শনিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৪

আবদুস শহীদ নাসিম

ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত দক্ষ জনসম্পদ তৈরির শিক্ষানীতি - আবদুস শহীদ নাসিম

১. সূচনা
‘শিক্ষা’ নিয়ে লেখা সহজ কথা নয়। শিক্ষা নিয়ে লেখার জন্যে চাই শিক্ষা। এর জন্যে প্রয়োজনী দীক্ষা, প্রয়োজন সমীক্ষা। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে শিক্ষার সবুজ চত্বর গড়া যায় না।
আমাদের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কম চেষ্টা হয়নি এ যাবৎ। কিন্তু আমাদের শিক্ষার নিজস্ব ভিত গড়ে ওঠেনি এখনো। আমাদের শিক্ষার ভিত এবং অবকাঠামো গড়ার জন্য তৈরি হয়েছে এ যাবৎ অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন। প্রথম কমিশন থেকেই দেখা যায়, কমিশনের লোকেরা আমাদের শিক্ষার ভিত গড়ার জন্যে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, পাথর সংগ্রহ করার জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন দেশে দেশে।
কী লাভ হয়েছে তাতে? অনেক কমিশন, সংস্কার কমিটি, উন্নয়ন কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে এ যাবৎ। কিন্তু কূলকিনারা হয়নি কিছুরই।
কেউ বলতে পারবেন -কোন্ কমিশনের প্রস্তাবনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা? আমাদের শিক্ষানীতি?
বরং বিভিন্ন সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিভিন্ন সময় নিজেদের চিন্তা-চেতনার আলোকে শিক্ষার কারিকুলাম এবং সিলেবাসে যে সংস্কার সংশোধন করেছে, সেসব মেরামত নিয়েই চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।

হ্যাঁ, অবকাঠামোগত বেশ উন্নতি হয়েছে (কাঙ্ক্ষিত না হলেও)। তবে সেটা অনেকটা অন্তঃসারশূন্য। দেশে বর্তমানে অনুমোদনপ্রাপ্ত ৫২টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেগুলোর মান নিয়ে ব্যাপক লেখালেখির পর সরকার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এ বছর (২০০৪ ইসায়ী) সেগুলোর অবস্থা পর্যালোচনার জন্যে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তাতে দেখা যায় ৫২টির মধ্যে মাত্র ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় মানে চলেছে। ১০টির কোন মানই নেই । বাকি ৩২টিও সঠিক মানে নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক শিক্ষক পয়সার জন্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস নিচ্ছেন। একেকজন শিক্ষক একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন।

অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি আর ধর্মঘটের কারণে সেশন জট লেগেই আছে। ফলে, একদিকে দেখা যায়, আমাদের শিক্ষার কোনো আদর্শিক ভিত নেই। অপরদিকে দেখা যায়, আমাদের শিক্ষার কোনো আদর্শিক ভিত নেই। অপরদিকে দেখা যায়, অবকাঠামো যা-ই আছে তার অভ্যন্তরে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই।

আমাদের দেশে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার দাবি অনেক দিনের। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে জোর দাবি চলে আসছে। '৬৯ সালে এ দাবির কারণেই আবদুল মালেককে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই এযাবৎ এ দাবি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়নি।

অবিরত জোর দাবির কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ইসলাম শিক্ষা কিছুটা লেজুড়ের মতো এখনো লেগে আছে। এবং মাদ্রাসাশিক্ষার অস্তিত্ব বহাল আছে। তা না হলে এর ইসলামী শিক্ষা কী? ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা কেমন হবে? ইসলামী শিক্ষানীতি বলতে কী বুঝায়? এসব প্রশ্ন তুলে আসছেন অনেকেই। কেউ তুলছেন ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে। তবে জানার আগ্রহ নিয়েও প্রশ্ন করেন অনেকে।

এই প্রবন্ধে আমার উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর নীতিদীর্ঘ জবাব পেশ করার চেষ্টা করছি।

আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, আমাদের শিক্ষানীতিতে নিম্নে বিষয়গুলি স্বচ্ছতার সাথে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে-
- আমাদের জাতীয় আদর্শ কী?
- আমাদের শিক্ষার আদর্শ কী হবে?
- আমরা যুবসমাজকে কোন্ চেতনায় উজ্জীবিত করতে চাই।
- আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানদণ্ড কী হবে?
- কোন্ আদর্শ-চেতনা এর কোন্ নৈতিক মানদণ্ডে বলীয়ান হলে তারা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে?

আমরা বলবো, নিঃসন্দেহে শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শ আর ঈমানী চেতনা দ্বারাই এটা সম্ভব। এছাড়া আর কোনো মতবাদ আর মতাদর্শ দ্বারা এটা সম্ভব নয়।

এই আদর্শিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কর্মমুখী ও জীবনমুখী শিক্ষা অর্জন করবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। তখনই আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজ হবে জাতির জনসম্পদ। কেবল তখনই তারা স্বপ্ন দেখবে বিশ্বজয়ের, স্বপ্ন দেখবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার।


২. শিক্ষা কী?
দার্শনিক ও শিক্ষাবিদগণ শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। প্রাচীন দার্শনিক এরিস্টোটল, সক্রেটিস ও প্লেটো শিক্ষার তাৎপর্য বর্ণনা করে গেছেন। সেই থেকে পরবর্তী সকল যুগের চিন্তাবিদরাই শিক্ষা সম্পর্কে কথা বলেছেন। শিক্ষার পরিচয় এবং সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন।

আল কুরআন থেকে জানা যায়, নবীগণ শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁরা শিক্ষার তাৎপর্য এবং লক্ষ্য উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে নিজ নিজ জাতির সামনে পেশ করেছেন। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর ওপর অবতীর্ণ আল কুরআন এবং তাঁর নিজের বাণী হাদীস থেকে শিক্ষার তাৎপর্য এবং লক্ষ্য উদ্দেশ্য দিবালোকের মতো প্রতিভাত হয়। ইংরেজি ও আরবি ভাষায় শিক্ষার জন্যে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়, এখানে আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করবো, যাতে করে শিক্ষার মর্মার্থ ও তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে যায়। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রতিশব্দ হলো Education Education শব্দের সাধারণ আভিধানিক অর্থ হলো : শিক্ষাদান ও প্রতিপালন, শিক্ষাদান, শিক্ষা । Educate মানেঃ to bring up and instruct, to teach, to train অর্থাৎ প্রতিপালন করা ও শিক্ষিত করিয়া তোলা, শিক্ষা দেওয়া অভ্যাস করানো। (Samsad English-Bengali Diction- ary, Calcutta 22nd pression September 1990)

Joseph T. Shiple Zuvi Dictionary of Word Origins' -এ লিখেছেন, Educa- tion শব্দটি এসেছে ল্যাটিন 'Edex' Ges 'Ducer-Duc' শব্দগুলো থেকে। এ শব্দগুলোর শাব্দিক অর্থ হলো, যথাক্রমে বের করা, পথ প্রদর্শন করা। আরেকটু ব্যাপক অর্থে ‘তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া” এবং ‘সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে দেয়া'।

একজন শিক্ষাবিদ লিখেছেন, Education শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীর মধ্যকার ঘুমন্ত প্রতিভা বা সম্ভাবনার পথনির্দেশক। (মোঃ আজহার আলীঃ পাঠদান পদ্ধতি ও শ্রেণী সংগঠক, বাংলা একাডেমী-১৯৮২)

আরেকজন শিক্ষাবিদ লিখেছেন:
Education denotes the realization of innate human potentialities of indiveduals through the accumulation of knowledge". (Education in Islamic Society: A.M Chowdhury: Dhaka 1995)

কুরআন, হাদীস এবং আরবি ভাষায় শিক্ষার জন্যে যেসব পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সে শব্দগুলো এবার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। এক্ষেত্রে পাঁচটি শব্দের ব্যবহার সুবিদিত। সে শব্দ গুলোর নিম্নরূপ বিশ্লেষণঃ ১. তারবীয়াহ্ ২. তা'লীম ৩. তা’দীব ৪. তাদরীব ৫. তাদরীস

এই শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থ নিম্নরূপ:
হয় এ শব্দটি জ) নির্গত হয়েছে তারবীয়াহ শব্দ থেকে। এর অর্থ : Increase, to grow, to grow up, to exeed, to raise, rear, bring up, to educate, to teach, instruct, to develop, argment.

আর মানে : Education, up bringing, Instruction, Pedagogy, Breed- ing, Raising. (মু'জামুল লুগাতুল আরাবিয়াতুল মু'আসিরাহ By J. Milton Cowan.) palai (তালীম) শব্দটি গঠিত হয়েছে pls থেকে। তা’আলীম অর্থ- Information, Advice, Instruction, Direction, Teaching, Training, Schooling, Educa- tion, Apprenticeship, 66 পূর্বোক্ত

জনি (তা’দীব) শব্দটি গঠিত হয়েছে এই (আদব) শব্দ থেকে। ‘আদব’ মানেঃ Culture, Refinement, Good breeding, Good manners, Social graces, Decorum. অর্থবহ এ. (আদব) শব্দটি থেকেই গঠিত হয়েছে ৬৯-এ তাদীব শব্দ । তাই তা’দীব শব্দের মধ্যে একদিকে যেমন এইসব অর্থও নিহিত রয়েছে, অন্যদিকে তা’দীব দ্বারা Education এবং Disciplinell বুঝায়। (পূর্বোক্ত গ্রন্থ)

(তাদরীব) মানে : Habitation, Accustoming, Practice, Drill School- ing, Training, Coaching Tutoring. (উক্ত গ্রন্থ)

৬১ (তাদরীস) শব্দটি গঠিত হয়েছে (দারস) শব্দ থেকে। তাদরীস মানেঃ To study,
to learn, to teach, to instruct, to wipe out, to blot, to thrash out, tution. (উক্ত গ্রন্থ)

আভিধানিক অর্থ থেকেই পরিষ্কার হলো, এই পরিভাষাগুলো ব্যাপক অর্থবোধক। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শব্দদ্বয় অত্যন্ত প্রশন্ত ভাব ব্যঞ্জনাময়। তৃতীয় শব্দটি ব্যবহৃত হয় বিশেষভাবে আচরণগত সুশিক্ষাদান অর্থে। চতুর্থ শব্দটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অভ্যাস গড়ে তোলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। পঞ্চম শব্দটি ব্যবহৃত হয় গঠন, শিক্ষাদান, পাঠদান এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত অভ্যাস ও অবস্থা দূরীকরণ অর্থে।

এই পরিভাষাগুলো থেকে শিক্ষার সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ও ব্যাপক পরিধি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এই পাঁচটি পরিভাষার মর্মার্থ সাজিয়ে লিখলে ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার তাৎপর্য পরিষ্কারভাবে বুঝা যাবে। আভিধানিক অর্থ থেকে এই পরিভাষাগুলোর মর্ম নিম্নরূপ দাঁড়ায়:
১. প্রবৃদ্ধি দান করা/বৃদ্ধি করা/বড় করে তোলা।
২. উন্নত করা/ উঁচু করা/অগ্রসর করানো।
৩. পূর্ণতা দান করা/মহত্ত্বর করা/মহান করা/প্রস্ফুটিত করা।
৪. জাগিয়ে তোলা/উত্থাপিত করা/উজ্জীবিত করা।
৫. নির্মাণ করা/প্রতিষ্ঠিত করা/গড়ে তোলা।
৬. লালন পালন করা/প্রতিপালন করা।
৭. শিক্ষাদান করা/শিক্ষিত করে তোলা।
৮. অভ্যাস করানো/অনুশীলন করানো/জ্ঞাপন করা/ উপদেশ দেয়া।
৯. পরামর্শ দেয়া/শিক্ষাপূর্ণ আদেশ দেয়া/জ্ঞাপন করা/ উপদেশ দেয়া।
১০. অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণাদি থেকে বিরত করার উদ্দেশ্যে শাসন করা/ সুসভ্য করে গড়ে তোলার জন্য শাসন করা।
১১. অন্তর্নিহিত শক্তি বিকশিত করা/সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করা/ জন্মগত শক্তি, প্ৰতিভা ও যোগ্যতাকে প্রস্ফুটিত ও উদ্দীপ্ত করে দেয়া।
১২. সম্প্রসারিত করা/একটু একটু করে খোলা/বিকশিত করা।
১৩. পথ প্রদর্শন করা/ পথ নির্দেশনা দান করা/সঠিক পথের সন্ধান দেয়া।
১৪. প্রেরণা দেয়া/উদ্বুদ্ধ করা/উদ্দীপ্ত করা/উৎসাহ প্রদান করা।
১৫. সন্ধান দেয়া/সংবাদ দেয়া/তথ্য প্রদান করা।
১৬. শিক্ষাদান পূর্বক নিয়মানুগ করানো।
১৭. আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান।
১৮. শিক্ষানবিশিতে ভর্তি হওয়া।
১৯. সংস্কার করা/সংস্কৃতিবান করা/সুসভ্য করা/সংশোধন করা/ঘষে মেজে পরিচ্ছন্ন করা/নির্মল করা।
২০. শালীনতা, ভদ্রতা, শোভনতা, শিষ্টাচার এবং সম্মানজনক ও মর্যাদা ব্যঞ্জক আচার ব্যবহার শেখানো।
২১. ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও অমায়িক আচরণ শেখানো।
২২. আদব-কায়দা শিক্ষাদান/উন্নত জীবন প্রণালি শেখানো।
২৩. উন্নত নৈতিক আচরণ শিক্ষাদান/সচ্চরিত্র শিক্ষাদান।
২৪. প্রথা ও রীতিনীতি অভ্যস্ত করানো।
২৫. মানসিক, নৈতিক ও শারীরিক ধাত পরিগঠন করা।
২৬. কর্মদক্ষ করানো/কর্মে অভ্যস্ত করানো/কৌশল শেখানে/নিপুণতা অর্জনে সহায়তা করা।
২৭. অধ্যয়ন করা/দক্ষতা অর্জনের জন্যে মনোনিবেশের সাথে পাঠ করা/স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে অধ্যয়ন করা।
২৮. বিচার বিবেচনা করা/চিন্তা ভাবনা করা/গবেষণা করা/পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা/অনুসন্ধান করা।
২৯. উদ্ভাবন করা।
৩০. বিদ্যার্জন করা/পাণ্ডিত্য অর্জন করা/শেখা/জানা/দক্ষতা অর্জন করা।

আরবি ও ইসলামী পরিভাষায় শিক্ষার জন্য যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়, সে হলো সেগুলোর বাংলা অর্থ ও মর্ম। এর মধ্যে একেবারে পাঠদান ও পাঠগ্রহণ থেকে আরম্ভ করে মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও শারীরিক পরিপূর্ণ বিকাশ উন্নয়ন, পরিশীলতা ও দক্ষতা অর্জনের ব্যাপকতা রয়েছে। শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও মনীষীদের মতামত আলোচনা করলেও দেখা যায়, তাঁদের কেউ কেউ শিক্ষার খুব সংকীর্ণ অর্থ করেছেন। আবার কারো কারো দৃষ্টিতে শিক্ষার পরিচয় পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। মূলত শিক্ষা মানুষের পুরো জীবন পরিব্যাপ্ত। ‘দোলনা থেকে কবর' পর্যন্ত শিক্ষার ব্যাপকতা পরিব্যাপ্ত। মানুষ তার পূর্ণঙ্গ জীবনে যা যা কিছুই আহরণ করে, আত্মস্থ করে, তা শিক্ষার মাধ্যমেই করে। যে কোনো জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে হলো শিক্ষা।


৩. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: কুরআনের আলোকে
শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল-কুরআনেও মৌলিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। এ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলো আমরা এখানে উল্লেখ করছি। শেষের দিকে আয়াতগুলো থেকে প্রাপ্ত নির্দেশিকা ও উল্লেখ করবো:
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمُ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ. অর্থ : “তাদের অধিবাসীদের প্রত্যেক অংশ থেকেই যেনো কিছু লোক দীনের জ্ঞান লাভের জন্য বেরিয়ে পড়ে, অতঃপর ফিরে গিয়ে যেনো নিজ নিজ এলাকার লোকদেরকে সতর্ক করে, যাতে করে তারা বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে।” (সূরা আত তাওবা : ১২২)

مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللهُ الْكِتَبَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولُ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِى مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِن كُونُوا رَبَّانِيِّينَ. (ال عمران (۷۹)

অর্থ : “কোনো মানুষের এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, জ্ঞান এবং নবুয়্যাত দান করবেন আর এগুলো লাভ করে সে মানুষকে বলবে ; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হয়ে যাও । বরং সেতো বলবে ; তোমরা আল্লাহর দাস হয়ে যাও । (সুরা আলে ইমরান : ৭৯)

অর্থ : “সেখানে তারা আমার এমন এক দাসকে পেলো, যাকে আমি আপন রহমতে ধন্য করেছি আর নিজের পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান দান করেছি। মূসা তাকে বললো; আমি কি আপনার সঙ্গে থাকতে পারি, যাতে করে আপনাকে যে সত্য জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়েছে আপনি তা আমাকে শিক্ষা দেন?” (সুরা আল কাহাফ : ৬৫-৬৬)
-
অর্থ : “এই জ্ঞান লাভ করো যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।” (সুরা মুহাম্মদ : ১৯)

অর্থ : “এই জ্ঞান লাভ করো যে, তোমাদেরকে অবশ্যি আল্লাহর নিকট একত্রিত করা হবে।” (সুরা আলা বাক্কারা : ২০৩)
وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ - (البقرة: ۲۰۳):

অর্থ :“জেনে নাও যে, তোমরা অবশ্যি আলাহর সাথে মিলিত হবে। (সুরা বাক্বারা : ২২৩)
وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ مُلْقُوهُ - (البقرة: ۲۲۳)

অর্থ : “এই জ্ঞান লাভ করো যে, তোমাদের সন্তান ও সম্পদ পরীক্ষার বস্তু আর আলাহ্র কাছে রয়েছে অবশ্য বড় পুরস্কার।” (সুরা আনফাল : ২৮)
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا امْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَّاَنَّ اللهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ.

অর্থ: “জেনে নাও যে, কেবল আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক; তিনি উত্তম অভিভাবক আর উত্তম সাহায্যকারি” (সুরা আনফাল : 80 )
فَاعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَوةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهُوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْاَمْوَالِ وَالْاَوْلَادِ ....... وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَ
অর্থ : “এই জ্ঞানার্জন করো যে, দুনিয়ার জীবনটা একটা খেল তামাশা ও চাকচিক্য মাত্র আর পরস্পরে গৌরব করা এবং সম্পদ ও সন্তানের দিক দিয়ে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা মাত্র। ............ ...বিপরীত পক্ষে রয়েছে পরকাল। সেখানে আছে কঠিন আজাব আর আছে আল্লাহ্ ক্ষমা ও সন্তোষ।” (সূরা আল হাদীদ : ২০)

অর্থ : “আল্লাহ্ দাসদের মধ্যে জ্ঞানীরা তাঁকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির : ২৮)
وَالرَّاسِخُونَ فِى العِلمِ يَقُولُونَ أَمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذْكُرُ إِلَّا أُولُوا الأَلْبَابِ رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أنتَ الْوَهَّابُ. رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَّا رَيْبَ فِيْهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ
অর্থ : “জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী লোকেরা বলে- আমরা এ কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছি। এর সবটুকুই আমাদের প্রভুর নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে । শিক্ষাতো কেবল বুদ্ধিমান লোকেরাই গ্রহণ করে। তারা প্রার্থনা করে; হে প্রভু! তুমিই যখন আমাদের সঠিক পথে এনে দিয়েছো, তখন তুমি আমাদের মনে কোনো প্রকার কুটিলতা আর বক্রতা সৃষ্টি করে দিও না । তোমার রহমতের ভাণ্ডার থেকে আমাদের দান করো । কারণ প্রকৃত দাতা তো তুমিই। আমাদের প্রভু ! নিশ্চয়ই তুমি একদিন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করবে, যে দিনের আগমনে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কখনো ভঙ্গ করেন না অঙ্গীকার।” (সূরা আল ইমরান: ৭-৯)
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّينَ رَسُولاً مِّنْهُمُ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ
الْكِتَبَ وَالْحِكْمَةَ ـ (الجمعة: ٢)
অর্থ : “তিনি নিরক্ষরদের নিকট তাদের মধ্যে থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদেরকে আল্লাহ্র আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ বিকশিত করে আর তাদেরকে আল কিতাব ও আল হিকমাহ্ শিক্ষা দেয়।” (সূরা আল জুময়া : ২)

‘হিকমাহ্’ অর্থ-জ্ঞানবিজ্ঞান, কর্মকৌশল, কর্মপ্রক্রিয়া, প্রযুক্তি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি।
لَقَد أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَتِ وَاَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَبَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ـ الحديد: ٢٥)
অর্থ : “আমি আমার রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি দিয়ে পাঠিয়েছি। সেই সাথে তাঁদের কাছে অবতীর্ণ করেছি কিতাব এবং মানদণ্ড, যাতে করে মানুষ সুবিচারের ওপর
প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।” (আল হাদীদ : ২৫)
অর্থ : “কিন্তু জ্ঞানবান লোকেরা বললো; তোমাদের জন্য দুঃখ হয়, ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য তো আল্লাহ্র পুরস্কারই উত্তম।” (সূরা কাছাছ : ৮০)

আল কুরআনে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমরা এখানে যে আয়াতগুলো উল্লেখ করলাম, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য হলো :
১. মানুষকে তার স্রষ্টা তথা মহান আল্লাহর দাস হিসেবে তৈরি করা।
২. দ্বীন তথা আল্লাহপ্রদত্ত জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান ও উপলব্ধি হাসিল করা।
৩. সত্যকে জানা ও সঠিক পথের সন্ধান লাভ করা ৷
৪. তাওহিদের জ্ঞানার্জন করা।
৫. পরকালকে জানা এবং পরকালে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করা সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
৬. দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ এবং আল্লাহ্ পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষি হওয়া।
৭. আল্লাহকে অভিভাবক বানাবার যোগ্যতা অর্জন।
৮. আল্লাহ্ ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
৯. আল্লাহ্র ভয় অর্জন।
১০. সঠিক পথের সন্ধান লাভ করা।
১১. আল কুরআনের মর্ম উপলব্ধি।
১২. কর্মকৌশল ও কর্মদক্ষতা লাভ করা।
১৩. মানসিক, আত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষতা লাভ।
১৪. মানবসমাজকে সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত করবার যোগ্যতা অর্জন।
১৫. ঈমানের ভিত্তিতে সৎকর্ম অনুশীলনের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ্ পুরস্কার লাভের যোগ্য হওয়া।
১৬. সূরা আল বাকারার ১৪৭ নম্বর আয়াতে শারীরিক যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের যোগ্যতা অর্জনের কথাও বলা হয়েছে।
১৭. একই আয়াতে মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের যোগ্যতা অর্জনের কথাও বলা হয়েছে।

মোট কথা, কুরআনের দৃষ্টিতে শিক্ষার মৌল লক্ষ্য হলো, আল্লাহকে জানা, আল্লাহ্র দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করা, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালের মুক্তির জন্য নিজেকে তৈরি করা। শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আত্মিক ও প্রযুক্তিগত যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে সৎকর্মশীল বানানো এবং মানবতাকে সত্য ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে আল্লাহপ্রদত্ত জীবন বিধানের ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা।

৪. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : হাদিসের আলোকে
রাসুলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদিসেও শিক্ষার দিক-নির্দেশিকা উল্লেখ হয়েছে। এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস আমরা এখানে উল্লেখ করছি । হাদিসগুলো থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনাসমূহ ও শেষে সাজিয়ে উল্লেখ করবো।
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ وَمَلَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةِ فِي حُجْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتِ لِيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ -
অর্থ : “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ্, তাঁর ফেরেস্তাতারা, আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, গর্তের পিপীলিকা এবং পানির মৎস্য পর্যন্ত ঐ ব্যক্তির কল্যাণ কামনা করে, যে, মানুষকে কল্যাণকর শিক্ষা দান করে।” (তিরমিযি)
إِنَّ رِجَالًا يَأْتُونَكُمْ مِنْ أَقْطَارِ الْأَرْضِ يَتَفَقَّهُونَ فِي الدِّينِ، فَإِذَا آتَوُكُمْ
অর্থ : “বিশ্বের দিক-দিগন্ত থেকে মানুষ তোমাদের কাছে ছুটে আসবে দীনের মর্ম জ্ঞান উপলব্ধি করবার উদ্দেশ্যে। তারা যখন তোমাদের কাছে আসবে, তোমরা তাদের কল্যাণকর উপদেশ (শিক্ষা) দান করবে।” (তিরমিযি)
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يَبْتَغِي بِهِ وَجُهُ اللهِ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ غَرْضًا مِّنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدُ عَرُفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ـ (مسند احمد وابو داؤد و ابن
অর্থ : “যে শিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ্র সন্তোষ অন্বেষণ করা হয়ে থাকে, কেউ যদি তা পার্থিব স্বার্থে অর্জন করে, কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের গন্ধও লাভ করবে না।” (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
الْمُبْطِلِينَ وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ.
অর্থ : “প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্মের ন্যায়পরায়ণ লোকেরাই (কুরআন সুন্নাহর) এই জ্ঞানকে বহন করবে। তারা এ থেকে সীমা লংঘনকারীদের বিকৃতি, বাতিলপন্থীদের মিথ্যারোপ এবং অজ্ঞ লোকদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা বিদূরিত করবে।” (বায়হাকি)
مَنْ جَاءَهُ المَوتُ وَهُوَ يَطْلُبُ العِلْمَ لِيُحْيِيَ بِهِ الْإِسْلَامَ فَبَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّبِيِّينَ دَرَجَةٌ وَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ - (دارمی)
অর্থ : “ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করবার উদ্দেশ্য জ্ঞান অন্বেষণে লিপ্ত থাকা অবস্থায় যে লোক মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে, বেহেশতে তার ও নবীদের মাঝে পার্থক্য হবে মর্যাদার একটি মাত্র স্তর।” (দারিমি : হাসান বসরি থেকে
تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ وَعَلِمُوهُ النَّاسَ ، تَعَلَّمُوا الْفَرَائِضَ وَعَلِّمُوهَا النَّاسَ تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ بن مسعود) وَعَلِمُوهُ النَّاسَ - (دارمی) و دار قطنی عبد الله
:
"
অর্থ : ‘তোমরা যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা করো এবং তা মানুষকে শিক্ষা দাও । তোমরা দীনের বিধি বিধান ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করো এবং তা মানুষকে শিক্ষা দান করো। তোমরা কুরআন শিখো এবং তা মানুষকে শিক্ষা দান করো।” (দারিমি)

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদিসগুলো থেকে আমরা শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করলাম। হাদিসগুলোর আলোকে আমরা জানতে পারলাম, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো :-
১. মানব কল্যাণ।
২. সুশিক্ষা বিস্তার।
৩. আল্লাহ্কে জানা ও আল্লাহ্র সন্তোষ অর্জন। ৪. আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের উপায় জানা।
৫. কুশিক্ষা নির্মূল করা ও শিক্ষা সংস্কার করা।
৬. ইসলমাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
৭. কর্তব্যপরায়ণ হওয়া৷
৮. কুরআনের আলো বিস্তার।

৫. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-মনীষীদের দৃষ্টিতে
এবার দেখা যাক, শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনীষীরা কে কী বলেছেন; জন ডিউই বলেছেন; “শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলব্ধি।”

প্লেটোর মত হলো : “শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছুই প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।”

প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।”

এরিস্টোটল বলেছেন : “শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।”

শিক্ষাবিদ জন লকের মত : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্তকরণ।”

বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বাট বলেছেন : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভাবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের কাঙ্খিত প্ৰকাশ ৷”

কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ -এর মতে : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলদ্ধি।”

কমেনিয়াসের মতে : “শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা।”

শিক্ষাবিদ বলেছেন : “দেহ ও মনের সমান্তরাল পূর্ণ বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।”

পার্কার বলেছেন : “পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্ম প্রকাশের জন্য যেসব গুণাবলি নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুণাবলির যথাযথ বিকাশ সাধান।”

জিন জ্যাক রুশোর মতে : সুঅভ্যাস গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

Bartrand Russell-এর মতে একটি মন্তব্য হলো : “---------------The education system must aim at producing in the future is one which gives every boy and girl an opportunity for the best that exists.Ó

স্যার পার্সিনান বলেছেন : শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো : “চরিত্র গঠন, পরিপূর্ণ জীবনের জন্যে প্রস্তুতি এবং ভালো দেহে ভালো মন গড়ে তোলা।”

ড. হাসান জামান বলেছেন : !“স্বকীয় সংস্কৃতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সুনাগরিক তৈরি করা.......এবং জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নই হওয়া উচিত শিক্ষার উদ্দেশ্য।”

আল্লামা ইকবালের মতে : “পূর্ণাঙ্গ মুসলিম তৈরি করাই হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য।”

বিখ্যাত দার্শনিক ও ইসলামী চিন্তানায়ক সাইয়্যেদ আবল আ'লা মওদূদী (র) বলেন : মানুষ কেবল চোখ দিয়েই দেখে না, এর পেছনে রয়েছে তার সক্রিয় মন ও মগজ। রয়েছে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত। জীবনের একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে তার। সমস্যাবলি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার একটা প্রক্রিয়া তার আছে। মানুষ যা কিছু দেখে, শুনে এবং জানে, সেটাকে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীল করে নেয়। অতঃপর সেই চিন্তা ধ্যান ধারণার ভিত্তিতেই তার জীবন পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এই জীবন পদ্ধতিই হলো সংস্কৃতি। যে জাতি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যের অধিকারী এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব জীবনাদর্শ তাদেরকে তাদের নতুন প্রজন্মকে সেই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও জীবনাদর্শ রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ ও উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। আর সে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলতে হবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা।” (সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী : তালীমাত)

১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে ‘শিশু অধিকার সনদ' গৃহীত হয়। এতে চুয়ান্নটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ‘অনুচ্ছেদ ২৮’ শিশু শিক্ষা নিশ্চিত করার দলিল। অনুচ্ছেদ ২৯/১-এ শিক্ষার লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপ:

শিক্ষার লক্ষ্য
অনুচ্ছেদ : ২৯
১. শরিক রাষ্ট্রসমূহ এ ব্যাপারে সম্মত যে, শিশুদের শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকবে- ক. শিশুর ব্যক্তিত্ব, মেধা এবং মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ
খ. মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার এবং জাতিসংঘ ঘোষণায় বর্ণিত নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ;
গ. শিশুর পিতা-মাতা তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তা, ভাষা ও মূল্যবোধ, তার মাতৃভূমি এবং অপরাপর সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
ঘ. সমঝোতা, শান্তি, সহিষ্ণুতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সকল মানুষ, নৃগোষ্ঠী, জাতীয় ও ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং আদিবাসী লোকজনের মধ্যে মৈত্রীর চেতনার আলোকে একটি মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবনের জন্য শিশুর প্রস্তুতি;
ঙ. “প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ।”

এই অনুচ্ছেদটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের দৃষ্টিতে শিশুর শিক্ষার লক্ষ্য হলো:

১. ব্যক্তিত্বের পরিপূন বিকাশ;
২. মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ,
৩. মানসিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ;
৪. শারীরিক সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ;
৫. মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
৬. মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
৭. জাতিসংঘ ঘোষণায় বর্ণিত নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
৮. পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
৯. নিজস্ব সংস্কৃতিক সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
১০. নিজস্ব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
১১. নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
১২. মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
১৩. অপরাপর সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ;
১৪. সমঝোতা, শান্তি, সহিষ্ণুতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সকল মানুষ, নৃ-গোষ্ঠী, জাতীয় ও ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং আদিবাসী লোকজনের মধ্যে মৈত্রীর চেতনার আলোকে একটি মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ;
১৫. প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ।


