চিকিৎসাবিদ্যার ইসলামীকরণ - ডা. মুহাম্মদ গোলাম মোয়াযযাম
বস্তুজগতের বিশেষ জ্ঞানকে আমরা ‘বিজ্ঞান' বলি। তাই অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদির মত চিকিৎসাবিদ্যাও বিজ্ঞানের অংশ। একথা ঐতিহাসিক সত্য যে কোরআন ও হাদীসের প্রভাবে উদ্বুদ্ধ প্রাথমিক যুগের মুসলিম বৈজ্ঞানিকগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান। সুতরাং ইসলামী বিধানের আওতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে গড়ে তোলা কোন নতুন সমস্যা নয়। যদিও মধ্যযুগের মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ গ্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা অধিক প্রভাবিত ছিলেন। তবুও মুসলমান হিসেবে তারা ইসলামী বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেছিলেন; যার প্রমাণ বর্তমান হাকিমী শাস্ত্রে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
আপাত দৃষ্টিতে বিজ্ঞানের কোন ধর্ম (দ্বীন) নেই। সুতরাং চিকিৎসাবিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞানের ইসলামীকরণ কথাটির কোন অর্থ হয় না। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে পদার্থবিদ্যার মত বস্তু বিজ্ঞানেরও ইসলামীকরণ সম্ভব। পদার্থবিদ্যার বদৌলতে আমরা বহু যন্ত্রপাতি লাভ করেছি যার মধ্যে সব রকমের যুদ্ধাস্ত্রও রয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে নেহাত বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক মহাশূন্যযান ও পদার্থবিদ্যা তথা বিজ্ঞানের ইসলামীকরণের অভাবে মানব কল্যাণের পরিবর্তে মানবতার ধ্বংস সাধনেই অধিক ব্যবহৃত হবার আশঙ্কা; যেমনটি হয়েছে যুদ্ধবিমান বিস্ফোরক, রকেট ইত্যাদির মাধ্যমে। এগুলোর ইসলামীকরণ বলতে এই যন্ত্রগুলোর সদ্ব্যবহার তথা কেবল মানব কল্যাণে ব্যবহার করা বুঝায় । আর তা সম্ভব যদি এই যন্ত্র আবিষ্কারক, প্রস্তুতকারক ও পরিচালক সবাই মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়। তখন দ্রুত গমনের জন্য আবিষ্কৃত বিমানকে বেসামরিক ও নিরপরাধ জনগণকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা বর্ষণের কাজে ব্যবহার করা হবে না ।
এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোচনা করা যাক। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলতে মানবদেহের গঠন, কর্ম পদ্ধতি, রোগ সৃষ্টির কারণ, রোগে শরীরের গঠন ও কার্যপদ্ধতির পরিবর্তন, রোগ নির্ণয় চিকিৎসাপদ্ধতি এবং রোগ প্রতিরোধ পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় বুঝায়। যেহেতু এই বিজ্ঞান মানবদেহ নিয়ে (মন নিয়েও বটে) আর দ্বীন ইসলামও মানুষের জন্য তাই এই দুয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং যোগাযোগ অপরিহার্য।
৮ম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত অন্যান্য বিজ্ঞানসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানেও মুসলমানগণ ছিলেন নেতৃস্থানীয়। আল-রাযী, ইবনে সীনা, আবুল কাসেম, প্রমুখ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের লেখা পুস্তক তখন সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবশ্যিক পাঠ্যপুস্তক ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁ আন্দোলন মুসলমানদের নিকট থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা লাভেরই ফলশ্রুতি।
পরবর্তীকালে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে উন্নতি শুরু হয় তার ফলে গত প্রায় দেড় শত বৎসরে ইউরোপ প্রাচ্য থেকে বহুগণ উন্নতি লাভে সমর্থ হয়। বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানও এই সময়ে গড়ে ওঠে। এ সময় পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে প্রচলিত বাইবেল সমর্থিত খ্রিষ্ট ধর্মের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ডারউইনের মতবাদের ভুল ব্যাখ্যা করে ধর্মকে চার্চের দেয়ালে সীমাবদ্ধ করে বিজ্ঞান সাধনা চালানো হয়। ফলে এটুকু বলতে পারি যে ১৯৪৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলে এনাটমি শব-ব্যবচ্ছেদ ক্লাস শুরু হয়। বেলা ১২ টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এতে জোহরের সালাত আদায়ে অসুবিধা হল। তাই একদিন গেলাম অধ্যক্ষ মস্টগোমারি সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সঙ্গে ছিলেন আমার সহপাঠী বন্ধু ডা. মুহাম্মদ ইউনুস দেওয়ান। (Brigyuns Dewan) আমরা যোহরের সালাতের জন্য দেড়টার সময় হলের বাইরে আসার অনুমতি চাইলে তিনি জবাব দিলেন-Science and Religion cannot go together. (বিজ্ঞান ও ধর্ম এক সঙ্গে চলতে পারে না।) আমরা জবাবে বললাম আমরা বিজ্ঞানকে ধর্ম বিরোধী মনে করি না। আর নামাযের জন্য মাত্র পনের মিনিট সময়ই যথেষ্ট। তখন তিনি আমাদেরকে অনুমতি দিলেন। এ ধরনের মনোভাব সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের মধ্যে বর্তমান যার প্রতিফলন ঘটে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও । যা হোক বর্তমান যুগের উন্নত ইসলামী চিন্তা ও গবেষণামূলক পুস্তকাদিও বিশ্বব্যাপী ইসলামী গণজাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ভুল অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। ইসলাম যেহেতু স্বয়ং আল্লাহর কিতাব আল কোরআন ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত তাই ইসলামের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি কুরআন বিজ্ঞান শিক্ষার যেভাবে তাগিদ দিয়েছে তাতে মুসলমানদের জন্য বিজ্ঞান শিক্ষা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহর প্রেরিত তাওরাত ও ইনজিল কিতাবের অবর্তমানে মানবরচিত ও বিকৃত প্রাচীন ও নতুন মতবাদ (Old and New Testaments) ধর্মের যে সীমিত পরিসর অনুমোদন করে এবং এই সমস্ত কিতাবে বিজ্ঞানে প্রমাণিত বিষয়ের বিপরীত এত বিষয়াদি রয়েছে যে তাতে কোন বিজ্ঞানী প্রচলিত ইয়াহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মকে মানতে পারে না। তাই ধর্মকে তারা ধর্ম মন্দিরে তালাবদ্ধ করে ধর্মহীন মনোভাব নিয়ে বিজ্ঞান চর্চা করে আজ পৃথিবীকে আণবিক যুদ্ধের দ্বার দেশে এনে উপস্থিত করেছে। ইসলাম এ দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক বিধায় বর্তমান মুসলিম বিজ্ঞানীগণ ক্রমেই দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেহেতু ইউরোপ থেকে ধর্মবিরোধী পরিবেশ নিয়ে এসেছে তাই এর ইসলামীকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
একজন মানুষ সে মুসলিম হোক বা কাফের হোক শরীরের গঠন থেকে শুরু করে সকল প্রকার শারীরিক দিক থেকে সবাই এক। তাই দ্বীন ইসলামে বিশ্বাসী না হলে যে ব্যক্তি কাফের হল তার সঙ্গেই একজন মুসলমানের বস্তুগত কোন অমিল নেই। কিন্তু দৈনন্দিন জীবন ধারা ও চাল-চলনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান তা প্রকাশ পেতে বাধ্য। এমনিভাবে একই মানব দেহের ওপর ভিত্তি করে রচিত চিকিৎসাবিজ্ঞানও তার ব্যবস্থার পদ্ধতি ও শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমেই এর ইসলামী ও অনৈসলামী রূপ ফুটে উঠবে।
এখন চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা থেকে শুরু করে গোটা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে কিভাবে ইসলামী- করণ সম্ভব সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
১. অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা বা এনাটমি
একজন মেডিক্যাল ছাত্র প্রথমেই যে দুটো বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে তার একটি হল অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা, এবং অপরটি হল শারীরবিদ্যা বা ফিজিওলজি।
ইসলামের দৃষ্টিতে সব দেহের কোনরূপ বিকৃতি নিষিদ্ধ। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা ছিল নিহত শত্রুর শবদেহের অপমান করার বিরুদ্ধে। ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হযরত হামযার (রা) লাশকে তখনকার অবস্থায় কাফের আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা যে অবমাননা করেছিল তা যেমন ছিল নৃশংস তেমনি ছিল অমানবিক। এ ধরনের শত্রুতা যা মৃত্যুর পরও চলে তা ইসলামে নিষিদ্ধ। অথচ এই বিধানের দোহাই দিয়ে যুগ যুগ ধরে শব-ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ থাকায় মুসলমান বিজ্ঞানীগণ এনাটমিতে আশানুরূপ উন্নতি করতে পারেনি। চিকিৎসক হওয়ার প্রয়োজনে, শরীরের গঠন প্রণালি শিক্ষা ও অস্ত্রোপচার শিক্ষার জন্য এনাটমি শিখতে হবে। আর সে জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ একান্ত প্রয়োজন । আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইসলামের জ্ঞান শিক্ষার জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ নয় ।
অমুসলিমগণ যেভাবে এই শব-ব্যবচ্ছেদ করবে তার সঙ্গে একজন মুসলমানের মূল প্রভেদ থাকবে মানসিক দিক থেকে। ইসলাম সমর্থিত পদ্ধতিতে শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য নিম্নোক্ত পরিবর্তন প্রয়োজন ।
(ক) শবদেহকে সম্মানের সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে হবে, একটি জড় পদার্থের মত নয়। আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মানুষের মৃতদেহ হিসাবে যথেষ্ট তা'যীমের সঙ্গে শবদেহ নাড়াচাড়া করতে হবে। আর এ কাজের জন্য অমুসলিম নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ডোমের পরিবর্তে পরহেজগার কোন মুসলমান নিযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। নারী শবদেহের জন্য নারী কর্মচারী হওয়া বাঞ্ছনীয় ।
(খ) যদিও ব্যবচ্ছেদের সময় উলঙ্গ করতেই হবে তবুও ব্যবচ্ছেদাগারে আনবার পূর্বে মৃতদেহ কাফন আবৃত থাকতে হবে।
(গ) মুসলিম মৃতদেহ হলে তার জানাজা আদায় করে ব্যবচ্ছেদের জন্য পাঠাতে হবে।
(ঘ) মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা আল্লাহর নাম স্মরণ করে এবং শুধু শিক্ষার প্রয়োজনে শব-ব্যবচ্ছেদ করছেন এ ধরনের মনোভাব নিয়ে ব্যবচ্ছেদ শুরু করবেন। এসময়ও যথেষ্ট তা'যীমের সঙ্গে কাজ করলে এনাটমি শিক্ষাও উত্তম হবে। কারণ তাতে সকল শারীরিক গঠন পদ্ধতি ও বিষয় বস্তুগুলো ভাল ভাবে দেখে জ্ঞান লাভ সম্ভব হবে। কারণ এতে ব্যবচ্ছেদের সময় বাজে গল্পগুজবে সময়ের অপচয় কম হবে ।
(ঙ) শব-ব্যবচ্ছেদ হবার পর যে সমস্ত হাড় ও মাংস ইত্যাদি পরিত্যক্ত হবে সে সব সসম্মানে মাটিতে দাফন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
(চ) শিক্ষার প্রয়োজনে শরীরের যে সব অংশ এবং হাড় সংরক্ষণের প্রয়োজন তা অবশ্যই রাখতে হবে। যদি কোন কারণে এ সব নষ্ট বা পচে যায় তখন সে গুলোও মাটিতে দাফন করতে হবে।
(ছ) এনাটমি শিক্ষায় মানবদেহের সৃষ্টি কৌশল এবং গঠনপদ্ধতি ইত্যাদি পড়াবার সময় এতে যে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি কৌশল ও প্রজ্ঞা রয়েছে সে দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। মানব সৃষ্টি যে প্রকৃতির খেয়াল খুশি নয় বরং আল্লাহ তায়ালার প্রোগ্রাম অনুযায়ী পবিত্র কুরআনের আয়াত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সে দিকটাও তুলে ধরতে হবে।
(জ) এমব্রিয়লজি বা ভ্রূণ-বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার সময় এ বিষয়ে আল-কোরআনে যে সব চমৎকার আয়াতসমূহ রয়েছে সে সবের উদ্ধৃতি দিলে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উত্তম দ্বীনি শিক্ষা হবে। উপরে বর্ণিত বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিয়ে যথারীতি এনাটমি হিস্টলজি এমব্রিয়লজি ও অস্টিওলজি শিক্ষা দিতে হবে। এমনি ভাবে এনাটমি বা শব-ব্যবচ্ছেদ বিদ্যাকে ইসলামীকরণ সম্ভব।
(ঝ) এনাটমি শিক্ষা দেয়ার সময় মুসলিম বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে যে সমস্ত অবদান রয়েছে তার উল্লেখ অবশ্যই করতে হবে। বর্তমান প্রচলিত পুস্তকেই ইউরোপীয় রেনেসাঁ অথবা প্রাক-মুসলিম যুগের অবদানের উল্লেখ থাকে অথচ মুসলিমদের অবদান প্রায়ই উল্লেখিত হয় না । এতে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে বিশেষ করে আবদুল লতিফের (১১৬২-১২৩১) নাম উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন যিনি সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন যে চোয়ালের হাড় একটি, এটা সংযুক্ত হাড় নয়।
