজ করবে কিন্তু নিজেদের দেশের চিন্তা চৈতন্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কোন কাজ করবে না। এখন একটি পরিশীলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যে পরিশী- লিত ব্যবস্থার সাহায্যে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারবো।


শিক্ষার একটি আদর্শগত ভিত্তি আছে। সেই আদর্শগত ভিত্তি মূলত ধর্মের ভিত্তি। আমরা জানি যে ধর্ম মানুষকে অনুশাসন দেয়, ধর্ম মানুষকে নির্ভরতা দেয়, ধর্ম মানুষকে আদর্শ সম্পর্কে সচেতন অর্থাৎ মানুষ যে পৃথিবীতে জীবন যাপন করবে সেই জীবন যাপনের অধিকার তার অর্জন করতে হবে। এই অধিকার সে অর্জন করে বিজয়ের সাহায্যে, বিশ্বাসের সাহায্যে এবং অন্তগূঢ় চৈতন্যের সাহায্যে। যদি আমাদের বিশ্বাস না থাকে এবং অন্তগূঢ় কোন চৈতন্য না থাকে তাহলে শিক্ষা শুধু সাধারণ অবস্থায় পর্যবসিত হবে এবং সে শিক্ষার দ্বারা একটি জাতি কখনও উপকৃত হবে না। মনে রাখতে হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা, মানুষকে পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা, মানুষকে তার জাতি এবং মানুষকে পৃথিবীর সঞ্চয় সম্পর্কে সাবধান করা । এটা না হলে শিক্ষার আদর্শ হয় না অথচ ধর্ম এই আদর্শগুলো আমাদের শিক্ষা দেয়। অথচ পাশ্চাত্যের যে শিক্ষা আমাদের দেশে এসেছে সে শিক্ষার মধ্যে ধর্মের এই ভিত্তি নেই । আমরা ইংল্যান্ডে লক্ষ্য করি, ইংল্যান্ডের চার্চ প্রশাসনের অধীনে যে সমস্ত স্কুল আছে তাদের একটা ধর্মীয় ভিত্তি আছে শিক্ষার কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এই ধর্মীয় ভিত্তি তারা স্বীকার করেননি। যার ফলে জ্ঞান লাভটা শুধুমাত্র জ্ঞান লাভেই পর্যবসিত হয়েছে। জ্ঞানলাভের প্রয়োজনটা কী তা কিন্তু ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। জ্ঞানের একটা প্রয়োজন হচ্ছে মানুষ যথার্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা, জ্ঞানের একটা প্রয়োজন হচ্ছে মানুষকে পূর্ণাবয়ব মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। জ্ঞানের একটা লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। আমরা জানি ধর্ম আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দেয় । তার মধ্যে প্রধান শিক্ষা হচ্ছে মানবতাবোধের শিক্ষা, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, মানুষ মানুষে হৃদ্যতা, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি এগুলো ধর্মের মাধ্যমেই আমরা শিক্ষা লাভ করে থাকি । এটা না হয়ে শিক্ষাটা যদি হয় শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য, অর্থাৎ জীবন ক্ষেত্রে কর্মের উপযোগী হওয়ার জন্যই যদি শিক্ষা হয় তাহলে মানুষ এই মেটেরিয়াল পৃথিবী যেটা, এই যে রূঢ় বাস্তবজগৎ সেই জগতের প্রয়োজনের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত রাখবে। নিজের স্বার্থের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখবে। সকল মানুষের জন্য সে কল্যাণকামী হবে না। এই যে, স্বার্থপরতা সেটা এক প্রকার স্বার্থপরতার শিক্ষা দেয় কিন্তু ধর্ম স্বার্থপরতা শিক্ষা দেয় না। ধর্ম স্বার্থবিমুক্ত শিক্ষা দেয়। সেই কারণে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমলের কাঠামোকে ঠিক রেখে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করা হয়েছিল এবং পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোকে অবিকল রেখে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে সুতরাং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মূলত কোন পরিবর্তন আসেনি। দেশের প্রয়োজন ও ধর্মের প্রয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করতে পারেন যে, শিক্ষার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা যদি বিচ্ছিন্নভাবে প্রবেশ করে তাহলে ধর্মীয় শিক্ষাটি একটি ভিন্ন উপকরণ হিসাবে লোকেরা গ্রহণ করবে। যেমন একজন ইতিহাস পড়ছে আবার সে ভূগোলও পড়ছে আবার সে-ই-ইংরজি পড়ছে আবার সে অংক করছে। এই ভূগোলের সঙ্গে ইতিহাসের অথবা ইতিহাসের সঙ্গে অংকের এগুলোর কোন সম্পর্ক নাই। পরস্পর কোন সম্পর্ক নাই। এগুলো প্রতিটি বিদ্যাই যেন স্বয়ং সম্পূর্ণ। তেমনি ধর্মীয় শিক্ষা যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয় সেটাও একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন শিক্ষা হিসাবে এর সঙ্গে যুক্ত হবে। বিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হয়ে ধর্মীয় শিক্ষাটাও পূর্ণাঙ্গ হবে না এবং অন্য শিক্ষাটাও পূর্ণাঙ্গ হবে না ।


আমি কথাটা আরেকটু বিশদভাবে বুঝিয়ে বলছি একটি পাঠ্যক্রমের মধ্যে কতগুলো পাঠ্যসূচি অনুসারে আমি একটা জ্ঞান লাভ করতে পারি। কিন্তু ধর্মীয় পাঠ্যসূচি একটি ভিন্নভাবে যদি থাকে তাহলে অনেক সময় দেখা যাবে ধর্মীয় পাঠ্যসূচির বিপরীত জিনিস এই পাঠ্যসূচিতে এসে উপস্থিত হয়েছে কেননা ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত এটাকে করা হয়নি সুতরাং ধর্মীয় পাঠ্যসূচি যা শিক্ষা দেয় এই পাঠ্যসূচি হয়ত তার বিপরীত শিক্ষা দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ একটি কথা বলা যায়, যেমন ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিসে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে বক্তব্য। ধর্মীয় শিক্ষা বলে, বাইবেলের শিক্ষাও বলে, ইসলামের শিক্ষাও বলে এবং অন্যান্য ধর্মের শিক্ষাও বলে যে, মানুষকে বিধাতা মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। অন্য কোন প্রাণী থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটেনি এবং পরবর্তীতে মানুষ অন্য কোন প্রাণীতেও পরিণত হবে না। মানুষ হিসাবে মানুষের আকৃতি বা স্বভাবের যুগে যুগে কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। আকৃতির পরিবর্তন বলছি আমি এই অর্থে যে এক সময় মানুষ হয়ত খুব বেশি লম্বা ছিল। বর্তমানে মানুষ অন্য আকৃতি ধারণ করেছে, তার চেয়ে সাইজে ছোট হয়েছে। কিন্তু তাই বলে মানুষের অবয়ব নষ্ট হয়নি। কিন্তু ডারউইন যে কথা বলেছেন তার সাথে এ কথা মেলে না। তাছাড়া সৃষ্টির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ডারউইনের যে ধারণা এবং বিশ্বাস তার সঙ্গে ইসলামের অথবা বাইবেলের অথবা অন্য ধর্মের বিশ্বাস মেলে না। কিন্তু আমি পাঠ্যপুস্তকে হয়ত ডারউইনের জীবনী পড়াব, আর জীব সৃষ্টির অন্য উৎস পড়ার এ দুটোতে মিলছে না । সেই কারণে প্রয়োজন হচ্ছে ধর্মের যে মূল আদর্শগুলো সেই আদর্শের দ্বারা অন্য পাঠ্যক্রমকে পরিশোধিত করা।


ফিজিকসই পড়ি, কেমেস্ট্রিই পড়ি অথবা সাহিত্য পড়ি যা কিছুই পড়ি না কেন ধর্মের আদর্শের দ্বারা তা যেন পরিশোধিত হয় অর্থাৎ প্রতিটি বক্তব্যের মধ্যে বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ যেন থাকে এবং বিশ্বাসের দ্বারা প্রতিটি পাঠ্যসূচি যেন পরিশুদ্ধ হয় এবং প্রতিটি পাঠ্যসূচি যেন বিবেচিত হয়। এটার প্রয়োজন আছে কিন্তু এটা আমাদের দেশে হয়নি, পৃথিবীর কোন দেশেই এ রকম হয়নি। কিন্তু বর্তমানে একটা চেষ্টা চলছে পৃথিবীর সর্বত্রই যে একটা বিশ্বাসের পটভূমি শিক্ষার জন্য রাখা প্রয়োজন। জীবন ধারণের জন্য যেমন প্রয়োজন শিক্ষার জন্যও তেমনি প্রয়োজন। যারা নাস্তিক এবং যাদের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হচ্ছে নাস্তিকতা তারাও নাস্তিকতাকেই তাদের সমস্ত শিক্ষার পটভূমি করে অর্থাৎ তাদের বিশ্বাসটি হচ্ছে নাস্তিকতা। সে নাস্তিকতকে পটভূমি করেই তারা কিন্তু তাদের সকল পাঠ্যসূচি নির্মাণ করেছে । ইতিহাসের, ভূগোলের, অর্থনীতির, সকল ধরনের পাঠ্যসূচি তারা এই নাস্তিক্যবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি করেছে। তাই দেখা যায় অর্থনীতি বিষয়ে তাদের যে শিক্ষা সে শিক্ষার সঙ্গে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শিক্ষার সাথে মেলে না অথবা ইতিহাস সংক্রান্ত তাদের যে শিক্ষা সেই শিক্ষার সঙ্গে অন্য দেশের ইতিহাসের শিক্ষার সাথে মেলে না। একেবারেই মেলে না। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর এদিক থেকে বিরাট একটা সততা আছে। তারা যা বিশ্বাস করে সে বিশ্বাসকে তারা তাদের পাঠ্যক্রমে বিচ্ছিন্নভাবে করেনি, সেই বিশ্বাসের দ্বারা পাঠ্যক্রমকে তারা পরিশোধিত করেছে, পাঠ্যক্রমকে সংশোধন করেছে এবং পাঠ্যক্রমকে লালন করেছে।


তাদের বিশ্বাস হচ্ছে নাস্তিকতা, আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা। সুতরাং এই দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ রয়েছে। সেই কারণে আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে আমাদের বিশ্বাসকে পরিমার্জনা করা এবং নতুন সময়ের উপযোগি করে গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে আমি আরেকটি কথা বলবো যে কথাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জীবনের জন্য, আমাদের দেশের জন্য সে কথাটি হচ্ছে একটি দেশের রাজনৈতিক বিতর্ক থাকতে পারে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন মনোভঙ্গির মানুষ পাওয়া যায়। কোন মানুষ হয়তবা নাস্তিক কিন্তু এইসব মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা সমাজকে শাসন পর্যন্ত করছে না এবং এরা বিশ্বাসী ধারার স্রোতের বাইরে, এই অর্থে বাইরে যে অজস্র মানুষের বিপুল স্রোত চলেছে সে স্রোতের মধ্যে এরা যুক্ত নয় । সুতরাং এদের দ্বারা স্রোত নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না, স্রোতের গতিতো এদের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যক্রমে এমন হয়েছে যে আমরা এই স্রোতের গতি এই দুই একজন মানুষের জন্য পরিবর্তন করতে চাই, চেষ্টা করছি অথবা এই দু একজন মানুষের চিৎকারে বিচলিত হয়ে এই স্রোতের গতির মধ্যে আমরা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই স্রোতের গতিতে পরিবর্তন আনা যায় না। আনা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়। সেই কারণে বিশ্বাসকে ভিত্তিমূল করে আমাদের শিক্ষার পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করতে হবে।