৬. আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা
মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় শিক্ষা লাভ করে যাচ্ছে। কোনা না কোনো উপায়ে সে অবিরাম জ্ঞানার্জন করেই চলেছে। শ্রেণিকক্ষ আর পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে জ্ঞান সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ প্রতিনিয়ত জগতের সকলের এবং সকল কিছুর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেছে, অর্জন করেছে জ্ঞান। এই অবিরাম ও প্রতিনিয়ত শিক্ষাকার্যক্রমকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
১. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বা Informal Education
২. উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা Nonformla Education
৩. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা Formal Education

বিধিবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও পাঠ্যপুহমশক এ শিক্ষার প্রধান প্রধান উপকরণ। এছাড়া সময়ের সীমারেখা, পাঠ্যসূচির সীমাবদ্ধতা, পরীক্ষার বিধিবদ্ধতা, কর্তৃপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ ও স্বীকৃতির বেষ্টনীতে এ শিক্ষার বসবাস। উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় এসব আনুষ্ঠানিকতা পুরোপুরি থাকে না বটে, তবে কিছু কিছু থাকে। আবার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাও এটা নয়।

আর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা যাতে কোনো কৃত্রিম আয়োজন নেই। এখানে গোটা সমাজ আর পুরো বিশ্বজগৎই মানুষের শিক্ষাগার। কোনো প্রকার বিশেষ আয়োজন ছাড়াই মানুষ এখানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিখেই চলে।

এ ক্ষেত্রে মানুষের মা তার প্রথম ও প্রধান শিক্ষক, তার বাপ শিক্ষক। ভাই বোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ সকল আত্মীয় স্বজন তার শিক্ষক। তার প্রতিবেশীরা তার শিক্ষক। তার পরিবেশ তার শিক্ষক। তার সমাজ ও চলমান সামাজিক কার্যক্রম তার শিক্ষক, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম তার শিক্ষক। চলমান বিশ্ব ও বিশ্বব্যবস্থা তার শিক্ষক। প্রকৃতি তার শিক্ষক। তার নিজের সৃষ্টিতে রয়েছে তার জন্যে শিক্ষা। নক্ষত্ররাজি, সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহ এবং রাতদিনের আবর্তনের মধ্যে রয়েছে তার জন্যে শিক্ষা। এসবের কাছ থেকে এবং এসব কিছু থেকে মানুষ তার চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শুনে আর মনমস্তিষ্ক দিয়ে অনুভব উপলব্ধি করে দিনরাত অবিরাম শিখছে আর শিখছে। আহরণ করছে জ্ঞান আর জ্ঞান। বিকশিত করছে নিজের দেহ ও মনকে। প্রস্ফুটিত ও পরিশুদ্ধ করছে নিজের আত্মাকে। প্রখরিত করছে নিজের বিবেককে। এই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা অকৃপণ, উদার ও প্রাকৃতিক। কেউই বঞ্চিত হয় না এ শিক্ষা থেকে। তবে আজ আমরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েই আলোচনা করছি। কারণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষাতেই প্রয়োজন হয় অনেক আয়োজনের।


৭. শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি
শিক্ষা কী? শিক্ষাব্যবস্থা কী? শিক্ষানীতি কী? এ নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন অনেকেই। শিক্ষার পরিচয় তো আমরা আগেই দিয়ে এসেছি। এবার জানা যাক অপর দু'টি কী? শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থাপনার সকল দিক ও বিভাগ নিয়ে গঠিত হয় শিক্ষাব্যবস্থা। অন্যকথায় শিক্ষার সাথে জড়িত সকল বিষয়ে সমন্বিত রূপই শিক্ষাব্যবস্থা। অর্থাৎ শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য, শিক্ষার স্তর, শিক্ষার বিভাগ, শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম), পাঠ্যসূচি (সিলেবাস), পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাগৃহ, শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গ্রন্থাগার, পরীক্ষা বা মূল্যায়ন, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার জন্যে অর্থ, শিক্ষার পরিবেশ-প্রভৃতির সমন্বয়েই গঠিত হয় শিক্ষাব্যবস্থা আর উপরোক্ত বিষয়গুলো যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও নীতিমালার ভিত্তিতে গঠিত ও পরিচালিত হয়, তাকেই বলা হয় শিক্ষানীতি বা এডুকেশন পলিসি ।

যেমন অনেক বিভাগ, উপবিভাগ, দফতর, অধিদফতর, পরিষদ, উপপরিষদ ইত্যাদি নিয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। আর গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হয় যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও নীতির ভিত্তিতে- তা হলো রাষ্ট্রনীতি।
এভাবে সব ক্ষেত্রেই কর্ম এবং কর্মের আনুষঙ্গিক বিষয়াদির সাথে সাথে কর্মনীতিও থাকতে হয়। যেমন, কর্ম কর্মনীতি; শ্রম শ্রমনীতি। মূলত কোনো প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সংস্থা, সমাজ, সমষ্টি, রাষ্ট্র সেই নিয়মনীতি ও বিধি বিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তার উদ্যোক্তারা তা পরিচালনার জন্য যে নীতিমালা ও বিধিমালা তৈরি করে থাকেন।


৮. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পরও আজ পর্যন্ত এখানে আদর্শভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়নি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থ্যায় নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থা চলে আসছে আরো আগে থেকে।

মুসলিম শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে চালুছিল ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। সে শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হতো আদর্শ নাগরিক, আদর্শ মুসলিম এবং দেশ পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্ব ও জনশক্তি।

কিন্তু ১৯৫৭ সাল থেকে যখন ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করে নিতে থাকে, তখন থেকে তারা এ দেশে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করে, যে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা তাদের মানসিক গোলাম হিসেবে তৈরি হবে। তাদের খাদেম ও সেবক হয়ে কাজ করবে এবং মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেও সত্যিকার মুসলিম হয়ে গড়ে উঠবে না। শেষ পর্যন্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাহীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা তার শৌর্যবীর্য হারিয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষ্যাব্যবস্থা জমে ওঠে। চাকরি বাকরিসহ বস্তুগত জীবনধারণ ও জীবনযাপনের জন্য তখন এই শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।

সেই থেকে এদেশে চালু হয় দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। অর্থাৎ দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। একটি হলো ব্রিটিশদের বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। আর অপরটি হলো পূর্ব থেকে চলে আসা মুসলমাদের ধর্মীয় তথা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। এ সময় মুসলমানরা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ার কারণেই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে সেকেলে হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য লোক তৈরি করবার উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলে। ১৯৪৭ সালে ভাতরবর্ষ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার সময় ভারত বিভক্ত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত হয় ভারত। মুসলমানরা স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্র দাবি করেছিল ইসলাম অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য।

তাদের আদর্শিক ঐতিহ্য ও শিক্ষা সংস্কৃতি চালু করবার জন্য। কিন্তু যারা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আরোহণ করে, তারা মুসলমানদের এই প্রাণের দাবির সাথে গাদ্দারি করে। তারা পাকিস্তানে কিছুতেই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও চালু করেনি। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেনি। তারা ইংরেজদের চালু করে যাওয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা সবই হুবহু বহাল রাখে। কিছু সংস্কার সংশোধন করলেও ইসলামের পক্ষে তেমন কিছুই করেনি। কেবল মুসলমান জনগণের প্রবল চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান' নামের সাইন বোর্ডটি গ্রহণ করে। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা করেনি অতঃপর চব্বিশ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যায় পাকিস্তান হিসেবে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ৩৪ বছর বিগত হলো। আদর্শভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থ্যা এখানে চালু হয়নি। জনগণের প্রাণের দাবি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

স্বাধীন বাংলাদেশে ৪০ বছরে বেশ কয়েকটি শিক্ষা সংস্কার ও সুপারিশমালা প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছে এবং সে কমিটিগুলো রিপোর্টও প্রদান করেছে। তবে এ যাবৎ পাঁচটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। পাঁচটি কমিশনই তাদের বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদান করেছে।

কমিশনগুলো হলো:
প্রথম: কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৭৪
দ্বিতীয়: মজিদ খান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৭৯
তৃতীয়: মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৮
চতুর্থ: শাসছুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৯৭
পঞ্চম: মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ২০০৩

মূল ভিত্তির প্রেক্ষিতে উপরোক্ত কোনো একটি রিপোর্টই পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ রিপোর্ট হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য নয়। প্রথম কমিশনটি ছিলো ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশন ১৯৭৪ সালের মে মাসের এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এ রিপোর্টের ভূমিকায় বলা হয় : ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির অবসান ঘটবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা হবে”। নবদিগন্ত সূচনাকারী উক্ত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট থেকে কয়েকটি সুপারিশ আপনাদের সামনে উল্লেখ করছি :

১. “কাজেই দেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তসহ সকল শ্রেণীর জনগণের জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের উপলব্ধি জাগানো, নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব ও লক্ষ্য।” (অধ্যায় ১: ১)

২. “আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত ও বিকশিত করে তুলতে হবে এবং তার বাস্তব জীবনে যেন এর সম্যক প্রতিফলন ঘটে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।” (অধ্যায় ১ : ২)

৩. “সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির স্বার্থে নাগরিকদের শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে।” (অধ্যায় ১ : ৫)

৪. “নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীলতা, সংগঠন ক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।” (অধ্যায় ১ : ৯)

৫. “প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশকে গভীরভাবে ভালবাসতে হবে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ আদর্শের সম্যক উপলব্ধি অর্জন করতে হবে।” (অধ্যায় ২ : ১৩)

৬. “সমগ্র দেশে সরকারি ব্যয়ে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত একই মৌলিক পাঠ্যসূচিভিত্তিক এবং অভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।” (অধ্যায় ৭ : ৯)। (অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা থাকবে না। )।

৭. প্রাথমিক শিক্ষার পঠিতব্য বিষয় : সাপ্তাহিক পিরিয়ড : প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা থাকবে না। (অধ্যায় ৭ :১০)

৮. “মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর হবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের বয়সের প্রেক্ষিতে একই শিক্ষা পরিবেশে শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সম্মত।” (অধ্যায় ৭ : ১০)

৯. “নবম শ্রেণী হতে শিক্ষা কার্যক্রম মূলত দ্বিধাবিভক্ত হবে : (ক) বৃত্তিমুলক শিক্ষা ও (খ) সাধারণ শিক্ষা।” (অধ্যায় ৮ : ৫)। (ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে না)।

১০. “মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি অনেকটা একদেশদর্শী। কেননা সকল শিক্ষার্থীকেই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষা প্রদান মাদ্রাসার লক্ষ্য।” (অধ্যায় ১১: ২)।

১১. “বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল সংস্কার ও যুগোপযোগী পুনর্গঠনের প্রয়োজন । আমাদের সুপারিশ হচ্ছে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রিপোর্টের সপ্তম অধ্যায়ের বর্ণিত একই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম (১ম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) প্রবর্তিত হবে।” (অধ্যায় ১১ : ৩) (অর্থাৎ মাদ্রাসা থাকবে না।)

এ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তব ও কর্মমুখী করার জন্য অনেক প্রস্তাবই আছে। তবে সেই সাথে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতির ঈমান আকীদা, ধ্যান ধারণা, দৃষ্টিভংগি ও ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি করার একটা পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হচ্ছে । শুধু তাই নয়, জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইসলামী আদর্শের বিপরীত বিশেষ ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভংগিতে গড়ে তোলার সুস্পষ্ট সুপারিশ এই রিপোর্টে রয়েছে। সুতরাং এ রিপোর্টকে কতটা গণমূখী ও বাস্তবভিত্তিক বলা যায়?

এরপর ১৯৮৮ সালে প্রফেসর মফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টটি কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্টের চেয়ে অনেকটা উন্নতর। এ রিপোর্ট থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার নীতি বাদ দেয়া হয়। ধর্মের প্রতি কিছুটা অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই রিপোর্টে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হয়েছে নিম্নরূপ:

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১. দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেও প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন করে তোলা।
২. দেশের নিরক্ষতার অবসান ঘটান।
৩. সমাজের প্রতি স্তরের মানুষকে নিজ নিজ মেধা ও প্রবণতা অনুসারে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া।
৪. নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সঞ্চার করে পারস্পরিক মর্যাদারোধ সৃষ্টি করা।
৫. আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে শিক্ষার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি শিক্ষার্থীদের সশ্রদ্ধ করে তোলা।
৬. বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মানুরাগ বৃদ্ধি করে আমাদের বিপুল জনশক্তিকে জাতীয় সম্পদে পরিণত করা।
৭. শিক্ষাকে প্রয়োগমুখী করে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ সাধনের সাহায্যে দেশবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা।
৮. শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মানুরাগ বৃদ্ধি করা এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সমূহের বিকাশ সাধন করা।
৯. বিশ্বের সকল দেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একাত্মবোধ সৃষ্টি করা এবং তাদের বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক ও সমাজ-সচেতন মানুষে পরিণত করা।
১০. মৌলিক চিন্তার স্বাধীন প্রকাশে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা এবং সমাজে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটান। (জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৮)
এই রিপোর্টটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
অতঃপর ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গঠিত শামসুল হক কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সরকার এ কমিটিকে কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করে। দেশের বর্তমান সংবিধান এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সামাজিক ও শিক্ষক সংগঠনের চাপের মুখে এ কমিটি কুদরত-ই- খুদা কমিশনের রিপোর্টের চাইতে অনেকটা উন্নতর একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। এ প্রতিবেদনে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে:
১. ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীকে সচেতন করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা এবং তাদের চিন্তাচেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।
৪. দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষাকে প্রয়োগরুখী, উৎপাদনক্ষম সৃজনশীল করে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা।
৫. কায়িক শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তোলা এবং শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে আত্মকর্ম সংস্থানে নিয়োজিত হওয়ার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনে সমর্থ করা।
৬. বিশ্বভ্রাতৃত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।
৭. গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের বিকাশের জন্য পারস্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী, বস্তনিষ্ঠ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে সহায়তা করা।
৮. শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে পূর্ববর্তী স্তরে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত দৃঢ় করা ও এগুলো সম্প্রসারণে সহায়তা করা এবং নবতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের সমর্থ করা।
৯. জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকশিত করে বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা।
১০. দেশের জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১১. বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষালাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা।
১২. শিক্ষায় জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে নারী পুরুষ বৈষম্য (Gender bias) দূর করা।
১৩. শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো।
১৪. পরিবেশ-সচেতনতা সৃষ্টি করা। (২২) প্রতিবেদন: জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭, পৃষ্ঠাঃ ৯:৪০।

এখানে ২ নং পয়েন্টে সুস্পষ্ট ও অকাট্য কথা বলে দেয়ার পর ৩ নং পয়েন্টে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী, তা উহ্য ও অস্পষ্ট রেখে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া ৬, ৭, ৯, পয়েন্টসমূহ খুবই বিভ্রান্তিকর। এছাড়া এ প্রতিবেদনের ভেতরেও মাঝে মাঝে বেশ বিভ্রান্তিকর সুপারিশ করা হয়েছে।

২০০১ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর এ সরকার প্রথমে প্রফেসর এম.এ বারীর নেতৃত্বে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করে। এ কমিটি একটি ভালো রিপোর্ট প্রদান করে। অতঃপর এ সরকার প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিঞার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন-২০০৩ হিসেবে পরিচিত। এ কমিশন ৩১ শে মার্চ ২০০৪ তারিখে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। এতে শিক্ষাব্যবস্থার নীতিমালা নির্ধারণ করা হয় নিম্নরূপ:

মৌলিক নীতিসমূহ
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কতগুলো মৌলনীতির ভিত্তিতে, যা কমিশনের কাজের প্রথম দিকেই আলোচিত ও গৃহীত হয়েছিল, এ প্রতিবেদনটি প্রণীত হয়েছে। এগুলো এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে :
১. মূল লক্ষ্য: শিক্ষার মূল লক্ষ্য সমগ্র জনগোষ্ঠীকে স্বল্পসময়ের মধ্যে সম্পদে পরিণত করা।
২. শিক্ষার সুযোগ: ধর্ম, গোষ্ঠী সংস্কৃতি, নারী-পুরুষ বা ভৌগোলিক অবস্থানভেদে শিক্ষার সুযোগ, বিশেষভাবে মৌলিক শিক্ষাক্ষেত্রে সমবণ্টনের নীতি অনুসরণ।
৩. শিক্ষার গুণগতমান: শিক্ষার গুণগত মান সর্ব পর্যায়ে সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্ৰহণ৷
8. বিদ্যালয়ে ভর্তির বয়স: যে দিন শিশুর বয়স ৫ বছর হবে সেদিন তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করার প্রক্রিয়া চালু করা।
৫. প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ: সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি আওতায় আনয়ন করতে হবে।
৬. শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ছাত্রের অনুপাত ১:৩০ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই অনুপাত ১:৪০-এ নামিয়ে আনা।
৭. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সকল পর্যায়ে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
৮. শিক্ষাকাঠামো: বর্তমানের শিক্ষাকাঠামো অপরিবর্তিত রাখা বাঞ্ছনীয়।
৯. শিক্ষার বিভিন্ন ধারার সমন্বয় সাধন: বর্তমানে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রচলিত বিভিন্ন শিক্ষার ধারা সমাজে আর্থ-সমাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অসমতা সৃষ্টি করছে, যা সামাজিক সংহতি বিরোধী। হাঠাৎ করেই আজ যেহেতু এসব ধারা পরিবর্তন করা বাস্তবসম্মত নয় সেহেতু অন্তত বিভিন্ন ধারার মধ্যে বিস্তৃত অংশ যাতে সমসত্ববিশিষ্ট হয় সে লক্ষ্যে কারিকুরাম প্রণয়নের প্রচেষ্টা।
১০. একমুখী মাধ্যমিক শিক্ষা: একমুখী মাধ্যমিক শিক্ষা ও ব্যবস্থা চালুকরণ।
১১. গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ বিস্তৃতকরণ: এ উদ্দেশ্যে সরকারি অর্থে পরিচালিত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বল এলাকায় অর্থাৎ যে সব এলাকায় শিক্ষার সুযোগ কম সেসব জায়গায় স্থাপন।
১২. মফস্বলে মডেল হাইস্কুল: স্বল সময়ের ব্যবধানে প্রত্যেকটি উপজেলায় একটি করে মডেল হাইস্কুল স্থাপন।
১৩. শিক্ষক নির্বাচন: বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষ কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ।
১৪. শিক্ষার গুণগত মান: শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নকল্পে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদানের ব্যবস্থা। বিশেষভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদান। স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণের জন্য দূরশিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার।
১৫. শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার: কমিশনের বিবেচনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রযুক্তির পূর্ণ ব্যবহার ছাড়া স্বল্পসময়ে শিক্ষার মান উন্নত করার অন্য কোন বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে একটি টি-ভি চ্যানেল শিক্ষার জন্য নিবেদিত (Dedicated) করা যেতে পারে।
১৬. জীবনমুখী শিক্ষা: মাধ্যমিক শিক্ষা এমনভাবে গড়ে তুলতে হব যেন ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীরাও সমাজের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হতে পারে।
১৭. শিক্ষা ও জনশক্তি: দেশের জনশক্তি ব্যবহার সম্পর্কে একটি জাতীয়নীতি প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যক যাতে কোন শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি না হয়।
১৮. শিক্ষার দূরশিক্ষণ পদ্ধতিঃ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক ও অব্যাহত শিক্ষাদানের জন্য দূরশিক্ষণ পদ্ধতিটি (টি-ভি'র সাহায্যে) ব্যবহার করতে হবে।
১৯. শিক্ষকের মর্যাদাঃ শিক্ষকদের বেতনকাঠামো, পদোন্নতির নিয়মাবলি, চাকরির শর্তাবলি ইত্যাদি এমন হতে হবে যেন তা সম্মাজনক হয়।
২০. পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিঃ (ক) সকল পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা ও মুল্যায়ন পদ্ধতি অনুরূপ রাখার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। (খ) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে (দশম শ্রেণীর শেষে এসএসটি পরীক্ষা ব্যতিরেকে) পরীক্ষার ফল কোন শিক্ষার্থীকে অকৃতকার্য ঘোষণার জন্য নয়। বরং শিক্ষাজীবনের প্রথম নয় বছর পরীক্ষা নিতে হবে কেবলমাত্র শিক্ষার্থীর অর্জন কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছেছে কি না তা দেখার জন্য এবং তা অর্জিত না হলে অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে তার মান উন্নয়নের সহায়তা করা।
২১. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণঃ ঢাকাকেন্দ্রিক প্রশাসনকে (বিশেষ করে মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা ক্ষেতে) বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে যাতে- ক) কোন এক ব্যক্তির হতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না থাকে; খ) বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার ক্ষমতার মধ্যে সংঘাত না থাকে; গ) অধিকতর দ্রুতগতিতে এবং স্থানীয়ভাবে সমস্যার সমাধান হয় এবং ঘ) বিদ্যালয়/কলেজ/কর্তৃপক্ষ বা প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষদের সকল কাজে রাজধানীতে আসতে না হয় বা অমর্যাদাকর অবস্থায় পড়তে না হয়।
২২. তথ্যপ্রযুক্তি: তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার জন্য প্রণীত জাতীয় নীতি স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২৩. নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনঃ সরকারি ব্যয়ে একক বিষয়ভিত্তিক (যেমন- কৃষি, প্রকৌশল, চিকিৎসা প্রভৃতি) বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিরুৎসাহ করতে হবে, কেননা তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ও অপচয়ী।
২৪. বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা: উচ্চশিক্ষা যেহেতু ব্যয়বহুল সেহেতু বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে না, কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
২৫. বিশ্ববিদ্যালয় নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা: বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সমুন্নত রেখে ১৯৭৩-এর আইনদ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা।
২৬. গবেষণায় উৎসাহদান: (ক) প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের গবেষণায় উৎসাহদানের জন্য বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে Centres of Excellence গড়ে তোলাসহ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি সম্প্রসারণ। (খ) পেশাগত শিক্ষাক্ষেত্ৰ (কৃষি, প্রকৌশল, চিকিৎসা) গবেষণার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
২৭. ভাষানীতি: সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।
২৮. বিজ্ঞাননীতি প্রণয়ন: সর্বাধুনিক জ্ঞানের আলোকে জাতীয় বিজ্ঞাননীতি প্রণয়ন এবং শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে স্বল্পসময়ে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।
২৯. অব্যাহত শিক্ষাদান: প্রযুক্তি (রেডিও, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট) ব্যবহারের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে শিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য বাস্তবভিত্তিক অব্যাহত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালুকরণ।
৩০. স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনঃ দেশে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার । কমিশনের কাজ হবে মূলত (ক) শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ; (খ) চলমান গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা নিরূপণ ও তার প্রতিকারের সুপারিশ করা ; (গ) শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন চিন্তাচেতনার উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে সুপারিশ করা। (জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩ প্রতিবেদন।)

জাতীয় শিক্ষা কমিশনের এই রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন, ডিন, নির্বাচন ও ভিসি নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া রিপোর্টে প্রত্যেক উপজেলায় ১০ বছরে একটি আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠা, স্কুল ম্যাপিং-এর ভিত্তিতে প্রতি বছর দেশে ২৫টি স্কুল প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন, বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো গঠন, কোচিং সেন্টার ও নোট বই নিষিদ্ধ করাসহ শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। রিপোর্টে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও আধুনিক করার সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি ফাজিল ডিগ্রিকে ব্যাচেলার এবং কামিল ডিগ্রিকে মাষ্টার্স ডিগ্রির সমতুল্য ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়। কমিশনের রিপোর্টে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নেরও সুপারিশ করা হয়।

সুপারিশ বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হবে ৫ বছর বয়ঃপ্রাপ্ত সকল শিশুকে আব্যশিক বিদ্যালয়ে আনতে হবে। সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা চক্র যাতে সম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে বর্তমান প্রচলিত ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার পাশাপাশি সাময়িক পরীক্ষাসমূহ গ্রহণ করতে হবে। তবে ইংরেজি ও ধর্ম শিক্ষা বিষয়ে শুধু মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করতে বলা হয়।
সুপারিশমালায় বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব হবে শিক্ষার্থীকে আধুনিক বিষয়সমূহে গবেষণা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও আইন শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে জ্ঞান রাজ্যের এক বর্ণালি প্রশিক্ষণ।

সুপারিশমালায় বলা হয়, দেশে মাদ্রাসা পরিচালনা জন্য যে পরিচালনা পরিষদ রয়েছে তা সঠিকভাবে কাজ করছে না। মাদ্রাসাগুলো পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধানের জন্যে বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে বিধায় সেগুলোর কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের নিমিত্তে নিবিড় পরিদর্শন কার্যক্রম গ্রহণ একান্ত জরুরি। সাধারণ শিক্ষাধারার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ যেসব সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও তা করা জরুরি। সুপারিশমালায় প্রচলিত শিক্ষাধারার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার প্রস্তাবও করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষা কমিশনের এই রিপোর্ট গ্রহণের পর তা বাস্তবায়নের জন্যে একটি বাস্তবায়ন সেল গঠনের নির্দেশ দেন।

এ রিপোর্ট বেশ Upgraded মাদ্রাসা শিক্ষাকেও এ রিপোর্ট বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেখা যাক এ রিপোর্ট কতটা বাস্তবায়িত হয়।

তবে, এযাবৎ যতোগুলো শিক্ষা কমিশন রিপোর্টই প্রকাশ হয়েছে, তার কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময় কিছু কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেযা হয়েছে। তবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলাম, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে এখানো ঢেলে সাজানো হয়নি।


৯. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা
আমাদের দেশে এখনো মূলত সেই ইংরেজ আমল থেকে চলে আসা দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। একটি হলো ট্রেডিশনাল মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আর অপরটি ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা। একটি আধুনিক জ্ঞান বিবর্জিত আর অপরটি ইসলামী আদর্শ বিবর্জিত। একই জাতির লোকেরা দুই ধারায় শিক্ষিত হচ্ছে। দুইটি ধারার দিগদর্শন দুই বলয়ে অবস্থিত। এক ধারার শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে আরেক ধারার শিক্ষার্থীরা সুধারণা পোষণ করে না। আদর্শ মুসলিম জাতি গঠনের জন্যে কোনো ধারাই এখন আর উপযুক্ত নয়।

ইংরেজরা আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় নাগরিকদের মধ্য থেকে একদল শিক্ষিত মানসিক গোলাম ও প্রভুভক্ত লোক তৈরি করা, যারা জাতিগতভাবে ভারতীয় থাকবে, কিন্তু মানসিকভাবে হানাদার শাসক ইংরেজদের ধ্যান ধারণায় পরিগঠিত হবে।

বৃটিশরা এসেছিল এদেশে শাসন শোষণ করতে। তাই এদেশীয়দের মধ্য থেকে তাদের এমন একদল লোক প্রয়োজন ছিলো, যারা তাদেরকে প্রভূ মনে করবে, তাদের সভ্যতা সংস্কৃকিতে শ্রেষ্ঠ মনে করবে, তাদের আচার আচরণ ও চিন্তা দর্শনকে চমৎকার মনে করবে এবং একান্ত অনুগত বাধ্যগত দাসের ন্যায় দেশ পরিচালনার কাজে তাদের সেবা সহযোগিতা করবে। যে ব্যক্তি তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যতো বেশি নিষ্ঠার সাথে সেবা করার সে নিজেকে ততো বেশি গৌরবান্বিত মনে করবে।

তাদের নিজেদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিলো, তা ছিল রাজ্য শাসন, রাজ্য বিস্তার ও নিজেদের চিন্তা দর্শন বিস্তারের উপযোগী লোক তৈরি করার উদ্দেশ্য প্রণীত। সুতরাং নিজেদের দেশে তারা যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে, তা থেকে তৈরি হচ্ছিল সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের উপযুক্ত লোক আর জবর দখল করা দেশগুলোতে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে তা থেকে লাভ করেছিল প্রভুভক্ত ও আনুগত্যপরায়ণ লোক। এভাবেই তারা শাসক ও সেবক শ্রেণীর লোক তৈরি করেছিল। তাদের চালু করে যাওয়া সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের দেশে চালু আছে।

বলাবহুল্য এ ছাত্ররাই আবার শিক্ষক হয়। তাই, আমাদের ছাত্র শিক্ষক সকলের জীবনই লক্ষ্যহীন, দক্ষ পথের অনুসারী। মোট কথা দেউলিয়া শিক্ষা ব্যবস্থার কবলে পড়ে আমাদের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে আজ এমন চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে যে, চিন্তাশীলরা জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আতংকিত।

এ শিক্ষাই উৎপাদন করে আমাদের দেশের কর্ণধারদের। এ দুষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জাতীয় তথা সর্বক্ষেত্রের নেতৃত্বের কাঠামোকে ভেংগে চুরমার করে দিয়েছে। জাতীয় রাজনীতির ধারা অসংখ্য গতিপথে প্রবাহিত। জাতীয় নেতৃত্বের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে আসছে। শুধু মাত্র লক্ষ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার কবলে পড়ে জাতি আজ সর্বক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ সংকটকাল অতিক্রম করছে। জাতিকে এখন বাঁচানো প্রয়োজন। তাকে এখন ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন।

এই বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থাটিই আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চালু রয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে একটি স্বতন্ত্র ও আদর্শ সভ্যতা সংস্কৃতির অধিকারী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। এ শিক্ষা আমাদের জাতিকে মানসিকভাবে করেছে বহুগামী। এই শিক্ষার অসংখ্য ত্রুটি আছে। তরে এর প্রধান প্রধান ত্রুটিগুলো নিম্নরূপ:

১. আল্লাহবিমুখ শিক্ষাব্যবস্থাঃ বৃটিশদের চালু করে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন সময় কিছু কিছু সংস্কার ও মেরামতের কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারা নিরেট আল্লাহবিমুখ জড়বাদী দর্শনের ভিত্তিতে উপরে প্রতিষ্ঠিত। এই পৃথিবী এবং এই মহাবিশ্ব কে সৃষ্টি করেছেন? কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন? আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এর জবাব নাস্তিকতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিংবা সংশয়বাদী ধারণা পেশ করা হয়েছে। এই বিশ্ব জগতের যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তিনিই যে গোটা মহাবিশ্ব অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে পরিচালনা করছেন, তিনিই যে মানুষকে বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, মানুষের জীবন যাপনের জন্যে জীবন দর্শন ও বিধান দিয়েছেন, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত।

২. ঈমানী দর্শন বর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা: আধুনিক শিক্ষ্যাব্যবস্থ্যা মানুষকে সঠিক জীবনের দর্শনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আল্লাহ, আল্লাহর একত্ব, রিসালাত, আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়াত, পরকাল, আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা, জান্নাত জাহান্নাম ইত্যাদি ঈমানি দর্শনের ধারণা বিবর্জিত এ শিক্ষাব্যবস্থা আদর্শবাদী মানুষ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এ শিক্ষাব্যবস্থা পরকাল থেকে বিমুখ দুনিয়া পূজারী মানুষ তৈরি করে। মানুষের প্রকৃত কল্যাণ অকল্যাণ, জীবনের আসল ব্যর্থতা ও স্বার্থকতা জানাবার ব্যবস্থা এখানে নেই। ঈমান বিবর্জিত বস্তুবাদী দর্শনই এ শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি।

৩. জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা বর্জিত শিক্ষা: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারাই যেহেতু আল্লাহবিমুখ ও ঈমান আকীদা বিবর্জিত দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আদর্শিক জীবন বিধান ও জীবন পদ্ধতি লাভ করার তো কোনো প্ৰশ্নই আসে না। মহান আল্লাহ অহি ও নবুয়্যাতের মাধ্যমে মুনষের জন্যে যে হিদায়াত ও জীবন যাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষা ব্যবস্থা সে সম্পর্কে নীরব। শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা না ইসলামী জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে কোন জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে, না সত্যিকার মুসলিম হয়ে গড়ে উঠতে পারছে, আর না জীবন যাপনের সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে। এর ফলে এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকদের মধ্যে বহুরংগী জীবন যাপনের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

৪. প্রকৃত লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা: ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মাঝে এক আল্লাহর গোলামি করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তি লাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহ প্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদেরকে পেশ করার যোগ্যতা অর্জন এবং খিলাফত পরিচালনা এবং মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভাবধারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ শিক্ষা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা জীবনের কোন মহৎ লক্ষ্য অর্জন করেনা এবং উপরোল্লিখিত শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না।

৫. নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা: এই আধুনিক ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে ছেড়েছে। গোটা জাতিকে নৈতিক অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। এখানে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির কোনো মানদণ্ড নেই। আদর্শ ও লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থার ফল এ রকম হয়। যে শিক্ষাব্যবস্থা এক আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করে না, পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করে না, আদৰ্শ জীবন পদ্ধতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে না, সে শিক্ষাব্যবস্থাতো আদতেই মেরুদণ্ডহীন। এরূপ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই পাওনা সম্ভব নয়। এ শিক্ষাব্যবস্থার কুফলে আমাদের জাতি দিন দিন নৈতিক অধঃপতনের দিকে তলিয়েই চলেছে।

৬. নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থতা: আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি, এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল বৃটিশদের মানসিক দাস আর অনুগত সেবক তৈরি করার জন্য । এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে স্বাধীন দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করার যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবার আশা করা যায় না। নিজ দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্যে আত্মত্যাগী শিক্ষিত মানুষ এখান থেকে বের হবার আশা করা যায়না। তাইতো দেখা যায়, জাতির মেধাবী লোকেরা স্বদেশ থেকে বিদেশকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

৭. জাতির ঐক্য ও সংহতি (National Consensus) সৃষ্টিতে ব্যর্থতাঃ এ শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থ্যা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে বহুমত ও পথের অধিকারী বানিয়ে দেয়। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মানসিকভাবে পরস্পরের শত্রু হয়ে গড়ে ওঠে। ছাত্র জীবন শেষে তারা বিভিন্ন মত ও পথে পরিচালিত হয় এবং জাতিকে বিভিন্ন পথ ও মতের দিকে ধাবিত করবার চেষ্টা করে। ফলে জাতির মধ্যে দিন দিন হানাহানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনৈক্য প্রসারিত হচ্ছে। ঐক্য ও সংহতির বন্ধন একেবারে শিথিল হয়ে পড়েছে। জাতি অসংখ্য মত ও পথের অনুসারী হয়ে পড়েছে।

৮. সংকীর্ণ মতপার্থক্য (Fanatic dissentions) সৃষ্টি ও লালন করা এ শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৯. সন্ত্রাস: এ শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক দেউলিয়াত্বের কারণে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সন্ত্রাস আজ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষকরা পর্যন্ত সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

১০. এ শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত জীবনবোধ সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

১১. এ শিক্ষা ব্যবস্থা স্বার্থপর, স্বার্থান্বেষী নিরেট বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির লোক তৈরি করছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি অকল্যানকর বৈশিষ্ট হলো সহশিক্ষা। সহশিক্ষা শিক্ষার পরিবেশকে বিনষ্ট করে দিয়েছে। ইসলামী জীবনবোধ ও মূল্যবোধকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ছেলে/মেয়েদের অবাধ মেলামেশার কুফল জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।

১২. দুর্নীতির প্রসার: দুর্নীতি আমাদের জাতি সত্তার অংশে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরীয়ে আসছে জঘন্য ঘুষখোর, চোরাকারবারি, মানুষের অধিকার হরণকারী, আইনকানুন ও নিয়মশৃংখলা লংঘনকারী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, স্বজনপ্রীতিকারী, যুলুমবাজ, মদখোর, জুয়াবাজ, ফাঁকিবাজ, প্রতারক, চোর, ডাকাত ইত্যাদি। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য, আদর্শ তৈরির মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। আর আমাদের ভাগ্যে জুটেছে এর বিপরীত ফল। আমরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছি, যা দুর্নীতি শিক্ষা দিচ্ছে এবং এর শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির কাজে দক্ষ হয়ে বেরুচ্ছে।

১৩. ধর্মীয় শিক্ষার লেজুড়: অবস্থার প্রেক্ষিতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার গোটা ধর্মহীন ভাবধারার সাথে ‘ইসলামিয়াত’ ও ‘ইসলামের ইতিহাসের' লেজুড় জুড়ে দেয়া হয়। ইসলামিয়াতকে নিচের শ্রেণীগুলোতে কখানো ঐচ্ছিক, কখনো বাধ্যতামূলক রাখা হয়। উচ্চ শ্রেণীতে ইসলামিয়াত ইসলামের ইতিহাস ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়।

‘ইসলামের ইতিহাস' নামে এমন ইতিহাস ছাত্রদের পড়ানো হয়, যাতে ইসলামকে বিকৃত এবং ইসলামের ইতিহাসকে স্বার্থপরতা ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা পাস করে বের হয় তারা ইসলামের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। বরং অনেকেই একেবারে ইসলামবিদ্বেষী হয়ে বের হয়। ইংরেজ শাসকরা মুসলিম যুবকদের ইসলামবিদ্বেষী বানাবার একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ চালু করে। অমুসলিমদের লেখা ইতিহাস এখানে ছাত্রদের পড়ানো হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে ইসলামকে একটি জঘন্য মানবতাবিরোধী ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে বৃটিশরা কাঁটা দিয়ে ‘কাঁটা তোলার’ নীতি গ্রহণ করে।

‘ইসলামিয়াত’ বা ‘ইসলামী শিক্ষা’ নামে যে বিষয়টি চালু করা হয়েছে তাতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়া হয় না। তবে যতটুকু ধারণাই দেয়া হয় তার ফলাফল ইসলামের পক্ষে খুবই একটা যায় না। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে।

প্রথম কারণ হলো, নিচের শ্রেণীগুলোর ইসলামিয়াত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা বিভাগে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয় না। ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয় না। ইসলামিয়াত বিষয়টি গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পরগাছার মতো। ছাত্রদের অন্য সকল জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যার ফলে গোটা বিশ্বজগৎ আল্লাহ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে এবং সফলভাবে পরিচালিত বলে তারা অনুভব করে। আল্লাহর রাসূল ও পরকালের প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করে না। ছাত্রদের গোটা চিন্তা ধারাই এ দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তোলা হয়। অতপর ইসলামিয়াতের ক্লাসে মৌলভী সাহেব আল্লাহ, রাসূল, কিতাব ও পরকাল আছে এবং এগুলোর প্রতি ঈমান আনতে হবে শিক্ষা দেন। একদিকে সামগ্রিকভাব ছাত্রদের মধ্যে আল্লাহ বিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি করা হচ্ছে, অপরদিকে ইসলামিয়াত ক্লাসে আল্লাহমুখী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সাথে ইসলামিয়াতের এই শিক্ষা খাপ খায়না। ফলে ছাত্রদের সামগ্রিক জীবনবোধের সাথে ইসলামিয়াতের শিক্ষাটা পরগাছার মতোই থেকেই যাচ্ছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কাছে চরমভাবে মার খাচ্ছে। নিরানব্বই মণ লবণের সাথে এক মণ চিনি মিশালে সে চিনি লবণের সাথে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য।

এভাবেই প্রবল আল্লাহবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে তার ওপর আল্লাহমুখী হালকা ধারণা পেশ করে ছাত্রদের মাঝে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়া হয় এবং সে দ্বন্দ্বে বেচারা পরগাছা এভাবেই প্রবল আল্লাহ বিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলে তার ওপর আল্লাহমুখী হালকা ধারণা পেশ করে ছাত্রদের মাঝে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়া হয় এবং বেচারা পরগাছা ইসলামিয়াত চরমভাবে পরাজিত হয়। এর ফলে ইসলামের বিরোধিতায় তারা সাহসী হয়ে ওঠে।

এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের কথায় আসা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়র সব চাইতে ঘৃনীত বিভাগ সম্ভবত একটি। এ বিভাগের ছাত্র শিক্ষকরা ‘মোল্লা’ ‘মৌলবাদী' খেতাবে ভূষিত। এ বিভাগের ছাত্রদের কর্মপোযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। এ বিষয়ে পাস করার পর তাদের না সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয় আর না সিভিল প্রশাসনে। কোনো প্রকারের ইসলামিয়াতের শিক্ষকতা করে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাদের সামাজিক মর্যাদাকে হেয় করে দেখা হয়। মোট কথা ধর্মীয় শিক্ষার এই লেজুড় ও পরগাছা থেকে ছাত্ররা
ক. ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে জনতে পারে না।
খ. ইসলামকে হানাহানি কাটাকাটির ধর্ম ও মানবতা বিরোধী বলে শিক্ষা লাভ করে।
গ. তাদের মন ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
ঘ. ইসলামকে একটি খেল তামাশার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে।
ঙ. এটাকে সমাজের জন্যে কল্যাণকর মনে করা হয় না।

১০. মাদ্রাসাশিক্ষা ব্যবস্থার প্রাচীনত্ব
আমাদের দেশে বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষার দুটি ধারা চালু আছে। একটি হলো ‘দরসে নেজামি' পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মূল আদর্শ দেওবন্দ মাদ্রাসা। অপরটি হলো আলিয়া মাদ্রাসা। এ পদ্ধতির সুচনা হয় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ পদ্ধতি শ্রেণীভিত্তিক এবং এতে আধুনিক শিক্ষার কিছুটা লেজুড়ে লাগানো হয়েছে। এই দুই ধারা মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে মৌলিক তফাত খুব কমই। মূলত উভয় ধারাই মুসলিম শাসন আমলে ভারতবর্ষে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিলে, তারই শিক্ষাক্রমের অনুযায়ী। মোটকথা, আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ও জরাজীর্ণ । মুসলিম শাসনামলে এ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল যুগ উপযোগী। তখন এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই সরবরাহ হতো রাষ্ট্র নায়ক, রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। সামরিক বিভাগের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী কূটনীতিকসহ সকল শ্রেণীর দায়িত্বশীল লোক।

এরপর বৃটিশরা এলো। তারা তাদের ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই রাষ্ট্রে কর্মচারী হবার উপযোগী লোক তৈরি করবার মতো শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে।

গোটা বৃটিশ আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তার প্রাচীনত্ব নিয়ে চলতে থাকে । বৃটিশরা চলে যাবার পর দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তান নামের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তার প্রাচীনত্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রাচীনত্ব নিয়েই সে এখনো ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেছে।

ইতিহাস এগিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পতন হয়। দেশ বিভক্ত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পরিবর্তন আসে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তার সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ও শিক্ষাক্রমকে বুকে ধারণা করে পাহাড়ের মতো অটল অবিচল হয়ে পড়ে আছে আপন স্থানে। ফলে যুগ ও কালের যতোই পরিবর্তন হতে থাকলো তাতোই এ শিক্ষাব্যবস্থা তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে থাকলো। এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুতে থাকলো, সমকালীন সমস্যাবলি ও জীবনধারর সাথে তারা সম্পর্কহীন হয়ে পড়লো। এখন এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, তাদের জন্য মসজিদের ইমামতি, মাদ্রাসা ও মক্তবের শিক্ষকতা, স্কুলের ধর্ম শিক্ষকের পদ অলংকার আর ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কের তুফান ছুটানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নোক্ত ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো দ্বারা জর্জরিতঃ

১. মূল শিক্ষাব্যবস্থাটিই বহু শতাব্দীকালের প্রাচীন এবং বর্তমান কালের কার্যকারিতা বর্জিত।

২. শিক্ষাক্রম ও পাঠসূচি যুগের চাহিদার অনুপূরক নয়।

৩. এখানে যুগ উপযোগী রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাণিজ্যনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আইন ও বিচারনীতি, কৃষি ও কারিগরি শিক্ষাদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলো শেখার জন্যে মাদ্রাস ছাত্রদেরকে মাদ্রাসা পাস করার পর পুনরায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। তাও সকল ক্ষেত্রে এবং সকলের জন্যে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয় না৷

৪. এখানে প্রাচীন ফিকাহ শাস্ত্রের ওপরই অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। স্বাধীন চিন্তা গবেষণা ও ইজতিহাদের দরজা এখানে সম্পূর্ণ বন্ধ।

৫. এখানে কুরআনের প্রাচীন তাফসীরই পড়ানো হয়। তাও পূর্ণাঙ্গ কুরআন পড়ানো হয় না। কুরআনের ওপর গবেষণাধর্মী পড়ালেখার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই।

৬. হাদীস শাস্ত্রেরও একই অবস্থা। হাদীসের ওপর গবেষণাধর্মী পড়া-লেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাদীস যাচাই বাছাই করবার মতো যোগ্যতা অর্জন করবার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

৭. ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন ও ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা এখানে নেই। ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করবার শিক্ষা ও কর্মপন্থা জানা যায় না।

৮. এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সিভিল সার্ভিসের জন্য লোক তৈরি হয়না। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হবার যোগ্য লোক তৈরি হয় না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ তৈরি হয় না । রাষ্ট্র পরিচালনার ‘কি পোস্ট’ গুলোতে তাদের স্থান হয় না।

৯. এখান থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, তারা সমাজে সত্যিকারভাবে মর্যাদাবান হতে পারছে না। ধর্মীয় কারণে কিছুটা ভক্তি শ্রদ্ধা তারা লাভ করেন বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়, প্রসাশনিক ও সামাজিক পদমর্যাদায় তারা অধিষ্ঠিত হতে পারছে না। ফলে সমাজে তাদের ছোট ও হেয় থাকতে হয়।

১০. এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যে জনশক্তি লাভ করা যায়না, সে কারণে মাদ্রাসাগুলো সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থেকেও বঞ্চিত।

১১. মাদ্রাসগুলোতে যারা শিক্ষাদান করেন, তারাও অদক্ষ। তাদের প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। সুতরাং এখানকার শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও কোনো উপযোগিতা নেই।

১২. মাদ্রাসাগুলো থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বের হয়, অদক্ষতা ও কর্মহীনতার কারণে তারা ব্যাপকহারে ধর্মীয় বাহাছ বির্তকে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সারা দেশে ধর্মীয় কোন্দল জাল বিস্তর করে আছে।

১৩. সামগ্রিকভাবে জাতি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি হতাশ ও আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। যেহেতু ধর্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরে এখান থেকে শিক্ষা লাভকারীরা সমাজ পরিচালনা ও সমাজে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করবার যোগ্যতা অর্জন করে না, সেজন্যে অভিভাব- করা সাধারণত তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাননা। কেবল তিনটি কারণে মাদ্রাসায় পড়তে আসে:
ক. একান্তধর্মীয় শিক্ষা লাভ করবার কামনায়।
খ. মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করার পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার নিয়্যতে।
গ. গরিব লোকেরা আর্থিক অনটনের কারণে তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠায়। এই তিনটি কারণে যারা মাদ্রাসায় পড়তে আসে তাদের সংখ্যা নিত্যন্তই অপ্রতুল্য। ছাত্রের অভাবে বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে বহু মাদ্রাসাকে ছাত্র সংখ্যা যা নয়, তার চেয়ে বাড়িয়ে দেখাতে হচ্ছে। এ থেকেই বুঝা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সামগ্রিকভাবে অনাস্থা কতো প্রবল এবং এ শিক্ষাব্যবস্থা কতোটা সেকেলে এবং অকেজো হয়ে পড়েছে।

১১. চাই ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত দক্ষ জনসম্পদ তৈরির শিক্ষানীতি
শিক্ষা মূলত একটি দেশের মেরুদণ্ড। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির নিয়ামক হলো সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। একদিকে মানুষের জীবনধারা ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার রাজপথ নির্দেশক। অপরদিকে শিক্ষাই মূলত মানুষের মধ্যে বিশেষ ধরনের জীবনধারা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। সুতরাং শিক্ষা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যাভিসারী। শিক্ষা বর্তমানে কানন, ভবিষ্যতের মুকুল। শিক্ষা বর্তমানের ফল, ভবিষ্যতের বল।

শিক্ষা একদিকে মহাকবি মিল্টনের ভাষায় Harmonious development of body, mind and soul. অপরদিকে শিক্ষা কালে সিঁড়ি, সভ্যতার নির্মাতা এবং অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতির ক্রেন।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রের অন্য দশটির মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা একটি সোনালি ঐতিহ্যমণ্ডিত গৌরবদীপ্ত জাতি। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয়, আজ আমরা সাংস্কৃতিক ভিক্ষুক, রাজনৈতিক কুঁদুলে, অর্থনৈতিক কোমর ভাঙা আর শিক্ষাব্যবস্থায় দেউলিয়া।

আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতি দেখে বিভিন্ন সময় এগুলোকে মেরামত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলোতে উর্দু মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হতো। বাংলাদেশ আমলে আলিয়া পদ্ধতিতে বাংলা মাধ্যমে চালু করা হয়েছে। দারসে নিযামি পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে এখনো সংস্কার করেনি। বিভিন্ন সময় আলিয়া পদ্ধতিতে বাংলা, ইংরেজি, অংক, সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় এবং কোথাও কোথাও কিছু কিছু শ্রেণীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন কিছু কিছু বিষয় চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর সাথে এগুলো খুবই একটা খাপ খায়নি। ফলে এসব মেরামত/সংস্কার মূল অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাও বিভিন্ন সময় সংস্কার মেরারমত করার চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন ধরনের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রকার সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন বিষয় ও বিভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু বৃটিশদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম আসলে এ ধরনের আংশিক মেরামত, সংস্কার, সংশোধন ও সংযোজন দ্বারা ফল হবে না। প্রয়োজন আমূল পরিবর্তনের।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নিজেদের রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রের উন্নয়ন, জাতীয় কল্যাণ ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের দায় দায়িত্ব নিজেদের ওপর। নিজেদের জাতিকে উন্নত করে গড়ে তোলা এবং বিশ্বের দরবারে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিজেদের।

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এখানকার শতকরা পঁচাশি ভাগ নাগরিক মুসলমান। এখানকার মানুষ অত্যন্ত ইসলাম প্রিয়, আল্লাহভক্ত ও ধর্মভীরু।

অর্থনৈতিক দিকে থেকে বাংলাদেশ পেছনে পড়ে আছে। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের সম্পদ কম। আমাদের জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মুসলিম হিসেবে আমাদের গৌরবান্বিত ইতিহাস। আছে মহান ঐতিহ্য। এক উন্নত অনুপম ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধিকারী জাতি আমরা। আমাদের আছে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা।

আমাদের কাছে আছে আল্লাহ্প্রদত্ত জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পূর্ণ নির্ভুল। পৃথিবীর অন্য কোন জাতির কাছে নির্ভুল জীবন বিধান নেই।

সারা বিশ্বে আমাদের সোয়াশো কোটি মুসলমান ভাই আছে। তারা আমাদের অংশ। তারা আমাদের সাহায্যকারী ও সহযোগী।

এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে আমাদের দেশে চালু করতে হবে নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থা। প্রণয়ন করতে হবে নতুন শিক্ষানীতি, নতুন কারিকুলাম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যতালিকা। এই শিক্ষব্যবস্থায় উপরোক্ত ভাবধারাগুলো গতিশীল থাকতে হবে নদীব স্রোতধারার মতো।

এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা হবে এমন শিক্ষাব্যবস্থা, যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের একটি আদর্শ ও সুসংহত জাতিতে পরিণত করবে আমাদের জাতিকে প্রকৃত মুসলিম উম্মাহ হিসেবে গড়ে তুলবে। আমাদের জীবনকে সামগ্রিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করবে। স্বাধীন মর্যাদাবান জাতি হিসেবে টিকে থাকতে শিখবে। আমাদের পরকালের মুক্তির পথে পরিচালিত করবে। দক্ষতার সাথে দেশ হবে এতোটা উন্নত, যুযোপযোগী ও বাস্তবধর্মী, যেনো এ থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের সন্তানরা জীবন ও জগৎকে জানতে শিখে, জীবন ও জগতের প্রতিটি বিভাগকে উপলব্ধি ও আবিষ্কার করতে শিখে এবং জীবন ও জগৎকে দক্ষতার সাথে কল্যাণমুখী খাতে পরিচালনা করতে শিখে। আমাদের শিক্ষা অবশ্যই এমন হতে হবে, শিক্ষা মানুষকে স্রষ্টামুখী করে এবং সাথে সাথ জীবন ও জগৎকে সঠিক নীতি ও দক্ষতার সাথে কল্যাণমুখী খাতে পরিচালিত করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। তাই শিক্ষানীতি আমাদের লাগবেই। আমাদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একথা সুস্পষ্ট করে বলে দিতে হবে যে, আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান-ধারণা, আক্বীদা-বিশ্বাস, কোন ঐতিহ্য চেতনা এবং কিসের প্রেরণা সৃষ্টি করতে চাই? অর্থাৎ আমরা আমাদের শিক্ষা দর্শনকে কোন্ ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাই? অর্থাৎ আমরা আমাদের শিক্ষা কোন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চাই? এ কথাতো পরিষ্কার, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে যদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভিত্তি বানানো না হয়, তাহলে Stunly b ull-এর তথাই যথার্থ। তিনি বলেছিলেন, তিনটি 'R' অর্থাৎ Religion, Writing এবং Arithmetic-এর সাথে যদি ৪র্থ 'R' অর্থাৎ Religion, যুক্ত না হয়, তাহলে আপনি কেবল ৫ম, 'R' অর্থাৎ Ruscal ই পাবেন। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা Ruscal হতে বাধ্য। বিশ্বের সব ধর্মের লোকই এক স্রষ্টাকে জানে এবং মানে। তাই শিক্ষা অবশ্যি এক আল্লাহমুখী হতে হবে। তিনি এবং তাঁর বিধানই মানুষের সত্যিকারে কল্যাণ সাধন করতে পারে।

আমাদের প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার, একটি আদর্শিক শিক্ষাব্যবস্থার। যে শিক্ষাব্যস্থা সব ইসলামী আদর্শের অনাবিল সংস্কৃতির বাহক। যে শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের অন্তগর্ত আক্বীদা বিশ্বাসকে সুপ্রতিষ্ঠিত কবে। তাদের মন মানসিকতাকে এক করে তুলবে। তাদের চিন্তাচেতনার গতিকে প্রবাহিত করবে অভিন্ন স্রোতে। যে শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সৎ প্রবণতাকে লালন করবে, বিকশিত করবে এবং করবে দুর্জয়। আর তাদের অসৎ প্রবণতাকে দমন করবে, নিরুৎসাহিত। তাদের মনকে করবে উদার। যে শিক্ষাব্যবস্থা হবে তাদের জীবনবোধ উৎসারিত সংস্কৃতির বাহন এবং তাদেরকে তাদের জীবন লক্ষ্যকে করবে এক। তাদের পরিণত করবে একই চিন্তার অধিকারী একটি শক্তিশালী জাতিতে। মোট কথা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হবে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত দক্ষ জনসম্পদ তৈরির হাতিয়ার।

 

উপমহাদেশের মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা

১. ভূমিকা
৬২২ ঈসায়ী সালে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা এখান থেকেই। মসজিদে নববী ইসলামের প্রথম শিক্ষায়তন। রাসূলুল্লাহ (স) প্রথম শিক্ষক। সাহাবায়ে কিরাম প্রথম ছাত্রসমাজ।

এখান থেকেই সম্মুখে অগ্রসর হয় উম্মতে মুহাম্মদীর শিক্ষার ইতিহাস। অতঃপর ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হতে থাকে । সাহাবায়ে কিরাম এবং তাঁদের উত্তরসূরিরা পৃথিবীর লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত মানবতার দুয়ারে দুয়ারে বয়ে নিয়ে যান ইসলামের সুমহান শিক্ষা। যেখানেই তাঁরা গিয়েছেন, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষ গড়ার কেন্দ্র। সেখানেই প্রজ্বলিত হয়েছে জ্ঞানের আলো। এক নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে প্রাণচাঞ্চল্য।

ইসলামের এই সুমহান সভ্যতা-সংস্কৃতির জোয়ারেই প্লাবিত হয়েছিলো তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশ হিন্দুস্তান। ব্যাপকভাবে এসেছেন এখানে ইসলামের পতাকাবাহীরা। তাঁরা এসেছেন আরব, ইরান ও আফগানিস্তান থেকে। তাঁরা এসেছেন কখনও বীরের বেশে, কখনও দরবেশের বেশে। তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন এদেশের প্রতিটি অঞ্চলে, গ্রামে-গঞ্জে-বন্দরে। ব্যক্তিগত ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা এদেশে গড়ে তুলেছিলেন হাজারো শিক্ষাকেন্দ্র। সেসব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য শাসক ও কর্মচারী, সৈনিক ও সেনাপতি, ফকীহ ও আলেমে দ্বীন এবং মুফাসসির ও মুহাদ্দিস। মোটকথা, একটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার লোকই সে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে তৈরি হয়েছিলো।


২. উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন ও শাসন
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকেই এদেশে ইসলাম প্রচারকগণ আসতে থাকেন। পরবর্তীকালে হাজারো মুবাল্লিগ এদেশে এসে ইসলাম প্রচার করেন। এমনকি মুসলমান আবর ব্যবসায়ীরাও এদেশে ইসলাম প্রচার করেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এদেশের অসংখ্য মানুষ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। বিরাট বিরাট এলাকা ইসলামের ভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু মুসলমানগণ এদেশের শাসন-ক্ষমতা লাভ করেন সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেকের শাসনকালে (৭০৫ খ্রি: - ৭১৫ খ্রিঃ) সেনাপতি ইমাদ উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে কাসেম সাকাফী সর্বপ্রথম (৭১২-১৩ খ্রি: ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু ও মুলতান এলাকা মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। অতপর গযনীর সুলতান সবুক্তগীন (৯৭৭–১০৩০ খ্রি:) পূর্ব দিকের সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত গযনীর ইসলামী রাজ্যকে বিস্তৃত করেন। এর পর বিভিন্ন সময়ে নানা উপায়ে বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তি ও বংশ এদেশের শাসন ক্ষমতা লাভ করেন এবং ধীরে ধীরে তাঁরা গোটা ভারতবর্ষ অধিকার করে নেন। এদেশে দিল্লিকেন্দ্রিক প্রথম স্বাধীন ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন কুতুবুদ্দীন আইবক (১২০৬-১০ খ্রিঃ)। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। ভারতবর্ষের সর্বশেষ শাসক ছিলেন মুগল বংশের সম্রাটগণ। তাঁদের শাসন যুগের শেষ দিকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম ইংরেজরা বাংলাদেশ দখল করে। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা রাজধানী দিল্লি দখল করে মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে তাদের আশ্রয়ে বৃত্তিভোগী শাসকে পরিণত করে। সর্বশেষ ইংরেজ বৃত্তিভোগী মুগল সম্রাট বাহাদুর শাহের (১৮৩৭-৫৮ খ্রি:) আমলে সিপাহি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় এবং বিপ্লবীগণ কর্তৃক-তাঁকে ভারত সম্রাট ঘোষণা করায় ইংরেজরা তাঁকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে এবং তাঁর সন্তানদের দিল্লির রাজপথে গুলি করে হত্যা করে।

এদেশের ইংরেজদের হাতে এভাবে মুসলমানদের ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। গোটা মুসলিম ভারত করায়ত্ত করতে তাদের একশত বছর সময় লাগে।


৩. উপমহাদেশে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন
কয়েক শতাব্দীকালের এ দীর্ঘ শাসনামলে এদেশে মুসলমানদের সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল দক্ষ ও আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা। মুসলমানরা এদেশে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী বিপ্লব সাধন করেন । ১৮৮২ সালে ইংরেজদের এক শিক্ষা-কমিশন রিপোর্টে বলা হয়: “আর সব মুসলিম দেশের মতই ভারতবর্ষে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের পর তাঁরা তাদের মসজিদগুলোকে শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করে। ধর্মই তাঁদের শিক্ষার বুনিয়াদ হবার কারণে এসব শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য সরকারকে তেমন ব্যয়ভার বহন করতে হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াক্ফ ও উইলের সম্পত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। দ্বীনদার লোকেরা পারলৌকিক পুণ্য লাভের জন্য ওয়াক্ফ এবং সম্পত্তি প্রদানের অসিয়ত করে যান। পাক-ভারতীয় মসজিদকেন্দ্রিক মাদরাসার এ অবস্থা ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমল পর্যন্ত বলব থাকে।”

উপমহাদেশে মুসলমানদের শিক্ষা কেন্দ্রগুলো গড়ে ওঠার একটা চিত্র এ রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এদেশে সর্বপ্রথম কখন এবং কোথায় মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল । অবশ্য ইতিহাস গ্রন্থাবলি থেকে এতটুকু জানা যায় যে, আবুল কাসেম মাহমুদের শাসনামল থেকে এদেশে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন হয়।

প্রফেসর সাইয়েদ মুহাম্মাদ সলীম লিখেছেন:
“৫৮৯ হিজরি মোতাবেক ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুস্তানে মুয়েযুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে সাম (শিহাবুদ্দীন ঘোরী নামে খ্যাত) কর্তৃক ইসলামী শুকুমাত কায়েম হয়। তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে রাজ্যের চতুর্দিকে শিক্ষা-দীক্ষার চর্চা ছড়িয়ে পড়ে। এ জ্ঞান প্রিয় বাদশা-ই সর্ব প্রথম দিল্লিতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাদশার নাম অনুযায়ী এ মাদরাসার নামকরণ হয়, ‘মাদরাসায়ে মুয়েযীয়া'। পরবর্তী বাদশাহ কুতুবুদ্দীন আইবক (১২০৬-১২ খ্রি :) আজমীরে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদরাসাকে ‘আড়াই দিনের ঝুপড়ি' বলা হতো । তৃতীয় মাদরাসটি মুলতান ও উচের শাসনকর্তা নাসীরুদ্দীন কুবাচন ‘উচে’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাযী মিনহাজুদ্দীন সিরাজ জুরজানী (মৃত্যু ১২৬০ খ্রি:) সর্ব প্রথম উচ্চ মাদরাসার শিক্ষক নিয়োজিত হন। পরে তিনি মাদরাসায়ে মুয়েযীয়ার প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি হন।”

অতঃপর মুসলিম শাসক, আলেম, আমীর ও বিদ্যোৎসাহী দ্বীনদার লোকদের প্রচেষ্টায় গোটা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে মক্তব মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। জনৈক ঐতিহাসিকের ভাষ্য অনুযায়ী:
“সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকের (১৩২৫-৫১ (খ্রি:) আমলে দিলিল্লতে এক হাজার মাদরাসা ছিলো। এর মধ্যে শাফেয়ী মাযহাবের লোকদের একটা মাদরাসা ছিলো। শিক্ষকদের সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা প্রদান করা হতো। মাদরাসাগুলোকে দ্বীনী শিক্ষার সাথে সাথে অংক এবং দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হতো।”

রোহিলা খণ্ডের হাফেযুল মুল্ক নওয়াব রহমত আলী খানের (মৃত্যু ১৭৭৪ খ্রি:) জীবন- চরিত থেকে জানা যায়: “দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ার পরও কেবলমাত্র রোহিলা খণ্ড জেলার বিভিন্ন মাদরাসায় পাঁচ হাজার আলেম শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত ছিলেন। হাফেযুল মুল্ক নওয়াব রহমত আলী খানের কোষাগার থেকে তারা নিয়মিত ভাতা পেতেন।'

এস, বসুর’ এডুকেশন ইন ইণ্ডিয়া' গ্রন্থ থেকে জানা যায় : ‘ইংরেজ শাসনের পূর্বে কেবলমাত্র বাংলাদেশেই আশি হাজার মকতব ছিল।” (ম্যাকস মুলারের শিক্ষা রিপোর্ট) ৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছিলো
মুসলিম শাসনামলে এদেশে বিভিন্ন সময় নানা প্রকার বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় মকতব ও মাদরাসা গড়ে ওঠে।

(১) কখনো ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কল্যাণধর্মী কাজ হিসেবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং খরচ বহনের জন্য মাদরাসার নামে সম্পত্তি ওয়াক্ফ করে দিতেন। এ সম্পত্তি থেকে শিক্ষক ও ছাত্রদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হতো। ছাত্রদের শিক্ষা ও জীবিকার যাবতীয় ব্যয় মাদরাসা থেকেই বহন করা হতো।

(২) অনেক সময় কোন আলেম ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং যাবতীয় ব্যয়ভার নিজেই বহন করতেন। তিনি নিজেই শিক্ষক নিয়োগ করতেন ছাত্রদের শিক্ষা ও খাবার ব্যয় নির্বাহ করতেন।

(৩) কখনো কোন ধনী ব্যক্তি নিজ সন্তানদের শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করতেন। ঐ শিক্ষককে কেন্দ্র করে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে বাড়তে মাদরাসার আকার ধারণ করতো। শিক্ষক নিয়োগকারী নিজেই যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতেন।

(৪) কখনো আবার যোগ্য আলেমকে কেন্দ্র করে জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা তাঁর পাশে জড়ো হতো। লেখাপড়া চলতো মসজিদে। ছাত্ররা লজিং থাকতো এবং শিক্ষকগণ থাকতেন মসজিদের হুজরায়।

(৫) কোন কোন সময় শাসকগণ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং তারাই এর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

এমনিভাবে অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অসংখ্য মকতব মাদারাসা গড়ে উঠেছিল। এটা ছিল শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের নজিরবিহীন আগ্রহের ফল।


৫. মাদরাসা গৃহ
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর কয়েক শতাব্দী যাবৎ মসজিদই মুসলমানদের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যে প্রথম স্বতন্ত্র গৃহ কখন এবং কোথায় নির্মিত হয়েছিলো সে ইতিহাস সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করা বড় মুশকিল। মাওলানা মানাযির আহসান গিলানীর ‘তালিম ও তারবিয়াত' গ্রন্থের ভাষ্য অনুযায়ী এদেশে মুসলমানদের চার প্রকার শিক্ষা কেন্দ্র ছিল:
(১) মসজিদ
(২) মাদরাসা ও মকতবের স্বতন্ত্র গৃহ
(৩) কোন আমীর বা ধনী ব্যক্তির বসতবাটির অংশ বিশেষ এবং
(৪) কোন গাছে নিচে।


৬. মাদরাসার আসবাবপত্র
প্রফেসর সাইয়্যেদ মুহাম্মদ সলীম তাঁর ‘হিন্দ ও পাকিস্তান মে মুসলমান কা নিযামে তা'লিম ও তারিবয়াত গ্রন্থে' মুসলিম শাসনামলে এদেশে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের আসবাবপত্র সম্পর্কে লিখেছেন-
“শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হতো খুবই সংক্ষিপ্ত আকারের। বালকদের সবার জন্য থাকতো চাটাইয়ের বিছানা; কিতাবপত্র রাখার জন্যে ভূমি থেকে অল্প কাষ্ঠখণ্ড, শিক্ষকদের বসার জন্যে গদির আসন। এ ছাড়া পাঠ্য পুস্তকাদি এবং সামান্য কাষ্ঠসামগ্রীর সমন্বয়ে গঠিত হতো গোটা প্রতিষ্ঠান। টেবিল চেয়ারতো সে সময় নবাবদের বাড়িতেও পাওয়া যেতো না । ইংরেজদের বিজয়ের পরই এ সবের প্রচলন শুরু হয়। অপ্রয়োজনীয় কোন আসবাবপত্র মাদরাসায় থাকতো না। অতিশয় মিতব্যয়িতা ও সাদাসিধেভাবে কর্ম সম্পাদন করা হতো। এ কারণে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা খুবই সহজ ছিল।”


৭.শিক্ষার কাঠামো
মুসলিম শাসনামলে এদেশে শিক্ষা বিভাগ নামে স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল না। পাঠ্য বিষয় এবং পাঠ্যসূচি প্রণয়নেও সরকারের কোন হাত ছিল না। উলামায়ে কিরাম এবং শিক্ষকগণই ঠিক করতেন কী পড়াবেন। তাই সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট কোন শিক্ষা-নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতো না। তবে শেষ পর্যন্ত নিম্নরূপ একটি বুনিয়াদি কাঠামো গড়ে ওঠে।

(১) মকতব : এতে কোরআন পাঠ ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হতো।

(২) ফার্সি মাদরাসা : এতে ফার্সি ভাষা এবং এ ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রদান করা হতো।

(৩) আরবি মাদরাসা : মূলত : আরবি মাদরাসাগুলোই ছিল উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র। এতে আরবি ভাষা ও দ্বীনি ইলমের উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা হতো।


৮.ভর্তি
মকতব এবং ফার্সি মাদরাসাসমূহে ভর্তির ব্যাপারে তেমন কোন নিয়ম-নীতি পালন করা হতো না। যখনই কেউ লেখা-পড়া করতে আসতো তাকে পাঠে শরিক করে নেয়া হতো। আরবি মাদরাসাগুলোতে অবশ্য ভর্তির সময় ছিল শাওয়াল মাস। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে এক মাস পরও ভর্তি করা হতো।


৯. ভর্তির বয়স
জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে বয়সের কোন প্রশ্ন ওঠে না । যখনই কোন ব্যক্তির বোধোদয় হতো তখনই সে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করতে পারতো। মাদরাসাগুলো তাকে সহযোগিতা করতো। বয়সের ভিত্তিতে কোন তারতম্য করা হতো না। কেউ কেউ অধিক বয়সে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করতেন। সাধারণভাবে মাদরাসাগুলোতে বালকদের সাথে বয়স্কদের দেখা যেতো।


১০. শ্রেণীবিন্যাস
যে সকল মাদরাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণীবিন্যাস পন্থা ছিল না, শিক্ষার বছর দ্বারা গণনা না করে পাঠ্যপুস্তক দ্বারা করা হতো । বলা হতো এ ছাত্র অমুক অমুক কিতাব পড়েছে, বা অমুক অমুক কিতাব পড়া বাকি আছে। প্রত্যেক ছাত্রকে পৃথক পৃথক সবক (পাঠ) দেয়া হতো। প্রত্যেকের প্রতি স্বতন্ত্রভাবে দৃষ্টি রাখা হতো। কেউ কেউ দ্রুত কিতাব শেষ করতে পারতো। আবার কেউ কেউ দীর্ঘদিন একই কিতাব নিয়ে পড়ে থাকতো। সকল ছাত্র একত্রে বসে তাদের পাঠ মুখস্থ করতো।


১১. শিশু শিক্ষার সূচনাকাল
শিক্ষিত মুসলিম পরিবারসমূহে প্রাচীনকাল থেকে এ প্রথা চলে আসছিলো যে, তাঁদের সন্তানরা যখন চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে উপনীত হতো, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শিক্ষাদান শুরু হতো। এ অনুষ্ঠানকে ‘বিসমিল্লাহর অনুষ্ঠান' বলা হতো। এটা একটা উৎসব অনুষ্ঠানে পরিণত হতো। অভিভাবকগণ তাদের বন্ধু-বান্ধবদের এ অনুষ্ঠানে দাওয়াত করতেন। তিনি ‘রাবি ইয়াসির ওয়ালা তু’আসসির ওয়া তামিমবিল খায়ির, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' পড়িয়ে অতঃপর সূরা আলাকের প্রাথমিক কয়েকটি আয়াত এবং সূরা ফাতিহা পড়িয়ে দিতেন। শিশু এ পাঠ আওড়াতে থাকতো। উপস্থিত সকলের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হতো। অভিভাবকের সামর্থ্যানুযায়ী অনুষ্ঠানে শিক্ষকগণ ইনাম পেতেন৷


১২. শিক্ষার সময়সূচি
মকতব ও মাদরাসাগুলোতে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শিক্ষাদান কাজ আরম্ভ হয়ে বেলা প্রায় ১১টা পর্যন্ত তা অব্যাহতভাবে চলতো। অবশ্য আরবি মাদরাসগুলো আসর পর্যন্ত চলতো। মাঝখানে যোহরের নামায ও খাবার বিরতি হতো। কোন কোন শিক্ষক চূড়ান্ত পর্যায়ের ছাত্রদের এশা ও তাহাজ্জুদের পরও পড়াতেন। পড়ালেখার যাবতীয় কাজ মাদরাসাতেই সম্পন্ন করা হতো।


১৩. সাপ্তাহিক ছুটি
শুক্রবার ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বৃহস্পতিবারে অর্ধদিবস পর্যন্ত মাদরাসা খোলা থাকতো। এ সময়টাও মসজিদ বা মাদরাসার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যয় হতো। কোন কোন আরবি মাদরাসার মঙ্গলবারে পাঠদান হতো। সেদিন ছাত্ররা পাঠ্যপুস্তকের কপি তৈরি করতো। শিক্ষকগণ গ্রন্থ রচনার কাজ করতেন।


১৪. বার্ষিক ছুটি
মুসলিম শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় সারা বছরই পড়ালোখা চলতো। ছুটি থাকতো খুবই কম। বার্ষিক ছুটি মোটামুটি নিম্নরূপ ছিল:

১. ঈদুল ফিতর ২ দিন

২. ঈদুল আযহা ৫ দিন

৩. মুহাররাম ৬ দিন (বাংলাদেশে)

৪. সফর মাসের শেষ বুধবার ১ দিন (বাংলাদেশে)

৫. শবে বরাত ১ দিন

মোট ১৫ দিন


১৫. খেলাধুলা
বর্তমান যুগের মত তখন খেলাধুলার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না। খেলাধুলায় সময় অপচয় করতে নিষেধ করা হতো। মাদরাসাগুলোতে খেলাধুলার ব্যাপক ব্যবস্থা ছিল না । অবশ্য কোথাও কোথাও ছাত্র-শিক্ষক সকলে মিলে ব্যায়াম করতেন। কোথাও কোথাও যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণ হতো। ইমাম গাযালী প্রমুখ শিশুদের জন্য খেলাধুলা অপরিহার্য মনে করতেন।


১৬. শাস্তি
শিষ্টাচার বা আদব শিক্ষাদানের জন্য সে যুগে শাস্তি বা দণ্ড প্রদানকে শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করা হতো। এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট ব্যাপারেও ছাত্রদের শাস্তি দেয়া হতো। ভর্তির সময় অভিভাবগণ বলে যেতেন; ‘হাড় আমাদের’ শরীর আর চামড়া আপনাদের। কোনো কোনো শিক্ষক দণ্ডদানে বিশষভাবে খ্যাতিমান হয়ে উঠতেন বেয়াড়া এবং পলাতক ছাত্রদের খুঁজে বের করে পেটাতে পেটাতে মাদরাসায় আনা হতো। শিক্ষাকে তখন কোন ঐচ্ছিক ব্যাপার মনে করা হতো না। বরং শিক্ষা ছিলো আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক। তাই লেখাপড়ায় ছাত্রদের সামান্যতম অলসতাও কঠোর দৃষ্টিতে দেখা হতো।


১৭. খাদ্য
মাদরাসায় খানা পাকানোর ব্যবস্থা ছিলে না। এলাকাবাসীরাই ছাত্রদের খাবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। ছাত্ররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতো অথবা মাদরাসায় এনে ছাত্র-শিক্ষক সকলে মিলে একত্রে খাবার খেতোনা।


১৮. থাকা
স্থানীয় ছাত্রদের বলা হতো মুকিম। দূরাগত ছাত্রদের বলা হতো মুসাফির। মুসাফির ছাত্ররা মাদরাসা কক্ষে কিংবা মসজিদের হুজরায় থাকতো। চাটাইয়ের ওপর শুয়ে পড়তো। লজিং থাকার প্রথাও ছিলো।


১৯. শিক্ষা-সমাপন
মেধাবী ছাত্ররা ১৪-১৫ বছর বয়সেই ফার্সি ও আরবি মাদরাসার শিক্ষা সমাপন করতো। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী পনের বছর বয়সে শিক্ষা সমাপন করেন। যাদের মেধা-শক্তি কম ছিলো, শিক্ষা সমাপন করতে তাদের আরো কয়েক বছর বেশি সময় লাগতো।


২০. সমাবর্তন (Convocation)
সকল ফার্সি মাদরাসা শিক্ষা সমাপনী ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা হতো। এতে বড় বড় আলমদের দাওয়াত দেয়া হতো। সেদিনে 'ফাতেহা পাঠ করে শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের জন্য দোয়া করা হতো। অতঃপর কোন একজন বুযুর্গ তাদেরকে উপাধিতে ভূষিত করতেন। এ সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ‘ফাতেহা' ফেরাগ' বলা হতো।


২১. উপাধি
সে আমলে ফার্সি মাদরাসা সমাপনকারীকে ‘মুন্সি’ এবং আরবি মাদরাসা সমাপনকারীকে ‘আলেম' খেতাব দেয়া হতো। মুগল আমলের পূর্বে চূড়ান্ত ইলম হাসিলকারীকে ‘দানিশ মন্দ' বলা হতো। মাওলানা গোলাম আলী আযাদের (মৃত্যু ১৭৮৫ খ্রি:) যামানায় দানিশ মন্দের পরিবর্তে ‘মৌলভী' খেতাব চালু হয়। ফার্সি মাদরাসা থেকে পাস করার পর ছাত্ররা সরকারি চাকরির উপযুক্ত বিবেচিত হতো।


২২. শিক্ষক
ফার্সি মাদরাসা শিক্ষকদের ‘মিয়াজী' ‘আখন্দজী' কিংবা ‘মোল্লাজী' বলা হতো। আরবি মাদরাসা শিক্ষকদের বলা হতো ‘মৌলভী' কিংবা মোল্লা সাহেব।


২৩. সর্দার পড়ুয়া (Monitor)
মুসলিম শাসনামলে নামকরা আলেমদের শিক্ষাকেন্দ্রে এ প্রথা ছিলো যে, তাঁরা কোনো উপযুক্ত মেধাবী ছাত্রকে ‘সর্দার পড়ুয়া নিয়োগ’ করতেন। উস্তাদ যা পড়িয়ে যেতেন সে তার পুনরালোচনা ও ব্যাখ্যা করতো। এরূপ ছাত্রকে ‘মুয়িদ' বা ‘মন্সবদার' বলা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে বোম্বাইতে নিযুক্ত Dr, Andrew Bell নামক জনৈক উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী ‘সর্দার পড়ুয়া' সংক্রান্ত এ প্রথা খুবই পছন্দ হয়। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে 'Monitor' নাম দিয়ে 'সর্দার পড়ুয়া' সংক্রান্ত এ প্রথা সেখানে চালু করেন। সেখান থেকে পুনরায় এদেশের আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে সে প্রথা আমদানি হয়।


২৪. পাঠ্যবিষয়
আগেই বলেছি, শিক্ষা বিভাগ বলে সরকারের তখন কোন বিভাগ ছিলো না। শিক্ষা-নীতি ও শিক্ষার বিষয় প্রণয়নে সরকারের কোন হাত ছিলো না। বড় বড় আলেম ও শিক্ষকগণই এ দায়িত্ব পালন করতেন। শিক্ষানীতি প্রণয়নে সরকারি হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা বরং বহু শাসক ও সুলতানদের প্রশাসনেই আলেমদের বিরাট প্রভাব ছিলো। সেকালে কোন বোর্ডের অধীনে শিক্ষা-ব্যবস্থা পরিচালিত হতো না। সারাদেশে আলেমরা এক জায়গায় বসে শিক্ষা-নীতি, পাঠ্য বিষয়, পাঠ্য-তালিকা ইত্যাদি প্রণয়ন করতেন না। তবে সকলেই একটি দ্বীন ও আদর্শের অনুসারী হবার কারণে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার একটা বুনিয়াদি কাঠামো গড়ে ওঠে। পাঠ্য বিষয় ও পাঠ-তালিকার ক্ষেত্রেও একটা সমন্বিত রূপ পরিলক্ষিত হয়।


২৫. পাঠ্য-তালিকা: মকতব

(১) সর্বপ্রথম ‘কায়দায়ে বাগদাদি' পড়ানো হতো।

(২) অতঃপর কোরআন শরীফের ৩০তম পারা (আমপারা) পড়ানো হতো।

(৩) আমপারা শেষ হবার পর গোটা কোরআন মজিদ খতম করানো হতো। কোরআন মজিদ খতন করার আগে অন্য কোন কিতাব পড়ানো হতো না।

(৪) কোরআন মজিদ খতমের পর ‘কালিমা’ প্রভৃতি চরিত্র গঠন মূলক ফার্সি বই পড়ানো হতো।

(৫) অযু এবং নামায শিখানো হতো। সকর ছাত্রকেই (আসর) নামাযের জামায়াতে শরিক হতে হতো।


২৬. শিক্ষাদান-পদ্ধতি: মকতব

(১) শিক্ষক-ছাত্র সকলেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' বলে পাঠ আরম্ভ করতেন।

(২) ছাত্ররা বিছানায় উস্তাদের সম্মুখে আদবের সাথে হাঁটু পেতে বসতো।

(৩) ছাত্রদের প্রথমে বিগত পাঠ শুনাতে হতো। তা' শুনাতে পারলেই নতুন সবক (পাঠ) দেয়া হতো।

(৪) বৃহস্পতিবারে নতুন করে সবক দেয়া হতো না। সেদিন বিগত সাতদিনের পড়া শিক্ষক শুনতেন।

শিশুরা সাধারণত: সাত-আট বছর বয়সেই কোরআন পড়ে শেষ করতো। পূর্ণ কোরআন খতম করার পূর্বে কোন ছাত্রই অন্য কোন শিক্ষা আরম্ভ করতে পারতো না।


২৭. পাঠ্য বিষয়: ফার্সি মাদরাসা
সুলতান মাহমুদ গযনভীর শাসনকাল থেকে নিয়ে কোম্পানির শাসনকাল পর্যন্ত (১০৩০-১৮৩৫ খ্রি:) ফার্সি ছিলো এদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। সে জন্য এদেশে ব্যাপক হারে ফার্সি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব মাদরাসায় হিন্দু ছাত্ররাও পড়তো। ফার্সি ভাষা ছাড়াও জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষাও দেয়া হতো। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য বিষয় ছিলো মোটামুটি নিম্নরূপ:

(১) ফিকাহ

(২) আখলাক : এতে সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকও অন্তর্ভুক্ত হতো। যেমন: নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পৌরনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি।

(৩) ইতিহাস : ইতিহাসের সাথে কিস্সা-কাহিনীও পড়ানো হতো।

(৪) ভাষা ও সাহিত্য : এতে ফার্সি গদ্য ও পদ্য পড়ানো হতো।

(৫) পত্র : এর দ্বারা চিঠিপত্র ও দরখান্ত-দস্তাবেজ ইত্যাদি লেখা শিখানো হতো।

(৬) গণিত : এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও হিসাব শাস্ত্রের যাবতীয় জ্ঞান দান করা হতো।

(৭) খোশ নবিশি (সুলেখা)

ফার্সি মাদরাসায় শিক্ষার মেয়াদ কত কছর ছিলো তা বিস্তারিতভাবে কিছু জানা যায় না । নবাব মিরযা দাগের (১২৪৭-১৩২৫ হিঃ) একটা পত্র থেকে জানা যায়, তিনি তিন বছরে ফার্সি মাদরাসার পড়া লেখা শেষ করেন।


২৮. শিক্ষাদান পদ্ধতি: ফার্সি মাদরাসা

(১) কোরআন মজীদ খতম হবার পর পরই ফার্সি ভাষা শিক্ষাদান শুরু হতো।

(২) মুখস্থ করার প্রতি জোর দেয়া হতো।

(৩) ছাত্ররা শুনে এবং পড়ে পাঠ মুখস্থ করতো।

(৪) প্রত্যেক ছাত্রকে পৃথকভাবে পাঠদান করা হতো। শিক্ষক প্রত্যেক ছাত্রের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন।

(৫) তৃতীয় প্রহর সুলেখা এবং অংকের জন্য নির্দিষ্ট থাকতো।

(৬) সাধারণত বুধবারে নতুন কিতাবের সবক দেয়া হতো।


২৯. পাঠ্য বিষয়: আরবি মাদরাসা
মুসলিম শাসনামলে এদেশে আরবি মাদরাসাগুলোই ছিলো উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে কোরআন, হাদীস এবং ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আরবি ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হতো। যারা এসব মাদরাসার শিক্ষা শেষ করতো তাদের আলেম বলা হতো। আরবি মাদরাসাগুলোতে পাঠ্যগ্রস্থ নির্বাচনে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। কোরআন, হাদীস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানদানের উপযুক্ত গ্রন্থাবলি পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা হতো। শেষ পর্যায়ে দর্শন শাস্ত্রের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হতো। পাঠ্য গ্রন্থাবলি পরিবর্তন করা হতো খুব কমই। মুসলিম শাসনামলের বিভিন্ন সময় মাদরাসাগুলোতে মোটামুটি নিম্নরূপ পাঠ্য বিষয় চালু ছিলো:

(১) ইলমে ছরফ

(২) ইলমে নাফ

(৩) উসুলে ফিকাহ

(৪) ফিকাহ

(৫) তাফসির

(৬) হাদীস

(৭) ইলমে কালাম

(৮) মানতিক, ফালসাফা (দর্শনশাস্ত্র)

(৯) তাসাওফ

(১০) আরবি সাহিত্য (গদ্য ও পদ্য)


৩০. শিক্ষাদান পদ্ধতি: আরবি মাদরাসা
পাঠ্য গ্রন্থাবলির গুরুত্ব ও আকারের প্রেক্ষিতে সেগুলোকে তিনভাবে ভাগ করে পড়ানো হতো।

(১) সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি: এ পর্যায়ে শিক্ষক বক্তৃতার মাধ্যমে গ্রন্থের উদ্দেশ্য ও মূল বক্তব্য বুঝাতেন। এ পদ্ধতি আধুনিক কালের Lecture Method এর অনুরূপ ।

(২) মধ্যম পদ্ধতি: এ পর্যায়ে ব্যাকরণ, অলঙ্কার শাস্ত্র প্রভৃতিও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দেয়া হতো। সন্দেহ-সংশয়ের নিরসন করা হতো এবং সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ ও যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে মূল বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়া হতো। এটা ছিলো সূক্ষ্ম (Intensive) অধ্যয়ন পদ্ধতি।

(৩) ব্যাপক আলোচনা পদ্ধতি: এ পর্যায়ে উপরোক্ত দু'প্রকারের আলোচনা ছাড়াও ব্যাপক ব্যাখ্যা এবং উপমা-উদাহরণের মাধ্যমে ছাত্রদের জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করার চেষ্টা করা হতো। এটা ছিল ব্যাপক (Extensive) অধ্যয়ন পদ্ধতি।


৩১. দারসে নিযামী মাদরাসা
মোল্লা কুতুবদ্দীন নামে একজন বিখ্যাত আলেম মাদরাসা সমূহের তৎকালীন সিলেবাস সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে একটা নতুন সিলেবাস তৈরি করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মোল্লা নিযামুদ্দীন (মৃত্যু ১৭৪৭ খ্রি:) পিতার পদ্ধতিতে আরো অধিক চিন্তা-ভাবনা করে প্রত্যেক বিষয়ে দু'দুটি কিতাব নির্বাচন করে নতুন সিলেবাস চালু করেন। তাঁর নাম অনুযায়ী এ সিলেবাসের মাদরাসাগুলো দারসে নিযামী মাদরাসা নামে অভিহিত ছিলো।


৩২. নারী-শিক্ষা
মুসলিম শাসনামলে নারী শিক্ষার প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করা হতো। মুসলমানগণ ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের কন্যাসন্তানদের পড়ালেখা করাতেন। মেয়েরা ব্যাপকভাবে মকতবে কোরআন শিক্ষা করতো । দিল্লির এক সময়ের একজন শাসক ছিলেন একজন নারী, সুলতানা রাজিয়া। তিনি ছিলেন একজন বিদুষী মহিলা। তিনি কয়েকটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে বতুতা (১৩০৩-১৩৭৭ খ্রি:) তাঁর ঐতিহাসিক সফরে এদেশে তিনটি মহিলা মাদরাসা দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সুলতান গিয়াসুদ্দীন খলজীর মহলে দশ হাজার মহিলা ছিলো। মুহাম্মদ কাসিম ফেরেশতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদের মধ্যে হাজার হাজার হাফেজা, ক্বারিয়া, দ্বীনের আলেমা ও শিক্ষিকা ছিলেন।

মুসলিম আমলে শিক্ষার দিক থেকে এদেশের নারীদের খুবই খ্যাতি ছিলো।


৩৩. চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষা
মুসলিম আমলে চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্যে স্বতন্ত্র কোন ব্যবস্থা ছিলো বলে জানা যায় না। তবে এসব বিদ্যায় বহু দক্ষ মুসলমানের নাম জানা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায, হয়তোবা কোন কোন মাদরাসায় এসব বিষয়েও শিক্ষাদান করা হতো। এসব শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতেন। মুসলিম আমলের ব্যাপক স্থাপত্য-নিদর্শন থেকে বুঝা যায় যে, তখন সুদক্ষ কারিগর তৈরি হতো।


৩৪. উপসংহার
মুসলিম শাসনামলে এদেশে যে শিক্ষা-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো, যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা এতক্ষণ আমরা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করলাম, যে শিক্ষাব্যবস্থা শত শত বছর ধরে এদেশে প্রচলিত ছিলো, তার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত ছিলো সৃষ্টিকর্তার একত্ব এবং আখিরাত স্রষ্টার সম্মুখে জবাবদিহির সুদৃঢ় বিশ্বাসের ওপর। এ বিশ্বাসই মুসলমানদের মন-মগজকে যাবতীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ শিক্ষা-ব্যবস্থা ছিলো দক্ষ মানুষ তৈরির কারখানা। গোটা ইসলামী শুকুমাত পরিচালনার জন্যে সর্ব প্রকার দক্ষ মানুষ এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই তৈরি হতো। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন: “আমরা এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পূর্বে মুসলমানরা কেবল রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারীই ছিলেন না বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বুদ্ধি ও মেধাগত দিক থেকেও তাঁরা ছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। ....... তাঁদের হাতে ছিলো এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যাকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখা যায় না। এতে ছিলো উন্নত নৈতিক ও মাসনিক প্রশিক্ষণের সু-ব্যবস্থা।”

মাওলানা মওদূদী (র.) মুসলিম শাসনামলের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এক পর্যালোচনায় বলেন: “তখন আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো, তা সে সময়ের দাবি ও প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট ছিলো। এ ব্যবস্থায় এমন সকল বিষয়ই পড়ানো হতো, যা তখনকার রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন ছিলো। তাতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই প্রদান করা হতো না, বরং সে শিক্ষাব্যবস্থা দর্শন, মানতিক, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হতো। কিন্তু যখন সে রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়, যার প্রেক্ষিতে আমারা গোলামে পরিণত হলাম, তখন এ গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।"


গ্রন্থপঞ্জি
(১) হিন্দ ও পাকিস্তান মে মুসলমানুকা নিযামে তা'লিম ও তারবিয়াত : প্রফেসর সাইয়েদ মুহাম্মাদ সলীম।
(২) তা'লিমাত : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী।
(৩) তারীখে মাদরাসা-ই-আলীয়া: আবদুস সাত্তার খান।
(৪) তা'লীম ও তারবিয়াত: মানাযির আহসান গিলানী।
(৫) History of the rise of the Mohamedan power in India: Mohammed Kasim Ferishta, Translated in english by John Briggs.
(৬) Our Indian Muslams : William Hunter.
(৭) History of Education in India : Noorullah & Niak.
(৮) British policy & Muslim Bengal : A. R Mullick.
(৯) ইনসানী দুনিয়া পর মুসলমাকে উরূজ ও যাওয়াল কা আসার: সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবভী।
(১০) হিন্দুস্থান মে ইসলাম কি পহেলি তাহরিক; মাওলানা মাসউদ আলম নদভী।
(১১) মাধ্যমিক ইতিহাস : মুহাম্মদ ইসহাক: বাংলাদেশ স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড : ঢাকা।
(১২) বাংলাদেশে ইসলাম : আবদুল মান্নান তালিব।
(১৩) বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা : মোহাম্মদ আজিজুল হক।
(১৪) আল কুরআন।
(১৫) সাইয়্যেদ আবল আ'লা মওদূদী : তাফহীমূল কুরআন। আধুনিক প্রকাশনী ঢাকা৷
(১৬) সিহাহ সিত্তার হাদীস গ্রন্থাবলী।
(১৭) মিশকাতুল মাসাবীহ।
(১৮) Miltion Cowan : A dictionary of Modern Written Arabic, Mac - donald & Evans Ltd. London, Third Printing 1974.
(১৯) শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, ড.শশীভূষণ দাশ গুপ্ত, শ্রী দীনেশচন্দ্র ভট্টাচর্য: সংসদ বাঙ্গালা অভিধান।
(২০) অশোক মুখোপাধ্যায় : সংসদ সমার্থ শব্দ কোষ, ২য় সংস্করণ ১৯৮৮ কলিকাতা।
(২১) গাজী শামছুর রহমান : শিশু অধিকার সনদের ভাষ্য। শিশু একাডেমী, ঢাকা ১৯৯৪।
(২২) প্লেটো : রিপাবলিক । সৈয়দ মকসুদ আলী অনূদিত।
(২৩) ড. খুরশীদ আহমদ: নেযামে তা'লীমে। আই পি ইসলামাবাদ।
(২৩) মুসলিম সাজ্জাদ: ইসলামী রিসালাত যে নেযামে তা'লীম। আই পি এস ইসলামাবাদ।
(২৫) মুহাম্মদ আবুল কুদ্দুস : শিক্ষানীতির কয়েকটি কথা।
(২৬) প্রফেসর সাইয়েদ মুহাম্মদ সেলিম: ইসলাম কা নেযামে তা'লীম। লাহোর ১৯৯৩।
(২৭) Report of the commission on National Education, Govern ment of Pakistan (Sharif Commission Report) 1959.
(২৮) বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট (কুদরাত-এ-খুদা কমিশন রিপোর্ট) ১৯৭৪।
(২৯) বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট (মফিজউদ্দিন আহমদ কমিশন রিপোর্ট) ১৯৮৮।
(৩০) প্রতিবেদন : জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭ ( শামসুল হক কমিটি)।
(৩১) জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৩ প্রতিবেদন।
(৩২) জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে প্রস্তাব ও সুপারিশমালা: আবদুস শহীদ নাসিম সম্পাদিতঃ সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ, ১৯৯৭।
(৩৩) আফজাল হোসাইন : তালীম ও তারবীয়াত, মাকতবা ইসলামী, নতুন দিল্লি।
(৩৪) আবদুস সাত্তার : আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮০।
(৩৫) মোহাম্মদ আজহার আলী ও হোসনে আরা বেগম : প্রাথমিক শিক্ষা, বাংলা একাডেমী।
(৩৬) সাইয়েদ মুহাম্মদ সেলিম : হিন্দ ও পাকিস্তান মে মুসলমানুকা নিযামে তা'লীম।
(৩৭) সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী : তা'লীমাত।
(৩৮) William Hunter : Our Indian Musalmans.
(৩৯) A. R. Mullik : British Policy & Muslim Bengal.

 লেখক: খ্যাতিমান চিন্তাবিদ, গবেষক ও পরিচালক মাওলানা মওদূদী রিসার্চ একাডেমি