যাদের অজস্র ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের এই কাফেলা - ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন
ইসলামী ছাত্রশিবির কোনো নতুন মতবাদ, ধ্যানধারণা নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়নি, এটা ১৯৭৭ সালে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো সংগঠনও নয়। এটা সেই পথ, যে পথে রাসূল (সা.) এবং সালফে সালেহিনরা যুগে যুগে সংগ্রাম করে গেছেন। এরই পথ পরিক্রমায় বিংশ শতাব্দীর ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বপ্নদ্রষ্টা মাওলানা মওদূদী (রহ.)-এর প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী জমিয়তে তালাবা পাকিস্তান-যা বাংলাদেশে পরিচিত ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ হিসেবে।
ছাত্রসংঘের প্রথম সভাপতি ছিলেন জাফরুল্লাহ খান। পরবর্তীকালে আমার প্রিয় আব্বা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৬৯ সালে নিখিল পাকিস্তান জমিয়তে তলাবার নাজিমে আলা তথা ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন প্রথম ও সর্বশেষ বাঙালি কেন্দ্রীয় সভাপতি। সেই সময়ে পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যেদর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন, যা পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যা থেকে অনেক কম। তা সত্ত্বেও আব্বু নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। আব্বুর পশ্চিম পাকিস্তানের কলিগরা তাকে উপহাস করে বখতিয়ার খিলজির সাথে তুলনা করতেন, যিনি ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে বাঙলা বিজয় করেছিলেন।
আমরা সেই সময়ের কথা বলছি, যখন পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছিল। দেশ কার্যত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদের পঙ্কিলতা সংগঠনকে স্পর্শ করতে পারেনি। এই সংগঠনের শুরুই হয়েছিল আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদকে চ্যালেঞ্জ করে, হারাম ঘোষণা দিয়ে। এই প্রসঙ্গে আরও আলাপ আছে, যা আরেক সময় করা যাবে। যাহোক,আব্বু পূর্বপাক ছাত্রসংঘের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে উনার প্রিয় সাথিঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেকের শাহাদাতের মাধ্যমে শহিদি মিছিলের যাত্রা শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় আব্বুও সে মিছিলে শামিল হন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আব্বু ছাত্রসংঘ থেকে বিদায় নেন। আব্বু মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখার পরও কামিলে (মাস্টার্স) ফিকহ বিভাগ থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তাই ছাত্রজীবন শেষে সংগঠন আব্বুকে গবেষণার কাজের দায়িত্ব দেয়। আব্বুর কর্মজীবন শুরু হয় ইসলামী রিসার্চ একাডেমির রিসার্চ ফেলো ও সংগ্রামের সাংবাদিক হিসেবে। মাওলানা মওদূদী (রহ.) এ কথা জানতে পেরে রাগান্বিত হন। তিনি বলেন ‘যে তলোয়ারকে আমরা তৈরি করলাম এবং ধার দিলাম ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য, সেই তলোয়ারকে তোমরা রান্নাঘরে বঁটি হিসেবে ব্যবহার করবা?’ মওলানার এই উক্তি আব্বুর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তার পরবর্তী জীবন-ইতিহাস আমরা সবাই জানি।
এরপরে আসে ১৯৭১ সাল। বাঙলার জমিনে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মওদূদী (রহ.)-এর হাতে গড়া কর্মীরা হাল ছেড়ে দেননি। এই শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মাখদুমের পুণ্যভূমিতে ইসলামকে আবারও জাগিয়ে তোলার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ শুরু করেন তারা। ছাত্রসংঘের সাবেক ও বর্তমান কর্মীরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। শুরুর দিকে নেতৃবৃন্দ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিলেন। আব্বু ও সরদার আব্দুস সালাম চাচাসহ নেতৃবৃন্দের একাংশ ছিলেন রাজশাহীতে আর মুজাহিদ চাচা নারায়ণগঞ্জে। বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রথম সভাপতি ছিলেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ চাচা। তারপরে এই সংগঠনে পর্যায়ক্রমে নেতৃত্ব দেন জনাব আবু নাসের মুহাম্মদ আব্দুজ জাহের এবং শহীদ মীর কাসেম আলী চাচারা। ১৯৭৫ সালে যখন শেখ মুজিবের পতনের মাধ্যমে জুলুমতন্ত্রের তথা বাকশালের অবসান ঘটে, তখন ইসলামী আন্দোলন প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পায়। আব্বু ১৯৭৬ সালে ঢাকায় চলে আসেন, মীর কাসেম আলী চাচা চট্টগ্রাম থেকে বাবা এবং মা-কে নিয়ে পিলখানার একটি বাসায় ওঠেন। তখন জামায়াতের গুটিকয়েক মানুষের ঢাকায় নিজস্ব বাসা ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল গোলাম আযম চাচার পি.এস নাজমুল হক চাচার আব্বার বাসা। এটা ছিল বাসাবোতে। বাসার নাম ছিল হইচই। যতদূর শুনেছি, এই বাসাটাই ছিল তখনকার দারুল আরকাম। তখন ময়মনসিংহ থেকে সবার খালাম্মা সাংগঠনিক কারণেই হইচইতে এসে ওঠেন। কামরুজ্জামান চাচাও এলাকাসূত্রে একই বাসায় ওঠেন। তাদের সবারই তখন টানাপোড়েনের সংসার, কিন্তু হৃদয় ছিল অনেক বড়ো। সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তো ছিলই। আব্বু যখন ঢাকায় আসেন, তখন ইউনুস চাচা উনার বাংলো দুয়ারের দুই রুমের বাসা আব্বুর জন্য ছেড়ে দেন। সেই বাসার এক রুমে আব্বু-আম্মুর সংসার আর আরেক রুমে সংগঠনের অফিস। প্রোগ্রামগুলোতে আপ্যায়ন হিসেবে থাকত পুরান ঢাকার সস্তা ডালপুরি আর চা। আম্মুর কাছে শুনেছি, চায়ের কাপ ছিল একটাই। সেই কাপেই একজন একজন করে পালাক্রমে চা খেতেন। আব্বুর কোনো আপন ভাই ছিল না। আমরা ছোটোবেলায় মুজাহিদ চাচা, কামরুজ্জামান চাচা ও মোল্লা চাচা মীর কাসেম আলী চাচাকে আপন চাচা মনে করতাম। আমাদের অধিকাংশের বাসা পাশাপাশি হওয়ায় আমাদের বেড়ে ওঠা এই সোনার মানুষদের দেখে দেখেই। যাহোক, সবাই তখন প্রকাশ্যে সংগঠনের আলোচনা করছেন। ছাত্র-সংগঠনের নাম কী হবে, এই নিয়ে সবাই একটু দ্বিধান্বিত ছিলেন। ছাত্ররা মরহুম সিদ্দিক জামাল চাচার কথামতোছাত্রশিবির নামটি প্রস্তাব করল। মাওলানা মওদূদী (রহ.) তখনও জীবিত, তাই ঠিক
হলো- তার সাথে পরামর্শ করেই নামচূড়ান্ত করা হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মীর কাসেম আলী চাচা ওমরায় গেলেন। ওমরা থেকে ফেরার পথে মাওলানার সাথে দেখা, পরামর্শ ও দুআ নিয়ে এলেন। মাওলানা মওদূদী(রহ)-এর পরামর্শের সারকথা ছিল, আসল উদ্দেশ্য তো ময়দানে কাজ করা; সেটা যে নামেই হোক। তার পরামর্শের ভিত্তিতে সংগঠনের নাম চূড়ান্ত হলো ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’। ১৯৭৭ সালের এই দিনে মীর কাসেম আলী চাচা, নাসের চাচা সকালে আমাদের বাসায় এলেন। তিনি আম্মুর জন্য ওমরাহ থেকে লাল রঙের একটি জায়নামাজ নিয়ে এসেছিলেন। আম্মু খিচুড়ি রান্না করেছিলেন। সবাই মিলে খিচুড়ি খেয়ে টিএসসিতে কেন্দ্রীয় মসজিদে গেলেন এবং শিবির প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলেন।
এই সেই ইসলামী ছাত্রশিবির, শুরুতে যার সদস্য ছিল ছয়জন। আজ সেই শিবির লাখো তরুণের ইসলাম শেখার পাঠশালা। এই অঞ্চলের ছাত্রাঙ্গনে পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্টদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়, যার বিষাক্ত থাবায় আমাদের কয়েক প্রজন্ম ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছে। ৬০-৭০ দশকে ছাত্রদের হাতে রেডবুক রাখা ছিল একধরনের ফ্যাশন। মেধাবী ছাত্র মানেই ছাত্র ইউনিয়নের কমরেড আর খারাপ ছাত্ররা ছাত্রলীগের গুন্ডাপান্ডা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আশির দশকে ছাত্রাঙ্গনে এই নাস্তিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আল্লাহর রহমতে আর শিবিরের কর্মতৎপরতায় কালের পরিক্রমায় আজকাল হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও এককালের প্রতাপশালী কমিউনিস্ট ছাত্র ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই। তারা এখন ছাত্রলীগের কাঁধে ভর করে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। আধুনিক শিক্ষিত ছাত্ররা ৭০-৮০-এর দশক থেকে ইসলাম শিখেছে ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে। সেই সময়ে এত ইসলামী বই বা লেকচার বাংলা ভাষায় পাওয়া যেত না। জামায়াত-শিবিরই এ দেশে আধুনিক শিক্ষিতদের জন্য সাহিত্য রচনা শুরু করে এবং ব্যাপকভাবে তা প্রচার করে। ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের সীমাহীন ত্যাগ আর কুরবানির ফলে এই প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আল্লাহর রহমতে ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করেছে।
শিবিরের এ অর্জন আমাদের জন্য নিছক গর্বের বিষয় নয়; বরং এটা আল্লাহর এক বিশাল রহমত এবং একটা বিরাট দায়িত্ব। যারা এক সময়ে শিবিরের নেতা-কর্মী ছিলেন, এখনও শিবিরকে ভালোবাসেন,অতীতের কথা ভেবে নস্টালজিয়ায় ভোগেন, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে একটু দূরে সরে গেছেন, সাংগঠনিক ভাষায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন; তারা আল্লাহর ওয়াস্তে একটু চিন্তা করে দেখুন- একজন শিবিরের সদস্যের পেছনে সংগঠনের কতটা সময় এবং রিসোর্স ব্যয় করা হয়। আপনি যার টার্গেট ছিলেন, সেই ভাইটি দিনের পর দিন আপনার কাছে এসেছেন, ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন; অপমানিত হয়েছেন, তারপরও আপনাকে ভালোবেসেছেন। আমি এক দায়িত্বশীলের কথা জানি, যিনি তার টার্গেটকৃত ভাইটিকে ফজরের জামাতে শামিল করতে নিয়মিত কয়েক মাইল হেঁটে কাদা-পানি ভেঙে কাকডাকা ভোরে তার বাড়িতে হাজির হতেন। এরপর যখন আল্লাহ আপনাকে কবুল করলেন, তখন ধাপে ধাপে সংগঠন আপনাকে প্রশিক্ষণ দিলো, হাতে-কলমে শিক্ষা দিলো, আপনি হয়ে উঠলেন মাওলানা মওদূদী (রহ.)-এর ভাষায় সেই তলোয়ার, যাকে প্রস্তুত করা হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের ময়দানে কাজ করার জন্য। আমরা কি আজ রান্নাঘরের বঁটি হয়ে বসে থাকব? শিবিরের প্রথম সভাপতি-সহ অসংখ্য নেতা-কর্মীরা নিজেদের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের পথ থেকে একচুল সরে যাননি। শহিদ মীর কাসেম আলী শাহাদাতের পূর্বে বলেছিলেন, শপথের দাবি পূর্ণ করে গেলাম। আমরা তাদেরই উত্তরসূরি। কাজেই আসুন, আমরা ততুন করে শপথ নিই। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, যে নামেই কাজ করি না কেন, ইসলামী আন্দোলনের পথে যেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকতে পারি। মহান আল্লাহ যেন এই পথেই চলা অবস্থায় তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার তাৗফিক দেন। আমিন।
লেখক : শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে
নতুন নতুন প্রবন্ধ পড়তে ভিজিট করুন>>