বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রফেসর আবুবকর রফিক আহমদ

একটি আদর্শ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখার আলোকে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাবনা - প্রফেসর আবুবকর রফিক আহমদ

১. প্রসঙ্গ কথা
১.১ চীন দেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘তুমি যদি স্বল্পতম সময়ে ফল লাভ করতে চাও, তাহলে মওসুমি ফসলের চাষ কর; তবে তুমি ফসল পাবে একবার মাত্র, আর যদি তুমি দশ বছর ধরে ফল পেতে চাও, তাহলে চাষ কর ফলদার বৃক্ষের। আর তুমি যদি শতাব্দীকাল ধরে ফল পেতে চাও তাহলে মানুষের চাষ কর।

বলাবাহুল্য মানুষের চাষ মানে হলো একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন। এই শিক্ষাব্যবস্থার ওপরই কোন জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রাসাদ বিনির্মিত হয় এবং এই ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতাই বিশ্বের দরবারে কোন জাতির মর্যাদা নির্ণয়ের প্রধান সূচক।

১.২ কোন জাতি তখনই সভ্যতার সোপান বেয়ে সুউচ্চ আসনে সমাসীন হয় যখন তার শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত ও সুস্থ এবং মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যদি সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা হয় ত্রুটিযুক্ত তাহলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে বাধ্য গোটা জাতির মন-মানসিকতায়, আচার-আচরণে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে। হয়ত একটি শিক্ষানীতির সুফল বা কুফল বাহ্যিক দৃষ্টিতে এবং দুই এক দশকের ব্যবধানে ধরা নাও পড়তে পারে, কিন্তু শতাব্দীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের কাছে অবশ্যই ধরা পড়বে, এতে সন্দেহ নেই।

১.৩ শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কিত দু'টি উদাহরণ এখানে পেশ করতে চাই। এর একটি হচ্ছে মহানবী (সা)-এর হাতে প্রবর্তিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা, আর দ্বিতীয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা।

এর প্রথমটি প্রবর্তিত হয় আল্লাহর প্রতি ঈমান, তথা মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্য হিসেবে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, তাকওয়া বা পরকালের জবাবদিহিতার ভয়কে নৈতিকতার মূল উৎস এবং রাসূলের আদর্শকে সর্বোত্তম আদর্শ বিবেচনা করে। আর দ্বিতীয়টি প্রবর্তিত হয় মানব রচিত আইন এবং জনগণের পছন্দ অপছন্দকে সার্বভৌমত্বের মূল ভিত্তি এবং আল্লাহর প্রদত্ত বিধানের ধারণা ও পরকালে জবাবদিহিতার ভয় হতে সম্পূর্ণ মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে।

প্রথমোক্ত দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে গড়ে ওঠে ইসলামী সভ্যতার এক গগনচুম্বী প্রাসাদ। মুসলমানগণ দীর্ঘ ৬৫৩ বছর ধরে শুধু যে অর্ধ পৃথিবীর ওপর একচ্ছত্র শাসন করেন এবং বিশ্বের অপ্রতিরোধ্য একক শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তা নয় বরং তারা ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে অগ্রণী, সভ্যতার পতাকাবাহী, সংস্কৃতির ধারক ও মানবতার মুক্তিদূত। আব্বাসীয় শাসনের পতনের পর মুসলিম শক্তি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকলেও এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যেখানে মুসলমানদের স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার মূলভিত্তি ছিল ইসলামী আদর্শনির্ভর, সেখানকার শাসনব্যবস্থা ছিল অধিকতর ন্যায়পরায়ণ, জনগণ ছিল নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ এবং মানবাধিকার ছিল সংরক্ষিত। প্রসঙ্গত : উল্লেখ্য যে, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান করুণ চেহারা তথা আদর্শের দেউলিয়াত্ব, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে দৈন্যদশা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদতা ইত্যাদি সব কিছুর মূলে দায়ী হচ্ছে সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দী হতে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে মুসলিম বিশ্বের পতন ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন।

পক্ষান্তরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা আমেরিকানদের কতটুকু শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছে এবং বিশ্ববাসীর জন্য কতটুকু কল্যাণকর ভূমিকা পালন করেছে তার চিত্র আজ সচেতন ব্যক্তি মাত্র অজানা নয়। বাহ্যত তাদের জীবনযাত্রার মান সর্বোচ্চ দাবি করা হলেও আল্লাহকে বিশ্বাস ও পরকালের ভয়ের ধারণা তাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিলুপ্ত হওয়ার কারণে সেখানে জনগণ বাস করছে নেকড়ে ও মেষের মত। আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একজন অন্যজনকে অহরহ প্রতারিত, পদদলিত ও পরাভূত করার প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত। সেখানে দুর্বলরা সর্বদাই সবলদের হাতে অত্যাচারিত। কোন নৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়ার কারণে সেখানকার মানুষ চরমভাবে নৈতিক অধঃপতনের শিকার। বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধনের পরেও আদর্শিক দিক দিয়ে তারা অন্তঃসারশূন্য। মানবাধিকারের ফাঁকা বুলি আওড়ালেও তাদের হাতে মানবাধিকার চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। নারী স্বাধীনতার পক্ষে যতই ওকালতি করুক না কেন সেখানে নারীরাই সর্বাধিক নির্যাতিত এবং নরপশু বৎ হায়েনাদের অবৈধ যৌনতৃষ্ণা নিবারণের প্রধানতম হাতিয়ার। জনগণের ইচ্ছাই আইনের প্রধানতম উৎস বিবেচিত হওয়ার কারণে অধিকাংশের সমর্থনের অজুহাতে সমকামিতার মত ঘৃণ্য অপরাধকেও আইনসিদ্ধ বলে বিবেচিত করা হয়েছে। শুধু এই একটি উদাহরণ থেকেই বুঝতে পারা যায় তাদের রুচিবিকৃতির মাত্রা কত অধঃপতিত । মার্কিন পরাশক্তি বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি হওয়ার দরুন গোটা বিশ্বে বিরাজ করছে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। ছোট ছোট দেশকে তার তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখেই তার পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করা হয়েছে । যারা তার মোড়লগিরি মানতে নারাজ তাদেরকে নানাভাবে কোণঠাসা করার কোন সুযোগই সে হাত ছাড়া করতে চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বর্তমানের প্রধান সমস্যা হল ইসলামের পুনরুত্থান। যাকে মৌলবাদ নামে আখ্যায়িত করে একে ঠেকাবার জন্য আটঘাট বেঁধে নেমেছে। তাদের এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশে এমন কিছু লোককে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে, যারা সম্ভাব্য সকল উপায় উপকরণকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন নীতিমালা অনুযায়ী নিজ দেশের সকল পলিসি নির্ধারণ করছে। এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন। বাংলাদেশে দুই শতাব্দীকাল পূর্বে ব্রিটিশ বেনিয়ারা যে শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া পত্তন করে গিয়েছিল তার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের সীমিত সুযোগ থাকার দরুন এখন মনে করা হচ্ছে যে ব্রিটিশ পলিসি ১০০% সফল হয়নি। তাই এখন আবার মার্কিন পলিসি বাস্তবায়নের প্রয়াসী। এই পলিসিকে সীমিত আকারের হলেও ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের আর কোন সুযোগই থাকবে না। এভাবে একটি নীলনকশা প্রস্তুত করা হয়েছে আমাদের আদর্শিক ভিত্তি চুরমার করে দিয়ে গোটা জাতিকে নৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের পথে ঠেলে দেয়ার।

১.৪ এদেশে প্রচলিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার কুফল কী তা আল্লামা ইকবালের মত সচেতন দার্শনিকের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। এ শিক্ষাব্যবস্থা প্রসূত নতুন প্রজন্মকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন-

“তুমি অন্যের জ্ঞান অর্জন করেছ
নিজের চেহারায় মেক আপ করেছ অন্যের কাছ থেকে
ধার করা রুজ দিয়ে।
আমি জানি না তুমি কি আসলে ‘তুমি’ না অন্য কেউ।
তোমার বুদ্ধিমত্তা বন্দী অপরের চিন্তার শৃংখলে।
তোমার গভীরের নিঃশ্বাসটুকু ও আসছে অন্যের সূত্র থেকে।
ধার করা ভাষা তোমার কণ্ঠে
ধার করা আকাঙ্ক্ষা তোমার হৃদয়ের গভীরে।
তোমার ক্যানারি পাখি ধার করা গান গায়।
তোমার সাইপ্রাস বৃক্ষের আবরণ ধার করা।
তোমার পানপাত্রে রক্ষিত সুরা সেওতো অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নেয়া
সুরাপাত্রটিও তুমি এনেছ ধার করে।
তুমিতো একটি সূর্য। একবার চেয়ে দেখ আপন সত্তার পানে
অপরের তারকার আলো তুমি চেয়ো না কোন ক্ষণে ।
সভার মোমবাতির আলোতে তুমি আর কতিদন নাচবে?
তোমার হৃদয়ের অনুভূতি যদি থাকে তাহলে জ্বালো
অনতিবিলম্বে আপন আলো। (১)

১.৫ একটি শিক্ষাব্যবস্থায় আদর্শিক দিকের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইকবাল আরও বলেন : একজন ব্যক্তির জীবন নির্ভর করছে আত্মা ও দেহের সম্পর্কের ওপর, একটি জাতির জীবন নির্ভর করছে তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর। আত্মার জীবনপ্রবাহ বন্ধ হলে ব্যক্তিদেহ হয়ে পড়ে মৃত। জাতি মৃত্যুবরণ করে যদি তার আদর্শ হয় পদদলিত। (২) বলাবাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষ ও আদর্শবিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা নতুন প্রজন্মের আত্মা ও অন্তরে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। মনের চাহিদা ও দেহের প্রয়োজন পূরণ নিয়েই সে ব্যস্ত। আত্মা চাহিদার প্রতি আদর্শিক প্রয়োজনের প্রতি তা চরমভাবে উদাসীন। যে শিক্ষাব্যবস্থায় আত্মার পুষ্টি ও আদর্শিক প্রয়োজনের দিক বিবেচিত হয় না তা জাতির জন্য মারাত্মক।

আল্লামা ইকবালের ভাষায়-

জ্ঞান যদি নিয়োজিত হয় তোমার দেহের সমৃদ্ধির জন্য
তবে এ জ্ঞান হচ্ছে এক বিষধর সর্প।
জ্ঞান যদি হয় তোমার আত্মার মুক্তির জন্য নিবেদিত
তবে এ জ্ঞান হবে তোমার পরম বন্ধু, তোমার গর্ব। (৩)


১.৬ আদর্শ নিরপেক্ষ জ্ঞান তথা শিক্ষাব্যবস্থা কী মারাত্মক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসে তার উপলদ্ধি অনেক সচেতন পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও করতে পেরেছেন। এখানে Prof. Harold H Titas এর একটি উক্তির উদ্ধৃতি দেয়াই সমীচীন মনে করছি। “সাধারণ জ্ঞান ভাণ্ডারের অভাবের চেয়েও অধিকতর মারাত্মক হচ্ছে সাধারণ আদর্শ ও প্রত্যয়ের অনুপস্থিতি । শিক্ষা সত্যাপণ দৃঢ় বিশ্বাস ও নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, মানবিক মূল্যবোধ এবং বাধ্যতা থেকে বিজ্ঞান ও গবেষণা বিপজ্জনকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ...... শিক্ষা অতীতের অধ্যাত্মিক ঐতিহ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে এবং তদস্থলে বিকল্প মূল্যবোধ প্রদান করতেও ব্যর্থ হয়েছে। পরিণামে শিক্ষিত লোকেরাও আজ বিশ্বাস বঞ্চিত, মূল্যবোধ বিবর্জিত এবং বঞ্চিত একটি সুসংহত বিশ্বদর্শন থেকে।' (৪)


২. একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
২.১ একটি শিক্ষাব্যবস্থা তখনই শুধু আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা বলে বিবেচিত হতে হতে পারে যখন ঐ ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করে একজন শিক্ষার্থীর ঈমান হবে সুদৃঢ়, চরিত্র হবে সুন্দর, জীব ও জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা হবে স্বচ্ছ, তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশের পথ হবে উন্মুক্ত, সমাজের প্রতি দায়দায়ীত্বের অনুভূতি হতে তীব্র। পরকালে আপন দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জবাবদিহীতার ভয় থাকবে অন্তরে সদা জাগ্রত। আপন সত্বা, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে থাকবে সচেতন এবং সর্বোপরি নিজের অর্জিত জ্ঞান ও লব্ধ অভিজ্ঞতার ফসল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার অনুপেরনায় হবে সর্বদা বিচলিত। যে শিক্ষাব্যবস্থায় এর এক বা একাধিক দিক ক্ষুণ্ন হবে, তা তত অপূর্ণাঙ্গ ও অকল্যাণ কর বিবেচিত হতে বাধ্য।

২.২ (ক) লক্ষ্যের সুস্পষ্টতা: একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত তাহলো ‘লক্ষ্যের সুস্পষ্টতা'। এ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কোন আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে চাই, কোন চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে এবং দেশ ও জাতির জন্য কোন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নাগরিক তৈরি করার প্রয়োজন সেসব বিষয়কে সামনে রেখে তার অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। বস্তুত শিক্ষা হচ্ছে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার মাধ্যম। একটি আদর্শ শিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে একটি জাতির মৌলিক আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং তাদের স্বকীয় সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, কেননা আদর্শ দ্বারাই তো জীবন হয় ঐশ্বর্যপূর্ণ। আদর্শ বিবর্জিত কোন জ্ঞান বা বুদ্ধিমত্তা কোন জাতির জন্য প্রকৃত সুফল বয়ে আনতে পারে না। লক্ষ্যস্থলের স্পষ্টতা ছাড়া কোন কাফেলা সঠিক গন্তব্যে পৌছতে পারে না। যেসব প্রত্যয় এবং আদর্শের জন্য একটি জাতি কোন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় সেগুলোকেই শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি জাতির ধর্ম সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নই হওয়া চাই শিক্ষার প্রধানতম উদ্দেশ্য ।
আল্লামা ইকবাল দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, “জ্ঞান বলতে আমি ইন্দ্ৰিয়ানুভূতি ভিত্তিক জ্ঞানকেই বুঝি । জ্ঞান প্রদান করে শক্তি, আর এ শক্তি দ্বীনের অধীন হওয়া চাই । কারণ তা যদি দ্বীনের অধীন না হয় তবে তা হবে নির্ভেজাল পৈশাচিক।' (৫)

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জ্ঞানের ‘ইসলামীকরণ’ (Isamization of knowledge)। তথা মানব সৃষ্ট ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে প্রত্যাদিষ্ট বা অহিলব্ধ জ্ঞানের সাথে সংযুক্ত করা। এভাবে জ্ঞান হতে হবে বৃহত্তর মানবকল্যাণে নিয়োজিত ও আল্লাহর আনুগত্যের পথে পরিচালিত।

আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটিতে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে :
“আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, ফেরেস্তাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (৬) এ আয়াতের আলোকে জ্ঞানীদের হতে হবে সত্যের সাক্ষ্যদাতা।

এ লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে তখন যদি শিক্ষাব্যবস্থাটি সার্বিকভাবে ইসলামী আদর্শের আলোকে সাজানো হয়। নতুন বই রচনা ও সঙ্কলনের সময়েও এ দৃষ্টিকোণটি অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়াবার সময় ছাত্রদের কাছে ইসলামী দৃষ্টিকোণটিও ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে এবং শিক্ষার প্রতিটি স্তরেও তার মনে আদর্শিক চেতনা সৃষ্টির বিষয়ে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। বলাবাহুল্য এটাই হবে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য।

২.২ (খ) আত্মসচেতনতা সৃষ্টি: একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তক এমনভাবে প্রণীত হতে হবে যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিসত্তার পরিচয় লাভ করে ও সৃষ্টিকূলে নিজের অবস্থান এবং আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে লাভ করে সর্বোচ্চ ধারণা।

ব্যক্তিসত্তার পরিচয় লাভের অর্থ একথা বিশ্বাস করা যে, মানুষ আল্লাহর দাস। তাই তার কোন আচার আচরণ বা ক্রিয়া কর্ম এমন হতে পারবে না যা আল্লাহর প্রতি দাসত্বের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। তাকে এ বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে যে মানুষ দুনিয়ার বুকে আলাহর খলিফা। এজন্য তাবৎ সৃষ্টিকুলকে আল্লাহ মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন। তাই মানুষের উচিত সৃষ্টিকুলের সকল উপায় উপকরণকে যেন এমন পদ্ধতিতে ও এমন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় যার মাধ্যমে সে আল্লাহ খিলাফতের দায়িত্ব পালনে সক্ষম। খিলাফতের একটি প্রধান দায়িত্ব হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে শিষ্টের লালন দুষ্টের দমন। আরও একটি বিশেষ দায়িত্ব হলো সমস্ত শক্তি, সামর্থ্য ও জ্ঞানকে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করা।

২.২ (গ) জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি
একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের তাদের আত্মপরিচয়ের সাথে জাতীয় পরিচয় ও বিশ্ব সভ্যতায় মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান সম্পর্কিত ধারণা দেয়া। অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে এ বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের জন্য এক বা একাধিক বই অধ্যয়নের সুযোগ থাকা দরকার।

২.২ (ঘ) সমাজ পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কিত জ্ঞান সমৃদ্ধি
ব্যক্তিসত্তার পরিচয় এবং জাতীয় ঐতিহ্যের জ্ঞান দানের পাশাপাশি একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের ব্যবস্থা থাকাও বাঞ্ছনীয়। কারণ ইসলামের অন্যতম শিক্ষা হলো মানুষের মনে সামাজিক দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা। ইসলাম সমাজ ও রাষ্ট্রের আওতায় ব্যক্তি মানুষগুলোকে সংগঠিত করে এবং ব্যক্তিকে সামাজিক কল্যাণে অংশগ্রহণের অনুভূতি জাগ্রত করে। যেহেতু ইসলাম মাতা-পিতা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যেকের পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য চিহ্নিত করেছে, তাই শিক্ষাব্যবস্থায় এসব দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞাত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে। এতদুদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইসলামী দৃষ্টিকোণে রচিত সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যবই সিলেবাসভুক্ত থাকতে হবে।

২.২ (ঙ) চরিত্র গঠন
একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে এই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। বিশেষ করে শিশু চরিত্র গঠনে চূড়ান্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর তা হবে পাঠ্যপুস্তককে আদর্শিক ছাঁচে ঢালাই ও শিক্ষার্থীদের যথাযথ তারবিয়তের মাধ্যমে। পবিত্র আল কুরআনের ভাষায় আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে প্রেরণের মাধ্যমে মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। এ উপলক্ষে নবীর প্রধান প্রধান কাজের অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি তাদের চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করেন। (৭) অর্থাৎ উত্তম তারবিয়তের মাধ্যমে তাদেরকে সকল চারিত্রিক কলুষতা থেকে মুক্ত করেন।

শিক্ষা যতক্ষণ না উত্তম চরিত্র গঠনে ব্রতী হবে, একে ততক্ষণ পর্যন্ত তা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল করতে সক্ষম হবে না। Prof. Lester Smith. বলেন, “সমাজ সদৃশ ধারণার সাথে চরিত্র গঠনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। (৮)

ইমাম গাজ্জালি বলেন, শিক্ষা পদ্ধতি তরুণ মনকে মধু জ্ঞানপূর্ণ করতেই চাইবে না একে অবশ্য শিশু নৈতিক চরিত্র সৃষ্টি এবং তার মন সামাজিক জীবনের নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা দিতে হবে। (৯)
শিক্ষার সর্বস্তরে ছাত্রদের আল কুরআনের শিক্ষা ও রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনাদর্শ শেখাতে হবে। এর জন্য চাই পরিকল্পিতভাবে একটি বিশেষ স্তর পর্যন্ত কুরআন ও হাদীসের নির্দিষ্ট অংশ পাঠ্যভুক্তকরণের ব্যবস্থা। তদুপরি শিক্ষা নিকেতনগুলোর সামগ্রিক পরিবেশ চরিত্র গঠনের উপযোগী হতে হবে। এ দুটি বিষয়ের কোন একটি ক্ষুন্ন হলে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার অভীষ্ট লক্ষ্য আদর্শ মুমিন তৈরি করা সম্ভব নয়।

২.২ (চ) মেধার লালন ও বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দান
একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মেধার লালন নিশ্চিত হবে এবং বিকাশের পূর্ণ সুযোগ থাকতে হবে। সকল শিক্ষার্থী একই মেধার অধিকারী নয় এবং সকলের ঝোঁক বা আকর্ষণও ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। কারও মেধা খুব তীক্ষ্ণ অপর কারও মেধা সাধারণ স্তরের। কেউ বিজ্ঞান মাধ্যমে বেশি মনোযোগী, কেউ সাহিত্য ও কলা চর্চায় আনন্দ পাবে, হয়তো বা কেউ প্রকৌশলী হতে চাইবে, আবার কেউ ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপার্জনের সহজ পথ হিসাবে হস্তশিল্প তথা ভোকেশনাল এডুকেশনও নিতে চাইবে। এই শিক্ষাব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট স্তরের শিক্ষার্থীদের মেধা ঝোঁক ও পছন্দ অনুযায়ী বিষয়ে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত অধ্যয়ন এমনকি গবেষণার সুযোগও রাখা হবে । শিক্ষার্থীদের মেধা চিহ্নিতকরণ এবং লালন তার ঝোঁক কোন কোন দিকে তা যাচাইয়ের প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে তাদেরকে প্রাথমিক স্তর থেকে পর্যায়ক্রমে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞানের ভাষা হিসাবে আরবি ও বর্তমান কালের আধুনিক বিষয়াদির মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি ভাষা, অংক ও বিজ্ঞান বিষয়াদি নির্বাচনের সুযোগ রাখা হবে। মূলত মাধ্যমিক স্তরে গিয়েই একজন ছাত্রের মেধা ও ঝোঁক সম্পর্কিত একটি ইংগিত পাওয়া যায় তাই পরবর্তী স্তরসমূহে যে পথ বেয়ে চলার জন্য তাকে সুযোগ করে দেয়া হবে।

২.২ (ছ) সমন্বিত জ্ঞান দানের ব্যবস্থাকরণ
একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো ইহা শিক্ষার্থীদের জন্য খণ্ডিত জ্ঞান দানের ব্যবস্থা করার পরিবর্তে সমন্বিত জ্ঞান দানের ব্যবস্থা করে, তথা বিশ্বের দৃশ্যমান বিষয়সমূহের বিভিন্নতার মাঝে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সমন্বিত উপলব্ধির সন্ধান দান করে। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতে সর্ববিধ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের একটি সুসংগত নকশা এবং একটি সমন্বিত জীবন পদ্ধতি প্রদান । (১০)

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এ শিক্ষাব্যবস্থায় তাই এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে যেন একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত লাভ করতে পারে এবং বিশিষ্টকরণের (Specialization) স্তরে প্রবেশ করার আগে জীবন ও জীবনের সমস্যাবলির প্রতি সুসংসহত দৃষ্টিকোণ অর্জন করতে পারে। ইসলাম জ্ঞানকে সমন্বিত ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও সামগ্রিক বলেই বিবেচনা করে। আল কুরআনই সমন্বিত জ্ঞানের উৎকৃষ্ট নমুনা। সেখানে রয়েছে আকিদা বিশ্বাসগত শিক্ষা, আদর্শিক দিকনির্দেশনা ইতিহাস বিশ্লেষণ, মনস্তত্ত্ব সৃষ্টি রহস্য, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তথ্যাবলি, সৌরজগৎ সম্পর্কিত বিবরণ ও পরকালে বিশ্বাসের যৌক্তিকতা এবং আখেরাতের বিস্তারিত ধারণা।


৩. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিরূপ হওয়া চাই?