শব-ব্যবচ্ছেদ না করা ধর্মীয় বিধান মনে করায় পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মত মুসলিমগণও এ ব্যাপারে পশ্চাৎপদ ছিলেন। তবে মুসলমানগণ বানর ও শিম্পাঞ্জীর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে গ্রিকদের কিছু ভুল সংশোধন করেন। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুজগত থেকে বর্জন করার পরই ব্যবচ্ছেদে অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করে।
মুসলিম বৈজ্ঞানিকগণ এ ব্যাপারে কেন যে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেননি যে, শিক্ষার জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ ইসলাম বিরোধী হতে পারে না তা বুঝা মুশকিল। বোখারী শরিফের প্রথম হাদীসেই বলেছে প্রত্যেক কাজের পরিণাম তার নিয়ত (উদ্দেশ্য) অনুযায়ী হবে। মুসলমান শিক্ষিত সমাজের এ ভ্রান্তি এখনও কাটেনি। এ ব্যাপারে আরও একটি ব্যক্তিগত ঘটনার উল্লেখ করছি।
১৯৪৫-৪৭ এই দুই বৎসর আমি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসাবে শব-ব্যবচ্ছেদ ক্লাস করি। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসের প্রবল মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার পর কলকতায় আমরা এক নতুন সমস্যায় পতিত হই। ইংরেজ আমলে কলকাতার একটি আইন ছিল যে কোন মুসলমান এবং খ্রিস্টান মৃতদেহ শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য মেডিক্যাল কলেজে নেয়া যাবে না। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর ভারতের চরম সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্ররোচনায় মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মেডিক্যাল কলেজে শব-ব্যবচ্ছে করতে দেয়া হল না। কারণ, কোন হিন্দু শব মুসলমানদেরকে ব্যবচ্ছেদ করতে দেয়া হবে না। সরকারি কলেজ হলেও কলেজের প্রায় সব মুফিদুল ইসলাম নামক একটি প্রতিষ্ঠান লা-ওয়ারিশ মুসলিম শবদেহ দাফন করত। একদিন আমরা কযেকজন মুসলিম ছাত্র এ ব্যাপারে আলাপ করার জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনার পর কয়েকটি শর্তে আমাদের জন্য মুসলিম মৃতদেহ জোগান দিতে রাজি হলেন। শর্তগুলো ছিল:
(১) কোন অমুসলিম যেন মুসলিম মৃতদেহ স্পর্শ না করে।
(২) শব-ব্যবচ্ছেদের পর খণ্ডিত অংশগুলো তাদেরকে ফেরত দিতে হবে যেন তারা সেগুলো দাফন করতে পারেন। এভাবে আমরা তখন এক মহাসংকট থেকে রেহাই পাই।
সুতরাং আজ এ কথা স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে যে, যেহেতু মুসলিম ডাক্তার হতে হবে, আর ডাক্তার হতে হলে শব-ব্যবচ্ছেদ করতে হবে। সুতরাং মুসলমান শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করতে দিতেই হবে, আর মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজনেই এর অনুমতি দিতে হবে। ইসলামের মত একটি বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক জীবন বিধানে শিক্ষার জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করার জন্য মৃত্যুর পর মৃতের উত্তরাধিকারীদের অনুমতিক্রমে শব-ব্যবচ্ছেদ বা Post mortem Autopsy করার পক্ষে অনুমোদন থাকতে হবে। মুসলিম দেশগুলোতে মৃতদেহের এই শিক্ষামূলক ব্যবচ্ছেদ হয় না বলে চিকিৎসাশাস্ত্রে যথেষ্ট উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না।
২ শারীরবিদ্যা বা ফিজিওলজি (Physiology)
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনই এই শারীরবিদ্যার উদ্দেশ্য। শব-ব্যবচ্ছেদের অভাবে এ বিষয়ে মুসলিম বৈজ্ঞানিকগণ যথেষ্ট উন্নতি লাভ করতে পারেননি ।
এই বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার সময় আল্লাহর সৃষ্টি কৌশলের বিস্ময়কর দিকগুলো আলোচনা করা উচিত। এ প্রসঙ্গে শারীরবিদ্যায় মুসলমানদের প্রধান ও বিখ্যাত অবদান ইবনে আন নাফিসের (১২০৮-১২৮৮) পালমোনারি সারকুলেশন (Pulmonary circulation) আবিষ্কার। তিনিই প্রথম গ্রিক চিকিৎসক গ্যালনের ভুল ধারণা দূর করেন। অবশ্য ইউরোপীয়গণ পরবর্তীকালে এই আবিষ্কার নিজেরা করেছে বলে মিথ্যা দাবি করে যা ১৯৩৬ সালে আন-নাফিসের লিখিত পুস্তক আবিষ্কারের পর পরিত্যক্ত হয়। এই ভুল সংশোধন না হওয়ায় রক্ত চলাচল বুঝতে মানুষের অনেক সময় লেগেছে। দুঃখের বিষয় আজও শারীরবিদ্যার পুস্তকগুলোতে ইবনে আন নাফিসের এই অবদানের কথা স্পষ্ট করে লেখা হয় না। মুসলিম শিক্ষাবিদদের উচিত এই ধরনের বিষয়গুলো তাদের লিখিত বই ও বক্তৃতায় সন্নিবেশিত করা। এতে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গবেষণার মনোবৃত্তি বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের হীনম্মন্যতা দূর হয়ে যাবে।
৩. ঔষধ বিজ্ঞান বা ফার্মাকোলজি (Pharmacology)
ঔষধ বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার সময় শিক্ষার্থীদেরকে বলা উচিত যে আল্লাহর শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘অর্থাৎ সব রোগেরই ঔষধ আছে' এই হাদীস যে মুসলমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরকে নতুন নতুন ঔষধ আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ঔষধ বিদ্যায় মুসলমানদের বিরাট অবদানের কথা অবশ্যই পাঠ্য তালিকায় থাকতে হবে। এ বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে আল বায়তারের (মৃ: ১২৪৮) অবদান বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। তার এ বিষয়ে লেখা দু'টো বিখ্যাত পুস্তক কিতাব আল জামেয়া ফিল আদারিয়া লিল মুফরাদাত এবং কিতাবু আল মুগনি ফিল আদারিয়া আর মুফরাদাতই বর্তমানে ফার্মাকোপিয়ার ভিত্তি। এ বিষয়ে আলকিন্দির (৮১৩-৮৭৩) বিশেষ অবদানের কথাও বলতে হবে।
বর্তমানকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের চরম উন্নতির মূলে রয়েছে রসায়ন ও জীব রসায়ন শাস্ত্রের প্রভূত উন্নতি। কিন্তু পাশ্চাত্যে যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ ও মনোবৃত্তি বিরাজমান সে জন্য ঔষধ প্রস্তুতিতে হালাল-হারাম বলে কোন বিধি নিষেধ নেই। এই প্রচার মুসলিম ঐতিহ্যবাহী বিষয়ে শিক্ষাদানের সময় ঔষধ প্রস্তুতিতে ইসলামী বিধি নিষেধের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। কোন হারাম বস্তু ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এ ব্যাপারে মুসলিম দেশসমূহের ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যথেষ্ট সাবধান হতে হবে। ঔষধে হারাম বস্তু ব্যবহারের দুটো মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি।
মদ বা এলকোহল (Ethyl alcohol) মদ যে ঔষধ হতে পারে না এ বিষয়ে বর্তমান জীব রসায়নবিদরা একমত। আর মহানবী (সা) স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন যে মদ নিজেই রোগ এতে কোন রোগ আরোগ্য হতে পারে না। অথচ বহু প্রচলিত টনিক জাতীয় ঔষধে বিনা প্রয়োজনে ১০% থেকে ২৫% মদ মিশান হয়। পাকিস্তান আমলে একবার পূর্ব পাকিস্তান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসাবে এক সম্মেলনে যোগ দিতে করাচিতে যাই। সেখানে একটি ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে দেখি সেখানকার তৈরি লিভার এক্সট্রাকট নামক ঔষধে প্রায় ১৫% মদ মিশান হচ্ছে । আমি কোম্পানির ক্যানাডিয়ান কেমিস্টকে এই মদ মিশানোর কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে জবাব দিল যে মদ Preservative বা সংরক্ষণকারী হিসাবে ব্যবহৃত হয় আর লোকেরা এটা পছন্দ করে । আমি বললাম পাকিস্তানের মুসলমানরা মদ পান হারাম মনে করে আর মদ একমাত্র সংরক্ষণকারী বস্তু নয়। উক্ত কেমিস্ট কথার জবাবে বললেন কেউ তো আপত্তি করে না আর পাশ্চাত্য এর ব্যাপক ব্যবহার হয়। অবশ্য মদ ছাড়াও বহু সংরক্ষণকারী রাসায়নিক বস্তু আছে। আমি এ ব্যাপারে প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করে আসলাম তাদের ভিজিটিং বইয়ে। কিছুদিন পর চিঠি পেলাম যে উক্ত কোম্পানি তাদের ঔষধে মদের ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন।
এখন অমুসলিম দেশের Liver extract জাতীয় জৈবিক ঔষধপত্র হারাম প্রাণী বা হারাম ভাবে নিহত প্রাণী থেকে সংগ্রহীত হতে পারে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। মুসলিম দেশ সৌদি আরব সরকারকে রাজি করিয়ে হজ্জের সময় জবাই করা লক্ষ লক্ষ প্রাণী থেকে প্রয়োজনীয় যকৃত, অগ্নাশয় ইত্যাদি জিনিস সহজেই আহরণ করা যায় মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজনে। এ জন্য খোদ মক্কা শরিফের আশেপাশেই গড়ে উঠতে পারে ঔষধ প্রস্তুত কারখানা।
মদ জাতীয় ব্রাহ্মি নামক পানীয়কে ডাক্তারি শাস্ত্রে ঔষধ হিসাবে গণ্য করা হয় যদিও এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। মদ পানে অভ্যস্ত ইউরোপীয়রা এই ভুল ঔষধ চালু করেছে।
আমাদের দেশে আয়ুর্বেদীয় ঔষধের নামে কিছু সুধা মূলত কিছু ঔষধ নামীয় ভেষজ মিশ্রিত মদ ছাড়া কিছুই নয়। অথচ প্রকাশ্যে এই মদ মুসলিম বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে।
এগুলো যে আসলে মদের দোকান সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঔষধ প্রস্তুতের দোহাই দিয়ে এরা কম ট্যাক্সে মদ কিনতে পারে বলে অনেক লাভ তাই গ্রামে-গঞ্জে এই সব ভুঁইফোড় মৃতসঞ্জীবনী সুধার দোকান খোলা হচ্ছে। এই ঔষধগুলো বিজ্ঞান বিরোধী ও স্পষ্ট হারাম ব্যবসা। এটা অচিরে বন্ধ হওয়া উচিত।
এছাড়া ঔষধ বিজ্ঞানে অন্য আরও কোন হারাম বস্তুর ব্যবহারও পরিত্যক্ত হতে হবে। যে কোন বিদেশী ঔষধ এবং দেশে প্রস্তুত ঔষধও ইসলামী দৃষ্টিতে হারাম কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন যাতে একজন ইসলাম অভিজ্ঞ সদস্য অবশ্যই থাকতে হবে। ঔষধ বিদ্যার আর এক প্রধান দিক হলো ঔষধ প্রয়োগ পদ্ধতি-বা Therapeutics এ ব্যাপারে ইসলামী নীতিবোধের প্রয়োজন যথেষ্ট।
যেহেতু একজন চিকিৎসককে বিশ্বাস করে একজন রোগী তার চিকিৎসার জন্য আসবে। তাই সেই চিকিৎসককে অবশ্যই একজন ভাল চিকিৎসক হতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যা ভালভাবে শিক্ষা না করে চিকিৎসা ব্যবসায়ে লিপ্ত হওযা গুনাহ্র কাজ এ কথা শিক্ষার্থীদেরকে বুঝাতে হবে। নতুবা লোককে ধোঁকা দেয়ার গুনাহ হবে।
এমনিভাবে বিনা প্রয়োজনে, শুধু বিক্রির জন্য ঔষধ দেয়া অন্যায়। এ ছাড়া এন্টিবায়োটিক, হরমোন ইত্যাদি বিশেষ ঔষধ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে নিশ্চিত না হয়ে প্রয়োগ করলে ক্ষতি হতে পারে। জ্ঞাতসারে এই ক্ষতির জন্য দায়ী হলে গুনাহ হবে।
ঔষধ যে আসলে আরোগ্য করে না বরং শরীরকে রোগ আরোগ্যে সাহায্যে করে মাত্র এই মূল কথাটি প্রথম বলেছেন বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী আলী বিন রাববান আত্তাবারি (৮১০-৮৯০)। তিনিই প্রথম ভুল ঔষধে উদ্ভুত রোগ (Iartogenic) সম্বন্ধে সাবধান করেন। সুতরাং একজন মুসলমান চিকিৎসক সব সময় মনে রাখবেন যে আরোগ্যের মালিক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, ডাক্তার নিমিত্ত মাত্র সুতরাং পত্রিকায় গ্যারান্টি দিয়ে চিকিৎসার বিজ্ঞাপন যে কত বড় অজ্ঞতা সে কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিজেদেরকে সীমিত জ্ঞান সম্বন্ধে সজাগ তবুও যদি কোন ডাক্তার এ বিষয়ে অহমিকা প্রকাশ করেন তবে সেটা তার ভুল। দেশে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকদেরকে ধোঁকা দেয়ার সকল পথও বন্ধ হওয়া দরকার।
(৪) রোগ বিদ্যা বা প্যাথলজি (Pathology)
এর প্রধান কাজ হলো রোগ কেন হয় তা বুঝা এবং রোগ নির্ণয়ে (Diagnosis) সাহায্য করা। এই বিদ্যা বলতে গেলে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একক অবদান। এই জন্যই এলোপ্যাথি (Allopathy) চিকিৎসা পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক এবং অধিক জনপ্রিয়।
প্যাথলজি মূলত চার ভাগে বিভক্ত যার প্রত্যেকটির আরও বিভাগ সম্ভব। মূল চারটি বিভাগ হল:
(ক) হিসটোপ্যাথলজি বা শরীরের তন্তুর অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা।
(খ) বায়ো কেমিস্ট্রিবা জীব রসায়ন তত্ত।
(গ) মাইক্রো বায়োলজি বা জীবাণু তব ।
(ঘ) হিমাটোলজি বা রক্ত-বিজ্ঞান-এই চারটি বিষয়ের পৃথক পৃথক আলোচনা প্রয়োজন।
হিসটোপ্যাথলজি
এনাটমি শিক্ষার সময় চাক্ষুষ পরীক্ষা ছাড়াও অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শরীরের বিভিন্ন তন্তু ও অন্ত্রের বিন্যাস দেখা যায়। ইহাকে Histology বলে। রোগ হলে যে পরিবর্তন হয় তা পরীক্ষা করার নাম Histopathology. এতে বিভিন্ন টিউমার অস্ত্রোপচারে ফেলে দেয়া শরীরের রোগাক্রান্ত অংশ বিশেষ অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়। এই বিদ্যা-শিক্ষার ব্যাপারে প্রচলিত প্রথার কোন অন-ইসলামিক নীতি নেই। বরং অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে জীবকোষগুলির আকৃতি-প্রকৃতি দেখা যে কেউ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কৌশল ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে তাতে সন্দেহ নেই।
পরীক্ষার জন্য যে সামান্য অংশ ব্যবহৃত হয় তা ছাড়া বাকি অংশগুলো ব্যবচ্ছেদ করা অংশের মত সযত্নে মাটিতে দাফন করা উত্তম।
বায়ো-কেমিস্ট্রি
এতে শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। বিভিন্ন রোগে এই উপাদানাগুলোর মান কম-বেশি হতে পারে। যেমন বহুমূত্র রোগে রক্তের শর্করা বৃদ্ধি পায় আর নেফ্রোসিস রোগে রক্তের প্রোটিন হ্রাস পায়। এই বিষয়ে প্রচলিত প্ৰায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এর একমাত্র ব্যতিক্রম পাকস্থলির হাইড্রোক্লোরিক এসিড পরিমাপ। এর প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি Gastric Analysis নামক পরীক্ষায় রোগীকে ৭% এলকোহল পান করান হয়। পাশ্চাত্য এলকোহল বা মদ সবার প্রিয় বলে এতে কেউ আপত্তি করে না। কিন্তু মুসলিম দেশসমূহে অন্ধের মত এই নিয়ম চালু করা মূর্খতা । তাই এর বিকল্প বের করার জন্য আমিও আমার এক সহযোগী রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে গবেষণা চালাই। আমরা প্রমাণ করি যে ৭% alcohal এর পরিবর্তে দুধ ও চিনি ছাড়া পাতলা গরম চা দিয়ে একই রূপ ফল পাওয়া যায় (.....) তা ছাড়া যে কোন দিন alcohal পান করেনি তাকে alcohal দিয়ে পরীক্ষা করলে পাকস্থলীর প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক হতে বাধ্য। আজকাল ধীরে ধীরে এই পরীক্ষার বিকল্প বের হচ্ছে। আমরাও তার একটা বিকল্প বের করি রাজশাহীতে যা খুবই নির্ভরযোগ্য (১৯৬৭) যা হোক নতুন যে কোন পরীক্ষা চালু করার আগে ইসলামের দৃষ্টিতে তা জায়েয কিনা সেটা অবশ্যই দেখতে হবে।
মাইক্রোবায়োলজি বা জীবাণু তত্ত্ব
জীবাণু বলতে Bacteria (Bacteriology), Virus (Virology), Parasites (Parasitology) এবং Fungus (Myeology) ইত্যাদি বুঝায়। এসব পরীক্ষা নিরিক্ষায় অনেক সময় ছোট ছোট জীব- যেমন খরগোশ, ইঁদুর, গিনিপিগ, মুরগি, গরু, ভেড়া, ঘোড়া ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় যার ফলে এই সমস্ত প্রাণী হত্যা করতে হয়। মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় বলে এতে কোন গুনাহ হওয়ার কথা নয়। তবে যথাসম্ভব মানবতার সংগে এই প্রাণীদের ব্যবহার করা উচিত।
ইউরোপে এইরূপ প্রাণী ব্যবহারের বিরুদ্ধে চার্চ সমর্থিত কোন কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ করে। যারা হিরোসিমা নাগাসাকিসহ অসংখ্যা এলাকায় নিরপরাধ লোক বোমা মেরে ধ্বংস করে তাদের এরূপ-মানবতা বোধের আন্দোলন নেহাত হাস্যাস্পদই বলতে হয়।
হিমোটোলজি বা রক্ত সম্পর্কিত বিদ্যা
এর দুটো অংশ (ক) রক্ত পরীক্ষা ও (খ) রক্ত সঞ্চালন বা Blood Bank পরিচালনা। বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্তের বিভিন্ন উপাদানের মান নির্ণয় ও গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়ে থাকে । এতে ইসলামবিরোধী কিছুই নেই। শুধু রমযান মাসে দিনের বেলায় রক্ত পরীক্ষা নিয়ে কেউ কেউ সমস্যায় পতিত হন। এ কথা জানা প্রয়োজন যে রক্ত শরীর থেকে বের করলে রোযা নষ্ট হয় না। আল কুরআনের সূরা ২ : ১৭৩ আয়াতে রক্ত খাদ্য হিসেবে হারাম। তাই Blood Transfusion রক্ত খাওয়ার মত বরং তার চেয়ে আরও বেশি সরাসরি গ্রহণ করা। কেউ এই জন্য রক্ত সঞ্চালন জায়েজ নয় বলে থাকেন। তবে একই আয়াতের শেষাংশে রয়েছে অর্থাৎ যদি কেউ বাধ্য হয়ে হারাম খাদ্য গ্রহণ করে তবে পসন্দ করেও নয় বা আল্লাহর আইন অমান্য করার উদ্দেশ্যে নয় তা হলে তাতে কোন গুনাহ হবে না। সুতরাং বলা যায় যে যদি জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় তবে রক্ত সঞ্চালন বা Blood Tarnsfusion নির্দোষ হবে। মাওলানা শাফি সাহেবের ফতওয়াও অনুরূপ।
৫. চিকিৎসা আইন বা মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স
বর্তমানে মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স বা ফরেনসিক মেডিসিন সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য ধর্মহীন সমাজ কর্তৃক লিখিত বলে এতে ইসলামী নৈতিক আইন কানুনের উল্লেখ নেই। সুতরাং এই বিষয়ের যাবতীয় ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ইসলামী বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ করতে হবে।
হঠাৎ মৃত্যুতে-মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করাই চেষ্টা করা হয়। সুতরাং এসব বিষয়ে ইসলামী আইন ভিত্তিক প্রয়োজনীয় রদবদল প্রয়োজন। ভ্রূণ হত্যা, পাশবিক অত্যাচার জাতীয় যৌন অপরাধ এবং অন্যান্য খুন-খারাবিতে ইসলামী বিধি নিষেধের ভিত্তিতে অপরাধ চিহ্নিত করতে হবে। বলাৎকার জাতীয় ঘটনায় সম্ভব হলে মেয়ে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এখানেও যথা সম্ভব সম্মানের সঙ্গে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ বা অটপসি করতে হবে। আর মেয়েদের জন্য মেয়ে সাহায্যকারী অবশ্যই থাকতে হবে।
৬. সামাজিক বা কম্যুনিটি মেডিসিন
এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো রোগ প্রতিরোধ শিক্ষা দেয়া। যদিও আজকাল এই ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তবুও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই শিক্ষা খুবই নগণ্য। মহামারী দেখা দিলে এবং বন্যা বা খরায় রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন এই বিদ্যার প্রধান অংশ। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর শেষ নবীর (সা) প্রদর্শিত স্বাস্থ্য রক্ষার নীতিগুলো এই বিষয়ে যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । কারণ এগুলো আধুনিক কম্যুনিটি মেডিসিনে নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, খাবার পূর্বে-পরে ভাল করে হাত ধোয়া, সপ্তাহে অন্তত একবার হাত পায়ের নক কাটা, গোঁফ ছোট করা, বগল ও গুপ্ত স্থানের লোম কামানো, অযুর মাধ্যমে দৈনিক কয়েকবার নাক কানের ছিদ্রগুলো পরিষ্কার করা, হাত-পা-মুখ ভাল করে ধোয়া, পেশাব-পায়খানার পর গুপ্তাঙ্গ ও হাত ধোয়া, খাদ্য ও পানীয় সব সময় ঢেকে রাখা, ভাল করে চিবিয়ে খাওয়া, খাওয়ার সময় পানি পান না করা, পেট বোঝাই করে না খাওয়া ইত্যাদি অসংখ্য সুন্নাত ফরয ও ওয়াজিবের মাধ্যমে শারীরিক রোগমুক্ত রাখার শিক্ষা রয়েছে। এ উপলক্ষে দৈনিক কয়েকবার দাঁত পরিষ্কার করা ও খেলাল করার উপদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাইজিনের পুস্তকে এগুলো স্বাস্থ্য রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে লিখিত হবে এবং এতে যে আল্লাহ ও রাসূলের (সা) হুকুম পালন করার সওয়াব পাওয়া যাবে এ শিক্ষাও দিতে হবে।
