বাংলাদেশে শিক্ষার সঙ্কট ও সমাধান - আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ
ভূমিকা:
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আকণ্ঠ সমস্যায় জর্জরিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অদ্যাবধি শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য সরকার সমূহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ এ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুমোদিত হয় সেই বছরই ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে আরও কতিপয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমশ সংকটমুখী যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাংগে ব্যথা ঔষধ দেব কোথা অবস্থা হলেও জাতীয় স্বার্থে এ অবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য। শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণশক্তি বা রুহ হল তার আদর্শ ও দর্শন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোন স্থির আদর্শ নেই। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন সমাজতন্ত্র গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কথা বললেও তা যে সোনার পাথর বাটির মতো একটি অবাস্তব কল্পনা বিলাস তা সকলেরই জানা। মূলত আদর্শের সংকটে আক্রান্ত বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার যে কাঠামো সিলেবাস কারিকুলাম রয়েছে তাও রক্তশূন্যতায় ভুগছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার রয়েছে বহুমুখী সংকট। এর প্রধান প্রধান দৃষ্টিকটু দিক গুলো হল : ১. আদর্শিক ২. সিলেবাস কারিকুলাম পদ্ধতি ৩. পাঠ্যপুস্তক ৪. শিক্ষক ৫. ছাত্ররাজনীতি ৬. সন্ত্রাস ৭. সেশনজট ৮. মেধাপাচার ৯. শিক্ষা খাতে বাজেট ১০.সর্বোপরি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গোলামি মানসিকতা।
এদেশের শিক্ষা অবকাঠামো বিগত ২৫ বছরে খুব যে বেড়েছে তা বলা যায় না। জনসংখ্যার অনুপাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে এ অবকাঠামো খুবই দুর্বল । যা-ও অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে। তার সিংহ ভাগ হয়েছে, বিশ্বব্যাংক ইউনিসেফ, ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন ডোনার এজেন্সির বদান্যতায়। জাতীয় বাজেটে মাত্র ৭% বরাদ্দ রেখে শিক্ষাকে আর কতদূর পুষ্ট করা সম্ভব ? একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন জাতির সিলেবাস, শিক্ষা কারিকুলাম আমাদের নেই। যা আছে তা কেবল আমলা মুৎসুদ্দি আর কেরানি তৈরির ক্ষেত্রে ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের জ্ঞানীজন টেক্সট রচনায় আগ্রহ পান না তাদের মেধা ব্যয়িত হয় নোট তৈরির কাজে। কারণ নোটের বাজার বড় অনেক বড়। শিশুশ্রেণী থেকে উচ্চ শিক্ষা যে দিকেই তাকানো যায় না কেন মানসম্পন্ন পাঠ্যবইয়ের অভাব।
সন্ত্রাস, সেশনজট আমাদের ভাগ্যলিপি। আর এরও মূল কারণ অস্থির রাজনীতি। শিক্ষাঙ্গনে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছাত্র সংগঠন যাদের প্রধান দায়িত্ব রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অন্ধ লেজুড়বৃত্তি। মেধা ও মননের বিকাশের পরিবর্তে এখানে চলছে সন্ত্রাস ও হননের অপ্রতিরোধ্য ধারা। এ শিক্ষাব্যবস্থার কুফল হিসেবেই পত্রপত্রিকায় ধিকৃত হতে অনেক বলাবলি লেখালেখির পরও আমাদের শিক্ষাঙ্গন আদুভাই মুক্ত হতে পারছে না। আদুভাই মারণাস্ত্র লাশ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের প্রতি লাঞ্জনা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন এগুলোই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বড় অবদান। এসব কি আমাদের জন্য সংকট নয়? অবশ্যই সংকট।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শতকরা ৪৫ জন শিক্ষক ডিগ্রির জন্য বৃত্তি নিয়ে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেন না। ছাত্ররাও বৃত্তির জন্য ছুটছে এবং কোনমতে একটি জুটলেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সময়ের ব্যবধানে গাড়ি বাড়ি নারীতে মত্ত হয়ে ওখানেই থেকে যাচ্ছে। মেধাবী তরুণ তরুণীরা এমন কোন উৎসাহ পাচ্ছে না যার জন্য তারা এদেশে থাকবে। আজ আমাদের গোটা জাতিকে হাড়ে হাঁড়ে মেধাপাচারের পরিণাম ভুগতে হচ্ছে।
বক্ষ্যমান প্রবন্ধে অবশ্য সংকটসমূহের বাহ্যিকরূপ ও তার বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরা হয়নি বরং সংকটের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তার সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা কী?
