মাদরাসা শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানে প্রস্তাবনা - আব্দুল্লাহ আল আরিফ
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের প্রায় ৯০ ভাগ লোকই মুসলমান। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম না হওয়ার কারণে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন। মুসলিম আমলে এ শিক্ষাব্যবস্থা কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন। মুসলিম আমলে এ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল যুযোপযোগী। তখন এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই সরবরাহ হত রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্র পরিচালনা কর্মকর্তা, কূটনীতিক সহ জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল। মুসলিম শাসনের বিলুপ্তির পর থেকে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বিমাতা সুলভ আচরণের শিকার। বর্তমানে বাংলাদেশে দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। তা হচ্ছে-সাধারণ শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা। চিন্তা গবেষণা করলে দেখা যায় যে, শাসক মহলের অবহেলা এবং এনজিও গোষ্ঠীর সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রর ফলে বর্তমান মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। যেমন-
১। মাদরাসা শিক্ষার শিক্ষানীতিতে যুগোপযোগী ও বাস্তবধর্মী কোন বিষয় নেই:
বরং এটা হলো শতবর্ষের পুরনো শিক্ষা (Traditional) শিক্ষাব্যবস্থ্যা। ১৯৮৭ সালের একটি অসম্পূর্ণ অর্ডিনেন্স অনুযায়ী এই শিক্ষাব্যবস্থা আজ অবধিও পরিচালিত হচ্ছে। আজ বিশ্বসভ্যতার পরিবর্তন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধন সহ মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ও শিক্ষানীতিই অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে। যে কারণে এ শিক্ষা ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। তাই যুগ বিবর্তনের ধারার সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী সর্বজনীন ও কল্যাণকর শিক্ষানীতি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকারের নিকট জোড় দাবি করছি।
২। যুগোপযোগী সিলেবাসের অভাব:
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মাদরাসা শিক্ষা সিলেবাসের নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা বইটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তা কোন প্রকারের সংস্কার-সংশোধন ছাড়াই ২০০১ সালেও পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। তাই সেখানে দেখান হচ্ছে দৈনিকবাংলা পত্রিকার সম্পাদক শামসুর রাহমান, যদিও শামসুর রাহমান অবসর নিয়েছেন আজ থেকে ১৫ বছর পূর্বে এবং পত্রিকাটিও বন্ধ হয়েছে পাঁচ বছর পূর্বে। ঠিক এমনিভাবেই সেখানে এখানো সংযোজিত হয়নি সুফীয়া কামালের মৃত্যুর সংবাদ এবং সেখানে লেখা আছে যে, হ্যালির ধূমকেতু পৃথিবীতে আগমন করবে ১৯৮৫ সালে, মনে হয় এখনো আসেনি সেই ৮৫ সাল। এসব সিলেবাসভিত্তিক সমস্যার আশু সমাধান হওয়া প্রয়োজন। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কাউকে ভাবতে দেখা যাচ্ছে না। যেমন-ফাজিল ক্লাসে আকায়েদে নাসফীনামক কেতাবে মুতাযেলা, রাফেজি, খারেজিয়া, জাবরিয়া ইত্যাদি প্রাচীন ফেরকা সম্পর্কে পড়ানো হলেও আধুনিক ফেরকা ও মতবাদসমূহ যেমন আলমানিয়া বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, ইস্তেরাকিয়া বা পুঁজিবাদ, মুস্তাসরিক ও কাদিয়ানী ফেতনা সম্পর্কে কোন কিতাব পড়ানো হয় না।
৩। প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় সংযোজিত না হওয়া:
যেমন-এই শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী, কম্পিউটার ইন্টারনেট, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাণিজ্যনীতি, কারবারপদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতি, আইন ও বিচারনীতি, কৃষি ও কারিগরি শিক্ষাদানের কোন ব্যবস্থা নেই।
৪। যুগপযোগী ইজতেহাদের/গবেষণার অভাব:
এখানে গবেষণাধর্মী নিত্য নতুন মাসয়ালার যুগোপযোগী স্বাধীন স্বতন্ত্র সমাধান উদ্ভাবনের পরিবর্তে তাকলীদি মাসয়ালায় নির্ভর করা হয়। অথচ আধুনিক সমস্যা যেমন-রক্তদান কর্মসূচি, জীবনবীমা, শেয়ার, ব্যাংকিং করবার, নভচারিদের কেবলা কোন দিকে হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নতুন করে ইজতেহাদের প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
৫। শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব:
মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র না থাকায় শিক্ষকরা বিশ্বের আধুনিক ও কার্যকর শিক্ষাদান পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে অবহিত হতে পারছেনা না । যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ সাধরণ শিক্ষায় পিটিআই, বিএড, এমএড-সহ নানা ধরনের উন্নত পদ্ধতি অবলম্বন করছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারছে মাদরাসা ছাত্ররা তা পারছে না।
৬। ইবতেদায়ী মাদরাসাকে সরকারীকরণ করা হয়নি
এবতেদায়ী মাদরাসা হল মাদরাসা শিক্ষার সূতিকাগার অথচ এ এবতেদায়ী মাদরাসা আজ চরম অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। যেমন-উলেক্লখ করতে হয় যে, আজ গোটা দেশে নামেমাত্র ৩৭১০টি একতেদায়ী মাদরাসা থাকলেও একটি মাদরাসাকেও সরকারীকরণ করা হয়নি। তারা সরকারি ভাবে একটি পয়সাও অনুদান পাচ্ছে না । এখানকার ছাত্ররা পাঠ্য পুস্তক থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত। অথচ গোটা দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৬,৯৩০টি, এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭,৬৭৭টি এবং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯,২৫৩টি এ উভয় প্রকার প্রাথমিক বিদ্যালয়েই সরকারি অনুদান পাচ্ছে এবং ছাত্ররা পাঠ্যপুস্তক ও সর্বপ্রকার পৃষ্ঠপোষকতাসহ খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির সুবিধাও পাচ্ছে। এ কারণে এবতেদায়ী মাদরাসার কোন প্রকার উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়।
৭। পৃথক পাঠ্যপুস্তক কারিকুলাম বোর্ড না থাকা
মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় পৃথক পাঠ্যপুস্তক কারিকুলাম বোর্ড না থাকার জন্য ছাত্রদেরকে সীমাহীন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তারা যথাসময়ে মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক পাচ্ছে না, যাও পাচ্ছে তাতে ভুলে ভরা। দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে একই সংস্করণ পুর্নমূদ্রণ হওয়াতে ছাত্ররা বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে।
৮। চরম বৈষম্যের শিকার দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তর
আজ বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার সকল স্তরেই রয়েছে চরম বৈষম্য। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেবেলে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, মাদরাসার দাখিল লেবেলে ও সমান বিষয় পড়ানো হয়। পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত শিক্ষার্থীরা ৫০% নম্বর অবজেকটিভ পরীক্ষা দেয় অথচ মাদরাসা ছাত্রছাত্রীদের ২০% নামে মাত্র থাকলেও তা কোন অবজেকটিভ নয় বরং তা হল ছোট প্রশ্নোত্তরের মত। এ কারণে মাদরাসা ছাত্রদের পক্ষে কোন দিন A+ পাওয়া সম্ভব হবে না। দাখিল ও আলিমকে এস,এস,সি ও এইচ,এস,সির সমমান প্রদান করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিষয়ে তাদেরকে অনার্স ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় না। ইংরেজি ও বাংলা আবশ্যিক বিষয় পড়া সত্ত্বেও স্নাতক স্তরে সমমর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। সমান লেখাপড়া করেও তারা আজ এলএলবি, বিএড, বিবিএসসহ সরকারি সকল সেক্টরে চাকুরি থেকে বঞ্চিত । অনুরূপ ভাবে কামিল পাশ করেও বঞ্চিত হচ্ছে স্নাতকোত্তর মর্যাদা থেকে।
৯। স্নাতক স্নাতকোত্তর স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ না করা
দেশের সাধারণ শিক্ষা স্নাতকোত্তর স্তরে এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া হয়নি। ফাযিলে অনার্সের অনুপ্রবেশও করা হয়নি এখনও। সবচেয়ে বড় কথা হলো মাদরাসাকে নিয়ন্ত্রণ করার মত কোন আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে নেই।
১০। শিক্ষা বোর্ডের অভাব
দেশের সাধারণ শিক্ষার পঞ্চম ও অষ্টম বৃত্তি পরীক্ষাসহ এস,এস,সি ও এইচ,এস,সি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৬ বিভাগে পৃথক পৃথক ৬টি শিক্ষা বোর্ডসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি বেসরকারি মিলে প্রায় ৩০টির বেশি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও মাদরাসা শিক্ষার, এবতেদায়ী বৃত্তি, অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল ক্লাসের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ সিলেবাস প্রণয়ন থেকে শুরু করে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা হচ্ছে মাত্র একটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে। এতে করে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডকে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
১১। সহ শিক্ষার প্রতিকূল প্রভাব
বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অদ্যাবধি সহশিক্ষার প্রচলন রয়েছে। যা ঈমান-আকিদা ও স্বাভাবিক মানসিকতায় মন্দ প্রভাব বিস্তার করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মাদরাসার ফিকহী মাসয়ালার মধ্যে হায়েজ নেফাস, সঙ্গম, সহবাস, গোসল ফরজ হওয়া না হওয়া বিবাহ-নিকাহ থেকে শুরু করে সকল মাসয়ালা পড়ানো হয় যা সহশিক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই আপত্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে।
১২। গ্রন্থাগার ও পাঠ্য গ্রন্থাবলির অভাব
মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় পর্যাপ্ত গ্রন্থ তো দূরের কথা কোন প্রকারের গ্রন্থাগারেই অস্তিত্ব নেই। অথচ সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বেশ নতুন কিছু নতুন বিষয়ের সংযোজন থাকায় মাদরাসা ছাত্রদের জন্য কুতুবখানা বা গ্রন্থাগারের একান্ত প্রয়োজন।
১৩। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার সংযোজন নেই
সিলেবাসভিত্তিক অধ্যয়নের পাশাপাশি মদরাসা ছাদদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা যেমন-মৎস্য খামার, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কুঠির শিল্প, হাঁস-মুরগি পালনসহ যে কোন ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ নেই।
১৪। শিক্ষায় ডিপ্লোমা স্তরসহ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তির সংযোজন করা হয়নি
সাধারণ শিক্ষায় বুয়েট, পলিটেকনিকেল, কম্পিউটার ডিপ্লোমা, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আর্থ সামাজিক নির্ভরশীল করে তোলার প্রচেষ্টা রয়েছে। অথচ মাদরাসা শিক্ষায় এ জাতীয় শাখা খোলার কোন উদ্যোগ সরকারের নেই।
১৫। বাণিজ্যিক বিভাগের অভাব
মাদরাসা শিক্ষায় বাণিজ্যিক শাখার সংযোজন করা হয়নি, অথচ এ শাখাটি জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বাণিজ্যিক শাখা যেমন- ইসলামী ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স, লেনদেনসহ বাণিজ্যিক সকল সেক্টরের জ্ঞান লাভ থেকে মাদরাসা ছাত্ররা বঞ্চিত।
১৬। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ললিতকলার অভাব
সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ললিতকলাসহ আর্টশিল্প কারু ও চারুশিল্প মাদরাসা ছাত্রদের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ নেই। যা ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাহজিব তামুদ্দুন ও মননশীল চিত্তবিনোদনের জন্য সহায়ক হত। মাদরাসা ছাত্রদেরকে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে।
১৭। মাদরাসা শিক্ষা সিলেবাসে আইন শিক্ষার অভাব
সাধারণ শিক্ষায় এম এ পাস করার পর এমফিল, পিএইচডিসহ নানা ধরনের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ দেয়া হলেও মাদরাসা শিক্ষিত ফাযিল বা স্নাতকোত্তর পাস ছাত্রদেরকে উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ কামিল পাস করার পরও একজন শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিক্ষার জন্য এমফিল বা পিএইচডি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।
১৮। উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার ক্ষেত্রে মাদরাসা ছাত্রদের জন্য পৃথক কোন ব্যবস্থান নেই সমস্যা সমাধানে কতিপয় প্রস্তাবনা
মাদরাসা শিক্ষার এ বহুমুখী সমস্যা ও সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসা শিক্ষার সীমাহীন বৈষম্য দূরীকরণে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জোর দাবি চলে আসছে বেশ কয়েক দশক আগ থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ মাদরাসা ছাত্র-আন্দোলন পরিষদ গত শতাব্দীর আশির দশকের পর অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গোটা দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, লিফলেট-পোস্টারিং, পত্রিকায় লেখালেখি, প্রতিবেদন ও স্মারকলিপি পেশসহ নানাভাবে প্রচার প্রসারের মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের যুগ থেকে শুরু করে আজোবধি শাসকগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন মহলের কূটকৌশল মাদরাসা শিক্ষার যে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, তার আশু সমাধানকল্পে এবং বর্তমান মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করা হচ্ছে:
১. শিক্ষানীতি প্রণয়ন
শিক্ষার্থীদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থাশীল ও বিশ্বাসী করে তুলে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে যাতে করে তারা দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উৎপাদনশীল জনশক্তিতে রূপান্তর হতে পারে। এ ব্যাপারে আদিম ও বিতর্কিত শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন করে যুগোপযোগী শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষা সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. জাতীয় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে
দেশে স্নাতক স্নাতকোত্তর স্তরকে পরিচালনার জন্য যেভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক তদ্রূপ ফাযিল ও কামিল স্তরকে পরিচালনার জন্য ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র মঞ্জুরি ক্ষমতা সম্পন্ন এফিলিয়েটেড ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে করে ফাযিল ও কামিল স্তর দুটি বোর্ডের অধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে।
৩. যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে
পাঠ্য সিলেবাসের সময়সীমা ও যুগোপযোগী বিষয়ে সংযোজন করা একান্ত প্রয়োজন। তাই সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজন মত সিলেবাস প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংস্কার ও সংশোধনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. ইবতেদায়ী মাদরাসাকে সরকারি করতে হবে
মাদরাসা শিক্ষার সূতিকাগার সকল ইবতেদায়ী মাদরাসাকে সরকারি করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তক থেকে শুরু করে সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্ৰদান করতে হবে । তাছাড়াও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নার্সারি ও শিশু ভবনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৫. দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরকে উপযুক্ত মান প্রদান করতে হবে
বর্তমানে এসএসসি লেভেলে যেভাবে ৫০% নাম্বার অবজেকটিভ রয়েছে দাখিল স্তরেও সেভাবে ৫০% নাম্বার অবজেকটিভ এর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ বর্তমান ফলাফলের গ্রেডিং পদ্ধতিতে ২০% সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর দিয়ে A+ পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। তাই দাখিল স্তরেও অবশ্যই ৫০% অবজেকটিভ প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়াও দাখিল ও আলিম পাসের পর এসএসসি ও এইচএসসি'র মত অনার্সে ভর্তির ব্যাপারে সম্পূর্ণ সমাধিকার প্রদান করতে হবে। যাতে করে তারা সকল বিষয়েই অনার্সে ভর্তি হওয়ার সমান সুযোগ পায়। অনুরূপভাবে ফাজিলকে স্নাতকের সমমর্যাদা প্রদান করতে হবে যাতে করে ফাজিল পাসের হার ছাত্ররা এলএলবি, বিএড, বিসিএসসহ সকল সরকারি বেসরকারি সেক্টরে সুযোগ পায়। অনুরূপভাবে ফাজিলকে স্নাতকের সমমর্যাদা প্রদান করতে হবে যাতে করে ফাজিল পাসের পর ছাত্ররা এলএলবি, বিএড, বিসিএসসহ সকল সরকারি বেসরকারি সেক্টরে সুযোগ পায়। অনুরূপভাবে ফাজিলে অনার্সপদ্ধতি চালু করতে হবে। আর কামিলকে স্নাতকোত্তরের সমমর্যাদা প্রদান করতে হবে। প্রতিটি জেলায় একটি করে কামিল সরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অনার্স কোর্স চালু করতে হবে এবং থানায় থানায় একটি করে সরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬. সমাজ জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
বর্তমানে জীবন চলার প্রতিটি পদক্ষেপেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিশেষ করে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন, বিচারনীতি, কৃষি, কারিগরিবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়সমূহ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৭. মাদরাসা শিক্ষার জন্য পৃথক পাঠ্যপুস্তক কারিকুলাম বোর্ড গঠন করতে হবে
মাদরাসা শিক্ষার জন্য পৃথক পাঠ্যপুস্তক কারিকুলাম বোর্ড গঠন করতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা সঠিক সময় সঠিক চাহিদা মাফিক পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ করতে পারে।
৮. উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কোর্স চালু করতে হবে
স্নাতকোত্তর স্তরের পর সাধারণ শিক্ষায় যেভাবে, এমফিল, পিএইচডি, পোস্ট ডক্টরেট ইত্যাদি উচ্চতর গবেষণা পদ্ধতি চালু আছে, মাদরাসা শিক্ষাতেও অনুরূপ উচ্চতর কোর্সের ব্যবস্থা করে ইজতেহাদধর্মী স্বাধীন স্বতন্ত্র মতামত প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং আধুনিক জীবন পরিক্রমার সকল নিত্য-নতুন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা করতে হবে। এ ব্যাপারে যথোপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিবেশ সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণাগার ও গবেষণাসমাগ্রী ও গবেষণা মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. সহশিক্ষা বন্ধ করতে হবে
মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যমিক থেকে উচ্চতর পর্যায়ে পর্যন্ত সকল স্তরের সহশিক্ষা প্রথা বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে নারী শিক্ষার জন্য সকল স্তরেই পৃথক মহিলা মাদরাসা চালু করতে হবে।
১০. কুতুবখানা বা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে
মাদরাসা ছাত্রদেরকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি যেহেতু শরিয়তের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে হয়, তাই তাদের রেফারেন্স বিভাগ হিসেবে কুরআন, তাফসির, হাসীসসহ ইসলামী সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই কুতুবখানা বা লাইব্রেরির সাহায্য নেয়া জরুরি। এজন্য প্রতিটি মাদরাসায় একটি করে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১১. শিক্ষা প্রশাসনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
শিক্ষা প্রশাসন শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে হিসেবে ইবতেদায়ী দাখিল ও আলিম ক্লাসকে পরিচালনার জন্য দেশের সাধারণ শিক্ষার মতই দেশের ৬ বিভাগে ৬টি শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর ফাযিল, ফাজিল অনার্স ও উচ্চতর শিক্ষাকে পরিচালনা করার জন্য ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১২. শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষায় যেভাবে বিএড, পিটিআই, এমএড, বিপিএড ইত্যাদি কোর্স চালু আছে, মাদরাসা শিক্ষকদের জন্যও অনুরূপ প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ প্রশিক্ষণই হল সাফল্যের চাবিকাঠি।
১৩. মাদরাসা শিক্ষায় বৃত্তিমূলক বিষয়ের সংযোজন করতে হবে
সিলেবাসভিত্তিক অধ্যয়নের পাশাপাশি মাদরাসার ছাত্রদেরকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, পশু-পালন, মৌমাছি পালন, তাঁত, হস্তশিল্প, গার্মেন্টস, কারুশিল্প, কাঠের কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, আর্ট শিল্প, মুদ্রা শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবস্যা, কৃষিভিত্তিক শিল্প, ইলেক্ট্রনিকস, ড্রাইভিং ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ছাত্রদেরকে ছাত্র বৃত্তিমুক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থাও করতে হবে।
১৪. মাদরাসা শিক্ষায় ডিপ্লোমা স্তর সংযোজন করতে হবে
সাধারণ শিক্ষার মতই, মাদরাসার ছাত্রদের জন্যও বুয়েট, পলিটেকনিক্যাল, কম্পিউটার ডিপ্লোমা, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমো, পর্যটন ডিপ্লোমা, গার্হস্থ্য ডিপ্লোমা, ক্রীড়া-কৌতুক রেডিও-টিভির সংবাদ পাঠ, উপস্থাপনা ইত্যাদি প্রশিক্ষণ কোর্স, সাংবাদিকতা, সম্পাদনাসহ সর্বপ্রকার পেশাবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সংযোজন করতে হবে।
১৫. মাদরাসা শিক্ষার বাণিজ্যিক বিভাগের সংযোজন করতে হবে
মাদরাসা শিক্ষায় বাণিজ্যিক শাখার সংযোজন করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ব্যাংকিং কারবার, শেয়ারবাজার মুদ্রাস্ফীতি, ইন্সুরেন্স পদ্ধতিসহ সকল বাণিজ্যিক বিভাগে মাদরাসা ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
১৬. আইন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে
মাদরাসা শিক্ষার সাধারণত আইন, আন্তর্জাতিক আইনসহ, ইসলামিক আইন (শরিয়াহ) শিক্ষার ব্যাপারে এলএলবি, এলএলএমসহ আইন বিষয়ক কোর্স চালু করতে হবে।
১৭. সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ললিতকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে
মাদরাসা শিক্ষায় সাহিত্য-সংস্কৃতি, ললিতকলা চারু কলাসহ সকল নান্দনিক কর্মকাণ্ডের সংযোজন করতে হবে, তবে এ ব্যাপারে শালীনতা রুচিশীলতা ও মানবকল্যাণের সমন্বয় সাধনমূলক কর্মকাণ্ড সংযোজিত করতে হবে।
পরিশেষে
আমাদের খুঁজে বের করা দরকার, সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাভক্তি থাকা সত্ত্বেও অনেকেই কেন মাদরাসায় তাদের সন্তানদের পড়তে দিচ্ছেন না? কেনই বা মাদরসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে? মাদরাসা শিক্ষার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে দেশের আলেমসমাজকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।
মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বৈষম্য দূর করতে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফাযিল ও কামিলকে বিএ ও এমএ'র মান দেয়ার ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের পরও তা বাস্তবায়িত আজও হয়নি। বিসিএস-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না মাদরাসার ছাত্ররা।
মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম সিলেবাস এবং পাঠদানপদ্ধতি উন্নত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারলে, মাদরসার ছাত্ররা সন্ত্রাসী নয়, উন্নত নৈতিকতাসম্পূর্ণ আরো প্রোজ্জ্বল হয়ে জেগে উঠবে।
লেখক: সাবেক কেন্দ্রীয় দাওয়াতি কার্যক্রম সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির