শুক্রবার, ৩০ আগস্ট ২০২৪

অনুবাদ: মোহাম্মদ আবদুল মান্নান

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের ভূমিকা - মুহাম্মদ কুতুব

ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলার সাথে সাথেই আমাদের সামনে প্রচলিত ও প্রাতিষ্ঠানিক এক বিশেষ ধরনের ধর্মীয় পাঠদানের চিত্র ভেসে ওঠে। ধর্মীয় শিক্ষার এই স্বাভাবিক সীমার বাইরে যদি চিন্তাকে প্রসারিত করি, সেখানে ধর্মোপদেশ বা ওয়াজ নসিহতের চৌহদ্দিতে গিয়ে তা আটকে পড়ে। তার বাইরে আর এক কদমও অগ্রসর হওয়া যাবে না। বস্তুত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা যা শিখাই, তা ধর্মীয় শিক্ষা নয়। ইসলামী শিক্ষা তো নয়ই।


মুসলিম দুনিয়ায় অধিকাংশ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে একটা দায়সারা ভাব বিদ্যমান। ধর্মীয় শিক্ষার প্রশ্নে এ অনাগ্রহ উদ্দেশ্যমূলক হলে ফলাফল যা দাঁড়ায়, এ শিক্ষা প্রচলনের আগ্রহ সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি না জানলে তার ফলাফলও ভিন্নরূপ হবে না। অর্থাৎ এ উভয় অবস্থায় ফল হবে অভিন্ন। তাহলো আমাদের ছেলে-মেয়েরা ইসলামী শিক্ষার সত্যিকার আদর্শ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে । আমাদের পাঠ্যক্রমে যথাযথ ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার প্রভাব অনুপস্থিত । প্রচলিত ধারার ধর্মবিষয়ক আনুষ্ঠানিক পাঠ সমকালীন মানবীয় চাহিদা পূরণেও যথেষ্ট নয়। মাত্রাতিরিক্ত ধর্মোপদেশ ও বক্তৃতা ধর্মকে আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়করূপে উপস্থিত না করে বরং বিরক্তি উদ্রেক করে এবং ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আমাদেরকে খোলাখুলি ও দ্ব্যর্থহীন অকপটতার সাথে এ সত্য স্বীকার করতে হবে যে, ধর্ম এখন আমাদের জীবন ও উপলব্ধি থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধর্মকে যেভাবে অনুসরণ করা দরকার আমরা সে ভাবে করি না। মুসলিম দুনিয়ার অধিকাংশ এলাকায় শরিয়ার অনুশাসন মানা হয় না। আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণকারী আইন ও বিধানসমূহ ইসলামী শরিয়ার নীতি থেকে উৎসারিত নয়। মোদ্দা কথা, আমাদের জীবন আল্লাহর বিধি-বিধান অনুযায়ী পরিগঠিত নয়। ইসলামী শরিয়ার বিধানে ঈমান, ইবাদত, আমল, অনুভূতি, আচরণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি সকল দিক ও বিভাগেরই নির্দেশন বিদ্যমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের চিন্তা-চেতনা বোধ-বিশ্বাস, রীতি-নীতি, প্রথা-পদ্ধতি, আবেগ অনুভূতি, আমাদের নৈতিকতা ও আচরণ ধারা ইসলাম থেকে উৎসারিত নয়। বরং আমরা যা অনুসরণ ও অবলম্বন করি তার অধিকাংশই পৃথিবীর এমন সব অঞ্চল ও উৎস থেকে পেয়েছি, যেখানে ইসলাম অপরিচিত ও অপরিশ্রুত। অর্থাৎ যারা ইসলামে বিশ্বাসী নয়, তাদের আদর্শই আমাদের জীবনে প্রাধান্য বিস্তার করে বসেছে। ধর্মকে এখন আমরা যেভাবে উপলব্ধি করি, আমাদের কাছে ধর্মের যে আবেদন, তার সাথে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের উপলব্ধির পার্থক্য অনেক বেশি। প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কাছে ধর্ম যে সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গরূপে নিয়ে উপস্থিত ছিল, আমাদের অবস্থান তার থেকে অনেক দূরে। আমাদের ধর্মীয় উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্যের পাদ্রিতন্ত্রের সাথে অনেক বেশি সাদৃশ্যমূলক। ধর্ম যেখানে বাস্তব জীবনের বাইরে স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে প্রভু ও ভৃত্যের এক আবেগপ্রবণ সম্পর্কের বেশি কিছু নয়। ধর্মীয় শিক্ষা সংক্রান্ত এ আলোচনায় আমরা সৎ ও ঐকান্তিক হলে এ সত্য আমরা মুক্ত মনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে স্বীকার করবো যে, আমাদের সার্বিক জীবনের ধর্মের পাদ্রিতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা গভীর ও দুর্ভেদ্য অপচ্ছায়া বিস্তার করে আছে। সে অপচ্ছায়ার প্রভাব আমাদের শিক্ষার পাঠ্যক্রমে অত্যন্ত প্রবল।


প্রাথমিক যুগের সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তির ওপর। ধর্মীয় শিক্ষা ছিল সে সমাজের অন্তঃকরণ। ধর্মীয় শিক্ষাই সে সমাজে পালন করতো কেন্দ্রীয় ভূমিকা । শরিয়া ছিল সে সমাজের জীবন পরিচালন বিধি। ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী আচরণ বিধি সে সমাজের সর্বাধিক কর্তৃত্বশীল ও সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারক উপাদানরূপে কাজ করতো । এ কথায়, প্রাথমিক মুসলিম সমাজে ইসলাম ছিল মূল চালিকাশক্তি এবং সকল কিছুর নিয়ামক। গৃহকোণে কিংবা বিদ্যালয়ে, মসজিদে কিংবা পথ ঘাটে এবং অন্য সকল যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার ও বিকাশের আয়োজন ছিল। সে সমাজের প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিকে তার বিশ্বাস, তার ইবাদত, তার যাবতীয় আচরণ সম্পর্কে ঘরে কিংবা মসজিদে সর্বত্র শিক্ষাদানের ব্যবস্থা চালু ছিল। শিক্ষাদানের এ সার্বিক দায়িত্ব অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে পালনের ব্যবস্থা থাকার কারণে ধর্মীয় বিষয়ে তাই প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমও ছিল প্রাসঙ্গিক ও সঙ্গতিপূর্ণ। ধর্ম বিষয়ে তাই প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ ধর্মীয় শিক্ষার নামে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে পুনঃপ্রবর্তনের প্রয়োজন হতো না। সে কাজটি শিক্ষার অন্য মাধ্যমগুলোই অব্যাহতভাবে আঞ্জাম দিত। বিশেষতঃ তা বাড়িতে এবং পরিবারেই সম্পন্ন হতো প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সীমিত সময়ের ওপর এ ব্যাপারে নির্ভল করার প্রয়োজন হতো না।


গোটা মানবজাতিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুস্থ ব্যবস্থার অধীনে গড়ে তোলা ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য। নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করার যে বিধান তাও একান্তভাবে শিক্ষামূলক । ইসলামের সামগ্রিক আচরণ ধারা একটি সুসমন্বিত সুবিন্যস্ত, ঐকান্তিক ও গভীরভাবে সম্বন্ধযুক্ত ব্যবস্থার অধীন। ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী শিক্ষার অবিচল অনুসরণে এ ব্যবস্থা শিশুদেরকে সাহায্য করে আল্লাহ নির্দেশের পূর্ণ অনুসারী। কথা, কাজে, ওয়াদা পালনে ও ইবাদতে নিবিষ্টচিত্ত একজন মানুষের দৃষ্টান্তও হতে পারে এক ধরনের শিক্ষা, যা অনুসরণীয় আদর্শরূপে শিশুদের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এ ধরনের দৃষ্টান্ত সহজেই উপস্থাপন করা যায়। এমনি সব টুকরো টুকরো আদর্শিক দৃষ্টান্ত ও ধর্মীয় তথ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে সন্নিবিষ্ট করার মধ্যে অবাক হবার বা আপত্তি করার মতো কিছুই নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেনিকক্ষের পাঠ্যক্রমের সীমিত গণ্ডির মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে যা কিছু শিখানো হবে, তার বাস্তব দৃষ্টান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরের পরিবেশেও নিশ্চিত করা গেলে তা আমাদের নবীন শিক্ষার্থীদের মনে ধর্মীয় শিক্ষা দৃঢ়মূল করার পূর্ণ ও মৌল উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। অস্বীকার করার যো নেই যে, ধর্মের সাথে আমাদের সম্পর্কে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমাদের মন থেকে ধর্মীয় চেতনা ক্রমশ লোপ পেয়েছে। আমাদের ঘরের ও ঘরের বাইরের পরিবেশ ধর্মীয় শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে তাকে নানাভাবে হেয় করার নেতিবাচক কাজটিই সম্পন্ন করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ছাড়া ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার ও বিকাশ ঘটানোর মাধ্যমরূপে আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় শ্রেনিকক্ষে বা মসজিদে প্রদত্ত বাস্তব বিবর্জিত, পরিবর্তন বিমুখ শতাব্দী প্রাচীন বর্তমান পাঠ কি পর্যাপ্ত এবং কার্যকর বিবেচিত হতে পারে? তা ছাড়া শিক্ষার এ মাধ্যম কি ধর্মীয় বক্তৃতা ও ধর্মোপদেশের বর্তমান ধারাকে স্বাগত জানানোর জন্য আগ্রহী থাকবে? নসিহত ও ধর্মীয় বক্তৃতার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল। সে ঐতিহ্যকে এখন এমন এক চমৎকার ইমরাতের সাথে তুলনা করা যায়, যা এক সময় ছিল, কিন্তু এখন বিধ্বস্ত । সে ইমারতের কয়েকটি বিক্ষিপ্ত পাথর এখন শুধু এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার জন্যই বিদ্যমান যে, এক সময় এখানে বিশাল আকৃতির একটি দেয়ালের অস্তিত্ব ছিল। এ পাথরগুলো সেই সুরম্য অট্টালিকার কাঠামো দাঁড় করাতে কি এখানে সাহায্য করতে পারে?