মাওলানা আবুল কালাম আজাদ একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন যে কুরআন শরীফের সূরা আল ফাতেহা যে ভালভাবে পাঠ করে সে খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, জৈন হোক অথবা যে কোন ধর্মাবলম্বী হোক সে ন্যায়বান, আদর্শবান, প্রজ্ঞাবান যথার্থ কুশলী মানুষ হতে বাধ্য। তার কারণ এই সূরা আল ফাতেহার মধ্যে সকল বিশ্বাসের অন্তঃসারটা আছে । সৎপথে যাবার জন্য প্রার্থনা আছে, অসৎ পথগামী যারা তাদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবার আকাঙ্ক্ষা আছে এবং বিশ্বাসের অনুকূলে সত্যকে আবিষ্কার করবার একটা আকাঙ্ক্ষা প্রবল বিদ্যমান। মাওলানা আজাদ বলেছেন এভাবে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সূরা আল ফাতিহা হচ্ছে একটি আদর্শ ভাষণ। এর ভিত্তি করেই সাহিত্য ও শিক্ষাকে নির্মাণ করতে হবে। অর্থাৎ সাহিত্যের মূল আদর্শ হবে ন্যায় পথে চলা, শিক্ষার মূল আদর্শ হবে মানুষকে ন্যায় পথে প্ররোচিত করা, অন্যায় পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসা এবং পৃথিবীতে যারা অধঃগামী যারা অন্যায় পথচারী তাদের সাহচর্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়া। যারা ন্যায়বান, সদাচারী তাদের সঙ্গে মানুষকে একত্রিত করা এটাই হচ্ছে বিশ্বাসের ভিত্তি। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এই বিশ্বাসের ভিত্তিটি একান্তভাবে প্রয়োজন। এটা সত্য যে, পৃথিবীর অন্যান্য মুসলমান দেশেও শিক্ষার ভিত্তি কিন্তু ঠিক আদর্শগতভাবে ইসলামী ভিত্তি এটা বলা যায় না। কিন্তু সম্প্রতি মক্কা ঘোষণার পর প্রতিটি মুসলমান দেশে এ বিষয়ে অনুসন্ধান আরম্ভ হচ্ছে। মক্কা ঘোষণায় পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ একটি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলেছিলেন যে, আমরা একটা সাম্য নির্মাণ করার চেষ্টা করবো মুসলমান উম্মার মধ্যে, একটা সমতা, একটা ঐক্য নির্মাণের প্রয়াস পাবো। দ্বিতীয়, বিশ্বাসকে ভিত্তি করে আমাদের জীবন আমরা পরিচালিত করবো। তৃতীয়, আমাদের সকল মুসলমান দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি ঐক্যতত্ত্ব থাকবে অর্থাৎ বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে আমাদের সকল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উপপাদ্য। এরই উপর নির্ভর করে বর্তমান সৌদি আরবে পাঠ্যসূচি পাঠ্যক্রম সংশোধনের প্রয়াস চলছে, মিসরের পাঠ্যক্রম সংশোধনের প্রয়াস চলছে, মালয়েশিয়ায় এ প্রয়াস চলছে কিন্তু আমাদের দেশে এ প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করি না।


আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা একটা বিচ্ছিন্ন শিক্ষা হিসাবে বিদ্যমান। আর সাধারণ শিক্ষা যাকে ইংরেজি শিক্ষা বলি এখনও নাম হল ইংলিশ হাইস্কুল, উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় সেই শিক্ষাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে আলাদাভাবে চলেছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে নানাভাবে আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে এবং এই শিক্ষাকেও বিভিন্নভাবে আধুনিকীকরণের চেষ্টা চলছে। তার ফলে না মাদ্রাসা শিক্ষা যথার্থ থিয়োলজিক্যাল শিক্ষা হচ্ছে না আধুনিক শিক্ষা যথার্থ আধুনিক শিক্ষা হচ্ছে। মূলত একটি দেশে একই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন তা না হলে একটি জাতি সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধিশালী হয় না।


মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষা এই দুয়ের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে আনতে হবে। এ ব্যবধান ঘুচিয়ে আনা সম্ভবপর এই ভাবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে আরম্ভ করে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষা বলি কিংবা স্কুল বলি কিংবা কারিগরি শিক্ষা বলি সকলের জন্য একই কারিকুলাম থাকবে। একই ধরনের মৌল পাঠ্যসূচি থাকবে, এর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতে পারবে না। সমপ্ত শ্রেণীর পর পার্থক্যগুলো আসবে। যে কারিগরি শিক্ষায় যেতে চায় সে কারিগরি শিক্ষায় যাবে, যে পুরোপুরি ধর্মীয় শিক্ষায় যেতে চায় সে ধর্মীয় শিক্ষায় যাবে, যে বিজ্ঞান শিক্ষায় যেতে চায় সে বিজ্ঞান শিক্ষায় যাবে, যে প্রকৌশল শিক্ষায় যেতে চায় সে প্রকৌশল শিক্ষায় যাবে, যে সাধারণ শিক্ষায় যেতে চায় সে সাধারণ শিক্ষায় যাবে। কিন্তু ঐ যে মৌল কাঠামোটি তাকে এমন করতে হবে যে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হলে একজন কারিগরী শিক্ষার ধারাক্রম অনুসরণ করতে সক্ষম হবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হলে একজন কারিগরী শিক্ষার ধারাক্রম অনুসরণ করতে সক্ষম হবে। মাদ্রাসা শিক্ষার ধারাক্রম অনুসরণ করতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞান শিক্ষার ধারাক্রম অনুসরণ করতে সক্ষম হবে এবং সাধারণ ধারাক্রম অনুসরণ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ নিম্ন পর্যায়ের ঐ শিক্ষাটাই হচ্ছে Basic শিক্ষা। সেই শিক্ষার মধ্যে এই ধর্মীয় ভিত্তিটা এনে দিতে হবে, বিশ্বাসের ভিত্তিটা এনে দিতে হবে এবং সকল শিক্ষার উপযোগী কার্যক্রম, উপযোগী ভূমিকা এবং সূত্রপাত এই শিক্ষার ভেতর দিয়ে দিতে হবে। যে পর্যন্ত না এনে দিতে পারছি সে পর্যন্ত আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনে সক্ষম হবো না।


বর্তমান কালে আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে শিক্ষার এই দ্বিধাবিভক্তি দূরীকরণ। আমরা বহুদিন আগে থেকে এ দূরীকরণের কথা বলেছি কিন্তু আমরা পূর্ণভাবে শুধু নয় একেবারেই সক্ষম হয়নি। সুতরাং আমার প্রস্তাব হচ্ছে নিউ স্কিমের সেই মৌল ভিত্তিটাকে নতুন করে আবিষ্কার করে তাকে আমাদের পাঠ্যসূচির মূল উৎস হিসাবে গ্রহণ করা। এবং তারপর বিভিন্ন ধারাক্রম নির্ধারিত করা। যদি এভাবে অগ্রসর হতে পারি তাহলে বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমুচ্চারিত হয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নতুন পথ নেবে এবং আমরা জীবনে যথার্থ সমৃদ্ধ এবং সার্থক ও সফল হতে পারবো।

লেখক: সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় অধ্যাপক।
‘ফিজিকসই পড়ি,
কেমেস্ট্রিই পড়ি অথবা
সাহিত্য পড়ি যা কিছুই
পড়ি না কেন
ধর্মের আদর্শের দ্বারা
তা যেন পরিশোধিত হয়’
                                   ..অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান