ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষার ইসলামী দৃষ্টিকোণ - অধ্যাপক আ.ন.ম. নুরুল করিম
প্রারম্ভিক কথা
বর্তমান বিশ্বের শিক্ষাজগতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির শিক্ষা এক বিশাল এলাকায় ব্যাপৃত হয়ে আছে। উৎপাদনকারীদের নিকট থেকে কিভাবে খরিদ্দাররা ন্যায্যমূল্যে যথাসময়ে যথা পরিমাণে পণ্যদ্রব্যাদি ও সেবা লাভ করবে তা মানবেতিহাসে সর্বযুগেই সেরা আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান লাভ করে এসেছে। কিভাবে একজন উৎপাদনকারী অন্য একজন খরিদ্দারের কাছে তার উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য পৌঁছিয়ে দেবে, উৎপাদনকালীন সময়ে সমগ্র উৎপাদন একসাথে বিক্রি না করে উৎপাদনবিহীন সময় পর্যন্ত ধরে রাখবে, এক স্থানের উৎপাদিত পণ্য অন্য স্থান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেবে- এসব কিছুই ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়বস্তু হয়ে আছে। তাছাড়া পণ্যদ্রব্যের প্রচারণা, খরিদ্দারদেরকে সচেতনকরণ, বাজার-তথ্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ ও বিনিয়োগ ইত্যাদি কার্যাবলিও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কাজ হিসেবে আজ স্বীকৃত। তাই, বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই শিক্ষাসূচিতে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এদিক থেকে বাণিজ্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের সবারই ধারণা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সাথে সাথে ইসলামী দৃষ্টিকোণ সম্পর্কেও আমাদের ধারণা অবশ্যই থাকতে হবে। বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁর নবীদের মাধ্যমে জীবন-পথে চলার যে আদর্শ আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন তাই হচ্ছে ইসলাম। হযরত আদম (আ)-এর মাধ্যমে যে জীবন-পথের দিশার আগমন শুরু, মুহাম্মদ (সা)-এর হাতে তার শেষ পূর্ণ পরিসমাপ্তি- আর তাই হচ্ছে ইসলাম। একটি জনসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী যদি ইসলামী আদর্শের অনুসারী হয়, তবে তা হয় একটি মুসলিম সমাজ। এরূপ একটি মুসলিম সমাজ, দেশ বা জাতি যখন তার শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রণয়ন করে তখন তাকে স্বভাবতই ইসলামী আদর্শবাদের মৌলনীতিসমূহের আলোকে তার শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করতে হয়। ইসলাম মানব জীবনের সর্বদিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নিৰ্দেশ করে। যদিও জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ইসলামের খুঁটিনাটি নির্দেশাবলি ইজমা ও কিয়াস করে নির্ধারণ করা হয়। ইসলাম খোদার দাসত্বের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকেই মানব জীবনের সাধারণ লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই, মুসলিম সমাজের জন্যে প্রণীত যে-কোন শিক্ষা ব্যবস্থায়- তা সাধারণ বা টেকনিক্যাল অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত হোক না কেন- ইসলামী দৃষ্টিকোণ অবশ্যই অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, যে-কোন মুসলিম দেশে সার্বিকভাবে এ দৃষ্টিভঙ্গিই হবে তা শিক্ষাব্যবস্থার মৌল নির্দেশিকা।
একটি সমস্যা
আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষাকে নিছক একটি জৈবিক শিক্ষা বলে ধরে নেয়া হয়। নীতি, নৈতিকতা, ধর্ম, ধর্মবাদিতা, চরিত্র নীতি, ন্যায়নীতি ইত্যাদির সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয় না। যেহেতু এ শিক্ষা শুধুমাত্র মানব সমাজে জিনিস-পত্র, পণ্যদ্রব্য উৎপাদন, উপহার বণ্টন ও বিতরণের সাথে জড়িত, সেহেতু নৈতিকতাবোধ অথবা আদর্শবাদিতার সাথে এর কোন সংস্রব থাকার কথা নয়। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে এ ভুল ধারণা থাকা সমীচীন নহে। যেহেতু ইহা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা এবং যেহেতু ইহা জীবনের সর্বদিক নিয়ন্ত্রণ করে, মুসলিম সমাজে গৃহীত শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ইসলামী ভাবাদর্শ থেকে উৎসারিত হতে হবে। ইসলামের ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফপ্রিয়তা, আদর্শবাদিতা, নৈতিকতা-প্রিয়তা আমাদের ইহলৌকিক পারলৌকিক তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। ইসলামে “ইবাদত” বা খোদার দাসত্বের যে ধারণা আছে, তা শুধু কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয় তা জীবনের যে কোন পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত হবার দাবি রাখে। যদি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ইসলামের নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে এবং এর মাধ্যমে “হালাল জীবিকা” অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালায়, তবে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপদেশে যত কাজ করতে হবে, ইসলামের দৃষ্টিতে সবকটিই “ইবাদত” বলে পরিগ- ণিত হবে। তাই, বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত জৈবিক শিক্ষাসূচিকেও ইসলামী- করণ করা হয় এবং এর ফলে ইসলামের নৈতিকতার আদর্শ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শান্তির ফল্গুধারা বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