শাব্দিক অর্থের দিক থেকে শিক্ষা শব্দটির ইংরেজি Education, education শব্দটি e, ex . ducre due শব্দ গুলো থেকে আগত । শাব্দিকভাবে যে অর্থ দাঁড়ায় pack the information in and draw the talents out মূলত এর অর্থ অবগতি বা জ্ঞান প্রদান এবং জ্ঞেয় বিষয়ে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ । বস্তুত মানুষকে মানুষ করার আয়োজনই শিক্ষা। মানুষ ছাড়া সকল প্রাণীই প্রকৃতির নিজস্ব আয়োজনে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জ্ঞানসমৃদ্ধ হওয়ার জন্য একটি পরিকল্পিত কৃত্রিম কার্যকরী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। মূলত মানুষই হচ্ছে সামাজিক রাজনৈতিক ও সংঘবদ্ধ জীব। এজন্যই তার এত আয়োজন ।
প্রকৃত পক্ষে মানুষ তার হিতাহিত জ্ঞান নিয়ে জন্মায় না। জীব জগতের অন্যান্য শিশুর মতই মানব শিশুই অবোধ ও অবুঝ হয়ে জন্মায় তার মা-বাবা আত্মীয় স্বজন সমাজ ও পরিবেশ ইত্যাদি তাকে হিতাহিত জ্ঞানের উন্মেষে সাহায্য করে। তাকে মানুষ ও পশুর মধ্যকার পার্থক্য শিখায়। শিক্ষাই মানুষকে ভাল, মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, ন্যায়-অন্যায় সত্য মিথ্যার পার্থক্য ধরিয়ে দেয়।
প্রত্যেক মানুষেই তিনটি সত্তার সমন্বয় । দেহ, মন ও আত্মা এই তিনটি সত্তার সমন্বয়ে এক একজন মানুষের অস্তিত্ব । মানব শিশুর জন্মের পর থেকে ক্রমাগত এবং অব্যাহত পরিচর্যার মাধ্যমে তার দৈহিক বিকাশ ঘটে। নানা সামাজিক বিক্রিয়ায় তার মন বেড়ে ওঠে আর আত্মার শুদ্ধশুদ্ধি নির্ভর করে নৈতিকতার পরিগঠনের ওপর । এই জন্যই কবি মিল্টন বলেছেন, eduction is the harmonious development of body mind and soul, দেহ মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশই শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথও মিল্টনের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা ।
সক্রেটিস কিংবা তার শিষ্য প্লেটোর মতে নিজকে জানার নামই শিক্ষা ৷
কোন জাতির সন্তানগণকে সে জাতির উপযোগী যোগ্য, দক্ষ, সামর্থক ও কল্যাণমুখী সদস্য হিসাবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা । স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক জাতির শিক্ষাব্যাবস্থা এক হবে না। কারণ প্রতিটি জাতির প্রয়োজন এক নয়, সংস্কৃতি এক নয়, আধ্যাত্মিক চিন্তা এক নয়, সামাজিক রীতিনীতি ও লোকাচার এক নয় বরং তা ভিন্ন ভিন্ন।
শিক্ষা একটি সামগ্রিক বিষয়:
মিসরীয় দার্শনিক professor muhammad qutub the concept of islamic education প্রবন্ধে বলেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে ইসলামের কাজ হচ্ছে পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করা গড়ে তোলা, এমন একটি লালন কর্মসূচি যা মানুষের দেহ, তার বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্মা তার বস্তুগত আত্মিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের একটিকেও পরিত্যাগ করে না। আর কোন একটির প্রতি অবহেলা ও প্রদর্শন করে না।
আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভূত বিকাশের ফলে শিক্ষাকে নানারকম বিভাজনের শিকার হতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু তারপরও শিক্ষা তার অখণ্ডতা ও অবিভাজ্যতার ধর্ম পরিহার করেনি। সারা দুনিয়া আজ তার সাক্ষী ।
শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কাঠামো:
প্রায়শই এ দুটি কথাকে এক করে দেখা হয় এবং এটা মস্ত বড় ত্রুটি। যে কোন কাজের জন্য প্রথমে প্রয়োজন নীতির তার পরই আসবে তার কাঠামো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আজকের দুনিয়া নীতি ও কাঠামোর তারতম্য যেমন ভুলে আছে তেমনি ভুলে আছে এ দুটির প্রয়োগ। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরে নিই তাহলে দেখা যাবে এখনি একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। দেশে কয়েকটি শিক্ষা কমিশনও এজন্য হল। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, মজিদ খান শিক্ষা কমিশন ইত্যাদি। কিন্তু সবশেষে কী হলো? শিক্ষা নীতির ব্যাপারে কারো বক্তব্যই পরিষ্কার হল না। সবাই শুধু শিক্ষা কাঠামো নিয়ে কথা বললেন নীতি নিয়ে নয়।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চতর শিক্ষা ইত্যাদি কাঠামোগত বিষয়ে পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের মধ্যে শিক্ষার গুনগত মান কমতে বাড়তে পারে এতে মৌল উদ্দেশ্যের কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। তেমনি জাতীয় উন্মুক্ত, আনুষ্ঠানিক, উপ বা আধা বা অনানুষ্ঠনিক যে কোন ধরনের কাঠামোতে আপনি যান না কেন এতে শিক্ষার মূলত তারতম্য নেই। এসব কাঠামোগত পরিবর্তন কেবলমাত্র পাস ফেল ও ড্রপ আইটের হার কমাতে বাড়াতে সহযোগিতা করতে পারে, মানুষের বাইরের কিছু কিছু পরিবর্তনও ঘটাতে পারে কিন্তু ভেতরের মানুষকে সুন্দরতম হিসেবে বিকশিত করতে পারে না। সারাটা দুনিয়া আজ পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণ ও অনুকরণ করে জাতে উঠার চেষ্টা করছে এবং পশ্চিম তার গগনচুম্বী উন্নতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুরতিক্রম্য অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও মানবিকতার এক করুণ সংকট মোকাবেলা করছে। শিক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসার শূন্য আয়োজনে সেখানে ডিগ্রির পাশাপাশি নৈতিকতাকে স্থান না দেয়ায় নামী-দামী ডিগ্রির অভাব হচ্ছে না, ভৌত উন্নতির ঘাটতি হচ্ছে না অর্থ-বিত্তের অভাব হচ্ছে না অভাব হচ্ছে চিত্তের, মেধা ও মননের, মানবতাবোধ ও কল্যাণকামিতার আস্থা ও নির্ভরতার। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল এটা ছিল না । Education does not necessarily mean mere acquisition of degrees and diplomas it emphasises the needs for acquisition of knowledge to live a worthy life. অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্মানজনক জীবনযাপনের জ্ঞান অর্জন।
বৃটিশগণ আড়াইশত বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মুসলিম দেশ শাসন করেছিল । তার আগে কম বেশি প্রায় সারাটা পৃথিবী মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। দুই আড়াই'শ বছরের শাসনামলে ইংরেজদের সবচেয়ে বড় সাফল্য তাদের রেখে যাওয়া ‘শিক্ষাব্যবস্থা’। এ শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল শাসিত জনপদের মানুষের সাথে শাসকগোষ্ঠীর যোগাযোগ রক্ষার জন্য একদল কেরানি, আমলা মুৎসুদ্দি বা বেনিয়ান তৈরি। এর দ্বিতীয় ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল যাই হোক না কেন আচার-আচরন ও সংস্কৃতিতে হবে ইংরেজ । হয়েছেও তাই। বিষয়টি উপলব্ধি করা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব প্রতিপত্তিতে ভীতসন্ত্রস্ত মুসলিম শাসক সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য ইংরেজদের রেখে যাওয়া ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঘষে মেজে চালিয়ে যাচ্ছেন, স্বাধীন দেশ ও জাতি সত্তার উপযোগী কোন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেননি।
বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে কথাবার্তা হতে হতে এক পর্যায়ে মুসলিম দেশসমূহের চৈতন্যে আঘাত লাগে এবং ১৯৭৭ সালে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রথম আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় সম্মেলন হয় পাকিস্তানের রাজধানী শহর ইসলামাবাদে ১৯৮০ সালে, তৃতীয় সম্মেলন হয় ঢাকা মহানগরীতে ১৯৮১ সালে এবং ১৯৮৩ সালে ৪র্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায়। উক্ত সম্মেলন সমূহে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর মাঝে দু'টি প্রধান সুর হচ্ছে—
(ক) বর্তমানে বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রচলিত দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করত একটি মাত্র শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
(খ) বিভিন্ন ময়দানে বিশেষজ্ঞ তৈরির সুযোগ সম্বলিত এ অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে চরিত্রগতভাবে ইসলামী তথা এ ব্যবস্থা হবে ইসলাম চরিত্রের অধিকারী ।
এসব সম্মেলনের ফলশ্রুতি স্বরূপ উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী কয়েকটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্নত অনেক কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র কিন্তু অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। যার প্রধান কারণ হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর গোলামি মানসিকতা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ও মুসলমানদের মাঝে বিরাজিত সুপ্তি।
বিরাজিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কট:
ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিশাল এলাকা ও আফ্রিকায় অবস্থিত মুসলিম দেশসমূহ শাসন করেছে। যে সমস্ত ইউরোপীয় মুসলিম দেশ ছিল সেখানেতো তারা সকল কিছুকে অনৈসলামীকরণ (De-islamisation) এবং মুসলিমশূন্য করণের (Elimination) কাজে প্রথমেই হাত দেয় যার প্রক্রিয়া সম্প্রতি বলকান দেশসমূহে আরো সুস্পষ্ট হচ্ছে। যদিও তাদের এ স্বপ্ন কখনও বাস্তবায়িত হওয়ার নয়। অ-ইউরোপীয় দেশগুলোতে তারা উপরোক্ত দুটি কাজ অসম্ভব ধরে নিয়ে তৃতীয় একটি পথ বেছে নেয়। আর তা হচ্ছে মোনাফেক তৈরির প্রকল্প। উপমহাদেশে পর্তুগিজ ফরাসী ও বৃটিশরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিল মূলত দুই দুইবার স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই-ই চালু আছে। এমনকি মাদ্রাসাসমূহও প্রায় একই উদ্দেশ্য সাধন করে যাচ্ছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একের পর এক কমিশন এসেও বৃটিশদের রেখে যাওয়া ব্যবস্থার তেমন কোন গুনগত বা মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে পারেনি। স্বদেশের মাটি ছেড়ে বিদেশের বুকে বহু যত্নে ইংরেজরা একটি শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিল কেন? ১৮৩৫ সালে শিক্ষা পরিকল্পনার প্রধান দিক নির্দেশনাদাতা লর্ড ম্যাকলের সরকারকে প্রদত্ত পরামর্শে বলেন we must at present do ur best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons Indians in blood and colour but english in taste in opinions in morals and in intellect অর্থাৎ তারা চেয়েছিল এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে যারা রং আর রক্তে হবে ভারতীয় যা একান্তই বাহ্যিক ব্যাপার কিন্তু মেজাজ, চিন্তা, চেতনা, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ যাদের দ্বারা তারা শাসিত বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে ভাব বিনিময় করবে।
ইংরেজদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দেশীয় হিন্দু সম্প্রদায়কে খুব শিগগীর কাছে টেনে নিল। আর পর্যায়ক্রমে মুসলমানগণ রাষ্ট্র ও সামাজিকভাবে অসহায় অবস্থায় পড়ে আত্ম মুক্তির সোপান হিসেবে ইংরেজদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করল। শিক্ষাব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয় বরং রাষ্ট্রীয় জীবনের একটি অংগ।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ফলস্বরূপ একদল তথাকথিত সুশিক্ষিত লোক তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তারা জাতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য নয় বরং বিশ্ব মোড়লের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই সদা তৎপর । শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এরা একই লক্ষ্যে নিয়োজিত।
সাম্প্রতিক কালের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ ড: ইউসুফ আল কারজাভী তার Islamic Education and Hassan Al Banna গ্রন্থে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন এভাবে `The second main reaason lies in the effects of ideological war or the attacks of cultural terrorists which the muslims had to face during the foreign usurpation. This conquering capitalist gave modern views and ideologies and new values to the life of Muslims which were entered through the veins of modern racess by means of educational institutions and through adoption of the cultural sources.
The most dangerous scheme in which the capitalist succeeded, that is raised bred and trained such song among Muslims who called themselves `standard bearers of culture and civilization' He brought them up before his own attentive eyes provided for them and suckled them with new philosophies of life. He fed them with his own point of view and taught their heart and soul th be proud of new civilization. He taught them how to respect his own civilization and love to imitate his way but if he gave them the education of their own reliagion cultural and inheritance it was very little in quantity, very weak in quality and very cheap in value. Its contents opposed each other and its appearance was completely marred and mutilated.
So we are not surprised that today muslims living as strangers in their own country. Their faces are similar to the Arab Muslims but their minds have adoped the americans of European mode of thinking." আরব দেশের মুসলমানদের নিয়ে যে সমস্যা আজ বাংলাদেশের মুসলমানদের নিয়েও একই সমস্যা। কারোরই আর (National identity) জাতীয় পরিচয় নাই। হযরত ইব্রাহীম (আ) এর সন্তানগণ তাদের পরিচয় বিস্মৃত হচ্ছে। এটাই হলো প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান ত্রুটি বা সঙ্কট।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বড় সঙ্কট তার আদর্শহীনতা। ধর্মবিমুখতা। শিক্ষাব্যবস্থার দুটো ধারা থাকতে পারে। ১. নৈতিক নির্দেশনা সম্পন্ন শিক্ষা এবং ২. নৈতিক নির্দেশনা বিহীন শিক্ষা । বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বিতীয় ধারার। আদর্শিক নির্দেশনা বিহীন এই শিক্ষাব্যবস্থা মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। বিখ্যাত মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, if you give three sie, reading writing and arithmatic and do not give the fourth r, i,e religion they are dure top become the fifth R rascal. অর্থাৎ আপনি শিক্ষার্থীকে কেবল পঠন লিখন ও অংক কষা শেখালেন কিন্তু ধর্ম শেখালেন না তাহলে তারা দুষ্ট হতে বাধ্য। আমাদের সংকটটি এখানেই। আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্ম ও নৈতিকতা বিহীন একটি কারখানায় পরিণত করেছি। ফলে যতই আমরা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলকে লিখে রাখি শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রবেশ কর সেবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড় ততই আমাদের শিক্ষার্থী বন্ধুরা কার্টুনিস্ট নূর নবীর ভাষায় মানুষ হয়ে ঢুকছে আর ছাগল হয়ে বের হচ্ছে।
তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এই শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগতভাবে ধর্মহীন ধর্মবিদ্বেষ বা নিদেনপক্ষে অন্য ধর্মের প্রতি আগ্রহের জন্ম দিচ্ছে। উচ্ছ শিক্ষার নামে বিদেশগামী তরুণ তরুণীরা যতটা ধর্ম বিদ্বেষী হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে পরধর্ম আগ্রহী। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ভয়ঙ্কর পুনর্জাগরণ এবং ইউরোপ আমেরিকায় সাংঘাতিক ক্রসেড প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় ভোগ বিত্ত ও খ্যাতির পেছনে ধাবমান তরুণ তরুণীগন সস্তা ও সহজ পথ বেছে নিচ্ছে। উপরোক্ত আলোচনায় প্রতিভাত হলো যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জাতির উপযোগী লোক তৈরিতে ব্যর্থ । শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হেদায়াত তথা আল্লাহকে পাবার সঠিক পথের অনুসন্ধান লাভ, ইমাম গাজ্জালীর এ বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নিলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিতীয় সংকট হচ্ছে এটি ক্রমাগতভাবে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এই ব্যবস্থায় শিক্ষা ও ডিগ্রি প্রাপ্ত মানুষ এক ধরনের অহংবোধ ও আত্ম প্রসাদে তৃপ্ত হতে থাকে যা তাকে স্রষ্টার প্রতি বিনয়ী হতে দেয় না । বরং এ ব্যাপারে উদাসীন করে তোলে। ইহ ও পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে অস্পষ্টতা কিংবা কেবল জগৎমুখিতা সৃষ্টির ফলে এ শিক্ষায় শিক্ষিত লোক নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক দূরের বাদ্য শুনে লাভ কি মাজখানে তার বেজায় ফাঁক- জাতীয় জীবনে দর্শন অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বাসগত এ অবস্থান নিয়ে কেউই জাতি গঠন কাঙ্ক্ষখিত ভূমিকা রাখতে পারে না।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার তৃতীয় সংকট হচ্ছে এটি ধর্ম ও বিজ্ঞানকে পরস্পরের দুশমন হিসেবে পেশ করে। হাজার হাজার বিকৃতির পথ পাড়ি দিয়ে খ্রিষ্টধর্ম বিজ্ঞানবিরোধী যা নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় চার্চ ও বিজ্ঞানের যে দ্বন্দ্ব হয় তাকে কেন্দ্র করে ইসলামের মত বিজ্ঞানময় জীবন বিধানকেও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞানের শত্রু রূপে উপস্থাপন করে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে বুঝার কোনই সুযোগ নেই যে রসায়নশাস্ত্রের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান এলজেবরার জনক আল জাবির চিকিৎসা শাস্ত্রের পথিকৃৎ, ইবনে সিনা কিংবা আধুনিক সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এসব শাখায় অতুলনীয় অবদান রাখতে সক্ষম হন। শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালি শ্রেয় কিংবা জ্ঞানীর এক ঘন্টা জ্ঞান সাধনা মূর্খের সারারাত্রি নফল এবাদতের চেয়ে কল্যাণকর ইসলামে নবীর এসব অত্যুজ্জ্বল বাণীর সাথে পরিচিত সুযোগ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। বরং আছে বিদ্বেষ বিষোদগার ও বিকার। ইসলাম বর্বর যুগের আইন এটি বিজ্ঞান ও প্রগতির অন্তরায় সমাজ ও সভ্যতার পথে প্রতিবন্ধক এই হচ্ছে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য।
এই শিক্ষা ব্যবস্থায় চতুর্থ সংকট মানুষ ও সৃষ্টি জগতের সঠিক পরিচয় থেকে বঞ্চিত রাখা। মানুষ প্রথম থেকেই যে আশরাফুল মাখলুকাত বা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে দুনিয়াতে এসেছে শিক্ষা না দিয়ে এই ব্যবস্থায় শেখানো হয় মানুষ একটি বিবর্তনের ফল, অন্য কোন প্রাণী হিসেবে তার পূর্ব পুরুষ দুনিয়াতে এসেছিল এক সময় তার লেজ ছিল পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সে মানুষে পরিণত হয়েছে। এই যদি হয় মানুষের ইতিহাস তখন স্বাভাবিকভাবেই দয়া-মায়া প্রেম-ভালবাসা স্নেহ-মমতা মানবিকতা ও উন্নত গুণাবলি সিক্ত মানুষের ব্যক্তিও সামষ্টিক জীবনের ভিত্তি হয়ে পড়ে খুবই দুর্বল। মানব সৃষ্টি সম্পূর্ণ বিষয়টিই হয়ে পড়ে অর্থহীন। অনুরূপভাবে ইহ; পারলৌকিক জীবনের গুরুত্ব মানব জীবনের জবাবদিহিতামূলক অবস্থান স্রষ্টার কাছে ফিরে যাবার চিন্তা ইত্যাদি সম্পর্কে কোন ধারণাই এই শিক্ষাব্যবস্থায় দেয় না বরং জীবনের সৃষ্টি স্থিতি ও ধ্বংস সবকিছুকে ইহলৌকিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে মানব সৃষ্টির মাহাত্মকে খাটো করে দেয় । এমত বস্থায় মানুষের মধ্যে উদার চিন্তা কর্মফলের মাঝে বেচে থাকার বাসনা ও মানবিকতার বিকাশ ব্যাহত হয় ।
শুধু তাই নয় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় সংকট তার ইউরোপকেন্দ্রিকতা জ্ঞান বিজ্ঞানের সমস্ত উৎস পাশ্চাত্যের হাতে তুলে দিয়ে এ শিক্ষাব্যবস্থা দুনিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান ইতিহাস সব কিছুকে বিকৃতির হাতে সঁপে দিয়েছে। পাশ্চাত্য তার সুবিধামত ইতিহাস সমাজ বিজ্ঞান রাজনীতি ও অর্থনীতি সকল বিষয়ের বিশাল গ্রন্থ রচনা করে সেগুলোকেই ইতিহাস তৈরি করছে যা অধ্যয়ন করে ইসলামের সোনালি যুগের আলোকিত মানুষগুলোকে মনে হয় সবচেয়ে বর্বর অসভ্য ও পশ্চাৎপদ আর বিকৃতির পথে ধাবমান শাসক সাধকদের মনে হয় সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব । এটাই হচ্ছে পাশ্চ্যাত্যের শিক্ষা সাম্রাজ্যবাদ আর প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এই সাম্রাজ্যবাদের শাখা।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কোন নৈতিক বন্ধন মানুষকে শেখায় না বরং নৈতিকতার বল্গামুক্ত শিক্ষার দ্রুতগামী ঘোড়ার সওয়ার করে দেয়। গল্পচ্ছলে একটি শিশুকে শিখানো হয় কিভাবে দাওয়াত দিয়ে লুকিয়ে থেকে প্রতারণা করা যায়। সুদ কষার মত অংকের মাধ্যমে মানবতার দুশমন সুদের প্রতি আকৃষ্ট করা হয় কিশোর মনকে। লাভ লোকসানের অংকের নামে দেয়া হয় সুদ কষার অংক দেয়া হয় ভেজাল দেয়ার তালিম, বিবর্তনবাদের নামে প্রদান করা হয় মানব ইতিহাসের বিকৃতি সবক। এভাবেই দেশ ও জাতির জন্য উপযুক্ত লোক তৈরির পরিবর্তে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে একদল ভোগবাদী স্বার্থ পূজারী ও অবিবেচক লোক যা কিনা সদা সর্বাদা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কটময় অবস্থার চিত্র।
ধর্মবিরোধ, ধর্মবিদ্বেষ ও ধর্মহীনতা বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে জঘন্য সংকট মূলত যেখানে ধর্ম উপেক্ষিত সেখানে সকল মহৎচিন্তা সৎকর্ম কল্যাণকামিতা ও কল্যাণধারা অনুপস্থিত। ধর্মবোধ তথা স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যই মানুষকে দায়িত্ববোধ সম্পন্ন কর্তব্যনিষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ সৎকর্মশীল ও বিনয়ী হতে শেখায়।
আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোর দিকে তাকালে আরেকটি সংকট লক্ষ্য করা যায় আর তা হচ্ছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাসের কবলে নিপতিত শিক্ষাঙ্গনের লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের সামনে এক চরম হতাশার ছায়া নেমে এসেছে। আজ কয়েক লক্ষ বাংলাদেশী তরুণ তরুণী পাশের দেশসহ বিভিন্ন দেশে পড়ছে প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে সেসব দেশে। সন্ত্রাস সেশনজট আর অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যেই তাদের এই ছুটাছুটি। সন্ত্রাসের কবলে পড়ে প্রতি বছর জীবন দিচ্ছে কত অসহায় নিরীহ ছাত্র বন্ধু, খালি হচ্ছে দুঃখিনী মায়ের বুক । ১৯৭১ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত এই ২৬ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে গড়ে ছাত্র হত্যার হার বছর প্রতি ১৩.৫ এর মতো আহত সংখ্যা গড়ে ৩৬৫ এর অধিক এবং বিভিন্ন সংঘর্ষের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের গড় হার বৎসরে ১৫ এর অধিক। এ চিত্রটি শুধু উদ্বেগজনক নয়, শংকাজনকও বটে। কারণ এ হার গত পাঁচ বছরে ক্রমবর্ধমান । বর্তমান সময়ে সন্ত্রাস ছাত্রদের বলয় ছেড়ে এখন ছাত্রীদের অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ইডেন কলেজে পর পর কয়েক দফা যা ঘটে গেল তা তো কোন শুভ লক্ষণ নয়।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি সঙ্কট হচ্ছে কাঙ্খিত মানের শিক্ষক সঙ্কট:
অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকগণ ছাত্রছাত্রীদের ফ্রেন্ড ফিলোসফার ও গাইড হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তা পালনে ব্যর্থ। আজকালকার অনেক শিক্ষকই যেনো শিক্ষা শ্রমিক কিংবা শিক্ষা ব্যবসায়ী মাত্র। যেন তারা কেবল অর্থের জন্যই ছুটছেন জ্ঞানের সওদাই যেন তাদের একমাত্র কাজ। ছাত্রদের নৈতিক আধ্যাত্মিক উন্নতির বিষয়টি প্রায় শিক্ষকের কাছেই উপেক্ষিত। জ্ঞান তপস্যার ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকগণ অধিক্তমাত্রায় রাজনীতিতে লিপ্ত । তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অপরিপক্ব অপরিনামদর্শী ছাত্র ছাত্রীগণ । শতকরা ৯০ জন মানুষ যে দেশে মুসলিম সে দেশের অধিকাংশ শিক্ষক যখন ইসলামী আদর্শের ব্যাপারে উদাসীন ও নির্লিপ্ত তাদের আচার আচরণ ও দৈনন্দিন চর্চায় যখন ইসলাম উপেক্ষিত তখন শিক্ষাব্যবস্থা সংকটে পতিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ধর্মহীনতার চরম বিকাশ ঘটেছিল সমাজতন্ত্রীদের হাতে। তাদের বস্তুতান্ত্রিক তথাকথিত প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানময় শিক্ষার চোখ ধাঁধানো সাফল্য পৃথিবীর মানুষকে বিমোহিত করেছিল। কিন্তু মাত্র চুয়াত্তর বছরের ব্যবধানে পিতৃভূমিতে সমাজতন্ত্রের আত্মহত্যা ও এর গগনচুম্বী সাফল্যের বিশাল ভগ্নস্তূপ পৃথিবীবাসীর মনে তৃতীয় এক চিন্তার জন্ম দিয়েছে। আজ ধর্ম ও স্রষ্টার অবিচল বিশ্বাসই তাদের একমাত্র ভরসা। সেক্যুলার আমেরিকার আগামী প্রজন্ম যখন বিয়ের আগে ইয়ে নয় বলে শপথ গ্রহণ করে তখন বুঝতে বাকি থাকে না সেখানেও ধর্ম এক অপ্রতিহত কল্যাণ ধারার জন্ম দেয়া শুরু করেছে। ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তকগুলো অচিরেই ফুটপাথের অপ্রয়োজনীয় গ্রন্থে পরিণত হতে কেবল বুঝি সময়ের অপেক্ষা মাত্ৰ৷
সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা:
জীবন বিধান হিসাবে ইসলাম একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিধান। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কেই ইসলামের নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে। ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের উদ্ভূত সকল সমস্যার সমাধান ইসলামে রয়েছে । জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার ব্যাপারেই ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি তত্ত্বীয় ও ফলিত বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য সবকিছুর ব্যাপারেই ইসলামের বক্তব্য রয়েছে। নবী করীম (সা) এর জামানা থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের মুসলমানগণ জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
সম্ভাবত কোরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যার প্রথম বাণী পড় যার ছত্রে ছত্রে মানব জীবনের সকল জটিল বিষয়ের সহজ সরল প্রাঞ্জল ও যুক্তিপূর্ণ অবতারণা এবং মুহাম্মদ (সা) ই একমাত্র রাসূল যিনি জগতের মানুষের কাছে জ্ঞান ও শিক্ষাকে বড় করে দেখিয়েছেন। ইসলামের সর্বশেষ নবী পরিষ্কার করে বলেছেন জ্ঞান অর্জন সকল নর নারীর ওপর ফরজ-চীনে যেতে হলেও জ্ঞান অর্জন কর। দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর । হযরত মুহাম্মদ (সা) যিনি মানবতার মহান শিক্ষক তিনি শিক্ষার একটি পরিপুর্ণতা দিয়ে গেছেন। তাঁর বা পরবর্তী চার খলিফার আমলে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা। তা চালু না হলেও ইসলামের প্রথম দিক থেকেই শিক্ষাকার্যক্রম চালু হয়েছিল। নবী করীম (সা) নিজের পরিচয়ে বলেছেন আমি প্রেরিত হয়েছি শিক্ষক হিসেবে। তাঁর কাছে কোরআনের কোন আয়াত নাজিল হলেই তিনি তা সাহাবীদের শোনাতেন কেউ তা মুখস্থ করে রাখতেন। পরবর্তীতে রাসূল (সা) এভাবেই ইসলামের বিকাশ স্তরেই একটি স্বতঃস্ফূত শিক্ষা কারিকুলাম ও ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এ শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচ আসহাবে সূফা। রাসূলের (সা) কোন শিক্ষাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। ফলে সাহাবীরা কখনও প্রান্তিকতায় ভোগেননি, তারা কেউই বিজ্ঞান বিদ্বেষী ছিলেন না। আবার অতিমাত্রায় বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ধর্মের সাথে বিরোধে অবতীর্ণ হননি বরং ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও বিজ্ঞানানুরাগী হয়েছিলেন। জ্ঞানের নানা বিচিত্র শাখার প্রবল বিকাশ ঘটেছিল ইসলামের সোনালি যুগের শাসকদের হাতে। এসবের ওপর বই লিখেছেন। তাদের পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় সমুহে সারা দুনিয়ার জ্ঞান পিপাসু ছাত্রগণ এসে জড়ো হয়েছিল। তারা জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত হওয়ার চেষ্টা করেছে। জ্ঞানের সাথে রাষ্ট্র ও ধর্মের কোন বিরোধ হয়নি। নির্বিরোধ জ্ঞান চর্চার সুযোগই ইসলামের ইতিহাসে জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন মনীষী।
আজ যদি প্রশ্ন করা হয় ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা কী? এর সরল সহজ জবাব হবে যে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসাবে শিক্ষাব্যবস্থা থাকে তাই ইসলামী শিক্ষা। এই শিক্ষার উদ্দেশ্য ইসলামী রাষ্ট্রের সকল দিক ও বিভাগ পরিচালনা করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন একদল লোক তৈরি যাদের মন মগজ চরিত্র হবে পূর্ণরূপে মুসলিম। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অন্যান্য সকল মতবাদের চাইতে ইসলামকেই ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে প্রয়োগযোগ্য উন্নত ও ব্যবস্থা কোরআন হাদিসকে প্রাধান্য দেয় এবং এরই আলোকে পাঠদান করে।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে যোগ্য ও দক্ষ বিজ্ঞানী দার্শনিক শাসক বিচারক অর্থনীতিবিদ সেনাপতি রাষ্ট্রপতি চিকিৎসক প্রকৌশলী সাহিত্যিক ইত্যাদি তৈরি করতে ব্যস্ত সেক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হল এসব যোগ্যতার পাশাপাশি লোকগুলোকে ভাল মুসলমানে পরিণত করা। আর কেবল তাহলে এইসব লোক অর্জিত জ্ঞান ও অধীত বিষয়কে মানুষের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে এদের কাছে দেখা দেবে অসহায় ক্ষুধাকাতর ও স্নেহবঞ্চিত লক্ষ্য শিশুর মুখে হাসি ফোটানোর বিষয়টি। এই যে মানবতা এই মানবতাই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য।
স্রষ্টার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস জগৎ সৃষ্টির স্রষ্টা প্রদত্ত ইতিহাস ও ব্যাখ্যা ইহলোক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে সুষম সমন্বয় বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও অগ্রগতির সাথে সমান্তরাল অগ্রযাত্রা এই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার সোনালি ফসল।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হবে কিভাবে:
শিক্ষাব্যবস্থা সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটি অংশ । রাষ্ট্র ইসলামের পুর্ণাঙ্গ অনুসারী না হওয়া পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বের মুসলিম দেশসমূহ ইসলামের পরিপূর্ণ বিধানকে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে না করার কারণেই কোথাও ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য মডেল নেই ।
ইসলামী রাষ্ট্র না হলেও যে সব লোক ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন তারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার অনস্বীকার্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে ব্যক্তি ও সাংগঠনিক পর্যায়ে এর রূপরেখা তৈরি করে বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। সমাজ বিপ্লবের অংশ হিসেবেই একদল লোককে শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব সৃষ্টির প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তক:
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর আগেই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন সমূহের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সরকারি অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব পাঠ্যপুস্তক চালু করা প্রয়োজন এবং তা হতে হবে ভবিষ্যৎ প্রয়োজন পূরণকে সামনে রেখে।