প্রকৃত অবস্থা আরো খারাপ। আমাদের এতক্ষণের আলোচনার ভিত্তিতে সংক্ষেপে এ কথাই বলা যায় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন থেকে তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়ালো, সে দায়িত্বের সম্পূর্ণ ভারী বোঝাটা গিয়ে পড়লো একান্তভাবে পাঠ্যক্রম ও শিক্ষার বাহনের ওপর। সে অবস্থায় ধর্ম বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ধর্মীয় বক্তৃতা ভাষণ ও নসিহত অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর হয়ে পড়লে এ কথাটি ধর্মীয় শিক্ষার অকার্যকারিতার ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ অবস্থায় স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ কিংবা রেডিও টিভির ধর্মীয় বক্তৃতা যদি ধর্মের মূল প্রেরণা ও আদর্শ থেকে দূরে সরে যায় এমনকি অধর্মীয় রূপ লাভ করে তখন অবাক হবার কিছুই থাকে না। এ প্রবন্ধে আমি গণমাধ্যম বা তথ্যমাধ্যম সম্পর্কে আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি না। এখানে আমি শিক্ষার পাঠ্যক্রমেই আলোচনা সীমিত রাখবো। ধর্ম সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ যেখানে দেয়া হয়, সে সাধারণ শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালের বা এর উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশই থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখে সেটিকে কোন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনে করার সুযোগ থাকে না। শ্রেনিকক্ষে যে বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়, কিংবা সেখানে শিক্ষাদানের যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তা ধর্মবিরোধী পাশ্চাত্য দেশগুলো শিক্ষার বিষয়বস্তু বা পাঠদান পদ্ধতি থেকে খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়। পাশ্চাত্য তার ধর্মবিরোধী স্বভাব প্রকৃতিকে সেক্যুলারিজমের দেয়াল দ্বারা আড়াল করার চেষ্টা চালায়। তার দাবি হলো, সে অধার্মিক মাত্র, ধর্মবিরোধী নয় । ইউরোপ তার রেনেসাঁ-পরবর্তী সময়গুলো কী পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে অতিবাহিত করেছে সে সম্পর্কে আমরা অবশ্যই ভালোভাবে, নিশ্চিতভাবে জানি। এই বিশেষ পরিস্থিতি বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে বহু যোজনের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে । লোকেরা ধর্মকে বিজ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলেছে। দু'য়ের মাঝে তারা এক প্রচ্ছন্ন বিরোধ সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞান গবেষণার কোন পর্যায়ে আল্লাহর নাম উচ্চারণও এখন তাদের বিবেচনায় আপত্তিকর।


তারা মনে করে আল্লাহর নামে বলার ফলে সব কিছুই দূষিত হয়ে পড়বে। ডারউইন তাঁর একটি বইতে এ সম্পর্কে বলেছেন, এটি ‘সম্পূর্ণ যান্ত্রিক বস্তুগত অবস্থার মধ্যে এক অতিপ্রাকৃতিক অবস্তুগত উপাদান যোগ করবে।' এ বিষয়ে ইউরোপীয়দের নিজস্ব যুক্তি যা-ই থাক, আল কোরআন এ সম্পর্কে স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছে : “মানুষ নিজেই নিজেকে খুব ভালো করে জানে, যতোই সে অজুহাত খাড়া করুক না কেন।” (সূরা কিয়ামত, আয়াত : ১৪-১৫)


আমরা মুসলমানরা ইউরোপীয়দের অনুসারী হয়ে তাদের অনুকরণের বিজ্ঞান ও ধর্মের মাঝে বিভেদের দেয়াল রচনা করে এ কাজের জন্য কি অজুহাত দাঁড় করতে পারি? মানুষের সহজাত প্রকৃতির মধ্যই বিজ্ঞান ও ধর্মের পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত পাশাপাশি অস্তিত্ব বিদ্যমান। মানব প্রকৃতিতে বিজ্ঞান ও ধর্মের কোন বিরোধ বা বৈপরীত্য কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাঁর বন্দেগি করা মানব স্বভাবের সাথে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ। ‘যখন তোমাদের রব বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করলেন এবং স্বয়ং তাদেরকেই তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমি কি তোমাদের রব নই?' তারা বললো : ‘নিশ্চয়ই, আপনি আমাদের রব।' (সূরা আরাফ, আয়াত ৭২) দুনিয়া জাহানের সব কিছু সম্পর্কে জানার আগ্রহ এবং দুনিয়ার সীমাহীন সকল সম্পদরাজি মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার আকাঙ্ক্ষা স্বভাবতই মানবিক।


সকল ব্যাপারে জ্ঞান লাভের এক সুতীব্র অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত। অন্যদিকে পৃথিবীর সকল কিছুর উত্তরাধিকার দান করা হয়েছে এই মানুষকেই । এই উভয় বিষয়ই পরস্পরের পরিপূরক। এ পৃথিবীতে বসতি বিস্তারের জন্য মানুষকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। “অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আদমকে সকল জিনিসের নাম শিক্ষা দিলেন।” (সূরা বাকারা, আয়াত ৩১) “যিনি জমিন ও আকাশ মণ্ডলের সমস্ত জিনিসকেই তোমাদের জন্য অধীন নিয়ন্ত্রিত করেছেন, সব কিছুই তাঁর নিজের নিকট থেকে।” (সূরা জাসিয়া, আয়াত ১৩) “পড়! আর তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা সে জানতো না।” (সূরা আলাক, আয়াত ৩-৫) বস্তুত সুস্থ মানব প্রকৃতিতে বিজ্ঞান ও ধর্ম এই দুই সহজাত প্রবণতার মধ্যে কোন বিরোধ বা বৈপরীত্য নেই। এই দুইয়ের মধ্যে একটি প্রবণতা মানুষকে পূর্ণরূপে আল্লাহর বিধি বিধানের অনুগামী ও অনুসারী হতে, সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে সাহায্য করে। অন্য প্রবণতাটি মানুষকে আল্লাহর নামসমূহ এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে এবং মানুষরূপে নিজ কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভে উদ্বুদ্ধ ও ব্রতী করে।” প্রকৃত কথা এই যে, আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে কেবল জ্ঞানবান লোকেরাই তাঁকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির আয়াত ২৮)


বিজ্ঞান ও ধর্মে পরস্পর সুসংবাদ ও অবিচ্ছেদ্য এই সম্পর্ক একমাত্র জাহেলিয়াতই পৃথক করে দেখে। বিশেষত সমকালীন ইউরোপীয় জাহেলিয়াত এই দুইয়ের মাঝে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত। আমাদের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ তা প্রাথমিক প্রিপারেটরি, মাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় যে পর্যায়েই হোক না কেন, কোন পর্যায়েই বিজ্ঞান ও ধর্মকে পৃথক করে দেখার এ মারাত্মক পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না । ধর্মকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান, কিংবা বিজ্ঞান বাদ দিয়ে শুধু ধর্ম সম্পর্কে পাঠ দানের এ অসঙ্গত ব্যবস্থা এখানে চলতে দেয়া উচিত হবে না। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে কোন সীমারেখা টানা অত্যন্ত খারাপ কাজ । তা এক জঘন্য পাপ। এ পাপ পঙ্কিল কাজটি আরো মারাত্মকরূপ ধারণ করে তখনি, যখন আমাদের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহুবিষয় এমন পদ্ধতিতে পড়ানো হয়, যা ইসলাম নীতি ও ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ডারউইনের মতবাদ পড়াই। কিন্তু তা নিছক বৈজ্ঞানিক প্রকল্প বা হাইপোথিসিসরূপে কিংবা নিছক বৈজ্ঞানিক সূত্র হিসেবে সঠিক বা ভুলরূপে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে হয় না। বরং এ মতবাদটি আমাদের সন্তানদের সামনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত এক বাস্তব সত্যরূপেই তুলে ধরা হয়। এ মতবাদটির যতটুকু গুরুত্ব রয়েছে, তারচে' অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক মূল্য ও গুরুত্ব আরোপ করে তা আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের কাছে পেশ করি। আমরা এ মতবাদটিকে চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত এক বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রামাণ্য দলিলরূপে আমাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দান করি। অথচ ডারউইনের মতবাদ তার জন্মের পর থেকে অদ্যাবধি বৈজ্ঞানিকদের সর্বসম্মত স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। নব্য ডারউইনবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা জুলিয়ান হাক্সলি ও স্বীকার করেছেন যে, মানুষ তার মনোগত, দেহগত ও জৈবিক দিক থেকে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নিষ্ঠাবান ডারউইনবাদী ও কট্টর নাস্তিক এই জুলিয়ান হাক্সলিও একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম 'ম্যান ইন দি মডার্ন ওয়ার্ল্ড।' এই বইতে তিনি ‘দি ইউনিকনেস অব ম্যান' বা ‘ মানুষের অনন্যতা' শীর্ষক দীর্ঘ ভূমিকায় বলেছেন যে, মানুষ আর — এইপ’ বা লাঙ্গুলবিহীন বানরের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান, তা পিঁপড়ার সাথে ‘এইপের’ ব্যবধানের চাইতেও বেশি। তিনি এখানে আরো বলতে চেয়েছেন যে, মানুষের যে পৃথক অবস্থানগত ভিত্তি রয়েছে, আধুনিক বিজ্ঞান তাকে সেই সঠিক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। ডারউইনবাদ সম্পর্কে খোদ একজন কট্টর ডারউইনবাদী নাস্তিক যখন এই বক্তব্য রাখছেন তখন আমরা মুসলমানরা আমাদের নবীন বংশধরদেরকে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে উক্ত মতবাদ শিক্ষাদানে অনেক বেশি সজাগ ও সচেতন থাকা কি উচিত নয়? ধর্মীয় বিশ্বাস, মানবিক মুল্যবোধ এবং উন্নততর নীতি নৈতিকতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ তার অব্যাহত ও অবিশ্রান্ত প্রচারণার কৌশলরূপে ডারউইনবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের সে কৌশলের সাফল্যই ডারউইনবাদের ব্যাপক প্রচার সম্ভব করেছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে, এ মতবাদটি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানার পরও কি আমরা চোখ কান বন্ধ করে থাকতে পারি?


নৃতত্ত্ব সম্পর্কেও একই কথা। ডারউইনের বিবর্তনবাদী মতবাদের প্রত্যক্ষ ফসলরূপে এবং উক্ত মতবাদের ধারাবাহিকতা হিসাবেই নৃবিজ্ঞানের জন্ম। আমাদের নিজস্ব পাঠক্রমে এটি আরেকটি বহিরাগত উপাদান। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সন্তানরা নৃতত্ত্ব অধ্যয়ন করছে। তাদেরকে শিখনো হয় যে, প্রথম মানুষ ‘এইপ; বা লাঙ্গুলবিহীন বানরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সাদৃশ্যমুলক ছিল। সে মানুষ তার হাত ও পায়ের পাতার ওপর ভর করে হাঁটতো। গাছ থেকে ফল ছেড়ার জন্য সে তার পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতো। তখন তার দেহ সোজা হতো। ধড়ের ওপরে তার মাথাটি ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে। তারপর সে মুখের শব্দ উচ্চারণ করতে শিখে। তার বুদ্ধি যথেষ্ট বিকশিত হবার সাথে সাথে সে অনেক কিছু করতেও সক্ষম হয়।


আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আরো শেখানো হয় যে, মানুষের জীবন, তার অভ্যাস, তার রীতি রেওয়াজ, আবেগ ও চিন্তা এবং তার আচরণ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে তার পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পরিবেশই এসব কিছু পরিগঠন করে। এখানে প্রথম বক্তব্যটি ডারউনবাদেরই সরাসরি প্রতিধ্বনি। এ ব্যাপারে অবশ্য কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা সাক্ষ্য সাবুদ বর্তমান নেই। দ্বিতীয় বক্তব্যটিও একই মতবাদের ধারাবাহিকতা মাত্র। ধর্মবিশ্বাসের অস্তিত্বহীন, পরিস্থিতিতেই কোন মানুষের ওপর এ মত আরোপ করা যায় । আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারকারী কোন অজ্ঞবাদী জাহেল নাস্তিকের কাছেই শুধু এমত গ্রহণযোগ্য হতে পারে। ধর্মবিশ্বাসহীন একজন মানুষই পরিবেশের সহজ শিকার হবে । পরিবেশ তাকে দাসে পরিণত করবে এবং তার জীবনকে যথেচ্ছভাবে পরিগঠন করবে। কিন্তু মানুষ যখন তার জীবন ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আল্লাহ প্রদত্ত আইন ও বিধান সম্বলিত আদর্শের বর্মে সুসজ্জিত হয়, সে আদর্শই তখন তার জীবন, অভ্যাস, রীতি-প্রথা, আবেগ অনুভূতি, চিন্তা ও আচরণ ধারাকে বিন্যস্ত ও পরিগঠন করে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ নয়, আদর্শের ভূমিকাই মুখ্য। ইসলামের ইতিহাসের প্রতি তাকালে আমরা দেখবো, ইসলাম এমন জাতি গঠন করেছে, যে জাতি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা নিজেই আল- কোরআনে ঘোষণা করেছেন : “মানবতার জন্য তোমরাই সর্বোত্তম জাতি।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১১০) আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবার কারণেই সে জাতি আজ তার গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য থেকেও সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপরোক্ত বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, মানুষের ওপর পরিবেশের কোনই প্রভাব নেই। ইসলাম বিশ্বের দিক-বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, বিস্তার লাভ করেছ। ইসলাম যেখানেই গেছে, সেখানকার পরিবেশ থেকে সর্বোত্তম জিনিসগুলো আহরণ করেছে। আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে জিনিসগুলোকে পুনর্গঠন করেছে। পরিবেশগত বিচ্যুতিসমূহ সংশোধন করে ইসলাম আদর্শ, মুল্যবোধ ও নীতিমালার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে।


নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়নও আমরা আসলে পশ্চিমা নৃতাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণার প্রতিই বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করি মাত্র, আমাদের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তা দেখি না । আমাদের অধ্যয়নে বার বার ঘুরে ফিরে, পশ্চিমা মতবাদসমূহই স্থান লাভ করে। সেগুলোই প্রশ্নাতীতরূপে প্রমাণিত সত্য বলে গ্রহণ করে আমরা তার নকল করি এবং নীরবে সেসব মতবাদ মেনে নিই। অথচ সেসব মতবাদ ইসলামী ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আধুনিক নৃতত্ত্ব আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে মানুষ শুধুই তার পরিবেশের সন্তান আর পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় শুধুমাত্র পরিবেশেরই দ্বারা। ইসলাম এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে।


ইতিহাসের ব্যাপারে আমরা একই ভুলে নিমজ্জিত। মানুষের ইতিহাস দু'টি আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করা হয়। সে উভয় দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী মতাদর্শের বিরোধী প্রথম মতবাদটি মানব জাতির ইতিহাসকে অব্যাহত ও ক্রমাগত উন্নতি ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা হিসেবে বিশ্লেষণ করে। দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণটি মানবজাতির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে নিছক বস্তুগত ও স্থাপত্যগত উন্নতির নিরিখে বিচার করে। তার ফলে আমরা ফেরাউনি, গ্রিক, রোমান, বেবিলনীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার মতো ধর্মহীন সভ্যতাগুলো স্তুতিবাদে লিপ্ত হই। এ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বর্তমান সভ্যতা রাসূল (সা) এর সাহাবীগণের যুগের চাইতেও অধিকতর উন্নত ও পরিশীলিত হিসেবে প্রায়শ আমাদের অভিনন্দন ও প্রশংসা লাভ করে। এই স্তুতি ও প্রশংসা যদিও আমরা খুব উচ্চ নিনাদে ঘোষণা করি না, কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস পাঠের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তা সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


মানুষ বৈষয়িক দিক থেকে যত উন্নতি বা অগ্রগতি অর্জন করুক, ইসলামের দৃষ্টিতে তার মাত্র দুটি অবস্থা। হয় সে সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, আর না হয় সে নিকৃষ্টতমদেরও নিম্ন পর্যায়ের। “আমরা নিশ্চয়ই মানুষকে সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠরূপে সৃষ্টি করেছি। তারপর তাকে নামিয়ে দিয়েছি নিকৃষ্টতমদেরও নিকৃষ্ট স্তরে; তাদেরকে ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে।” (সূরা ত্বিন, আয়াত ৫-৬) মানুষ যখন আল্লাহর ওপর ঈমান আনে এবং তাঁর নির্দেশসমূহ কঠোরভাবে পালন করে, তখন সে সৃষ্টির সেরা। আর যখন সে আল্লাহর একত্বে অবিশ্বাসী হয়, কিংবা তাঁর নির্দেশ পালনে হয় পরাঙমুখ, তখন সে নিকৃষ্টতমদেরও নিকৃষ্ট পর্যায়ে নেমে যায়। বস্তুগত দিক থেকে সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক না কেন, মানবজাতির অগ্রগতির মাপকাঠি তা নয়। পবিত্র কোরআন এক্ষেত্রে তাদের কথাই বলছে, যারা পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং বিরাট সভ্যতা গড়ে তুলেছিল; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল জাহেল বা অজ্ঞ। তারা এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনি; তাঁর নির্দেশ পালন করেনি। তাদের কাজে বিজ্ঞান ছিল, সে বিজ্ঞান দ্বারা তারা আলোকিত হয়েছিল। কিন্তু তা থেকে তারা বেশি কিছু ফায়দা হাসিল করতে পারেনি। তারা যে বিজ্ঞান অনুসরণ করেছে, তা ছিল আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন। অথচ আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত যে বিজ্ঞান তা-ই তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দিতে পারতো। ইসলাম ফেরাউনি, গ্রিক, রোমান বেবিলনীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার মতো প্রাচীন সভ্যতাকে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতা বলে বিবেচনা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাহাবীদের সময়কালই বিশ্বে সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোত্তম যুগ অন্যদিকে বিরাট বস্তুগত সভ্যতা এবং ব্যাপক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সত্ত্বেও বর্তমান যুগের জাহেলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্নতার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অধঃপতন এখন ভয়াবহ আকারে সর্বত্র সর্বনাশের যে কালোছায়া বিস্তার করেছে, অতীতে আর কখনো এমনটি ঘটেনি।


আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, তা নিছক ইহজগৎকেন্দ্রিক। এই সীমিত গণ্ডিতে মানবজাতির অর্জিত সাফল্য বা ব্যর্থতাকে বিশেষ একটি মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার করা হয়। সে মানদণ্ড অনুযায়ী কোন একটি ঘটনা বা বিষয় কতটা পরিশীলিত বা প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল তা নির্ধারণ করা হয়। মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতা পরিমাপের ক্ষেত্রেও ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী সাফল্য বা ব্যর্থতাই বিচাৰ্য বিষয়রূপে বিবেচনা করা হয। ইসলাম ইতিহাসের এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে। ইসলামের মতে, ইতিহাসকে শুরু ও শেষ, এই উভয় প্রান্ত হতেই বিবেচনা করা উচিত। “তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, কেউ ঈমানদার হয়, কেউ হয় অবিশ্বাসী।” বিশ্বের বস্তুগত সভ্যতাও একটি মাপকাঠি। তবে আল্লাহতায়ালা মানুষকে বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। “তিনিই তোমাদেরকে জমিন হতে পয়দা করেছেন এবং এখানেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।” (সূরা হুদ, আয়াত ৬১) শুধুমাত্র মানুষের বস্তুগত সাফল্য বিবেচনা করলেই চলবে না। বস্তুগত সাফল্য তো প্রকৃত সাফল্যের ভিত্তিরূপে কাজ করে মাত্র। এ ক্ষেত্রে বিচারের প্রধান মাপকাঠি হলো, বস্তুগত সাফল্য আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিইে অর্জিত কি-না। ঈমানদার ও অবিশ্বাসী নির্বিশেষে যে কেউ-ই পৃথিবীতে বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম। কিন্তু দুয়ের মাঝে পার্থক্য হলো : ঈমানদার বান্দাই সভ্যতাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের কাজে ব্যবহার করে। অপর দিকে অবিশ্বাসীরা তা ব্যবহার করে শয়তানের নিকটবর্তী হওয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দৃষ্টিভঙ্গির এ পার্থক্যের দিকটি উপেক্ষা করা হয়। ইউরোপীয় জাহেলিয়াতের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমাদের সন্তানদেরকে ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হয়। নির্ভরযোগ্য পাণ্ডিত্যের উৎস ও প্রামাণিক গ্রন্থাদির সূত্ররূপে আমরা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদেরকেই স্বীকার করি। যে কোন সমস্যার জবাব পাবার জন্য আমরা তাদেরইে দ্বারস্থ হই। আমাদের শেখা বুলির সত্যতা প্রমাণের জন্যও প্রায়শ তাদেরকেই সাক্ষীরূপে উপস্থিত করি। সমাজতত্ত্ব অধ্যয়নকালে আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদেরকে ইহুদি ডারউইনের মতবাদ শিক্ষা দেই, অথচ এই মতবাদ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত। ডারউইনের মতবাদে মানুষের সকল স্থায়ী মূল্যবোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। ডারউইন বলেন, ধর্ম, নৈতিকতা, বিবাহ কিংবা পরিবার সামাজিক ইউনিটরূপে মানুষের স্বভাবসঙ্গত নয়। সেগুলো সমষ্টিগতমনে কর্ম মাত্র, যা কোন কিছু ইচ্ছা মতো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। মনস্তত্ত্বে আমরা ফ্রয়েডের যৌন সম্পর্কীয় মতবাদসহ এমনসব মতবাদ শিক্ষা দেই যেগুলো ধর্মকে মানব প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বা ভিত্তি বলে স্বীকার করে না।


রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, প্রকৌশল, ভেষজ, প্রভৃতি ভৌত বিজ্ঞানকে খোদায়ী জ্ঞানের উৎস থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। আমরা আরো মারাত্মক ভুল করি তখন, যখন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে এই শিক্ষা দেই যে, প্রকৃতিই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছে এবং প্রকৃতিই তাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে; আর প্রকৃতির আইনই হচ্ছে সর্বোচ্চ, চরম ও অলংঘনীয়। ‘ন্যাচার' শব্দটি ‘প্যাগান’ বা প্রকৃতি পূজার মতবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ইউরোপে এই শব্দটি ‘গত’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি বড় হরফের ‘এন’ এর আদর্শিক তাৎপর্য প্রকৃতির মাহাত্মের প্রতীকরূপে চিহ্নিত হয়। গির্জাকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছিল। উপাস্যের নামে গির্জা তাদেরকে গোলামে পরিণত করে যে নিপীড়ন চালাতো তার ফলে ধর্ম ও গির্জা ইউরোপবাসীর কাছে নির্যাতনের প্রতীকে পরিণত হয়। সে কারণেই ইউরোপীয়রা যাযকতন্ত্রের সৃষ্ট গডকে বর্জন করে এবং গির্জার সাথে সম্পর্কহীন এক নতুন ঈশ্বরকে তার স্থলাভিষিক্ত করে। এই নব্য গড়কেই তারা প্রকৃতি বা ন্যাচার নামে অভিহিত করে। এই নতুন উপাস্যের প্রতি তাদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। এ উপাস্যটি সম্পর্কে ডারউইন বলেন, প্রকৃতিই সব কিছু সৃষ্টি করেছে এবং তার সৃষ্টি ক্ষমতার কোন সীমা নেই।