৩.১ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয় সে প্রশ্নটির ফায়সালা হয়ে গেছে আজ থেকে ২০ বছর পূর্বে পবিত্র মক্কা নগরিতে অনুষ্ঠিত OIC কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে। প্রস্তাবটি নিম্নরূপ:

OIC এর বিভিন্ন সদস্য দেশে প্রচলিত দ্বি-মুখী শিক্ষাব্যবস্থার বিলুপ্তি সাধন করে তদস্থলে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। এই শিক্ষাব্যবস্থা হবে চরিত্রগতভাবে ইসলামী । (১১) বলা বাহুল্য বাংলাদেশও OIC এর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করে এবং উক্ত সিদ্ধান্তের শরিক দেশ। অতএব বাংলাদেশ নীতিগতভাবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অংগীকারবদ্ধ। উক্ত সম্মেলনে শুধু ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাতে শিক্ষা সংস্কার কমিটি নামক একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ঐ কমিটি পরবর্তী বছরগুলোতে যথাক্রমে ইসলামাবাদ, ঢাকা ও ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যসূচির একটি সুপারিশমালা প্রণয়নের কাজও সমাপ্ত করে।

ইতোমধ্যে OIC এর বিভিন্ন সদস্য দেশ ঐ সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশের সরকার অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়নে রীতিমত অনীহা প্রদর্শন করে। যদ্দরুন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিরূপ হবে সে প্রশ্ন এখনও একটি বিতর্কিত ইস্যু হয়ে রয়েছে।

৩.২ যেহেতু সরকারি উদ্যোগ ছাড়া একটি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প কিছু প্রবর্তন সম্ভব নয় তাই বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় এ প্রস্তাবনাগুলো চালু হওয়ার বিষয়টি সুদূর পরাহত। অতীব দুঃখজনক যে ইদানীং বাংলাদেশ সরকার এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন যা চালু হলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আদর্শিকভাবে হয়ে পড়বে পঙ্গু। ধর্মীয় দিক দিয়ে হবে চরম ধর্মহীন, চারিত্রিকভাবে দেউলিয়াপনা, দৃষ্টিকোণের দিক দিয়ে সংকীর্ণ জংলীবাদী এবং জ্ঞানার্জনে হয়ে পড়বে খণ্ডিত জ্ঞানের অধিকারী। আল্লাহ আমাদেরকে এ অবস্থায় থেকে মুক্তি দান করুন।

বর্তমানে দেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাটি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা হিসাবে পরিচিত। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি ভাষা ও সাহিত্য, কুরআন-হাদীস, ফিকাহ, আকাইদ, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অধ্যয়নের সুযোগ থাকলেও এ ব্যবস্থাটি একটি লক্ষ্যহীন গন্তব্যের পথে ধাবিত ও অসম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। সচেতন মহলের সকলেই এর একটি উত্তম বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করছেন। তাই প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থারই একটি বিকল্প প্রস্তাব আমি এখানে পেশ করার প্রয়াস পেলাম।


৪. প্রস্তাবিত বিকল্প ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও পাঠ্যসূচি

৪.১ প্রস্তাবিত এ শিক্ষাব্যবস্থায় নিম্নবর্ণিত চারটি স্তর থাকবে

৪.১ (ক) প্রাথমিক শিক্ষা স্তরঃ শিশু শ্রেণী ছাড়া ছয় বছর। (১ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত)
(খ) নিম্নমাধ্যমিক স্তর তিন বছর (সপ্তম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত)
(গ) উচ্চ মাধ্যমিক স্তর তিন বছর (১০ম থেকে ১২শ শ্রেণী)
(ঘ) ডিগ্রি স্তর তিন বছর
(ঙ) স্নাতকোত্তর দুই বছর। মোট ১৭ বছর।

তা ছাড়া কোন শিক্ষার্থী মাস্টারস ডিগ্রি অর্জনের পর গবেষণা করতে চাইলে তার জন্য এমফিল ও পিএইচডি মানের অধ্যয়ন এবং গবেষণার সুযোগ রাখা হবে।

৪.২ পাঠ্যসূচি সম্পর্কিত আলোচনা
প্রস্তাবিত এ শিক্ষাব্যবস্থার স্তর সমূহের মধ্যে শিশু শ্রেণীর কথা উল্লেখ করা হয়নি এবং এর কোন সিলেবাসও প্রস্তাব করা হচ্ছে না। কারণ এ স্তরটি মূলত শিশুদেরকে স্কুলের পরিবেশের সাথে পরিচিত করানোর সময় এবং খেলাধুলার মাধ্যমে বর্ণ ও রং সম্পর্কিত পরিচয় দানের মধ্যেই তাদের পাঠ সীমিত থাকে।

৪.২ (ক) প্রাথমিক স্তর
প্রাথমিক স্তরে প্রথম ৩ বছরের পাঠ্যসূচি থাকবে আরবি বর্ণ পরিচয়, বাংলা লিখন ও গঠন, বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণসহ কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা, ধারাপাত ও গণনা শিক্ষা, প্রয়োজনীয় কিছু দোয়া দরুদ ও অজু নামাজের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দান। ৩য় শ্রেণী থেকে ইংরেজি বর্ণমালা ও সহজ অংক যথা-যোগ বিয়োগ, গুণ ও ভাগ শিখানো হবে। পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে থাকবে বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ, ইংরেজি ও আরবি ভাষা, ইসলামিয়াত তথা আকাইদ ও ফিকাহ প্রশিক্ষণ, সমাজ ও পরিবেশ বিজ্ঞান, অংক ও ভূগোল ইত্যাদি । প্রাথমিক স্তরের সিলেবাসভুক্ত বিষয়াদির পাশাপাশি ব্যবহারিক আমল আখলাক শিক্ষা, শরীর চর্চা ও ব্যায়াম এবং শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য কিছু কুইজ জাতীয় বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৪.২ (খ) নিম্ন মাধ্যমিক স্তর (৭ম থেকে ৯ম শ্রেণী)
এ স্তরের পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে থাকবে : বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষা এবং ব্যাকরণ (প্রত্যেক ভাষায়), সাধারণ বিজ্ঞান, সমাজ, অংক, ইসলামের ইতিহাস, আকাইদ ও ফিকাহ শিক্ষা, তাজবিদ শিক্ষা, ভূগোল, বাংলাদেশের ইতিহাস (এদেশে মুসলমানদের আগমন ও তাদের শাসনকালে এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কেত বিবরণ সম্বলিত)।

আকাইদের পাঠ্যপুস্তক কুরআনের আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি সহকারে মৌলিক আকিদা বিশ্বাস তথা তৌহিদ ও রেসালত, পরকালে বিশ্বাস, নৈতিক মুল্যবোধ ও তাকওয়ার ধারণা ইত্যাদির ভিত মজবুত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পুস্তক রচনা করতে হবে।

ইসলামের ইতিহাসে মহানবী (সা) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও খোলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাস ৩ বছরের সিলেবাসভুক্ত থাকবে । ইসলামের ইতিহাস ঘটনাপঞ্জির নিরস বর্ণনা হিসাবে উপস্থাপন করার পরিবর্তে ইসলামের মহান আদর্শ এবং সভ্যতা সংস্কৃতি, জ্ঞান বিজ্ঞান ও আর্তমানবতার সেবায় এর বিশেষ অবদানসমূহের ওপর আলোকপাত করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রকৃতি বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু যেন না থাকে সে বিষয়ে বিশেষ নজর রাখতে হবে।

৪.২ (গ) উচ্চমাধ্যমিক স্তর (১০ম থেকে ১২ম শ্রেণী)

এ স্তরে পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে থাকবে।
বাংলা (২০০), আরবি (২০০), কুরআন (১০০), হাদীস (১০০), ইসলামের ইতিহাস ( ১০০ ) = মোট ৭০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক বিষয়। বাকি ৮০০ নম্বরের বিষয়ে নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার স্বাধীনতা থাকবে, যা আপন প্রতিভা ও পছন্দ অনুযায়ী নিম্নের যে কোন একটি গ্রুপ থেকে নির্বাচন করতে পারবে :

গ্রুপ-ক: ফিকহ ও উসুলে ফিকহ (২০০), আরবি ব্যাকরণ ও বালাগাহ (২০০), ইলুমুল হাদীস ও উলুমুল কুরআন (২০০), অর্থনীতি অথবা পৌরনীতি (২০০), বিদেশী ভাষা (ইংরেজি অথবা উর্দু অথবা ফারসি) (২০০)। উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে যে কোন ৪টি = মোট ৮০০ নম্বর।

গ্রুপ -খ: হিসাব বিজ্ঞান (২০০), বুক কিপিং ও অংক (২০০), অর্থনীতি অথবা পৌরনীতি অথবা সমাজ বিজ্ঞান (২০০), ইংরেজি (২০০) = ৮০০ নম্বর।

গ্রুপ-গ: রসায়ন (২০০), পদার্থ বিদ্যা (২০০), অংক অথবা জীব বিজ্ঞান (২০০), ইংরেজি (২০০) = ৮০০ নম্বর।

গ্রুপ- ঘ: অর্থনীতি (২০০), পৌরনীতি (২০০), সমাজ বিজ্ঞান (২০০), তর্কশাস্ত্র (২০০), কৃষি বিজ্ঞান (২০০), ফিকহ ও উসুলে ফিকহ (২০০), গার্হস্থ্য অর্থনীতি (২০০), মনোবিজ্ঞান (২০০)- এগুলোর যে কোন ৩টি তৎসহ ইংরেজি (২০০) = মোট ৮০০ নম্বর।

৮.২ (ঘ) ডিগ্রি স্তর : (৩ বছর)
ডিগ্রি স্তর সাধারণ ও সম্মান এ দুটো ধারায় বিভক্ত হতে পারে। তবে উভয় ধারায় এমন কিছু মৌলিক বিষয় বাধ্যতামূলক রাখা হবে যা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি ও তার মধ্যে ইসলামী সচেতনতা Awareness বৃদ্ধি আদর্শিক মনোন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। সাধারণ ও সম্মান উভয় কোর্সের সময়সীমা হবে ৩ বছর করে। তবে সাধারণ (পাস) কোর্সের জন্য শিক্ষাবর্ষ পদ্ধতি ও সম্মান (Hon's) কোর্সের জন্য সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হবে।

সাধারণ (পাস) কোর্সে ৩ বছরে মোট ১৫০০ নম্বর বিষয়ে অধ্যয়ন ও পরীক্ষা দিতে হবে। তন্মধ্যে বাধ্যতামূলক বিষয় হচ্ছে বাংলা (২০০), ইসলামের ইতিহাস (২০০), ইংরেজি অথবা আরবি (২০০) = মোট ৬০০। ঐচ্ছিক বিষয় সমূহের প্রত্যেকটিতে (৩০০ নম্বর) করে যে কোন ৩টি গ্রুপ নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে । এ গ্রুপগুলো হবে নিম্নরূপ :

সাধারণ: ক. হাদীস ও উলুমুল হাদীস খ. তাফসীর ও উলুমুল কুরআন, গ. ফিকহ ও উসুলুল ফিকহ (৩০০) ঘ. আকাইদ ও উসুলুল দ্বীন (৩০০) ঙ. অর্থনীতি (৩০০) চ. রাষ্ট্র বিজ্ঞান (৩০০) ছ. সমাজ বিজ্ঞান (৩০০) জ. মনোবিজ্ঞান (৩০০) ঝ. কৃষি বিজ্ঞান (৩০০) ঞ. ভুগোল (৩০০) ইত্যাদি।

বিজ্ঞান: ক. রসায়ন (৩০০ খ. পদার্থ (৩০০) গ. অংক (৩০০) ঘ. জীব বিজ্ঞান (৩০০), ঙ. মনোবিজ্ঞান (৩০০) চ. পরিসংখ্যান (৩০০) ছ. আকাইদ ও উসুলুল দ্বীন (000) I

বাণিজ্য: ক. বাণিজ্য বিষয়ের যে কোন ৩টি, তবে কেউ ইচ্ছা করলে এর একটি বিষয়ে হিসাবে বিজ্ঞান গ্রুপের অনুরূপ আকাইদ ও উসুলুল দ্বীন বিষয়ও গ্রহণ করতে পারবে।

৪.২ ঙ. স্নাতক সম্মান কোর্স
স্নাতক সম্মান কোর্স অধ্যয়নের ব্যবস্থা থাকবে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ও নির্দিষ্ট কয়েকটি মাদ্রাসায় মাত্র । এ কোর্সে সেমিস্টার পদ্ধতি ও ক্রেডিট আওয়ার পদ্ধতি (Credit Hour System) অনুকরণ করা হবে। এ কোর্সে মোট ৬টি সেমিস্টারে ৩০টি বিষয়ে অধ্যায় সমাপ্ত করতে হবে। তন্মধ্যে ১০ টি বিষয় মৌলিক (Basic Compulsory Subject) বাধ্যতামূলক বিষয় থাকবে। যথা: আরবি ভাষার ২টি, প্রতিটি (১০০) নম্বর করে (২ সেমিস্টার), ইংরেজি ভাষার ২টি, প্রতিটি (১০০) নম্বর করে (২ সেমিস্টার), ইসলামের ২টি, প্রতিটি (১০০) নম্বর করে (২ সেমিস্টার), বাংলাদেশ স্টাডিজ ২টি, প্রতিটি (১০০) নম্বর করে (২ সেমিস্টার), আধুনিক মুসলিম পরিস্থিতি ২টি; প্রতিটি (১০০) নম্বর করে (২ সেমিস্টার)।

বাকি ২০টি বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগের অধীনে নির্ধারিত হবে। সম্ভাব্য বিভাগ সমূহের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।
১. উলুমুল কুরআন এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
২. আল হাদীস এবং উলুমুল হাদীস বিভাগ
৩. আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
৪. আকাইদ ও উসুল দ্বীন বিভাগ
৫. আল ফিকাহ ওয়া উসুল আল ফিকাহ বিভাগ
৬. প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিভাগ
৮. প্রায়োগিক বিজ্ঞান বিভাগ
৯. চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগ
১০. কম্পিউটার সায়েন্স এবং টেকনোলজি বিভাগ
১১. বিজনেস এউমিনিস্ট্রেশন বিভাগ ইত্যাদি।

(শেষোক্ত ৫টি বিভাগ সকল প্রয়োজনীয় প্রাথিমক প্রস্তুতি ব্যবস্থাকরণ সাপেক্ষে খোলার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে)

৪.২ (চ) স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পর্ব
স্নাতকোত্তর পর্বের দুই বছরের প্রথম বর্ষে কোর্স সিস্টেম এবং দ্বিতীয় পর্বে গবেষণা অভিসন্দভ (Reasearch Dissertation) প্রস্তুত করার মাধ্যম এ কোর্স চালুর সুপারিশ করা হচ্ছে। ১ম পর্বের দুই সেমিস্টারে মোট (১০০০) নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে এবং গবেষণা অভিসন্দর্ভের জন্য থাকবে ৫০০ নম্বর। মোট ১৫০০ নম্বর। তা ছাড়া যদি বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে অথবা শিক্ষাবর্ষ শেষে পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেও এম, এ করার সুযোগ রাখা যেতে পারে।

৪.৩ কেন্দ্রীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও সনদের নাম ও মান
প্রস্তাবিত এ শিক্ষাব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে যথাক্রমে

৪.৩ (ক) প্রাইমারি সনদ পরিক্ষা: (Primary Certificate Exam.) এ পরিক্ষা ৬ষ্ঠ শ্রেণী সমাপনান্তে অনুষ্ঠিত হবে, আর এ পরীক্ষা হবে বাধ্যতামূলক ।

৪.৩ (খ) নিম্ন মাধ্যমিক সব পরীক্ষা: (Lower Secondary Certificate Exam.) এ পরিক্ষা ৯ম শ্রেণী সমাপনান্তে অনুষ্ঠিত হবে এবং এ পরীক্ষা একটি বাধ্যতামূলক গণ পরীক্ষা (Compulsory Public exam.)

৪.৩ (গ) উচ্চমাধ্যমিক সনদ পরীক্ষা: (Higher Secondary Certificate Exam.)- এ পরীক্ষা ১২শ সমাপনান্তে অনুষ্ঠিত হবে এবং এ পরীক্ষা একটি বাধ্যতামুলক গণ পরীক্ষা (Compulsory Public exam.)

৪.৩ (ঘ) স্নাতকোত্তর পর্ব পরীক্ষা (Post Graduate Course Exam.) এ পরীক্ষা প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদান করা হবে।

৪.৩ (ঙ) স্নাতকোত্তর গবেষণা কর্মসূচি (Post Graduate Research Program) আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণের পর আগ্রহী গবেষকদের জন্য এম. ফিল এবং পি.এইচ,ডি, পর্যায়ে গবেষণার দ্বারা উন্মুক্ত রাখা হবে। আর যারা বিদেশে গিয়ে উচ্চতর স্তরে গবেষণা কর্ম অব্যাহত রাখতে চান তাদের সুবিধার্থে বিভিন্ন পর্যায়ের সনদসমূহকে বিদেশী সনদের সমমান দানের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।


৫. সনদ প্রদানকারী কৃর্তপক্ষ
এ প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত প্রশাসনিক পবিরর্তন সাধনা করতে হবে

৫.১ বর্তমানে বিদ্যমান বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে একটি ইনস্টিটিউটে পরিণত করতে হবে। এর নামকরণ করা হবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক এডুকেশন। এ ইনস্টিটিউট প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের এফিলিয়েশন দান করবে এবং সরাসরি পরীক্ষাসমূহ নিয়ন্ত্রণ করবে। ৫.২ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এর ফ্যাকাল্টি অব শরিয়াহ এবং ইসলামিক স্টাডিজকে ঢাকায় স্থানান্তর করে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় তা পুনঃস্থাপন করতে হবে। ৫.৩ ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি পরীক্ষাসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীনে এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসাবে উপরে বর্ণিত ইনস্টিটিউট নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবে।

তবে ডিগ্রি ও মাস্টার্স লেভেলে প্রতিষ্ঠানসমূহের এফিলিয়েশন ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ের দায়িত্ব পালন করবে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়। এম. ফিল এ ডক্টরেট লেভেলের গবেষণা কর্ম শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়েই পরিচালিত হবে।


৬. সার্টিফিকেটের নাম ও মান প্রসংগে
এ প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় পরীক্ষা ও সনদসমূহকে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল ইত্যাদি নামে অভিহিত করার পরিবর্তে তদস্থলে প্রাইমারি বা ইবতেদায়ী পরীক্ষার সনদ /নিম্ন মাধ্যমিক বা মুতাওয়াসসিতা পরীক্ষার সনদ /উচ্চ মাধ্যমিক বা সানাভিয়া উলিয়া পরিক্ষার সনদ, ডিগ্রি (বি. এ. সাধারণ/শরিয়াহ/কুরআন ওসুন্নাহ/ আকীদাহ ও দাওয়াহ/কৃষি ইত্যাদি) পাশ বা সম্মান নামে অভিহিত হবে এবং অনুরূপভাবে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য গ্রুপের সনদকেও যথাক্রমে বি. এস.সি (সম্মান বা পাস) এবং বি. কম (সম্মান বা পাস) ডিগ্রি বলা হবে।

বর্তমানে যেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মাঝপথে কলেজে পাড়ি জমাবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এ প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পাশ করার পূর্বে ছাত্রদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কোন সুযেগাই থাকবে না। তদুপরি বর্তমান ফাজিল শ্রেণীর স্থলে ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্সের প্রস্তাব করায় ছাত্ররা অন্তত বিশ্বাস করতে পারবে যে, তাদের সনদও মানসম্পন্ন এবং গ্রহণযোগ্য হবে।


৭. পরীক্ষা পদ্ধতি
বর্তমানে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিকে আরো সহজতর করতে হবে। একটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি থেকে নিয়ে ফল প্রকাশিত হওয়া এবং পরবর্তী স্তরে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত ছাত্রদের এক একটি বছর করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক । পরীক্ষার প্রস্তুতি থেকে ফল প্রকাশ পর্যন্ত সময়সীমা ৩/৪ মাসের অধিক হওয়া কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। পরীক্ষার নামে ছাত্রদের জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় রোধকল্পে এ শিক্ষাব্যবস্থায় দু'বছর অন্তর গণপরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে ৩ বছরের মাথায় গিয়ে এক সাথে অনেক বিষয়ের পরীক্ষা দান যেন বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য নিম্ন মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত প্রতি বছরান্তে সে বছরের অধীত বিষয়াদির পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এ পরীক্ষার জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা কিংবা পরবর্তী শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার পূর্ব শর্ত স্বরূপ ফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কোন ছাত্র সংগত কারণে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে অথবা কোন বিষয়ে অকৃতকার্য হলে কিংবা কম নম্বর পেলে তার জন্য পরবর্তী বছরের উক্ত বিষয়ের পরীক্ষায় পুনরায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে।


৮. পাঠ্যসুচি নির্ধারণ ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন

৮.১ উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শ্রেণীসমূহের পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশনের অধীনে একটি কমিটি থাকবে, উক্ত কমিটি বিভিন্ন সময়ে বৈঠকে মিলিত হয়ে পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও মান পরীক্ষা করবে।

৮.২ ডিগ্রি ও মাস্টার্স পর্বের পাঠ্যসূচি ও রেফারেন্স ইত্যাদি নির্ধারণ করবে বিশ্ববিদ্যালয়।


তথ্যসূত্র:
১. প্রফেসর খুরশীদ আহমদ ইসলামী শিক্ষার মূলনীতি (বাংলা সংস্করণ) পৃষ্ঠা : ৭ (ঈষৎ পরিবর্তিত)
২. প্রাগুক্ত ; পৃষ্ঠা ১০ (ঈষৎ পরিবর্তিত)
৩. প্রাগুক্ত ; পৃষ্ঠা ১০ (পরিবর্তিত)
৪. প্রাগুক্ত ; পৃষ্ঠা ১২-১৩
৫. ইকবাল ; বাংগে দায়া
৬. আল কুরআন : আল ইমরান -১৯
৭. আল কুরআন : আলে ইমরান -১৬৪
৮. ইসলামী শিক্ষার মুলনীতি-২১
৯. প্রাগুক্ত - ২২
১০. প্রাগুক্ত-২०
১১. দেখুন ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনের দলিল।


লেখক: প্রো- ভাইস চ্যান্সেলর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।