নিয়তের পরিশুদ্ধতা - মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক
حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الزُّبَيْرِ، قَالَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الأَنْصَارِيُّ، قَالَ أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَلَى الْمِنْبَرِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ .
সরল অনুবাদ : আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস আল লাইসী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উমর ইবনুল খাত্তাবকে (রা) মসজিদের মিম্বারে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, নিশ্চয়ই যাবতীয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই প্রাপ্ত হয় যা সে নিয়ত করে। কাজেই কারো হিজরত যদি হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে তাহলে সেটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই পরিগণিত হবে। আর কারো হিজরত যদি হয় দুনিয়ার কোনো সুখ-শান্তি বা সুবিধা-স্বার্থ হাসিলের জন্য অথবা কোনো নারীকে বিবাহের জন্য তাহলে তার সে উদ্দেশ্যই অর্জন হবে যে উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫০৩৬; আল জামিঈ লিত তিরমিযী, হাদিস নং ১৬৪৭; সুনানু আবী দাঊদ, হাদিস নং ২২০৩; সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪২২৭; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ১৬৮, ৩০০; সুনানুন নাসাঈ, হাদিস নং ৭৫, ৩৪৩৭, ৩৭৯৪; শারহু মাআনিল আছার, হাদিস নং ৪২৯৩, ৪২৯৪).
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম-পরিচয় : হাদিসটির বর্ণনাকারী হলেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)। তাঁর মূল নাম উমর। উপনাম আবু হাফস। উপাধি আল ফারুক। পিতার নাম খাত্তাব। মাতার নাম হানতামা বিনতে হাশিম ইবনে মুগীরা।
জন্ম : ৫৮৩ খৃস্টাব্দে তাঁর জন্ম। রাসূলের চেয়ে তিনি ১৩ বছরের ছোট ছিলেন। হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর।
প্রাথমিক জীবন : বাল্যজীবনে উমর ইবনুল খাত্তাব পিতা-মাতার আদরে লালিত পালিত হন। একটু বড় হয়েই তিনি পিতাকে উট চরাতে সাহায্য করেন। যৌবনের প্রারম্ভে যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তিবিদ্যা, প্রখর স্মরণশক্তি, বক্তৃতা এবং নসবনামা শিক্ষা লাভ করে তিনি অত্যন্ত আত্ম-প্রত্যয়ী যুবক হিসেবে বেড়ে উঠেন।
ইসলাম কবুল : তাঁর ইসলাম কবুলের ব্যাপারে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) দোয়া করেছিলেন। সহিহ হাদীসে এসেছে,
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عنهما أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اللَّهُمَّ أَعِزَّ الْإِسْلَامَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِأَبِي جَهْلٍ أَوْ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَكَانَ أَحَبُّهُمَا إِلَى اللَّهِ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ.
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, হে আল্লাহ! আবু জাহল কিংবা উমর ইবনুল খাত্তাব- এ দুজনের মাঝে তোমার নিকট যিনি বেশি প্রিয়, তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে মজবুত করো এবং মর্যাদা দান করো। রাবী বলেন, ঐ দুজনের মাঝে উমর ইবনুল খাত্তাবই (রা) আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হিসেবে বিবেচিত হন।’ (জামিউত তিরমিযী, হাদিস নং ৩৬৮১, ৩৬৮৩; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ৫৬৯৬)
ওমর (রা)-এর ইসলাম কবুলের বিষয়ে আরো বর্ণিত আছে,
خلاصة الروايات مع الجمع بينها ـ في إسلامه رضي الله عنه أنه التجأ ليلة إلى المبيت خارج بيته، فجاء إلى الحرم، ودخل في ستر الكعبة، والنبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قائم يصلي، وقد استفتح سورة {الْحَاقَّةُ} ،فجعل عمر يستمع إلى القرآن، ويعجب من تأليفه، قال فقلت أي في نفسي هذا والله شاعر، كما قالت قريش، قال فقرأ {إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيلًا مَا تُؤْمِنُونَ} [الحاقة: ৪০، ৪১] قال قلت كاهن . قال {وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ تَنزِيلٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ} إلى آخر السورة [الحاقة :৪২، ৪৩] . قال فوقع الإسلام في قلبي .
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত বিবরণাদির সমন্বিত সারসংক্ষেপ হচ্ছে, এক রাতে তাঁকে বাড়ির বাইরে অবস্থানের মধ্য দিয়ে রাত যাপন করতে হয়। তিনি হারামে প্রবেশ করেন এবং কাবা গৃহের পর্দার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন সালাতে মগ্ন হন। সালাতে তিনি সূরা হাক্কাহ তিলাওয়াত করছিলেন। উমর নীরবে গভীর মনোযোগের সাথে তিলাওয়াত শ্রবণ করলেন এবং এর আলংকারিক ঝংকার, বাক্য বিন্যাস ও সুর-মাধূর্যে মুগ্ধ, চমৎকৃত ও হতবাক হয়ে গেলেন। বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর কসম! কুরাইশরা যেমনটি বলে থাকেন তিনি হচ্ছেন কবি। এসময় নবী (সা) তিলাওয়াত করলেন, ‘অবশ্যই এ কুরআন এক মহাসম্মানিত রাসূল {জিবরাঈল} এর বহন করে আনা বাণী। তা কোনো কবির কথা নয়, তোমরা তা বিশ্বাস করো না।’ (সূরা আল হাক্কা, আয়াত: ৪০-৪১) উমর বললেন, এটা তো আমার মনে মনে বলা কথা, সে কী করে তা জানল? নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সা) মন্ত্রতন্ত্রধারী গণক। আমার মনে এ ভাব উদয় হওয়ার পরই মুহাম্মাদ (সা) তিলাওয়াত করলেন, ‘এটা কোনো গণকের কথা নয়, যদিও তোমরা নসিহা গ্রহণ করো না। এটা বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ বাণী।’ (সূরা আল হাক্কা, আয়াত: ৪২-৪৩) এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) পুরো সূরা তিলাওয়াত করলেন। এ প্রসঙ্গে উমর (রা) বলেছেন যে, সে সময় ইসলাম আমার অন্তররাজ্যে স্থান অধিকার করে বসল।’ (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃ: ৭৯-৮০; তারীখু ওমর ইব খাত্তাব, পৃ: ৬)
নবুয়তের ষষ্ঠ সালে বীরদর্পে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে গিয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর মাধ্যমে মুসলিমদের সংখ্যা চল্লিশ পূর্ণ হয়। অতঃপর তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে আল ফারুক উপাধিতে ভূষিত করেন। কেননা তাঁর ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে হক্ব ও বাতিলের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য সূচিত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, যতদিন পর্যন্ত উমর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেননি ততদিন পর্যন্ত আমরা কাবাগৃহের নিকট সালাত আদায় করতে সাহস করিনি। (মুখতারুস সীরাহ, পৃ: ১০৩)
ফারুক উপাধি : ইসলাম কবুলের প্রেক্ষিতে তাঁর সাহসিকতার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে ফারুক বা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্ণিত আছে,
عن ابن عباس رَضِيَ اللَّهُ عَنْهما قال سألت عمر بن الخطاب لأي شيء سميت الفاروق؟ قال أسلم حمزة قبلى بثلاثة أيام ثم قص عليه قصة إسلامه. وقال في آخره قلت أي حين أسلمت يا رسول الله، ألسنا على الحق إن متنا وإن حيينا ؟ قال ( بلى، والذي نفسي بيده، إنكم على الحق وإن متم وإن حييتم)، قال قلت ففيم الاختفاء؟ والذي بعثك بالحق لنخرجن، فأخرجناه في صفين، حمزة في أحدهما، وأنا في الآخر، له كديد ككديد الطحين، حتى دخلنا المسجد، قال فنظرت إلىّ قريش وإلى حمزة، فأصابتهم كآبة لم يصبهم مثلها، فسماني رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ (الفاروق) يومئذ .
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাবকে (রা) প্রশ্ন করা হলো, আপনাকে ফারুক নামে কেন নামকরণ করা হয়? তিনি বলেন, হামযা (রা) আমার তিনদিন পূর্বে ইসলাম কবুল করেন। তারপর তিনি তার ইসলাম কবুলের ঘটনা বর্ণনা করে শেষে বললেন যে, আমি যখন ইসলাম কবুল করলাম, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমরা কী সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নই, যদি জীবিত থাকি কিংবা মরে যাই? তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, অবশ্যই! সেই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমরা যদি জীবিত থাকো কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হও, হক্ব বা সত্যের ওপরই তোমরা থাকবে। তখন আমি বললাম, তাহলে গোপনীয়তার আর কী প্রয়োজন? সেই সত্ত্বার কসম যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আমরা অবশ্যই গোপনীয়তা পরিহার করে বাইরে বের হব। তারপর আমরা দুই সারি বেঁধে রাসূলুল্লাহকে (সা) দুই সারির মধ্যে নিয়ে বের হলাম। এক সারির শিরোভাগে হামযা (রা) আর অন্য সারির শিরোভাগে ছিলাম আমি (উমর রা.)। আমাদের চলার কারণে রাস্তায় যাঁতার আটার মতো হালকা ধূলি কণা উড়ে যাচ্ছিল। এভাবে যেতে যেতে আমরা মসজিদুল হারামে গিয়ে প্রবেশ করলাম। উমর (রা) বলেন, কুরাইশরা যখন আমাকে এবং হামযাকে মুসলিমদের সাথে দেখল, তখন মনে মনে তারা এতো আঘাতপ্রাপ্ত হলো যে, এমন আঘাত ইতোপূর্বে আর কখনো পায়নি। সেদিনই রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ফারুক উপাধি দিয়েছিলেন।’ (আর রাহীকুল মাখতুম, ১ম খ-, পৃ: ৮০-৮১; কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল, হাদিস নং ৩৫৭৪২)
খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ : প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর ইন্তিকালের পর হিজরি ১৩ সালের ২৩ জুমাদাল আখিরা মাসে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সাড়ে দশ বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালনের পর তিনি শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর শাসনামলে প্রায় ১৩০৬টি রাজ্য বিজিত হয়। তিনিই সর্বপ্রথম হিজরি সাল গণনা চালু করেন। সামরিক কেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা বাহিনী গঠন, কাজীর পদ সৃষ্টি ও বিধর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মোটকথা, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তিনিই বাস্তব ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
হাদিস বর্ণনার সংখ্যা : প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় তিনি হাদিস বর্ণনায় তেমন বেশি অবদান রাখতে পারেননি। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৯টি। সহিহুল বুখারীতে এককভাবে ৯টি এবং সহিহ মুসলিমে এককভাবে ১৫টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি অনেক হাদিস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদের নিকট প্রেরণ করেন। জনসাধারণকে হাদিস শিক্ষা প্রদানের জন্য তিনি বড় বড় সাহাবীদেরকে বিভিন্ন রাজ্যে পাঠান। সেখানে তাঁরা হাদীসের প্রশিক্ষণ দিয়ে হাদিস শাস্ত্রের বড় বড় মুহাদ্দিস তৈরি করেন। হাদিস রিওয়ায়াতের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের জন্য তিনি মজবুত নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
শাহাদতবরণ : হিজরি ২৩ সালের ২৪শে যিলহাজ্জ বুধবার মসজিদে নববীতে সালাতের ইমামত করার সময় মুগীরা ইবন শু‘বার কৃতদাস আবূ লু’লু’ তাঁকে বিষাক্ত তরবারি দিয়ে আঘাত করলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তিন দিন পর ২৭ জিলহজ শনিবার তিনি শাহাদাতবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
হাদিসটির প্রেক্ষাপট
হাদিসটির শানে উরুদ সম্পর্কে বর্ণিত আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আমিনা উম্মু কায়িস নামের এক মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ঐ মহিলা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের শর্তে বিয়েতে রাজি হয়েছিল এবং লোকটি হিজরত করেন। যেখানে সাহাবীগণ আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হিজরত করেছেন সেখানে এ লোকটি হিজরত করেছে বিবাহের উদ্দেশ্যে। নবী করীম (সা) এ ঘটনাটি অবগত হওয়ার পর এ হাদিসটি অবতারণা করেন এবং বলেন যাবতীয় কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।
আলোচ্য বিষয়
হাদিসটিতে নিয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ যে নিয়তে কোনো কাজ করে সে আলোকেই সে কাজের ফলাফল পায়। যে কোনো কাজের মাধ্যমে বৈষয়িক কোনো স্বার্থ প্রত্যাশা করলে তাই অর্জিত হয়। আর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সন্তুষ্টি চাইলে তাই অর্জিত হয়। লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ব্যতিক্রম চাওয়াও অন্যায় এবং পাওয়াও অসম্ভব। বিশেষ করে মৌলিক ইবাদাতের ক্ষেত্রে এই লক্ষ্য উদ্দেশ্যের কোনোরূপ ব্যত্যয় ইসলামে অনুমোদিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ .
আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দ্বীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই ‘ইবাদাত করে।’ (সূরা আল বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
إِلاَّ الَّذِينَ تَابُواْ وَأَصْلَحُواْ وَاعْتَصَمُواْ بِاللّهِ وَأَخْلَصُواْ دِينَهُمْ لِلّهِ فَأُوْلَـئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللّهُ الْمُؤْمِنِينَ أَجْراً عَظِيماً .
‘তবে তাদের মধ্যে যারা তাওবা করবে, নিজেদের কার্যাবলি সংশোধন করে নেবে, আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধারণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিজেদের দ্বীনকে খালিস করে নেবে তারা ঐসব লোক যারা মুমিনদের সাথেই রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে অবশ্যই বিরাট পুরস্কার দেবেন।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত: ১৪৬)
তাই মুমিনের যাবতীয় কাজ হবে একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহরই জন্যে নিবেদিত। অন্যথায় তা শুদ্ধও হবে না এবং মহান আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্যও হবে না। নিয়ত সংক্রান্ত আলোচ্য হাদিসটির বক্তব্যও তাই। এটি ইসলামী জীবন বিধানের মৌলিক ফর্মুলা হিসেবে বিবেচিত। আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) এই হাদিসটি দিয়ে তাঁর ভাষণ শুরু করতেন। ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব এ কারণেও বেশি যে, মানুষ যখন কোনো ভাল কাজের নিয়ত করে তখনই তাকে এর জন্য একটি সওয়াব দেওয়া হয়। আর যখন সে কাজটি বাস্তবে করে তখন তাকে তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে সে যখন কোনো মন্দ কাজের নিয়ত করে তখন তার আমলনামায় কোনো গুনাহ লিখা হয় না। অথচ সে যখন সেই মন্দ কাজটি বাস্তবে করে তখন তার বিরুদ্ধে কেবল একটি গুনাহই লিখা হয়। আবার মন্দ কাজ সে যত ভাল নিয়তেই করুক না কেন তার জন্য তা বৈধও নয় এবং সে এর কোনো প্রতিদানও আশা করতে পারে না।
পাশাপাশি দ্বীন ও ইসলামের স্বার্থে এবং ইক্বামাতে দীনের জন্য হিজরত করাও এ হাদীসের অন্যতম একটি নির্দেশনা। শুধুমাত্র ইসলামী সমাজ বিনির্মানের জন্য নিজ বাসা-বাড়ী বা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া একটি বিরাট ত্যাগ-কুরবানীর দৃষ্টান্ত। উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে এরকম স্থানান্তর হিজরতের অংশ। পাপ বা গুনাহের কাজে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়া শরয়ী হিজরতের পর্যায়ে গণ্য হবে না। এ সকল কারণেই মানব জীবনে হাদিসটির গুরুত্ব অপরিসীম।
হাদিসটির গুরুত্ব
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়তের এ হাদিসখানা ইসলামের একটি মৌলিক প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে গণ্য। এতে অল্প শব্দে অধিক অর্থ নিহিত রয়েছে। নিয়ত ও হিজরতের বিষয় উক্ত হাদীসে সবিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হওয়ায় ইমাম বুখারী (রহ) কর্তৃক সহিহুল বুখারীর শুরুতেই এ হাদিসটি উল্লেখিত হয়েছে। নিয়তের এহেন গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই অনেক লেখক তাঁদের লিখনীতে এটিকে সর্বপ্রথমে স্থান দিয়েছেন। বর্ণিত আছে, এ হাদিসটি দ্বীন ইসলামের এক তৃতীয়াংশ (ثلث الدين)। ]
হাদিসটির ব্যাখ্যা
হাদিসটির শুরুতেই রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে, নিশ্চয়ই সকল কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। কথাটিতে অল্প শব্দে অধিক অর্থ নিহিত রয়েছে। এটি রাসূলুল¬াহ (সা) অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, তিনি ছিলেন (جَوَامِعُ الْكَلِم) ‘জাওয়ামি‘উল কালিম’।
অর্থাৎ তিনি এমন শব্দ চয়নে কথা বলতেন যাতে অনেক অর্থের সমাহার থাকত। যে কোনো কাজ বিশুদ্ধ হতে হলে তার নিয়ত তথা উদ্দেশ্য বিশুদ্ধ হতে হবে। একইভাবে যে কোনো কাজ থেকে যথাযথ ফলাফল পেতে হলেও নিয়তের বিশুদ্ধতা অপরিহার্য। নিয়ত সঠিক না হলে কাজ সঠিক হতে পারে না এবং কাজের ফলাফলও সঠিক হবে না।
হাদিসটির শুরুতে এই নীতি কথাটি বলার পর রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই আরো পরিষ্কার করার জন্য ব্যাখ্যা হিসেবে বলেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তা-ই বরাদ্দ থাকে যা সে নিয়ত করে। এখানে ‘ইমরুউন’ শব্দটিকে নাকিরা বা অনির্দিষ্টবাচক ব্যবহার করা হয়েছে এবং ‘লি কুল্লি¬’ শব্দটিকে তার সাথে জুড়ে দিয়ে এটিকে আরো ব্যাপক অর্থবোধক করা হয়েছে। ফলে নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, ধনী-গরীব, আলিম-জাহিল, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, চাকুরীজীবী-ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণি পেশার লোককেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এরপর তিনি আরো ব্যাখ্যা করে বললেন, কাজেই কেউ যদি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হিজরত করে তাহলে তার হিজরত দ্বারা সে লক্ষ্যই অর্জিত হবে। আর যদি কারো হিজরত দুনিয়াবি কোনো স্বার্থসিদ্ধি অথবা বিশেষ কোনো নারীকে বিবাহের উদ্দেশ্যে হয় তাহলে তার হিজরত দ্বারা সে উদ্দেশ্যই অর্জিত হবে। এখানে রাসূলুল্লাহ (সা) ‘দুনইয়া’ এবং ‘ইমরাআহ’ শব্দ দু’টিকে নাকিরা বা অনির্দিষ্টবাচক ব্যবহার করেছেন। ফলে এটিও ব্যাপকতা বুঝাচ্ছে। অর্থাৎ দুনিয়ার যে কোনো স্বার্থসিদ্ধি অথবা যে কোনো নারীকে বিয়ের লক্ষ্যে হিজরত করে থাকলে কেবল তা-ই অর্জিত হবে; আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না।
আবার নিয়ত শব্দটিকেও তিনি বহুবচনে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নিয়তের অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তাছাড়া একই কাজের মাধ্যমে কারো ভালো নিয়ত এবং কারো খারাপ নিয়ত থাকতে পারে। অথবা একই কাজের একাধিক নিয়তও থাকতে পারে। অথবা একই কাজ করে একজন সঠিক নিয়তের কারণে সুফল পাবে; আর অপরজন অশুদ্ধ নিয়তের কারণে সুফল থেকে বঞ্চিত হবে ইত্যাদি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قُلْ كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَى شَاكِلَتِهِ.
‘বলে দাও, প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বভাব বা নিয়ত অনুযায়ী কাজ করে।’ (সূরা আল ইসরা, আয়াত: ৮৪)
এখানে আপন স্বভাব অর্থ নিয়ত অনুযায়ী মানুষ তার পরিবারের জন্য সওয়াব লাভের নিয়তে যা খরচ করে, তা সদকা। সহিহ হাদীসে এসেছে,
عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ.
সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে (রা) বলেন, ‘তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা-ই খরচ করো না কেন, তোমাকে তার সওয়াব অবশ্যই দেওয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তারও।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৫৬, ১২৩৩, ২৫৯১, ২৫৯৩, ৩৭২১, ৪১৪৭, ৫০৩৯, ৫৩৩৫, ৫৩৪৪, ৬০১২, ৬৩৫২; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৪২৪৯; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ১৫৪৬; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং ৭৫২; মুসনাদুত ত্বায়ালিসী, হাদিস নং ১৯৬; মুসনাদু আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৭৪৭)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآَخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ.
‘যে আখিরাতের কৃষিক্ষেত্র চায় আমি তার কৃষিক্ষেত্রে বাড়িয়ে দেই। আর যে দুনিয়ার কৃষিক্ষেত্র চায় তাকে দুনিয়ার অংশ থেকেই দিয়ে থাকি। কিন্তু আখিরাতে তার কোনো অংশ নেই।’ (সূরা আশ শূরা, আয়াত: ২০)
অন্যত্র এসেছে,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا (১৮) وَمَنْ أَرَادَ الْآَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا.
‘যে কেউ আশু লাভের আকাক্সক্ষা করে, তাকে আমি এখানেই যা কিছু দিতে চাই দিয়ে দেই, তারপর তার ভাগে জাহান্নাম লিখে দেই, যার উত্তাপ সে ভুগবে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়ে। আর যে ব্যক্তি আখিরাতের প্রত্যাশী হয় এবং সে জন্য প্রচেষ্টা চালায়, যেমন সে জন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত এবং সে হয় মুমিন, এ ক্ষেত্রে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রচেষ্টার যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হবে।’ (সূরা আল ইসরা, ১৮-১৯)
এ প্রসঙ্গে অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) আরো ইরশাদ করেন,
عن أبي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إلى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إلى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ .
‘আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মহান আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক অবয়ব এবং ধন-সম্পদের দিকে তাকান না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর এবং বাস্তব কাজের দিকে তাকান।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৭০৭, ৬৭০৮; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ৭৮২৭; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৩৯৪; সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪১৪৩; শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ১০৪৭৭, ১১১৫১)
অন্যত্র এসেছে,
عَنْ أَبيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ قَالَ رَجُلٌ لأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ سَارِقٍ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ تُصُدِّقَ عَلَى سَارِقٍ فَقَالَ اَللّٰهُمَّ لَكَ الحَمْدُ لأتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ زَانِيَةٍ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلَى زَانِيَةٍ فَقَالَ اَللّٰهُمَّ لَكَ الحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ لأتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فوَضَعَهَا فِي يَدِ غَنِيٍّ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ تُصُدِّقَ عَلَى غَنِيٍّ ؟ فَقَالَ اَللّٰهُمَّ لَكَ الحَمْدُ عَلَى سَارِقٍ وَعَلَى زَانِيَةٍ وعلى غَنِيٍّ فَأُتِيَ فَقِيلَ لَهُ أَمَّا صَدَقَتُكَ عَلَى سَارِقٍ فَلَعَلَّهُ أَنْ يَسْتَعِفَّ عَن سَرِقَتِهِ وَأَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا تَسْتَعِفُّ عَن زِنَاهَا وَأَمَّا الغَنِيُّ فَلَعَلَّهُ أَنْ يَعْتَبِرَ فَيُنْفِقَ مِمَّا أَعْطَاهُ اللهُ .
‘আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, একটি লোক বলল, (আজ রাতে) আমি অবশ্যই সদকা করব। সুতরাং সে আপন সদকার বস্তু নিয়ে বের হলো এবং (অজান্তে) এক চোরের হাতে তা দিয়ে দিলো। লোকে সকালে উঠে বলাবলি করতে লাগল যে, আজ রাতে এক চোরের হাতে সদকা দেওয়া হয়েছে। সদকাকারী বলল, হে আল্লাহ! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা! (আজ রাতে) অবশ্যই আবার সদকা করব। সুতরাং সে নিজ সদকা নিয়ে বের হলো এবং (অজান্তে) এক বেশ্যার হাতে তা দিয়ে দিলো। সকাল বেলায় লোকে বলাবলি করতে লাগলো যে, আজ রাতে এক বেশ্যাকে সদকা দেওয়া হয়েছে। সে তা শুনে আবার বলল, হে আল্লাহ! তোমারই প্রশংসা যে, বেশ্যাকে সদকা করা হলো। আজ রাতে পুনরায় অবশ্যই সদকাহ করব। সুতরাং তার সদকা নিয়ে বের হয়ে গেলো এবং (অজান্তে) এক ধনী ব্যক্তির হাতে সদকা দিলো। সকাল বেলায় লোকেরা আবার বলাবলি করতে লাগল যে, আজ এক ধনী ব্যক্তিকে সদকা দেওয়া হয়েছে। লোকটি শুনে বলল, হে আল্লাহ! তোমারই সমস্ত প্রসংশা যে, চোর, বেশ্যা তথা ধনী ব্যক্তিকে সদকা করা হয়েছে। সুতরাং (নবী অথবা স্বপ্নযোগে) তাকে বলা হলো যে, তোমার সদকা ব্যর্থ হয়নি বরং তোমার যে সদকা চোরের হাতে পড়েছে তার দরুন হয়তো চোর তার চৌর্যবৃত্তি ত্যাগ করে দেবে। বেশ্যা হয়তো তার দরুন তার বেশ্যাবৃত্তি ত্যাগ করবে। আর ধনী; সম্ভবতঃ সে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং সে তার আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর রাহে ব্যয় করবে।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩৫৫, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৪০৯, মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ৮২৮২, ৮৬০২; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৩৩৫৬; সহিহুত তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদিস নং ২০, ৮৭১; কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল, হাদিস নং ১৬১৯৩, ১৬৫০২; সুনানুন নাসাঈ, হাদিস নং ২৫২৩; সুনানুল বায়হাকী, হাদিস নং ৭৬৩৫, ১৩০৩১)
সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَقَالَ لَهُ نَاتِلُ أَهْلِ الشَّامِ أَيُّهَا الشَّيْخُ حَدِّثْنَا حَدِيثًا سَمِعْتَهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ نَعَمْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِىَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ. قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لأَنْ يُقَالَ جَرِىءٌ. فَقَدْ قِيلَ. ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِىَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِىَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ. قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ. وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ. فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِىَ فِى النَّارِ. وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِىَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ. فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِىَ فِى النَّارِ.
‘ইয়াহইয়া ইবন হাবীব আল হারিসী (র)....সুলাইমান ইবন ইয়াসার (রহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা লোকজন যখন আবু হুরাইরা (রা)-এর নিকট থেকে বিদায় নিচ্ছিল, তখন সিরিয়াবাসী নাতিল (রহ) বললেন, হে শাইখ! আপনি রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট থেকে শুনেছেন এমন একখানা হাদিস আমাদেরকে শুনান। তিনি বলেন, হ্যাঁ! (শুনাব)। আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে শহীদ হয়েছিল। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং আল্লাহ তার নেয়ামতরাজির কথা তাকে বলবেন এবং সে তার সবটাই চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে)। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, এর বিনিময়ে কী আমল করেছিলে? সে বলবে, আমি তোমারই পথে যুদ্ধ করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বরং এ জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে বলে, তুমি বীর। তা বলা হয়েছে, এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে। সে মতে তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন মাজীদ অধ্যয়ন করেছে। তখন তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তায়ালা তার প্রদত্ত নেয়ামতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তা চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে) তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, এত বড় নেয়ামত পেয়ে বিনিময়ে তুমি কী করলে? জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে কুরআন অধ্যয়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি তো জ্ঞান অর্জন করেছিলে এজন্যে যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে যাতে লোকে বলে, তুমি একজন ক্বারী। তা বলাও হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেওয়া হবে, সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে যাকে আল্লাহ তায়ালা সচ্ছলতা এবং সর্ববিধ বিত্ত-বৈভব দান করেছেন। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকেও প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের কথা বলবেন। সে তা চিনতে পারবে এবং স্বীকারোক্তিও করবে। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, এসব নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কী আমল করেছো? জবাবে সে বলবে, সম্পদ ব্যয়ের যেসব খাতে সম্পদ ব্যয় করা তুমি পছন্দ করো, আমি সেসব খাতে তোমার সন্তুষ্টির জন্যেই ব্যয় করেছি। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বরং এজন্যে তা করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে ‘দানবীর’ বলে অভিহিত করে। তা বলাও হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেওয়া হবে। সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫০৩২; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ৮২৭৭; শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ২৬১৮; সুনানুন নাসাঈ, হাদিস নং ৩১৩৭)
অন্য হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبيْ مُوْسَى عَبدْ اللهِ بنِ قَيسٍ الأشعريِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سُئِلَ رَسُولُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَن الرَّجُلِ يُقاتلُ شَجَاعَةً ويُقَاتِلُ حَمِيَّةً ويُقَاتِلُ رِيَاءً أَيُّ ذلِكَ في سبيلِ الله؟ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ قَاتَلَ لِتَكونَ كَلِمَةُ اللهِ هي العُلْيَا فَهوَ في سَبِيلِ اللهِ.
‘আবু মূসা আব্দুল্লাহ ইবনে কায়স আশয়ারী (রা) বলেন, আল্লাহর রাসূলকে (সা) এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, যে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য যুদ্ধ করে, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করে এবং লোক প্রদর্শনের জন্য (সুনাম নেয়ার উদ্দেশ্যে) যুদ্ধ করে, এর কোন যুদ্ধটি আল্লাহর পথে হবে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালিমাকে উঁচু করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে, একমাত্র তারই যুদ্ধ আল্লাহর পথে গণ্য হয়।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৭৪৫৮, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫০২৯; আল জামিঈ লিত তিরমিযী, হাদিস নং ১৬৪৬; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ১৯৫৪৩, ১৯৬৩১; সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৭৮৩; সুনানুল বায়হাকী, হাদিস নং ১৮৩২৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৪৬৩৬)
অন্য বর্ণনায় এসেছে
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ اللهِ وَهُوَ يَبْتَغِى عَرَضًا مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أَجْرَ لَهُ
‘আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি বলল, ’হে আল্লাহর রাসূল! এক ব্যক্তি জিহাদ করতে চায়, কিন্তু সে তাতে পার্থিব কোনো স্বার্থ কামনা করে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তার জন্য কোনো সওয়াব নেই। লোকটি ঐ একই কথা তিনবার ফিরিয়ে বলল। মহানাবী (সা) প্রত্যেক বারেই উত্তরে বললেন, তার জন্য কোনো সওয়াব নেই।’ (সুনানু আবী দাঊদ, হাদিস নং ২৫১৮; আল মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন, হাদিস নং ২৪৩৬; সুনানুল বায়হাকী আল কুবরা, হাদিস নং ১৮৩৩২; মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ৩৮৪৫)
অন্যত্র এসেছে,
عَنْ عَبدِ اللهِ بنِ عَبَّاسِ بنِ عَبدِ المُطَّلِبِ رَضِيَ اللهُ عَنه عَن رَسُول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيمَا يَروِي عَن رَبّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالى قَالَ إنَّ اللهَ كَتَبَ الحَسَنَاتِ والسَّيِّئَاتِ ثُمَّ بَيَّنَ ذلِكَ فَمَنْ هَمَّ بحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَها اللهُ تَبَارَكَ وتَعَالى عَندَهُ حَسَنَةً كامِلَةً وَإنْ هَمَّ بهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ عَشْرَ حَسَناتٍ إِلى سَبْعمئةِ ضِعْفٍ إِلى أَضعَافٍ كَثيرةٍ وإنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ تَعَالَى عَندَهُ حَسَنَةً كَامِلةً وَإنْ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً .
‘আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর বরকতময় মহান রব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ পুণ্যসমূহ ও পাপসমূহ লিখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার ব্যাখ্যাও করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি কোনো নেকি করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত করতে পারে না, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য (কেবল নিয়ত করার বিনিময়ে) একটি পূর্ণ নেকি লিখে দেন। আর সে যদি সংকল্প করার পর কাজটি সম্পাদন করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তার বিনিময়ে দশ থেকে সাতশ গুণ, বরং তার চেয়েও অনেক গুণ নেকি লিখে দেন। পক্ষান্তরে যদি সে একটি পাপ করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিকট একটি পূর্ণ নেকি হিসেবে লিখে দেন। আর সে যদি সংকল্প করার পর ঐ পাপ কাজ করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ মাত্র একটি পাপ লিপিবদ্ধ করেন।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৭৫০১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৫৫; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ২৮২৭, ৩৪০২, শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকী, হাদিস নং ৩৩৪; মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ২৩৭৪; সহিহুত তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদিস নং ১৭)
অন্য হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَقُولُ اللهُ إِذَا أَرَادَ عَبْدِي أَنْ يَعْمَلَ سَيِّئَةً فَلَا تَكْتُبُوهَا عَلَيْهِ حَتَّى يَعْمَلَهَا فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا بِمِثْلِهَا وَإِنْ تَرَكَهَا مِنْ أَجْلِي فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً وَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَعْمَلَ حَسَنَةً فَلَمْ يَعْمَلْهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ.
‘আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সা) বলেন, আল্লাহ (পাপ-পুণ্য লেখক ফিরিশতাকে) বলেন, আমার বান্দা যখন কোনো পাপ করার ইচ্ছা করে, তখন তা কাজে পরিণত না করা পর্যন্ত তার আমলনামায় পাপ লিপিবদ্ধ কোরো না। অতঃপর যদি তা কাজে পরিণত করে, তাহলে অনুরূপ ১টি পাপ লিপিবদ্ধ কোরো। আর যদি তা আমার কারণে ত্যাগ করে (কাজে পরিণত না করে), তাহলে তার জন্য ১টি নেকি লিপিবদ্ধ কোরো। পক্ষান্তরে যখন সে কোনো নেকির কাজ করার ইচ্ছা করে এবং তা কাজে পরিণত না করতে পারে, তাহলে তার জন্য ১টি নেকি লিপিবদ্ধ কোরো। আর যদি তা কাজে পরিণত করে ফেলে, তাহলে তার জন্য ১০ থেকে ৭০০ গুণ নেকি লিপিবদ্ধ কোরো।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৭৫০১; সহিহুত তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদিস নং ১৮; শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৩৩৬, ৭০৪৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৩৮২; আল মু’জামুল আওসাত্ব, হাদিস নং ৪৩৯০)
হিজরত প্রসঙ্গে উদাহরণ
হিজরত আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো- ত্যাগ করা, স্থানান্তর করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা, ছেড়ে দেওয়া, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া ইত্যাদি। মহান আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করাও শাব্দিক অর্থে হিজরত। শরীয়তের পরিভাষায় হিজরত হলো- নিজের দ্বীন ও ঈমান সুরক্ষা ও হেফাজতের নিমিত্তে ‘দারুল হারব’ থেকে ‘দারুল ইসলামে’ প্রস্থান করা। মহানাবী (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং নিজেদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষার উদ্দেশ্যে মক্কা (দারুল হারব) ছেড়ে মদিনায় (দারুল ইসলাম) হিজরত করেছিলেন।
হিজরত ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদাত। এ ইবাদাতটি করতে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়। আর তাই এর ফজিলতও অনেক বেশি। হিজরতের গুরুত্ব ও মুহাজিরদের মর্যাদা বর্ণনায় আল কুরআনে অনেক আয়াত এসেছে। এই হিজরতের বিধান রহিত হয়ে যায়নি। নিজের দ্বীন ও ঈমান রক্ষার খাতিরে এটি এখনো চলমান আছে এবং চলমান থাকবে। হাদীসে এসেছে-
عن مُعَاوِيَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَا تَنْقَطِعُ الْهِجْرَةُ حَتَّى تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَلاَ تَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا .
‘মুয়াবিয়া (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি, তওবা করার অবকাশ থাকা পর্যন্ত হিজরতের ধারা বন্ধ হবে না। আর তওবার অবকাশও বন্ধ হবে না পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত।’ (সুনান আবী দাঊদ, হাদিস নং ২৪৮১; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ১৬৯০৬; সুনানুদ দারিমী, হাদিস নং ২৫১৩; কানযুল ‘উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল, হাদিস নং ৪৬২৪৯; সুনানুল বায়হাকী, হাদিস নং ১৭৫৫৬; আল মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ৯০৭; ইরওয়াউল গলীল, হাদিস নং ১২০৮; মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ২৩৪৬)
ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইবাদাতটি সম্পাদন করতে নিয়তের বিশুদ্ধতার প্রতি লক্ষ্য রাখা অতীব জরুরি। অন্যথায় এত ত্যাগ বিফলে যাওয়াকে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। অতএব অন্যান্য ইবাদাতের বেলায়ও নিয়ত যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট করার জন্যই রাসূলুল¬াহ (সা) হিজরতের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
তাছাড়া যে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এ হাদিসটি বর্ণনা করেছিলেন তখন হিজরতের মৌসুম চলছিল। সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষার্থে আল্ল-াহর নির্দেশে তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজেদের ঘর-বাড়ি, বাগ-বাগিচা, সহায়-সম্পত্তি এবং আত্মীয়-স্বজন সব কিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় তাদের এই ত্যাগ নিয়তের শুদ্ধতার অভাবে যেন বিফলে না যায় সে জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সা) নিয়তের গুরুত্ব বলতে গিয়ে বিশেষভাবে হিজরতের উদাহরণ দিয়েছেন।
দুনিয়াবি স্বার্থে হিজরত
হিজরতের উদ্দেশ্য যদি হয় বৈষয়িক কোনো স্বার্থ হাসিল করা কিংবা কোনো নারীকে বিবাহ করা তাহলে এ হিজরত দিয়ে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে না। বরং ঐ উদ্দেশ্যই অর্জিত হবে যার জন্য সে হিজরত করেছে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, হিজরতের সময় সাহাবীদের মধ্যে একজন ছিলেন এমন যিনি একজন মুসলিম নারীকে ভালবাসতেন। ঐ নারী যখন তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে হিজরত করেছেন, তখন তার প্রেমিক পুরুষও তাকে পাওয়ার আশায় হিজরত করতে মনস্থ করে। বিষয়টি অবগত হয়ে রাসূলুলল্লাহ (সা) এভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যেহেতু কোনো নারীকে বিবাহ করা এটি দুনিয়াবি স্বার্থেরই একটি, তাই রাসূলুল্লাহ (সা) প্রথমে সাধারণভাবে দুনিয়ার যে কোনো স্বার্থের কথা বলার পর পরবর্তীতে বিশেষভাবে কোনো নারীকে বিবাহের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য যে, হাদীসে উল্লে¬খিত ঐ নারীর নাম ছিল কায়িলা, উপনাম উম্মু কাইস। পুরুষ সাহাবীটির নাম জানা যায়নি।
নিয়তের অর্থ
নিয়তের আভিধানিক অর্থ হলো- (اَلْقَصْدُ وَالْإِرَادَةُ) ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, অভিপ্রায়, দৃঢ় সংকল্প ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করার দিকে হৃদয় মনের লক্ষ্য আরোপ করা ও উদ্যোগ গ্রহণ করাকে নিয়ত বলে। আল্লামা খাত্তাবী (রহ) নিয়তের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন:
هُوَ قَصْدُكَ الشَّيْئَ بِقَلْبِكَ وَ تَحَرِّيُ الطَّلَبِ مِنْكَ .
‘নিয়ত হলো, তুমি তোমার মনে কোনো কাজের সদিচ্ছা পোষণ করবে এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে।’ (উমদাতুল ক্বারী শারহি সহিহ বুখারী, ১ম খ-, পৃ: ৩)
ফাতহুর রব্বানী গ্রন্থকার বলনে,
تَوَجُّهُ الْقَلْبِ جِهَةَ الْفِعْلِ اِبْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ تَعَالى وَاِمْتثَ لآ آلأمْرِهِ ـ
‘আল্লাহর সন্তষ্টি লাভ ও তাঁর আদেশ পালনার্থে কোনো কাজের দিকে মনে ঐকান্তিক আগ্রহ ও অভিপ্রায় প্রয়োগ করা।’ (ফতহুর রব্বানী ২য় খ-, পৃ: ১৭)
আল্ল¬ামা বাইজাবী (রহ) বলেন:
اِنْبِعَاثُ الْقَلْبِ نَحْوَ مَا يَرَاهُ مُوَافِقًا لِغَرْضٍ مِنْ جَلْبِ نَفْعٍ أَوْ دَفْعِ ضَرَرٍ حَالًا أَوْ مَآلاً .