মুসলমান হয়ে আমরা কী করে কুফরি ও জাহেলি এই ‘প্রকৃতি' শব্দটি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করি? এমন কি আরো একধাপ এগিয়ে আমরা বইপত্রে এই শব্দটিকে স্থান করে দেই এবং আমাদের সন্তানদের জন্যও তা পাঠ্য তালিকাভুক্ত করি? সব কিছুই যখন এভাবে চলছে এভাবে যখন ডারউইনের মতবাদ গলাধঃকরণ করানো হচ্ছে, এবং অনৈসলামী চেতনা ও ইসলামবিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস ভুগোল, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্বশিক্ষা, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান তথা সকল বিষয়ে পাঠ দেয়া হচ্ছে, তখন আমরা কিভাবে আশা করতে পারি যে, আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুসলিম বংশধররূপে বেরিয়ে আসবে? বস্তুত, যতদিন আমাদের প্রতিটি কারিকুলামে, প্রতিটি পাঠ্যবিষয়ে ইসলামবিরোধী প্রচারণা এই বিপুল ও ব্যাপক আয়োজন অব্যাহত থাকবে ততদিন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে প্রকৃত মুসলমানরূপে গড়ে তোলার আশা করতে পারি না। অধ্যাত্মবাদবিরোধী ও ধর্মহীন পরিবেশ ধর্ম সম্পর্কে আত্মকেন্দ্রিক কিছু খণ্ডিত বিষয় পাঠদানের কতুটুকুই বা মূল্য থাকতে পারে? ইসলামবিরোধী এই স্রোত, প্রবল এই অন্তঃপ্রবাহ আর বিপরীতমুখী এই প্রচণ্ড তোড়ের মধ্যে একটু ধর্মীয় শিক্ষার তাৎপর্য কতটুকু? ক্ষুদ্র পাঠ্যসূচির কিছু অংশ মুখস্থ করা এবং বছরের শেষে পরীক্ষা দেয়ার মধ্যেই এ শিক্ষাদান সীমিত। এ পরিস্থিতি সত্যি উদ্বেগজনক। অবিলম্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। সার্বিক পদ্ধতির ভিত্তিভূমি নাড়া দিয়েই এ সংস্কার সাধন করা জরুরি। শিক্ষাদানের পাঠ্যসূচিতে ধর্মকে তার যথাযথ স্থান দেয়ার ব্যাপারে আমরা যদি আন্তরিক হই তবে দুটি কাজ আমাদেরকে প্রায় একই সাথে করতে হবে। প্রথমত, ধর্মের ব্যাপারে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রচলিত আছে, ধর্মীয় নির্দেশনা শুধু তার মধ্যেই সীমিত রাখা চলবে না। দ্বিতীয়ত, এই বিশেষ শিক্ষাদানের সিলেবাস আমাদেরকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ এলাকার সিলেবাস এ উদ্দেশ্যে পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে।


ধর্মীয় শিক্ষা বিশেষত ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীকে মুসলিম পুরুষ বা মুসলিম নারীরূপে গড়ে তোলা । ধর্মীয় কিছু তথ্য মুখস্থ করে বছর শেষে পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য সাধন কোন মতেই সম্ভব নয়। কোন ব্যক্তির চিন্তা চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি নৈতিকতা ও আচার আচরণ সার্বিকভাবে অনৈসলামী বা ইসলামবিরোধী হয়ে গড়ে উঠলে সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা পাসের জন্য কিছু ইসলামী তথ্য মুখস্থ করিয়ে তাকে মুসলিমরূপে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য কিভাবে অর্জিত হতে পারে?


বর্তমানে আমরা যদি ইসলামী শিক্ষার সকল প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণের অধিকারী না হই এর দ্বারা আমি বুঝাতে চাচ্ছি, যদি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে ইসলামের আইন ও বিধান প্রয়োগ না করি এবং বাড়িতে ও রাস্তায় এ বিধানকে সমুন্নত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারি, ইসলামী শিক্ষাও মূল্যবোধকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি। তাহলে আমাদের জীবন বা এর অংশ বিশেষ ইসলামের বিরাট শূন্যতা পূরণের চেষ্টায় একমাত্র অবলম্বন হিসাবে শিক্ষাব্যবস্থার সবটুকু সম্ভাবনার ‘সদ্ব্যবহার করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সফল করতে হলে আমাদের সকল শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষাপদ্ধতি সংশোধন করতে হবে এবং সেগুলোকে সঠিক ইসলামী ভিত্তির ওপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সে অবস্থায় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরেও ইসলামী শিক্ষার জন্য আমাদের হাতে একাধিক কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি থাকবে। ইসলামী শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে স্কুল জীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ পর্যন্ত এবং প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম বর্ষ হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ পর্যন্ত কার্যকর রাখতে হবে। তার অর্থ নিশ্চয়ই এটা নয় যে, আমাদের সকল পাঠ্যসূচিকে নিছক ধর্মোপদেশে পরিণত করা হবে। মোটেই তা নয়। বাস্তব অবস্থা তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কেননা, ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য ও প্রকৃতি এটা নয়। নিছক ধর্মোপদেশমূলক? শিক্ষা এককভাবে আমাদেরকে ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে তেমনি পরিচালিত করে না, তেমনি কাঙ্ক্ষিত ফলও প্রদান করে না । সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে অনুসারীদের সবচে' প্রিয় বন্ধু ও সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মহানবী (সা) সাহাবীগণকে শুধু প্রয়োজনের মুহূর্তেই উপদেশ দিতেন, নসিহত করতেন। যখন তখন নয়। তিনি উপদেশ দানের এ নীতি গ্রহণ করতেন, যাতে উপদেশ গ্রহণে ক্লান্ত বা অনাগ্রহী হয়ে না পড়েন। আমরা সাধারণ মানুষেরা ধর্মীয় নসিহতকে বিরামহীন সার্বক্ষণিক বিষয়ে পরিণত করলে তা সুফল বয়ে আনবে না। ধর্মীয় উপদেশ যতো অপরিহার্যই হোক, সারাদিনের মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিটের বেশি সময় এজন্য নেয়া উচিত নয়। বরং শিক্ষার অন্যান্য কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় কাঙ্ক্ষিত ধর্মীয় সচেতনতা সৃষ্টিতে ধর্মীয় হিতোপদেশের চাইতে অনেক বেশি কার্যকর ও বাস্তব অবদান রাখবে।


এ প্রসঙ্গে আমরা জীববিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদানের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারি। যদি আমরা আমাদের পাঠ্যসূচি থেকে ‘প্রকৃতি' শব্দটি বাদ দেই এবং তার পরিবর্তে যথাযথভাবেই ‘আল্লাহ’ শব্দটি বসাই, তাহলে ফলটা কী দাঁড়াবে? এখানে আমরা আমাদের পাঠের সমগ্র সময়জুড়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি ক্ষমতার অতি সংবেদনশীল পবিত্র উপস্থিতি অনুভব করবো। জীববিজ্ঞানে এমন কোন বিষয় আছে, যা যথাযথ বৈজ্ঞানিক পন্থায় শিক্ষাদান করলে সে জ্ঞান সত্যিকারের একমাত্র স্রষ্টারূপে আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন করবে না? প্রাণীদেহের কোন অংশটি আমাদের মনকে আলোড়িত করে না? জমিতে বীজ থেকে চারার উৎপাদন ঘটান কে? পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীত দিকে চারার কাণ্ডকে উপরের দিকে ঠেলে দেয় কোন শক্তি? ফুল কে ফোটায়, আর ফল কে সৃষ্টি করে। কে এতে বিচিত্র রং, স্বাদ ও গন্ধ জোগায়? আল্লাহ ছাড়া আর কোন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব কি কল্পনা করা যায়? এমনি ধরনের বহু ‘কে’ এবং ‘কি’ থাকতে পারে। বিস্ময়কর সকল সৃষ্টি সম্পর্কে এমনি হাজার হাজার, লাখ লাখ প্রশ্ন থাকতে পারে। আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহই এমনি সকল প্রকার বিস্ময়কর বিষয়ের স্রষ্টা।


পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন বিজ্ঞান থেকেও আমরা দৃষ্টান্ত নিতে পারি। এক একটি পদার্থকে আলাদা আলাদা সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে কে রূপদান করেছেন? বস্তুকে তাপের মাধ্যমে প্রসারিত এবং ঠাণ্ডা হলে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজটি কে সম্পাদন করেন? কে পানি সৃষ্টি করেছেন? এই পানি যখন জমাট বাঁধে একে তখন প্রসারিত আকার দান করেন কে? একমাত্র পারদ ছাড়া আর সকল তরল পদার্থের উপরিভাগ সমতল করে দিয়েছে কে? পারদেরই বৈশিষ্ট্য হলো, এটা বৃত্তবৎ ক্রমোন্নত তলা বিশিষ্ট । একটি নির্দিষ্ট উপাদানের সাথে আর একটি নির্দিষ্ট উপাদানের রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটান কে? সেখানে অন্য কোন উপাদান ক্রিয়া করে না কেন? হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নামক দু'টি উপাদান দিয়ে পানি কে সৃষ্টি করেছেন? এ দু'য়ের মধ্যে একটি উপাদান দাহ্য এবং অপরটি অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে। অথচ এই দুইয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি পানি আগুন নেভাতে ব্যবহৃত হয় কেন? আল্লাহ ছাড়া কি অন্য কোন সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে?


ভূ-প্রকৃতি বিদ্যা থেকে আমরা ভুত্বক ও আবহাওয়া, পর্বত, উপত্যকা, সাগর, নদী, মেঘ, বাতাস ইত্যাদি উদাহরণ টানতে পারি। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সত্যকে আধুনিক জাহেলিয়াতের মোড়কে আবৃত না করে আমরা সহজেই বৈজ্ঞানিক সত্যের আলোকে একে তুলে ধরতে পারি। আধুনিক জাহেলিয়াত যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার অতি প্রাকৃতিক কোন উপাদানের প্রবর্তন মানতে রাজি নয় বরং প্রকৃতির বাইরের কোন কিছুকে গ্রহণ করার ফলে গবেষণার বিশুদ্ধতা নষ্ট হবে বলে সে অজুহাত দাঁড় করায় আল্লাহর নাম ব্যবহারে এভাবেই সে আপত্তি তোলে। আধুনিক জাহেলিয়াত প্রকৃতির প্রতি এমন অন্ধ হলো কেমন করে? যার দরুন প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি ক্ষমতার আরোপের বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আনাটাকেও তারা ক্ষতিকর মনে করেন? প্রকৃতি জিনিসটি আসলে কী? কখন এবং কিভাবে এটি তার বিশাল সৃষ্টি ক্ষমতা ধারণ করলো ? সমকালীন ইউরোপীয় জাহেলিয়াতের ধারকরা যেভাবে চায়, আমরা কি সেভাবেই প্রকৃতির সৃষ্টি ক্ষমতার ওপর নিরঙ্কুশ বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেদেরকে প্রতারিত করবো? আমরা কি সে প্রতারণার শিকার হয়ে একক স্রষ্টার কথা ভুলে অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্বের ব্যাপারে সংশয়, অস্পষ্টতা ও অজ্ঞানতা প্রকাশ করবো? এর দ্বারা প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেতনার বিপরীত মিথ্যা জিনিসের নামই কি ব্যবহার করা হবে না?


জ্যোর্তিবিদ্যা থেকে আমরা দৃষ্টান্ত গ্রহণ করতে পারি। আমরা আল্লাহ তায়ালার এই মহাবিশ্বের বিস্ময়কর পরিবেশে বারবার আধ্যাত্মিক সফল করতে পারি। আর প্রত্যক্ষ করতে পারি তাঁর মহাসৃষ্টির আশ্চর্যজনক বিশালত্ব, যা এক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত। আমাদের মন, আর আমাদের সর্বাধুনিক সুনিপুণ, যন্ত্রপাতি মহাবিশ্বের এই বিশালতাকে ভেদ করতে বা এর গভীরে পৌঁছতেও সক্ষম নয়। মহাবিশ্বের গ্রহ নক্ষত্ররাজির বিস্তৃতিকে আমাদের কল্পনা শক্তিও ধারণ করতে অপারগ। এদের নির্বিঘ্ন আবর্তনের বিস্ময়কর শৃঙ্খলা আমাদের বোধশক্তির অগম্য। “সূর্যের ক্ষমতা নাই চাঁদকে ধরে ফেলার, কিংবা দিনকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা নাই রাতের; সব কিছু সাঁতার কাটছে মহাশূন্যে।” (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৪০)। ছাত্রছাত্রীদের অন্তঃকরণে ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করার ব্যাপারে মহান সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম । এজন্য কোন ছলনা বা কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন নেই । এসব বিষয় যখন যথার্থভাবে শিক্ষা দেয়া হবে, তখন আল্লাহর মহানুভবতার ধারণা আমাদের হৃদয় মনকে পূর্ণ করে তুলবে। তাঁর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা আমাদেরক অন্তরকে আলোকিত করবে। আল্লাহ যে অনন্য, অসাধারণ, সে ধারণা তাঁর সৃষ্টির সামনে প্রকাশ করার এ পদ্ধতি আল কোরআনই আমাদের শিক্ষা দেয়। “শীঘ্রই আমরা এদেরকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দিকচক্রবালে দেখাইব এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও যেন তাদের সামনে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই কোরআন বাস্তবিকই সত্য।” (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত ৫৩)


সমকালীন ইউরোপীয় জাহেলিয়াতের ধারকরা এ পদ্ধতি সহজভাবে মেনে নিতে ও প্রয়োগ করতে অস্বীকার করে। কারণ আল্লাহর সাথে তারা একটি নিরন্তর ও হাস্যকর যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহকে তারা তাদের সবচে' ঘৃণ্য ও ভীতিপ্রদ দুশমন মনে করে। এখানে আমরা আবার জুলিয়ান লিওএর কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেন, অজ্ঞানতা ও অসহায়ত্বের যুগে মানুষ আল্লাহর ওপর শক্তি আরোপ করেছিল। কিন্তু এখন তারা জ্ঞানের বর্মে পুরোপুরি সজ্জিত। পরিবেশের ওপর তারা নিজেদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। তাই (আল্লাহর ওপর আরোপিত) সে শক্তি এখন মানুষের নিজের ওপরই আরোপ করা উচিত। মানুষের এখন নিজেকেই খোদা বলে চালিয়ে দেয়া প্রয়োজন।' হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে এই অন্ধ নাস্তিকের হাত থেকে হেফাজত করো।


দীক্ষিত আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কথা বলছি। কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আল্লাহর নাম উল্লেখ করতে তাঁরাও তাঁদের ইউরোপীয় দীক্ষাদাতাদের মতোই অস্বীকৃতি জানান । মানুষের মন এর ফলে মহাবিশ্বের গতি, শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আপতন সূত্রের ব্যাপারে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারা ধর্ম ও দর্শন সংক্রান্ত বিদ্যার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। এই বুদ্ধিজীবীদেরকে আমরা বলি, ইসলামী শিক্ষা মানুষকে আপতন সুত্রের সাথে সংশিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে অন্ধ করে দেয় না। বরং ইসলামী শিক্ষা এ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন করে এবং এই সূত্রের যিনি স্রষ্টা সেই আল্লাহর দিকেই মানুষকে চালিত করে । আল্লাহর সৃজনশীল ক্ষমতা সম্পর্কে যতই আমরা অধ্যয়ন করবো, ততই আমাদের মন তাঁরই দিকে ধাবিত হবে। আল্লাহর ভাষায় এটাই সত্য: “প্ৰকৃত কথা এই যে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানসম্পন্ন লোকেরাই তাঁকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির, আয়াত ২৮)
এই পাঠ্যসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমাদের জন্য ধর্মীয় চেতনা সৃষ্টি ও বিকাশের সুযোগ বয়ে আনবে। তখন আমরা অন্য ধরনের কিছু ইসলামী পাঠ্যসূচি নিয়েও অগ্রসর হতে পারবো, যা ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে আরেক পর্যায়ে ভূমিকা পালন করবে। এই ভূমিকা মানুষকে ইসলামী আদর্শের ছাঁচে ফেলবে এবং সে তখন প্রতিটি বাহ্যিক বিষয়ের ভেতরের স্বভাবের প্রতি সম্পূর্ণ ইসলামী দৃষ্টি দিয়ে তাকাতে পারবে। ইতিহাস, মানবীয় ভূবিদ্যাশিক্ষা, মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় তখন সে ইসলামের চোখ দিয়েই দেখতে সক্ষম হবে।