আজকাল এই বিষয়ের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনার নামে বার্থ কন্ট্রোল বা জন্ম নিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। অথচ এতে সমাজের ওপর যে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হয় তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। মেডিক্যাল শিক্ষা ইসলামীকরণের সময় এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হয় তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। মেডিক্যাল শিক্ষা ইসলামীকরণের সময় এর ক্ষতিকর দিকে লক্ষ্য রেখে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনার নামে ব্যাপক যৌন-অনাচার প্রসার হোক এটা কেউ চায় না। ইসলাম কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনার বিরোধী নয়। যাদের কোন সন্তান হয় না তাদের সমস্যাও একইভাবে পরিবার পরিকল্পনার অংশ হতে হবে। জনসংখ্যা রোধের উদ্দেশ্যে বেপরোয়া গজ বা গর্ভপাত করা কখনই ইসলাম সমর্থন করে না।
৭. মেডিসিন বা সাধারণ চিকিৎসা
বর্তমানে এর অধিক বিভাগ রয়েছে যেমন, শিশু-চিকিৎসা, কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, মানসিক চিকিৎসা, নেফরোলজি এভিয়েশন মেডিসিন, ট্রপিক্যাল মেডিসিন, ইত্যাদি। এসব পদ্ধতি সাধারণত কোন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। অধিকাংশ রোগী প্রথমত এ সব বিষয়ের যে কোন অভিজ্ঞ ডাক্তারের নিকট-প্রথম গিয়ে থাকে।
চিকিৎসা ইসলামীকরণের বেলায় পুরুষ রোগীর জন্য পুরুষ ডাক্তার ও নারী রোগীর জন্য নারী ডাক্তার যথেষ্ট সংখ্যায় থাকা উচিত। এর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে যেন আগামী ২০-২৫ বৎসরে এই লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। এতে নারী শিক্ষা ও নারী জাতির স্বাবলম্বী হওয়া সহজ হবে।
এই প্রসঙ্গে নার্সের কথা এসে যায়। ইসলামে যেহেতু পর্দা ফরয তাই পুরুষ নার্স এবং স্ত্রী রোগী ও শিশুদের জন্য মেয়ে নার্স নিযুক্ত হওয়া উচিত। নার্স শব্দকে জোর করে স্ত্রীলিঙ্গ করার বদলে বাংলা সেবক ও সেবিকা শব্দের ব্যবহার অধিক যুক্তিসঙ্গত।
যতদিন যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা চিকিৎসক না হবে ততদিন পুরুষ ডাক্তার দিয়ে চালাতে হবে। তবে স্ত্রী রোগ চিকিৎসার জন্য যথাসম্ভব শীঘ্র যথেষ্ট সংখ্যায় মহিলা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বর্তমান বিভিন্ন হাসপাতালে মহিলাদের পৃথক বিছানা থাকলেও মহিলা ওয়ার্ডে সত্যিকার কোন পর্দা নেই। যে কোন পুরুষ ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়ও সাক্ষাৎকারী বিনা দ্বিধায় মহিলা ওয়ার্ডে ঢুকতে পারে। এ ব্যবস্থা বাঞ্ছনীয় নয়। মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষ ডাক্তারদের ভিজিটের সময় এবং বিকেলে সাক্ষাৎকারীদের সাক্ষাতের সময় প্রত্যেকটি বিছানাকে অস্থায়ী পর্দা দিয়ে ঘিরে নিতে হবে। মুমূর্ষু রোগীর জন্য এ ধরনের পর্দার ব্যবস্থা সব হাসপাতালেই রয়েছে।
রোগীদের ওয়ার্ড ডাক্তার, নার্স ছাড়াও ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ড বয় ও মহিলা সাহায্যকারী থাকে। পুরুষ ওয়ার্ড মাস্টার ও ডাক্তার এবং সাক্ষাৎকারী দেখা করার জন্য মহিলা ওয়ার্ডে যেতে পারবে। আর পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষ ও মহিলা সাহায্যকারি এখনও আছে, তবে এরা বিনা বাধায় যে কোন ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায়। কারণ পর্দার কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। মহিলা ডাক্তার, নার্স ও সাহায্যকারী সবাই মাথায় রুমাল ও স্কার্ফ বেঁধে এপ্রোন পরে হাসপাতালে কাজ করবেন।
যেহেতু ইসলামী পর্দার প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই তাই পাশাপাশি পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড রাখা হয় এবং দরজায় পর্দা পর্যন্ত থাকে না। কোন পাহারাদার তো নয়ই। হাসপাতালের দুই অংশে মহিলা ও পুরুষদের পৃথক পৃথক ওয়ার্ড তৈরি করতে হবে। শিশুদের ওয়ার্ড মহিলা ওয়ার্ডের সঙ্গেই থাকবে। অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে প্রয়োজনে যেখানে চিকিৎসার একান্ত প্রয়োজন সেখানে পুরুষ ডাক্তার অবশ্যই মহিলা রোগীকে পরীক্ষা ও চিকিৎসা করবেন যদি মহিলা ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ না পাওয়া যায়।
৮. সার্জারি বা অস্ত্রোপচার বিভাগ
এখানেও পর্দার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মহিলাদের শরীর অপারেশনের পূর্বে প্রয়োজনের বেশি শরীর অনাবৃত না করা উচিত। অবশ্য অপারেশনের সময় কেবল কাটার অংশ ছাড়া বাকি অংশ ভালভাবেই আবৃত থাকে। ইনফেকশন থেকে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে ডাক্তার ও নার্সর্গণ যে সাবধানতা অবলম্বন করেন তা ইসলামী বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। অপারেশন একটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার আর রোগীর বিশ্বাস বা নির্ভরশীলতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং নির্ভরযোগ্য মহিলা বিশেষজ্ঞ না পেলে বিনা দ্বিধায় পুরুষ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। সব সময়ে নিয়ত-ই আল্লাহর নিকট বিচার্য বিষয় হবে। অনেক বড় ও দীর্ঘস্থায়ী অপারেশন মহিলাদের জন্য কঠিন হয়ে থাকে তাই খুব কম মহিলা (General surgeon) পাওয়া যায়। সার্জারিতেও মেডিসিনের মূল বিষয়গুলো প্রযোজ্য।
৯. ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা (Obstetrics & Gynaecology)
এখানে যদিও মেডিসিন ও সার্জারির মূলনীতিগুলো প্রযোজ্য তবুও এখানে একটু বেশি আলোচনা প্রয়োজন। যেহেতু এই রোগগুলো কেবল স্ত্রী যৌন অঙ্গের সঙ্গে জড়িত তাই এই বিভাগে সব চিকিৎসক নার্স ও সাহায্যকারি যে মহিলা হওয়া উচিত তা অনস্বীকার্য। মুসলমান মহিলাগণ পর্দার জন্য পুরুষ ডাক্তার দেখাতে চায় না বলে খ্রিষ্টান মিশনারিরা এই উপমহাদেশের প্রথম স্ত্রীরোগ ও ধাত্রী বিদ্যার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তাদের ধর্ম প্রচারের জাল ফেলে । তাদের হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্স এর কুফলও আমরা দেখতে পাই । তাই বাংলাদেশ তথা সকল মুসলিম রাষ্ট্রে এই বিভাগগুলো অবশ্যই মহিলাদের দিয়ে পরিচালনা করতে হবে।
১০. চক্ষু চিকিৎসা বা অপথালমোলজি (Ophtalmology)
এখানেও যেহেতু চেহারা খোলা অবস্থায় ডাক্তারের সম্মুখীন হতে হবে তাই এখানেও মহিলা ডাক্তার ও নার্স মহিলা রোগীদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। চক্ষু অপারেশন স্বল্প স্থায়ী ও অপেক্ষাকৃত কম কষ্টসাধ্য বিধায় এতে মহিলাদের পারদর্শী হওয়াই সহজ।
১১. নাক-কান-গলা বা Ear Nose-Throat বিভাগ
এখানেও চক্ষু বিভাগের নীতি প্রযোজ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমান চিকিৎসকগণ এককালে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সে সব কথা বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দেয়ার সময় মনে রাখতে হবে। প্রসঙ্গে আল রাযী (৮৫০-৯২৫) ইবনে সীনা (৯৯০-১০৩৭), আল-জুরজানী (মৃত্যু ১১৩৬) প্রমুখ চিকিৎসকদের বিশ্বজোড়া খ্যাতি এবং মেডিসিন ও সার্জারিতে তাদের অমর অবদানের কথাও বলতে হবে। এমনিভাবে আবুল কাসেম জাহরাবীর (৯৩৬-১০১৩) সার্জারিতে বিশেষ অবদান ও বহু যন্ত্রপাতির আবিষ্কর্তা হিসাবে বিশ্বজোড়া স্বীকৃতির কথাও স্মরণ করতে হবে।
ইবনে হাইসাম ও ইবনে রুশদ ১২শ শতাব্দীর চক্ষুরোগ চিকিৎসায় বিশেষ অবদান, মাসুবিয়াহ জুনিয়র (১১শ শতাব্দী) এবং বাহাউদ্দিন (১৬ শ শতাব্দীর) অজ্ঞান করা ঔষধ (Anasthetics) আবিষ্কারের ইতিহাস ও শিক্ষার্থীদের জানতে হবে।
এবার হাসপতালের পরিবেশ ইসলামীকরণ ও শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করার ব্যাপারে কিছু আলোচনা করা যাক।
হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে এবং ওয়ার্ডের ভেতর শিক্ষামূলক কোরআন ও হাদীসের আয়াত সমূহ টাঙিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার প্রয়োজনীয় উপদেশাবলি চারদিকে টাঙিয়ে রাখা প্রয়োজন।
হাসপাতালের রোগী কর্মচারীদের জন্য একটি ভাল লাইব্রেরি থাকবে হবে যেখানে ধর্মীয় কিতাবসহ গল্প ইতিহাস-উপন্যাস ইত্যাদি সব রকম পুস্তক ও পত্রিকা থাকবে। সকল বইয়ের একটি তালিকা থাকবে। ওয়ার্ডবয় বা লাইব্রেরির সহযোগী রোগী একবার এই তালিকাসহ বিভিন্ন রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এবং তিনি কী বই পড়তে চান তা জেনে নিয়ে পরে সরবরাহ করতে হবে। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যাতে বই-পুস্তক যথারীতি বিলি ও সংগ্রহ করা হয়। হাসপাতালে পুরুষ ও মেয়েদের জন্য আলাদা নামাযের কামরা থাকবে যাতে চলতে সক্ষম রোগীগণ জামায়াতে নামায আদয় করতে পারেন। হাসপাতালের কর্মরত যে কেউ প্রয়োজনের ইমামের কাজ করবেন। হাসপাতাল ও কলেজ এলাকায় একটি বড় জামে মসজিদ থাকবে যেখানে বাইরের লোকও জামায়াতে যোগ দিতে পারেন। এই মসজিদে একজন উপযুক্ত ইমাম যোগ্য বেতনসহ রাখতে হবে যিনি রোজ একবার সকল ওয়ার্ড ঘুরে বেড়াবেন যাতে কেউ তওবা করতে চাইলে তওবা করতে পারে বা কেউ কোন মাসলা-মাসায়েল জিজ্ঞাসা করতে পারে। বিশেষ করে বহু রোগীকে তায়াম্মুম শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন হয়। হাসপাতালের পক্ষ থেকে এ জন্য প্রস্তুত মাটির ঢেলা সরবরাহ করা উত্তম। এ প্রসঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি।
এ দেশে প্রথম আইয়ুবী মার্শাল ল' জারি হওয়ার পর একবার জনৈক এক বাঙালি কর্নেল (বর্তমানে মরহুম) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রশাসক নিযুক্ত হন। তখন মেডিক্যাল কলেজে জামায়েতে নামাযের কোন ব্যবস্থা ছিল না। তবে হাসপাতালে গাড়িবারান্দার উপরের কামরায় নামায হতো। ১৯৫৯ এর দিকে নতুন আউট ডোর বিল্ডিংয়ের সঙ্গে হাসপাতালে সংযোগের জন্য পশ্চিম দিকের গাড়িবারান্দা ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং সেই সঙ্গে নামাযের জায়গাও গায়েব। এর কোন বিকল্প ব্যবস্থা না করায় নামাযী কর্মচারীবৃন্দ পশ্চিম দিকের লম্বা বারান্দায় জুময়াসহ সব নামায আদায় করতে লাগলেন।
একদিন বিকেলে কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে প্রশাসক সাহেবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় । তাঁকে পেয়ে বললাম ‘স্যার হাসপাতালের নামাজের জায়গাটা ভেঙ্গে দিলেন অথচ তার বিকল্প স্থান দিলেন না। অন্য যে কোন গাড়িবান্দার ঘর দিলেও চলতো।' তিনি বললেন, ‘আরে বলো না, জায়গাই তো নেই। তুমিই বলো কোথায় দিতে পারি?' আমি বললাম- ‘আপনার কলেজ ও হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের দুটি আলাদা বড় বড় অফিস কামরা রয়েছে। এর একটি যদি নামাযের জন্য ছেড়ে দেন তবে আপনার অফিসের জন্য আর একটি জায়গা পেতে কোন অসুবিধা হবে না। আমি হলে তাই করতাম।' আমার এরূপ স্পষ্ট কথায় একটু অপ্রস্তুত হলেও তিনি হেসে বললেন, “আরে তুমি যে একেবারে মোলা হয়ে গেছ হে। আচ্ছা দেখা যাক কী করা যায়।' হোক অনেকদিন পর আউটডোর দালানের দোতলায় একটি মসজিদ তৈরি হয়।
হাসপাতালের মসজিদের ইমামদের কোন পদ আজও মঞ্জুর হয়নি। পাকিস্তানের তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের আমলেও নয় আর স্বাধীন বাংলাদেশেও নয়। আর অনেক জায়গায় ইমামকে একজন চতুর্থ শ্রেণীর (পিয়ন জাতীয়) কর্মচারী হিসাবে বেতন দেয়া হয় আর নামাযীরা চাঁদা করে কিছু অতিরিক্ত টাকার ব্যবস্থা করেন। আইয়ুব আমলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সুন্দর মসজিদটিতে বহু চেষ্টা করেও একটি ইমামের পদ মঞ্জুর করা গেল না। তখনকার জনৈক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়াদা করেও তা পালন করেননি।