বর্ণমালার বই থেকেই শিশুর প্রথম মানুষ গঠনের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচনা করলে দেখা যাবে ঘরে ঘরে আজ ভর্তুকি দেয় ভারতীয় বর্ণমালার বই যা শিশুর মনে জাতীয় ও ধর্মীয় বিষয়সমূহের একটি হিন্দুয়াণি ও ভারতীয় ছাপ সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় শিশুপাঠ্যসহ সকল পর্যয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণোয়ন প্রকাশ বিক্রি ও বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকসমূহে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে।
(ক) প্রচলিত পরোক্ষ নীতিতেই শিশু পাঠ্যসমূহে খেলার মাধ্যমে অক্ষর সংখ্যা ও শব্দ জ্ঞান দিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে ইসলামী বিষয়সমূহকে পরিচিত করার প্রয়াস পেতে হবে।
(খ) পরোক্ষভাবে সুদ ভেজালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য প্রচলিত শিক্ষায় যে সুদকষা ও লাভ লোকসানের অঙ্ক রয়েছে সেখানের যাদ সুদের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হয় যা ভেজাল দেয়ায় লোকের কত ক্ষতি হলো বা গোয়াল ঠকিয়েছে। এ প্রশ্ন করা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে এ দুটো বিষযে ঘৃণাবোধের জন্ম হবে।
(গ) স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লিখতে গিয়েই পবিত্রতার ইসলামী ধারণা দিয়ে দেয়া যায়। সৌরজগৎ সম্পর্কে বই লিখতে গিয়ে সেখানে আসমান গ্রহ, তারা ছায়াপথ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করলে শিক্ষার্থী কোরআন ও বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য খুঁজে পাবে।
পরিবেশ রচনা:
কেবল পাঠ্যপুস্তক মানুষকে শিক্ষিত করে না শিক্ষার্থীর ওপর একটি ব্যাপক প্রভাব ফেলে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ। অথচ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী পরিবেশ নিশ্চিত নয় বরং সেখানকার পরিবেশ একেবারেই ইসলামবিরোধী। এ ধরনের পরিবেশ কোরআন হাদীসের যত কথাই শুনানো হউক না কেন শিক্ষার্থীর চরিত্রে এর কোন প্রভাব পড়বে না । আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে প্রায় ক্ষেত্রে নামাজের ঘর বা মসজিদ থাকে কিন্তু সেখানে নামাজ আদায় বাধ্যবাধকতা নয় বরং ঐচ্ছিক। আবার কোথাও নামাজের আয়োজন নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে পর্দার বিষয়টিও উপেক্ষিত । মিথ্যাচার মিথ্যা সাক্ষ্য নির্বাচনকালে দূষণীয় বিষয় হিসাবে গণ্য না হয়ে আর্ট বলে বিবেচিত হয়। ইসলামী নৈতিকতা সেসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকা কঠিন ।
আমাদের শিক্ষার্থীগণ অশৈশব পারিবারিক প্রথা ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাসের আলোকে যা কিছু ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে তারা সে সবের সম্পূর্ণ বিপরীত অভিজ্ঞতার লাভ করে। আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা ও বিশ্বাস পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব শ্রদ্ধাবোধ সালাম বিনিময় নীতি নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয় উপেক্ষিত হতে দেখে তার ভেতর ধীরে ধীরে ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। এমতাবস্থায় তাদেরকে এমন একটি পরিবেশ দেয়া প্রয়োজন যা তার ভেতরে বিষয়গুলোর প্রতি ক্রমাগত শ্রদ্ধা জাগাবে। তা নাহলে গোটা শিক্ষা জীবনে বিশ্বাসের বিপরীত কাজ করার ট্রেনিং লাভ করতে থাকে যে শিক্ষার্থী সে ঘুষ খাওয়াকে অন্যায় জানার পরও তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
মূল্যবোধের উজ্জীবন:
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা আল্লাহ-রাসূল (সা) ও আখেরাত সম্পর্কে ইসলাম প্রদত্ত চেতনা হালাল হারামের যে সীমা ইসলাম বেঁধে দিয়েছে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলাম যে বিধান দিয়েছে তা হুবহু মেনে চলতে গেলে মানুষের মধ্যে একটি মূল্যবোধের জন্ম নেয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেইসব মূল্যবোধের সাথে পরিচিত করা না হলে তারা ডিগ্রি লাভ করবে কিন্তু ভেতরের মানুষটি শিক্ষিত হবে না। পাশ্চাত্যের সাথে আমাদের পার্থক্য মূল্যবোধগত। আর পাশ্চাত্যের প্রচেষ্টা আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করার জন্যই নিবেদিত। অবশ্যই ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্যে যারা কাজ করছেন নিজস্ব পরিসরে এসব মূল্যবোধ ধরে রাখার একটি প্রয়াস অব্যাহত থাকে।
দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে পার্থক্য নেই:
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা একজন মানুষকে পার্থিব কাজের জন্য বেশ ভাল মানের জ্ঞান প্রদান করলেও আখেরাতের ব্যাপারে উদাসীন করে দেয়। এর মূল শিক্ষাই হচ্ছে জীবনকে অখণ্ডভাবে না দেখে বিভাজিত রূপে দেখা। দুনিয়া ও দ্বীন-এ দু'ভাগে জীবনকে ভাগ করে দেয়া। কিন্তু ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম কথাই হলো- ‘দুনিয়া আখেরাতের কর্মক্ষেত্র'। এই দুনিয়ার কাজ কর্মের পরিণতিতে মানুষ আখেরাতের পুরস্কার বা তিরস্কার লাভ করবে।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে দুনিয়ার সমগ্র সৃষ্টির যথাযথ ব্যবহার, প্রয়োগ ও কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত করে থাকে। প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষকে তথাকথিত কল্যাণকর জীবনযাত্রা, দুনিয়া বিমুখ সন্ন্যাসব্রত পরিহার করে দুনিয়ার কর্ম ব্যস্ততার মাধ্যমে আখেরাতমুখী জীবনযাপনের শিক্ষায় অভ্যস্ত করতে হবে। এ কাজটি করা জন্য প্রয়োজন ‘হে রব, আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও, দাও আখেরাতেও'-এ দোয়ার আলোকে গড়ে ওঠা মানুষদের জীবন দিয়ে বুঝানো।
একটি সময় ছিল মুসলমানগণ যখন দুনিয়ার সমস্ত ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল এবং ‘দিনে ঘোড় সওয়ার, রাতে জায়নামাজে সিজদায়রত’ থেকে এক অনিন্দ্য সুন্দর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে আখেরাতের সাফল্য লাভে তৎপর ছিল। আজকের তরুণকে শেখাতে হবে তার খাওয়া, পরা, নিদ্রা, কথা বলা, চাকুরি করা, ব্যবসা, স্ত্রীর সাথে রাত্রিযাপন, সন্তানকে স্নেহের চুমো এঁকে দেয়া সবকিছুই যদি আল্লাহ্র দেয়া বিধান মতে হয় তবে তাই হবে ইবাদত। সুতরাং রাষ্ট্রচালনা, বিচারকার্য, যুদ্ধ করা, রাজনীতি চর্চা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন সবকিছুই হতে পারে ইবাদত আখেরাতে মুক্তির পথ-কেবল দুনিয়াদারী নয়।
জ্ঞানের ইসলামীকরণ:
ইসলামী সমাজ বিপব বা রাষ্ট্রব্যবস্থা চালুর আগেই প্রয়োজন বিভিন্ন বিষয়ের ইসলামীকরণের কাজ। ইসলামীকরণের নামে জ্ঞানের মূল বিষয় পরিবর্তন করা নয় বরং দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতির পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের কাজটি করতে হবে । বলা যায় জ্ঞানকে ইসলামের আলোকে পুণর্গঠিত করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ নিজ নিজ বিভাগে উচ্চতর শিক্ষার জন্য গবেষণামূলক অনুবাদধর্মী ও মৌলিক গ্রন্থ রচনার কাজ করতে পারেন। এক্ষেত্রে তারা স্ব স্ব বিভাগে বিষয় সিলেবাস পরীক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদি চালু করতে পারেন। সরকারি বেসরকারি গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা সমূহ প্রয়োজনীয় বইপুস্তক রচনা ও প্রকাশের কাজ হাতে নিতে পারে । কেউ কেউ অল্পমাত্রায় হলেও কাজটি করেছেন । কবি সাহিত্যিক বিজ্ঞানী আলেম শিল্পী ও লেখকগণ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নিজ নিজ বিষয়গুলোর ওপর গবেষণা করতে পারেন।
ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিশেষ কথা:
১. জনমত গঠন
দেশের শতকরা ৯০ জন মানুষ যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মুল্যবোধ নিয়ে জীবন যাপন করেছেন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা তারই অংশ। অতএব জনমত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে । যদি তা নাও হয়ে থাকে তাহলে জনমতকে প্রেষণা ও নির্দেশনার মাধ্যমে পক্ষে নিয়ে আসতে হবে। জনগণ যে শিক্ষা চায় না তা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে জনমত সংগ্রহ খুবই সহজ ধর্মদ্রোহীগণ ছাড়া আজ এর বিরূধিতা করতে পারবে না। আর ধর্মদ্রোহীগণ তো জনবিচ্ছিন্ন সংখ্যা লঘূ ।
২. মসজিদকেন্দ্রিক শিক্ষা
প্রায় সমগ্র মুসলিম দেশেই মসজিদ গড়ে উঠেছে মুসলিম সমাজের প্রাত্যহিক মিলনকেন্দ্র হিসাবে। মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, মডেলে মসজিদ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়া যায় । মসজিদকেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা বা স্কুল পূর্ব শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের কাজ সহজ হবে। কারণ লক্ষাধিক মসজিদের সবকটিই স্কুল ভবনের মত ব্যবহার করা সম্ভব।
৩.প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
বেসরকারিভাবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার মত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন । এ কাজটি কম বেশি চলছে সর্বত্র। আরব বিশ্বে ইখওয়ানুল মুসলি- মুন উপমহাদেশে জামায়াত তুরস্কে নুর জামায়াত অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। ইসলামী রাষ্ট্র হলে এসব প্রতিষ্ঠান ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের কাজটিকে সহজ করে দেবে। অবকাঠামোগত এসব অগ্রগতি ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রভূত সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে।
৪. প্রশিক্ষিত শিক্ষকমন্ডলী
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দেবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলীর অভাব। এই জাতীয় সঙ্কট থেকে বাঁচার উপায় শিক্ষাব্যবস্থায় অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী । শিক্ষকমণ্ডলীর ভেতর থেকেই ব্যাপক দাওয়াতি কাজের মাধ্যেমে একদল লোককে বেছে নিতে হক্ষে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসমান থেকে কতিপয় যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী নাযিল হবেন এমনটা কখনই হবে না। এক্ষেত্রে অতীতের চাইতেও বর্তমানে ইসলামপ্রিয় মানুষদের অবস্থান অনেক আশাপ্রদ।
৫. ইসলামী রাষ্ট্র পূর্বশর্ত
তাত্ত্বিকভাবে আমরা যতই আলোচনা করি না কেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যতিরেকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন অসম্ভব। রাষ্ট্রের আনুকূল্য ছাড়া বিশাল শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা সিলেবাসভুক্ত বইপত্র প্রকাশ প্রয়োজনীয় শিক্ষাপোকরণ সরবরাহ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্র কাঠামোর একটি অংশ মাত্র। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষাব্যবস্থাও ইসলামী হবে। এখন প্রয়োজন এমন এক প্রস্তুতির যাতে আমাদেরকে ৪৭ এর স্বাধীনতাত্তোর পাকিস্তান, ৭১ এর স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ কিংবা একের পর এক স্বাধীনতা প্রাপ্ত মুসলিম দেশগুলোর ভাগ্যবরণ করতে না হয় যারা ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে ঠিকই কিন্তু চিন্তা চেতনা ও মানসিকতায় সাবেক প্রভুদের গোলামির পরাধীনতা থেকে মুক্তি পায়নি৷
শেষ কথা:
মানুষ কোন বিষয়েই শেষ কথা বলতে পারে না এবং শিক্ষার মত একটি ক্রমবিকাশমান বিষয়ে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর পুঁজিবাদ মনে হচ্ছে যেন আরেকবার দপ করে জ্বলে উঠেছে। আর এটিই তার সর্বশেষ জ্বলে ওঠা। সভ্যতা সংস্কৃতি, জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দুনিয়াকে তেমন কিছু দেয়ার নেই এই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের। সমগ্র দুনিয়া জুড়ে নতুন এক পূর্ণর্জাগরণের পদধ্বনি শোনা যায়। আর তা হচ্ছে বিশ্বময় ইসলামী পূণর্জাগরণ।
বাংলাদেশকে শিক্ষার সংকট থেকে উদ্ধার করতে হলে মানুষ তৈরির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণসংস্কার করতে হবে। ইসলামীব্যবস্থা প্রবর্তনই হচ্ছে সেই সংস্কার কর্মসূচীর সর্বশেষ ধাপ।
লেখক: ডিরেক্টর- ষ্টুডেন্টস এ্যাফেয়ার্স ডিভিশন, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।