শিক্ষাসূচির উদ্দেশ্য
যে-কোন ধরনের শিক্ষাসূচিই কতগুলো মৌলিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রণয়ন করা হয়ে তাকে এবং এ ব্যবস্থা থেকে উৎসারিত লোকেরা এ সমস্ত উদ্দেশ্যাবলি বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাণিজ্য শিক্ষার পেছনে কতকগুলো উদ্দেশ্য রয়েছে। সেগুলোকেও বাস্তবায়িত করার জন্যেই এই বাণিজ্য সিলেবাস প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত বাণিজ্য শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য এমন একটি জনশক্তি গড়ে তোলা যারা বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি, ইহার বণ্টন ও বিতরণ এব ইহার ভোগের বিষয়ে সহায়তা করবে। এ দিক থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের গ্রহণযোগ্য একটি সংজ্ঞা আমাদের সামনে থাকা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে। “Commerce is the sum-total of all those activities which are connected with the removal of hindrance of time. place and persons." এদিক থেকে ইসলামের দৃষ্টিতে বাণিজ্য শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে, পণ্যদ্রব্য ক্রয়বিক্রয়, বণ্টন-বিতরণ, ব্যয়-ব্যবহারে শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলা। কোন বিশেষ দ্রব্য এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় স্থানান্তর, এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সমষ্টি থেকে অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির কাছে বিক্রি করার এবং এক সময় থেকে অন্য সময় পর্যন্ত উৎপাদিত পণ্যকে দাম পড়ে যাওয়ার ভয়ে ধরে রাখা-ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের বিধি বিধান মেনে চললে, তাই ইসলামী ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে যাবে (Islamic Trade and Commerce)। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে:
(ক) ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে পণ্য বণ্টন সহজ করে তোলা এবং মানুষ যাতে করে সহজভাবে জীবন-ধারনের সামগ্রী লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
(খ) পণ্য দ্রব্য বণ্টন-বিনিময়ে একচেটিয়া লাভ যাতে কারো না হতে পারে, তার ব্যবস্থা করা।
(গ) বণ্টন ব্যবস্থা থেকে সুদ, ঘুষ, রিশওয়াত সহ যাবতীয় অন্যায় থেকে বেঁচে থাকা এবং বাঁচিয়ে রাখা।
(ঘ) বণ্টন-ব্যবস্থায় বিশুদ্ধ পরিমাপ ব্যবস্থা চালু করা এবং মজুদদারি, মুনাফাখোরি ও কালোবাজারি কার্যকলাপ থেকে বিরত করা।
(ঙ) ক্রেতা সাধারণকে বিক্রেতাদের হক আদায় করতে, প্রতি হক আদায় করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং বিক্রেতাদেরকে ক্রেতাদের
(চ) পণ্যদ্রব্যের বৈধতা, জায়েজ, না-জায়েজ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া।
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরত্ব
ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পৰ্কীয় শিক্ষাসূচি প্রণয়নকালে আমাদের শিক্ষা প্রণেতাদের সম্মুখে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে গুরুত্ব, তা পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন ৷ ধনোপার্জনের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ধনোপার্জন অন্যতম। ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
কোরআন মজিদে বলা হয়েছে :
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَوةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
“নামাজ সমাপ্ত হওয়ার পর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং খোদার অনুগ্রহ-ধন-সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ ও উপার্জন করো।” (আল জুময়া)
কোরআন মজিদে অন্যত্র বলা হয়েছে :
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأكُلُوا اَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ
تَرَاضٍ بَيْنَكُمْ. (النساء)
“মুসলমানগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে অসদুপায়ে পরস্পর পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না। তোমাদের পাস্পরিক সম্মতিক্রমে কৃত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই অর্থের আদান প্রদান কর।” (সূরা আন নিসা)
নবী করিম (সা) মুসলমানদিগকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিশেষ উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং ইসলামী সমাজে সত্যবাদী, বিশস্ত ও ন্যায়পন্থী ব্যবসায়ীদের বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করছেন। তিরমিজী শরিফে বলা হয়েছে :
التَّاجِرُ الصَّدِيقُ الْآمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ.
“সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দীক ও শহীদ প্রমুখ মহান ব্যক্তিদের সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে।”
নবী করিম (সা) আরো বলেছেন :
تسُعَةُ أَعْشَارِ الرِّزْقِ فِي التِّجَارَةِ
“রুজির দশভাগের নয়ভাগই রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্যে মধ্যে।”
‘কানযুল উম্মাল’ নামক ইসলামী অর্থনীতির বইতে বলা হয়েছে :
لَوْ لَا هَذِهِ الْبُيُوعُ لَصِرْتُمْ عَالَةٌ عَلَى النَّاسِ
“ব্যবসা-বাণিজ্যের এই ব্যবস্থা না হলে তোমাদের জীবন দুর্বিষহ ও অপরের ওপরে দুর্বহ বোঝা হয়ে উঠতো।”
কালামে পাকে বলা হয়েছে:
اَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبوا. (البقرة)
“আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয়-ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন; কিন্তু সুদ ও সুদ- ভিত্তিক যাবতীয় কাজ কারবার হারাম করেছেন।”
ইসলামী বাণিজ্য শিক্ষার মূলনীতি
একটি সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থার যে-সব মূলনীতি থাকার প্রয়োজন, ইসলামী বাণিজ্য শিক্ষাকে তার অতিরিক্ত কতিপয় মৌলিক নীতি মেনে চলতে হবে। এগুলো হচ্ছে, এ শিক্ষা-ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর, যার ওপরে এ শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রাসাদ গড়ে তোলা যাবে । এ মূলনীতিগুলো নিম্নরূপ হতে পারে:
(১) ইহা মানব সমাজের বৈধ জীবিকা অর্জনের সহায়ক হবে। ইসলাম জীবন ধারণের নিমিত্ত যেসব হালাল উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছে, ইহা সেগুলিকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করবে। এবং হারাম উপায়গুলোকে পরিহার করে চলবে।
(২) ইহা সুদ অথবা সুদি কাজকারবার ও লেনদেনে উৎসাহ জোগাবে না; বরং পারস্পরিক লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে কৃত-বাণিজ্যের প্রতি জনসাধারণের বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
(৩) যে-কোন ধরনের লেন-দেনে পরিমাপ ও পরিমাণের ক্ষেত্রে কারচুপি যাতে না হয় ইহা সে দিকে খেয়াল রাখবে।
(৪) ইহা মজুদদারি, মুনাফাখোরি, গুদামজাতকরণের ব্যবস্থাকে সমর্থন দেবে না। ব্যবসায়ের স্বাভাবিক প্রয়োজনাতিরিক্ত দ্রব্যাদি গুদামজাতকরণকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
(৫) ইহা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাবতীয় হারাম কাজ, অনিয়ম, নীতি-বহির্ভূত কাজের বিরোধী হবে । ইহা অনিয়ম ইত্যাদিকে অবৈধ বা হারাম বলে ঘোষণা করবে।
(৬) ইহা নৈতিকতা-উদ্দীপক হবে এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিজনেস মোরালিটি (Business Morality) জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করবে।
(৭) ইহা ইসলামের “মুজারাবাত” ও “মুদারায়াত” নীতি অথবা তার কোন আধুনিক বিকল্পকে ভিত্তি করে বাণিজ্য শিক্ষা গড়ে তুলবে।
(৮) ইহা শিক্ষার্থীদিগকে তাদের জীবনের মূল লক্ষ্যে প্রতি আগ্রহান্বিত করে তুলবে। আর তা হচ্ছে, খোদার দাসত্ব মেনে নেয়া ও পালনের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জন। এ জন্যে শিক্ষাসূচির সর্বত্র এ ধারণা বদ্ধমূল থাকবে যে, আমাদের এ বিশ্বে আগমন ও অবস্থান এক ধরনের পরীক্ষা মাত্র। সে পরীক্ষায় আমাদেরকে পাস করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমান বাণিজ্য শিক্ষার অবস্থা
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ন্যায় আমাদের দেশেও বাণিজ্য শিক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ অব্যাহত রয়েছে। ১৯৪৭ সালে হিমালয়ান উপমহাদেশের দুটি স্বাধীন দেশ বিভক্তির পর থেকে এদেশের শিক্ষাজগতে বাণিজ্য শিক্ষার প্রবেশ ঘটে। অকালে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এম, এ, (কম) ডিগ্রি দেয়া হতো। তখনকার দিনের সিলেবাস ছিলো অর্ধেক বাণিজ্য-শিক্ষানির্ভর আর বাকি অর্ধেক অর্থনীতি শিক্ষা-নির্ভর। এরপর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয়সমূহ হিসাব-বিজ্ঞানে এবং ব্যবস্থাপনায় এম, কম ডিগ্রি দেয়া শুরু করে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মোট চারটি বিষয়ে বাণিজ্যে মাস্টারস ডিগ্রি প্রদান করছে। বিষয়গুলো হচ্ছে হিসাব-বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফাইনান্স ও মার্কেটিং। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাব-বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াও ফাইনান্স এবং মার্কেটিং কোর্স চালু করার মাঝ পথে রয়েছে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে বি,কম, (পাস) ডিগ্রি দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বি,কম, (অনার্স) ও এম, কম, (প্রিলিমিনারি) ডিগ্রি ও দিচ্ছে। ওইঅ/উট ব্যবস্থাপনায় গইঅ ডিগ্রি দিচ্ছেন। তাছাড়া মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন বিষয়াকারে বাণিজ্য শিক্ষা চালু আছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট স্তর বাণিজ্য শিক্ষাকে একটি স্বতন্ত্র গ্রুপের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এতে একটি প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায় যে, পণ্য-দ্রবাদি উৎপাদন বৃদ্ধি ও মানুষের বিভিন্নমুখী ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য শিক্ষার পরিসর ক্রমাগতই বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আমাদের ইপ্সিত সমাজ বিনির্মাণের জন্য বাণিজ্য শিক্ষার যে লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে তার সাথে সংগত কারণেই ঐক্যমত পোষণ করা সুকঠিন বলে মনে হয়। এই উদ্দেশ্য নির্ধারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাস, নৈতিকতাবোধ ও জীবন-লক্ষ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। তাই, উদ্দেশ্য নির্ধারণের বিষয়টিও পুনর্বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন ।
এতক্ষণ ইসলামী বাণিজ্য শিক্ষার যেসব বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলোর আলোকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের বাণিজ্য শিক্ষাকে “আইডিয়াল” বলা চলে না। আমাদের বাণিজ্য শিক্ষা-ব্যবস্থা “বৈধ জীবিকা” অর্জনের ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে বেখবর।
এ শিক্ষা লাভের ফলশ্রুতি হিসেবে এক ধরনের “রিজিক” বা জীবিকা অর্জন করা গেলেও উহার “হালাল” বা “হারাম” হবার বিষয়ে এর কোন মাথা ব্যথা নেই।
এ শিক্ষাসূচি সুদ অথবা সুদ-ভিত্তিক কায়কারবার চলাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে না। বরং এ ধরনের ব্যবসায়িক কাজ কারবার কতভাবে কতরূপে ফুলে ফলে সুশোভিত করে চালানো যায় সে নিয়ে চিন্তা করে। অথচ আদর্শবাদের দৃষ্টিতে সুদ প্রদান ও গ্রহণ সর্বতোভাবে পরিহার্য।
আমাদের বাণিজ্যে শিক্ষাসূচি আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক কায়কারবারে পরিমাপ ও পরিমাণগত অসাধুতা সম্পর্কে সাধারণভাবে নিন্দামুখর বলেও এসব বিষয়ে যে পরিমাণ ইস্পাত কঠিন মনোভাব রাখা দরকার তা পোষণ করছেন না ।
মজুদদারি, মোনাফাখোরি, গুদামজাতকরণের ভয়াবহতা তথা অকার্যকারিতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে যে ধরনের ঘৃণা বা অনীহা সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন আমাদের বাণিজ্য শিক্ষাসূচি তা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাবতীয় হারাম কাজ, অনিয়ম, নৈতিকতা-হীনতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
নৈতিকতা সম্পর্কে সাধারণভাবে এবং ব্যবসায়িক নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের শিক্ষাসূচি সম্পূর্ণ নীরব। অথচ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নৈতিকতা মেনে চলার গুরুত্ব অসামান্য। বাণিজ্য শিক্ষাসূচি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে।
আমাদের বাণিজ্য শিক্ষা নিছক একটি বৈষয়িক শিক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে। জীবনের মৌল লক্ষ্য বিন্দুর সাথে বাণিজ্য শিক্ষার লক্ষ্যকে একাত্ম করে দেখার চেষ্টা করা হয় না। তাই বাণিজ্য শিক্ষার উদ্দেশ্য আমাদের জীবনোদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে কোন সহায়তা করতে পারছে না। তাই যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে জীবন পথে চলছেন, তারা জীবনোদ্দেশ্যের বিষয়ে অনেকখানি গাফিল হয়ে পড়েছেন। তারা জীবনকে অনেকখানি জৈববাদের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেছেন। যার ফলে ধর্ম চিন্তা ও ধর্মবাদিতার সাথে বাণিজ্য শিক্ষার একাত্মতা প্রমাণ করা সুকঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে সমকালীন বাণিজ্য শিক্ষা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন-বোধের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। তাই, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন-উদ্দেশ্যের সাথে একাত্ম হবার পরিবর্তে আমাদের বাণিজ্য শিক্ষার লক্ষ্য অনেকখানি- বলতে গেলে সম্পূর্ণতই বিপরীতধর্মী হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই, এর পরিবর্তন আশু প্রয়োজন।
উপসংহার
ওপরের আলোচনায় আমি অন্যান্য দিকে না গিয়ে শুধুমাত্র আদর্শবাদের দৃষ্টিতে আমাদের প্রচলিত বাণিজ্য শিক্ষা-ব্যবস্থা তথা শিক্ষাসূচির একটি পর্যালোচনা পেশ করেছি। আলোচনা যতটুকু সম্ভব মূলনীতি ও মৌল কাঠামোর দৃষ্টিতে করা হয়েছে। সময় ও সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ আলোচনার আরো বিষয়-ওয়ারি এবং পাঠ্যক্রম অনুযায়ী করা সম্ভব। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি পাবে এ আশংঙ্কায় আমি আলোচনা আরো বিস্তারিত করা থেকে নিরুড় হয়েছি। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে আরো অধিক কার্যকর চিন্তার প্রয়োজন আছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ তথা তাৰ্জীব ও তমদ্দুন থেকে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং তারই ফলশ্রুতি হিসেবে বাণিজ্য শিক্ষা সম্পর্কে একটি মৌল কাঠামো পাওয়া যায়। এরই ভিত্তিতে যুগচাহিদা ও জনসাধারণের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী একটি বিস্তারিত-বাণিজ্যক শিক্ষাসূচি রচনা করা যায়। এটি একদিকে আমাদের জীবন-লক্ষ্য উত্তরণে সহায়তা করবে, অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে “বৈধ জীবিকা” অর্জনের পথ সুগম করে দেবে। বাণিজ্য শিক্ষার এ দৃষ্টিকোণ নিয়ে যারা এগুতে চান, তাদেরকে কয়েকটি বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান হতে হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে!
(ক) ইসলামের আদর্শবাদ-বিশেষ করে এর ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন,
(খ) আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য পদ্ধতির (ব্যবস্থার) পটভূমিকা, ক্রমোন্নতি এবং এর বর্তমান অবস্থ পর্যালোচনা,
(গ) সমকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে গৃহীত কর্মপন্থা অধ্যয়ন এবং
(ঘ) ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগকৃত রূপ সম্পর্কে ধারণা অর্জন। তার সাথে সাথে এটাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, পূর্ণাঙ্গ সমাজ-কাঠামো ইসলামী না হলে ইসলামের ব্যবস-বাণিজ্যের নীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের শিক্ষা কোনটিই পূর্ণভাবে চলতে পারে না। তাই, ইসলামী সমাজ গঠন প্রচেষ্টা এবং ইসলামী ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষার প্রবর্তন দুটো যুগপৎ চালু করতে হবে। আরো একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে পূর্বাহ্নে শিক্ষাসূচি পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি করে তারপর এর বাস্তবায়ন হয়ে যাবে- এ ধরনের ধারণা পালটানো প্রয়োজন। বরং নীতিগতভাবে যদি ইহা স্বীকৃতি পায়, এর সিলেবাস তৈরি তেমন কোন সমস্যা হবে না। এজন্য পূর্বাহ্নে? অফিসিয়াল স্বীকৃতি প্রয়োজন। তাই বলা যায়, ইসলামী আদর্শবাদ ও আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন চিন্তাবিদগণ কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে একটি বাণিজ্য শিক্ষাসূচি তৈরি করার সাথে সাথে তার বাস্তবায়নও অপরিহার্য হয়ে উঠবে। এ অপরিহার্যতাই আমাদের যুবসমাজকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বাণিজ্য শিক্ষানীতির প্রতি আরো অধিক আগ্রহান্বিত করে তুলবে।
গ্রন্থপঞ্জি
১. কাবারের সংগঠন : ডা. এম, হাবিবুলাহ, ডীন, বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
২. Education and Ideology: Dr. Hasan Zaman.
৩. ইসলামের অর্থনীতি : মাওলানা আব্দুর রহীম।
৪. Principles of Islamic Education: Khurshid Ahmad, Director, Islamic Foundation, Leicester, U.K.
৫. Islamic Education System: Maulana Syed Abul A'la Maududi.
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়