হাসপাতালের কর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদের জন্যে একটি মকতব বা প্রাইমারি স্কুল সহজেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেই স্কুলের দ্বীনিয়াত শিক্ষক হিসাবে একজন আলেম নিযুক্ত হলেও এর সহজ সমাধান সম্ভব। মুসলিমদের প্রথম যুগের হাসপাতাল যা বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আধুনিক হাসপাতালের পূর্বসূরিরা কোন কোন দিক দিয়ে আরও উন্নতমানের ছিল। দূরদূরান্ত থেকে যেসব রোগী আসতো তাদের সঙ্গীদের মুসাফিরখানা থাকতো যেখানে, তিনদিন পর্যন্ত রোগীর সঙ্গীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কারণ ইসলামে মেহমান শুধু তিন দিনের জন্য। বর্তমানে সরকারের এত প্রাচুর্য নেই বলে মুসাফিরখানায় দু'রকম ব্যবস্থা থাকবে। যারা ধনী তারা মটেল জাতীয় এক বা দু কামরায় Flat ভাড়া নেবে আর যারা গরিব তারা বড় বড় হল কামরায় বিনা ভাড়ায় থাকবে আর রেস্তোরাঁ থেকে খাদ্য কিনে খাবে। তিন দিনের মধ্যে রোগীর ভর্তি হওয়া উচিত এবং এরপর কাউকে মুসাফিরখানায় থাকতে দেয়া হবে না। অবশ্য এখানেও মেয়েদের থাকার সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
রোগীর খাদ্য: সততার অভাবে বর্তমানে কোন হাসপাতালেই খাদ্য সরবরাহ সন্তোষজনক নয় । একে তো রোগীর মাথা পিছু বরাদ্দ কম। তা থেকে কর্মচারীদের চুরি আর বড় সাহেবদের ঘুষ দিয়ে যা থাকে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তাই আজকাল যারা সমর্থ তারা নিজেরাই খাবার সরবরাহ করে। এজন্য ঈমাদানর কর্মচারী নিয়োগ ও উপযুক্ত তদারক প্রয়োজন।
হাসপাতালের ক্যান্টিন
পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ক্যান্টিন আমাদের দেশে কল্পনা মাত্র। সুতরাং সকল কর্মচারী ইসলামী সততায় চরিত্রবান না হলে রোগীর খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহে কোন ন্যায়নীতি সম্ভব নয়। মেডিক্যাল শিক্ষা ইসলামীকরণের বেলায় এসব দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে হবে।
এমনিভাবে হাসপাতালের ধোপা, কন্ট্রাক্টরবৃন্দ ও স্টোর কিপারদের বেলাও একই কথা প্রযোজ্য। পেশাব পায়খানার জায়গাগুলো সব সময় পরিষ্কার করার সুব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালের লেট্রিনগুলো লজ্জাজনকভাবে অপরিষ্কার।
ছাত্র ভর্তি
প্রথমেই বলতে হয় যে ইসলাম সহশিক্ষা (Co-education) সমর্থন করে না। সুতরাং পুরুষ ও মহিলা ডাক্তার তৈরির জন্য পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। পাকিস্তানে, এমনকি হিন্দু প্রধান ভারতে পর্যন্ত পৃথক মহিলা মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে।
যেহেতু কেবল প্রতিভাবান হলেই চলবে না একজন ডাক্তারকে হতে হবে আদর্শ ও নিষ্ঠাবান সমাজসেবক। তাই নৈতিকতাবোধ যার কম তাকে ভর্তি করা ঠিক হবে না। সুতরাং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে মেধাবী এবং নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ছাত্র-ছাত্রীরাই শুধু ভর্তি হতে পারবে। এজন্য এ সব বিষয়ে বিচার করতে সক্ষম এমন একটি নির্বাচন কমিটি ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির অনুমোদন দেবে। মুসলমান শিক্ষার্থীদের বেলায় তাদের ইসলাম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কুরআন-হাদীসের জ্ঞান এবং ন্যায়, অন্যায় সম্পর্কে ইসলামী নীতিবোধ আছে কিনা তা অবশ্যই দেখতে হবে।
ভর্তির পর যদি কোন শিক্ষার্থীকে ইসলামী শরিয়তের ন্যূনতম বিধি-বিধানও মেনে চলতে অপারগ দেখা যায় তবে সংশোধনের সুযোগ দিয়েও যদি কোন ফল লাভ না হয় তবে তাকে কলেজ থেকে বিদায় করতে হবে। অমুসলমানদের বেলায় তাদের নৈতিক চরিত্র সন্তোষজনক হলেই চলবে।
শিক্ষক নিয়োগ
ছাত্র-ছাত্রীদের বেলায় যেমন নৈতিকতার মূল্যায়ন জরুরি শিক্ষক নিযুক্তির বেলায় তা আরও বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ইসলামবিরোধী কোন শিক্ষক কিছুতেই প্রতিষ্ঠানে থাকতে পারবে না। অবশ্য এ ব্যাপারে গোঁড়ামি নয় মানুষের অন্তরের কথা আল্লাহই ভাল জানেন ।
এ প্রসঙ্গে মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি আওতায় থাকা ঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসাবে নতুবা পৃথক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালিত হবে। এ জন্য পৃথক সিনেট ও ফ্যাকাল্টি থাকবে যাতে সরকারি প্রতিনিধিও থাকবেন। শিক্ষকদের নিয়োগ শুধু সেই প্রতিষ্ঠানের জন্যই হবে আর বদলির কোন ঝুঁকি থাকবে না ।
চিকিৎসা বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন:
এ ব্যাপারে কয়েকটি দিক বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত। একজন ডাক্তার বর্তমানে যেহেতু গ্রাজুয়েট বলে স্বীকৃত তাই তার বেতন-স্কেল অন্যান্য গ্রাজুয়েটদের সঙ্গে মিল রেখে করা হয়। এটা ঠিক নয়। কারণ যেখানে যে কোন ব্যক্তি HSC পাসের পর ২ থেকে ৩ বৎসরে সাধারণ বা অনার্স গ্রাজুয়েট হন সেখানে একজন ডাক্তারকে পাঁচ বৎসর কঠিন অধ্যয়ন করতে হয়। আর উচ্চ মেধা না হলে মেডিক্যালে ভর্তি হওয়াও যায় না। সুতরাং যেখানে চার বৎসরে একজন মাস্টার ডিগ্রি হাসিল করে এবং ইঞ্জিনিয়ার হয় সেখানে একজন ডাক্তার পাচঁ বৎসরে পাস করে এবং আরও এক বৎসর ট্রেনিং নিয়ে পুরোপুরি ডিগ্রি লাভ করে। সুতরাং আমাদের এ সব অনিয়ম দূর করার জন্য U.S.A এর মত ডাক্তারদের প্রাথমিক ডিগ্রিকেই গ্রাজুয়েট ডিগ্রি M.D বলা উচিত। তাহলে তাদের উপযুক্ত উচ্চতর প্রাথমিক বেতন দিতে অসুবিধা হবে না ।
এরপর ডাক্তারদের মধ্যে Teaching এবং Non teaching Cadre সৃষ্টি করতে হবে যেন একমাত্র তারাই শিক্ষক হয় যারা শিক্ষকতা পছন্দ করেন এবং গবেষণা করা ভাল বাসেন। যে সব বিষয়ের ডাক্তারদের Practice করার সুযোগ নেই যেমন এনাটমি, ফিজিওলজি ইত্যাদি তাদের বেতন যারা Practice করবে তাদের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য মূল বেতনের সমান অংশ অতিরিক্ত পাবেন। (Non practising allowance)।
Clinical বিষয়ের ডাক্তারগণ যেহেতু শিক্ষক হলেও Practice করতে পারবেন তারা কোন অতিরিক্ত বেতন পাবেন না। গবেষণালব্ধ নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকাশনা ব্যতীত কোন শিক্ষক উচ্চতর পদে প্রমোশন পাবেন না। মোটকথা এ সবই ইসলামী ন্যায়নীতির ভিত্তিতে করতে হবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, রাজশাহী ও মোমেনশাহী মেডিক্যাল কলেজ।