ইতিহাস সংক্রান্ত পাঠ্যসূচি কার্যত শিক্ষারই একটি অঙ্গ। আমরা জানি কি জানি না, তার ভিত্তিতে নয় বরং আমরা চাই কি চাই না তার ভিত্তিইে সে পাঠ দেয়া হয়। ইতিহাস শিক্ষা দানের যে পদ্ধতি আমরা প্রয়োগ করি, সে পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের ওপর তার নিজস্ব ছাপ ফেলে । ইতিহাসের কোন পাঠে শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। যদি এই প্রভাব সুস্থ ও শুভ হয় তবে তা শিক্ষার্থীদের সঠিক অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি করবে। পক্ষান্তরে তা ভুল ও অসুস্থ হলে তা ক্ষতিকর ও দুঃখজনক ফল দান করবে। ইতিহাস পড়ানোর ইসলামী পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো: বস্তুত, ইতিহাস শিক্ষাদানের যে পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হোক না কেন, সেখানে একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব আমরা আমাদের মনের মাঝে অবশ্যই অনুসন্ধান করি। এটা এড়ানো যায় না। সে ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড এবং যে জবাব আমরা পাব, তা মানুষ ও তার ঘটনাবলির আলোকে মুল্যায়ন করতে পারবো এখানে মৌলিক প্রশ্ন হলো : এ পৃথিবীতে মানব অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী? এ প্রশ্নের যথেষ্ট পরিষ্কার জবাব ছাড়া ইতিহাস নিছক কতগুলো পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত ঘটনা ও বর্ণনার সমষ্টিতে পর্যবসিত হবে। এটা কোন মতেই ইতিহাস নয়। প্রকৃত ঘটনা পরীক্ষা ও দিন তারিখের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানোর পরই ঐতিহাসিক ঘটনাবলরি ব্যাখ্যা দেয়াই হচ্ছে একজন ঐতিহাসবিদের প্রকৃত কাজ। তাঁর ব্যাখ্যার ভিত্তি কী হবে, এবং কিসের মাপকাঠিতে তিনি ঘটনাবলি যাচাই করবেন, এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। এই পৃথিবীতে মানব জন্মের চরম লক্ষ্য হচ্ছে, বস্তুবাদী সভ্যতা গড়ে তোলা এবং এখানে যা পাওয়া যায় তা ভালোভাবে উপভোগ করা।' এই ধারণাটির ওপর ভিত্তি করেই জাহেলি ও ধর্মহীন পরিবেশে পাশ্চাত্যের ইতিহাস চর্চার সূচনা। এর ভিত্তিতেই দেশ ও জাতি, ব্যক্তি ও সমষ্টিকে বিচার বিবেচনা করা হয়। বৈষয়িক শক্তি, সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, জীবনের সুযোগ সুবিধা ও তা ভোগের রেকর্ড যাচাইয়ের মধ্যেই পাশ্চাত্যের ইতিহাস রচনার কাজ সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন থাকে। সেখানে চিন্তাধারা, শিল্পকলা, এবং নৈতিক সামাজিক ও মানবীয় মূল্যবোধের মতো মুষ্টিমেয় অবস্তুগত মূল্যবোধ ইতিহাসে একটি ক্ষুদ্র জায়গা লাভ করলেও এর কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভিত্তিভূমি নেই।


ইসলামী বিদ্যায় যে দৃষ্টিকোণ ও পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তার জন্ম ইসলামী বিশ্বাসের পরিবেশে এ পদ্ধতিটি অন্যান্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে অন্যান্য ইতিহাসে যেসব বিষয়ে উল্লেখ ও লালন করা হয়, এখানে সেসব কিছুকে একেবারে উপেক্ষা করা হয় না। ইসলামী ইতিহাস বিদ্যার মৌল ও সার কথা হলো, শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার জন্যই এই পৃথিবীতে মানুষের জন্ম। “আমি জ্বিন ও মানুষকে অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি, কেবলমাত্র এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার বন্দেগি করবে।” (সূরা আয যারিয়াহ আয়াত ৫৬) ‘বল আমার সালাত, আমার সব ইবাদত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।' (সূরা আনআম-১৬২৯)


পশ্চিমা ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা এই দৃষ্টিভঙ্গিটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ, সীমিত ও গণ্ডিবদ্ধ বলে শুরুতেই ধরে নিতে পারেন । আল্লাহর ইবাদতের ধারণাটি পরবর্তী যুগের মুসলমানদের কাছে সংকীর্ণ হতে হতে বর্তমানে নিছক কতক অনুষ্ঠানে এসে ঠেকেছে। কিন্তু ইসলামে ইবাদাতের ধারণাটি এর কম নয়। মানুষের জীবনের সকল কিছু তার বিশ্বাস, কর্ম, চিন্তা, অনভূতি ও আচরণ, সকল দিক ও বিভাগ নিয়েই হচ্ছে ইবাদাত। সূরা আল আনয়ামে এ দিকটির ওপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সেখানে বলা হয়েছে : আমার সালাত, আমার যাবতীয় ইবাদত, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু সারা জাহানের রব আল্লাহরই জন্য। মানুষের পরিপূর্ণ, সমগ্র জীবন, এমনকি তার মৃত্যুও, সারা জাহানের একমাত্র প্রভু আল্লাহর জন্য। আল্লাহর ইবাদাত সম্পর্কে ইসলামের ধারণা মানুষের সকল কর্ম, চিন্তা ও অনুভবের মধ্যে ন্যস্ত। সেখানে শর্ত মাত্র একটি। তাহলো, মানুষকে তার দেহ ও আত্মা, হৃদয় ও মন দিয়ে আল্লাহর কাছে এবং আল্লাহর সকল নির্দেশের কাছে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইসলামের ইতিহাস প্রণয়নের পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি তাই ইতিহাস রচনার অন্যান্য পদ্ধতির বিষয়সমূহকেও উপেক্ষা করে না । এতে সকল কিছুই সংরক্ষণ ও বিবেচনা করা হয। সামান্যতম একটি ঘটনাও এখানে দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। আল্লাহর দেয়া মাপকাঠিতে ইসলাম সবকিছুই যাচাই ও পরিমাপ করে নেয় । পৃথিবীতে মানব অস্তিত্বের যে মূল লক্ষ্য, আল্লাহ ইবাদাত বন্দেগি করার সে একমাত্র লক্ষ্য মানুষের সকল চিন্তা, অনুভূতি, কর্ম নিয়োজিত রয়েছে কি? “ তোমাদের পূর্বেও বহু জীবনপদ্ধতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল, সেসব যুগ অতীত হয়েছে, পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে দেখ, আল্লাহর (আদেশ ও বিধান) অমান্যকারীদের পরিণতি কী হয়েছে? (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৩৭) অতঃপর আমাদের পরিণতি কী হবে?


ইতিহাস রচনার ইসলামী কিংবা অনৈসলামী, কোন পদ্ধতিইে প্রকৃত ঘটনাবলি পরিবর্তিত হবে না । ঐতিহাসিক সত্যকে ইসলামী রীতিতে কিছুমাত্র উপেক্ষা করা হবে না। ফেরাউনদের কথা যখন বলা হয়, তখন তাদের প্রতিষ্ঠিত বিশাল সভ্যতা, তাদের মূর্তি, পিরামিড, মন্দির, নগরী, নির্মাণ প্রকল্প, সামরিক ব্যয়, যন্ত্রপাতি, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়কে উপেক্ষা বা অবমূল্যায়ন করা হবে না। যখন আমরা গ্রিকদের কথা বলি, তখন তাদের কোন দর্শন ও বিজ্ঞানকে উপেক্ষা বা অবমূল্যায়ন করা হবে না। আমরা যখন রোমানদের কথা বলি, তখন তারা যা কিছু নির্মাণ করেছিল, তাদের যত স্থাপত্য নিদর্শন, ব্যবস্থাপনা ও সংগঠন সব কিছুই বিবেচনা ও উল্লেখ করা হবে । এই সকল কিছুকে আল্লাহ প্রদত্ত মানদণ্ডের সাহায্যে মূল্যায়ন করতে হবে। এসব সভ্যতার ধারক ও বাহকরা কি সকল প্রভুর প্রভু একমাত্র আল্লাহর জন্যই জীবন ধারণ এবং কেবলমাত্র তারই নিমিত্ত মৃত্যুবরণ করেছে? অথবা তারা কি মানব অস্তিত্বের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে না পেরে অন্য কিছুর জন্য বেঁচে থেকেছে এবং সে ভুল লক্ষ্য পথেই মৃত্যুবরণ করেছে? অন্যভাবে বললে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তারা কি ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ঈমানদার ছিল নাকি তারা জাহেলিয়াতের অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল? ঐসব জাতি জাহেলিয়াতের মধ্যে ডুবে ছিল বলে যদি প্রমাণিত হয়, তবে যথাযথ ইতিহাসের দৃষ্টিতেই তাদের সত্যিকার বৈশিষ্ট্য নির্ণীত হবে।


একজন ছাত্র যখন কোন স্বতন্ত্র বিষয়ের বাহ্যিক প্রকৃতির ভেতরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকাতে অভ্যস্ত হবে, তখন সে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, শিক্ষা, মনস্তত্ত্ব সাহিত্য বা শিল্পকলা তথা জ্ঞানের যে কোন শাখাতেই অধ্যয়ন করুক না কেন, তার চিন্তাশক্তি ইসলামের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে এবং তার আদর্শ ও ইসলামী ছাঁচ অনুযায়ী গড়ে উঠবে। অধিকন্তু, ইতঃপূর্বে যে প্রথম পাঠ্যসূচির কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহকে সর্বত্র উপস্থিত জানা, তাকে ভয় করা ও ভালোবসার জন্য মানব মনকে তৈরি করবে। “তারা তাঁর রহমত লাভের প্রত্যাশা করে এবং আজাবকে ভয় করে।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৫৭)। যে শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মোপদেশ প্রচার করা হয় না, কিংবা ধর্মোপদেশ প্রদানের কাজকে উৎসাহিত করা হয় না প্রচলিত অর্থে সে শিক্ষাব্যবস্থাই পুরাপুরি বৈজ্ঞানিক বলে পরিচিতি। অথচ কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিজ্ঞানই বান্দাহকে তার প্রভুর নিকটতর হওয়ার ব্যাপারে সচেতন করতে পারে। সে বিজ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমেই বান্দাহ তার চারপাশের বিষয় সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হতে পারে।” বল! হে পরোয়ারদিগার, আমাকে আরো অধিক জ্ঞান দান কর।” (সূরা ত্বাহা, আয়াত ১৪৪)


ইতঃপূর্বে যেসব বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব নিয়ে, বিশেষ করে সমাজ- বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, শিক্ষা, সাহিত্য ও শিল্পকলার ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিস্তারিতভাবে আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ এখানকার সীমিত পরিসরে অনুপস্থিত। বিস্তারিত ও দীর্ঘ আলোচনাতেই তা সম্ভব হতে পারে।


পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশসমূহ সকল বিষয়কে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে। কম্যুনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আবার এই অভিন্ন বিষয়গুলো কম্যুনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের মুসলিম স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব বিষয় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পড়ানো হয় না। আমাদের মধ্যকারই কিছু লোক তো বরং এটিকে এক অদ্ভুত ধারণা বলেই বিবেচনা করে থাকেন। কেননা এসব বিষয় শিক্ষাদানে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণ করা হলে তা তাদের মতে আমাদের মনে যুক্তিহীন খেয়াল সৃষ্টি করবে এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধানের সত্যিকার চেতনার বিরুদ্ধে এক বেমানান কুসংস্কাররূপে পথ রোধ করে দাঁড়াবে। কিছু লোক তো নিজেদের ধর্মীয় বিষয়ে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে প্রশ্ন করতে পারে যে, এ ধরনের বস্তুগত বিষয়ের সাথে ইসলামী উপাদান কি আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ হবে? বিজ্ঞানও কি শুধুই বিজ্ঞান নয়, যার সাথে ধর্মের কোনই সম্পর্ক নেই এবং থাকা উচিতও নয়।


তাদের এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে নিশ্চিত এবং চূড়ান্তভাবেই বলা যায় : নাহ্! আমরা আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষাদান পদ্ধতি ধর্মীয় চেতনার উজ্জীবন ও বিকাশের কাজে যদি নিয়োজিত করতে পারি, আর আমাদের জীবনকে যদি ইসলামী আদর্শের মজবুত ভিত্তির ওপর স্থাপন করি, তাহলে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠায় আমরা সফলতা অর্জন করবো এবং তা আমাদের সার্বিক জীবনে বয়ে আনবে বিরাট, সীমাহীন সাফল্য । ক্রুসেড সাম্রাজ্যবাদ অধিকাংশ মুসলিম দেশের স্কুল শিক্ষার কারিকুলামে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণের পথ রুদ্ধ করেছে। সে অবস্থা থেকে আমাদের নিজেদের ব্যবস্থার মধ্যে প্রত্যাবর্তন এবং আমাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিক সত্তার পরিচয় উদঘাটনের এখনই চূড়ান্ত এবং উপযুক্ত সময়। সম্মেলন এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।


আমাদের স্কুলগুলোতে নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতির পূর্বোল্লিখিত বিষয়সমূহ সন্নিবিষ্ট করার পর বাকি থাকবে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়। অন্য সকল বিষয় সমন্বিত ও সম্মিলিতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সে অনুকূল পটভূমিতে প্রত্যক্ষ ও সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় তথ্য সম্বলিত বিষয় যদি অন্তর্ভুক্ত করা তবে তা সকল মূল্যমানের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। এ নিয়ে তখন কারো কোন আপত্তি ও থাকবে না। এসব ধর্মীয় তথ্যের মধ্যে ঈমান, ফিকাহ শাস্ত্র, কিরাত, হাদীস শামিল হবে। এছাড়া অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকে আপাতদৃষ্টিতে অনুপস্থিত বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। এসব কিছুর সমন্বয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ পাঠ্য বিষয় পাওয়া যাবে। সকল বৈজ্ঞানিক তথ্য, উপাত্ত ও উপাদান ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মুল্যায়ন, ব্যাখ্যা ও প্রমাণের লক্ষ্য যদি আমাদের নির্দিষ্ট হয়,তবে যে কোন বৈজ্ঞানিক বিষয় অধ্যয়ন কিংবা ইতঃপূর্বে উল্লেখিত যে কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদের আলোচনায় পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতি দিলে তাতে ক্ষতির কিছুই থাকবে না।


সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নিবেদিত পাঠ্য বিষয়ের আশু লক্ষ্য হবে ইবাদত, আচার- আরচণ, বিচারের সংক্রান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের সকল প্রয়োজনীয় তথ্য সম্পর্কে জ্ঞান দান করা কিন্তু ইসলামের আকর্ষণীয় সহনশীলতা এবং এর আলোক উজ্জ্বল চেতনার সাথে বিরাট অসঙ্গতি সৃষ্টি করে এ শিক্ষাকে কঠিন, প্রাণহীন ও নিরসভাবে উপস্থাপিত করার জন্য জেদ করার কোন কারণ নেই। জীববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ধর্মীয় প্রেরণার উজ্জীবন ও বিকাশের কাজে প্রয়োগের কথা কিভাবে অস্বীকার করা যাবে? প্রচলিত ধর্মীয় পাঠ্যসূচিকে কেন আমরা এত অনমনীয় ও মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী উপাদানে ভরে তুলবো? সে শিক্ষা ইসলামী আদর্শের কোন কাজে আসে না এবং মানুষের অন্তরকে তা এক ইঞ্চি পরিমাণও আল্লা- হর নিকটবর্তী করে না। মানুষের বিশ্বাস, তার আইন বিধান, তার ইবাদাত ও আচরণ সম্পর্কিত দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষাদানের জন্য যে কোরআন নাজিল হয়েছে, আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আল-কোরআনের সে পদ্ধতি ও ধারা আমরা অনুসরণ করি না কেন?


আল্লাহ, পরকাল, হাদীস, নৈতিকতা, বিচার ফয়সালা, কিংবা জিহাদের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে আল-কোরআন ধর্মীয় সচেতনতার এক প্রসারিত মহা সড়কে আমাদেরকে পরিচালিত করে। ইসলামী আইন বিধান সম্পর্কিত আল কোরআনের এমন একটি আয়াতও নেই, যা আমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না। বস্তুত, এমনি ধরনের প্রতিটি আয়াতই মানব মনকে আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে সমর্পিত হবার জন্য উন্মুখ করে তোলে। আমাদের ধর্মীয় পাঠ্যসূচি প্রণয়নের বেলায় আমরা কেন কোরআনপন্থী হবো না? মুসলমানরা এক সময় তাদের ধর্মকে দর্শন ও অধিবিধ্যা বা সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক এক অন্তহীন ও জটিল বিতর্কের বিষয়বস্তুত পরিণত করেছিল। সে যুগটি ইসলামের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়ের অংশ ছিল না। ইতিহাসের সে বিশেষ সময়টিতে বিদেশী ভাবধারার অনুপ্রবেশ ও সংক্রমণ মুসলমানদেরকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছিল; ফলে ইসলামী আদর্শের বিশুদ্ধতা, ইসলামী বিশ্বাসের সহজতা ও ঋজুতা, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা এবং তার জীবনীশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।


আমরা যদি যুগ সঞ্চিত সব মালিন্য ঝেড়ে ফেলে ইসলামের সঠিক, দ্ব্যর্থহীন সুস্থ ও প্রকৃত দৃষ্টান্তসমূহ অবলম্বন করে অসংকোচে উঠে দাঁড়াই, যদি আমরা আবার কোরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি, রাসূল (সা) এর জীবন এবং তাঁর সাহাবাদের ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি এবং বিশেষভাবে কোরআনের পথ ও পদ্ধতিকে আমাদের সকল বিতর্ক নিরসনের উপায়রূপে অবলম্বন করি, তবে আবার আমরা সম্মান ও মর্যাদার মস্তক উন্নত করে দাঁড়াতে পারবো।


এ প্রবন্ধে কোন কিছু বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। সঠিক পথের ওপর আলোক সম্পাতের জন্য কিছু টুকরো টুকরো বিষয়ের অবতারণাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন ।


লেখক: প্রফেসর, শরীআ’হ বিভাগ, কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।