‘বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোনো উপকার লাভ বা কোনো ক্ষতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তার অনুকূল কাজের জন্য মনের যে উদ্যোগ তাকেই নিয়ত বলে।’ (ফাতহুল বারী শারহিল বুখারী, ১ম খ-, পৃ: ১৩)
মোটকথা কোনো কাজের পেছনে মানব মনে যে উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে তাকেই নিয়ত বলা হয়। নিয়তের মূল স্থান হলো ব্যক্তির অন্তর। ব্যক্তি অন্তরে যা টার্গেট করে সেটিই তার আসল নিয়ত। যে কোনো ‘ইবাদাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য এবং তা মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এই নিয়তই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ; মৌখিক নিয়ত (تلفظ باللسان) নয়। ইসলামী জীবন বিধানে কেবলমাত্র হজ এবং উমরা ছাড়া অপর কোনো ইবাদাতেই মৌখিক নিয়তের বিধান প্রমাণিত নয়। হজ এবং ‘উমরার ইহরাম বাধার সময় মুখে উচ্চারণ করে বলতে হয়- (لَبَّيْكَ حَجًّا – لَبَّيْكَ عُمْرَةً) হে রব! আমি তোমার কাছে হজের বা উমরার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়েছি। এছাড়া অন্য কোনো ইবাদাতেই মৌখিক নিয়তের কোনো ভিত্তি নেই। বরং মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, আমি এখন অমুক কাজটি করব। আর এটিই হলো নিয়ত।
ইবাদাতমূলক কাজে নিয়তের তাৎপর্য
বুনিয়াদি পর্যায়ে ইবাদাত দুপ্রকার। যথা- ১) মাকসুদা বা মূল ইবাদাত: ২) গায়রে মাকসুদা বা সহায়ক ইবাদাত।
১) ইবাদাতে মাকসুদা : যে ইবাদাতের দ্বারা সওয়াব পাওয়ার সাথে সাথে দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্য নিহিত থাকে তাকে ইবাদাতে মাকসুদা বা মূল ইবাদাত বলা হয়। যেমন- সালাত, সওম, হাজ্জ ইত্যাদি।
২) ইবাদাতে গায়রে মাকসুদা : যে ইবাদাত মূল ইবাদাতের সহায়ক। যে ইবাদাত দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যে করা হয় না বরং সেটা মাকসুদা বা মূল ইবাদাতের সহায়ক বা মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন- অজু, তায়াম্মুম ইত্যাদি। এটা সরাসরি ইবাদাত নয় বরং ইবাদাতে মাকসুদা। যেমন সালাত সেটার ওপর নির্ভরশীল। আর সালাতের জন্য সেটা সহায়ক বা মাধ্যমও বটে।
নিয়তের অপরিহার্য গুণাবলি
বিশুদ্ধ নিয়তের জন্য চারটি গুণ থাকা প্রয়োজন।
১. নিয়তকারীকে মুসলিম হতে হবে।
২. নিয়তকারীকে সুস্থ ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে।
৩. যে কাজ বা ইবাদাতের জন্য নিয়ত করছে সেই কাজ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে।
৪. যে কাজ বা ইবাদাত করতে চায় তা সম্পাদন করার সুন্নত নিয়ম এবং উদ্দেশ্য জানা থাকতে হবে।
সঠিক নিয়তের জন্য সঠিক ইলম
ইলম হলো আমলের পূর্বশর্ত। ইলম না থাকলে আমল করা যায় না। ইলম সঠিক না হলে আমলও সঠিক হয় না। ইলম অর্জনকে তাই ইসলামে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং সেই ইলম যাতে সঠিক হয় সে ব্যাপারেও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম নাযিলকৃত আয়াত হচ্ছে ইলম অর্জন সংক্রান্ত। মহান আল্লাহ বলেন,
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ.
‘পড়–ন তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আল আলাক্ব, আয়াত: ১)
‘যার ইলম (জ্ঞান) আছে তাকে বলা হয় আলিম (জ্ঞানী)। মহান আল্ল¬াহ আলিমের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ .
‘তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন আর যারা আলিম (জ্ঞানী), মহান আল্ল¬াহ তাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করেন। আর তোমরা যা কিছু করো সে সম্পর্কে আল্লাহ খবর রাখেন।’ (সূরা আল মুজাদালা, আয়াত: ১১)
অন্য আয়াতে মহান আল্ল¬াহ বলেন:
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاء اللَّيْلِ سَاجِداً وَقَائِماً يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ .
‘এ লোকের চাল-চলনই ভালো, না ঐ ব্যক্তির যে আদেশ পালন করে চলে, রাতের বেলা দাঁড়ায় ও সিজদা করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রবের রহমতের আশা করে? তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে।’ (সূরা আয্ যুমার, ৯)
আবার যার ইলম যত বেশি তার জবাবদিহিতাও তত বেশি। ইলম অনুযায়ী আমল করতে না পারাও আরেক বিপদ। আমলবিহীন ইলম ফলবিহীন গাছের ন্যায়। ফলবিহীন গাছের চেয়ে ফলবান গাছের যেমন মূল্য বেশি, আমলবিহীন আলিমের চেয়েও তেমনি আমলদার আলিমের মূল্য বেশি। তাই জাহিল ব্যক্তি কোনো অন্যায় করলে তেমন চোখে লাগে না; কিন্তু আলিম ব্যক্তি অন্যায় করলে তা খুব দ্রুতই দৃশ্যমান হয়ে পড়ে।
হাদীসে এসেছে,
عن عبد الله بن عمرو رَضِيَ اللَّهُ عنه عن رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قال قَلِيْلُ الْفِقْهِ خَيْرٌ مِنْ كَثِيْرِ الْعِبَادَةِ، وَكَفَى بِالْمَرْءِ فِقْهًا إِذَا عَبَدَ اللهَ، وَكَفَى بِالْمَرْءِ جَهْلاً إِذَا أَعْجَبَ بِرَأْيِهِ، وَإِنَّمَا النَّاسُ رَجُلاَنِ مُؤْمِنٌ وَجَاهِلٌ فَلاَ تُؤْذِ الْمُؤْمِنَ وَلاَ تُحَاوِرِ الْجَاهِلَ .
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, না জেনে বেশি ইবাদাত করার চেয়ে জেনে বুঝে অল্প ইবাদাত করা উত্তম। প্রকৃত ফকিহ সে-ই যে বুঝে শুনে ইবাদাত করে। আর প্রকৃত জাহিল সে-ই যে নিজেকে প-িত মনে করে। মানুষ দুরকম : মুমিন এবং জাহিল। অতএব তুমি মুমিনকে কখনো কষ্ট দিও না; আর জাহিলের সাথে তর্ক করো না।’ (কানযুল ‘উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল, হাদিস নং ২৮৭৯৪; আল মু’জামুল আওসাত্ব, হাদিস নং ৮৬৯৮)
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
عن هَرِمِ بن حَيَّانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ انه قال إِيَّاكُمْ وَالْعَالِمَ الْفَاسِقَ فَبَلَغَ عُمَرَ بنَ الْخَطَّابِ فَكَتَبَ إليهِ وَأَشْفَقَ مِنْهَا مَا الْعَالِمُ الْفَاسِقُ قَالَ فَكَتَبَ إليهِ هَرِمٌ ياَ أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ وَاللهِ مَا أَرَدْتُ بِهِ اِلاَّ الْخَيْرَ يَكُونُ إِمَامٌ يَتَكَلَّمُ بِالْعِلْمِ وَيَعْمَلُ بِالْفِسْقِ فَيُشَبِّهُ عَلَى النَّاسِ فَيَضِلُّوْنَ .
‘হারিম ইবনে হাইয়ান (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা ফাসিক আলিমদের থেকে বেঁচে থাকবে। তার এই কথা যখন উমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) কানে পৌঁছল, তিনি তাকে লিখে পাঠালেন এবং (বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে) ফাসিক আলিম বলতে তিনি কাদেরকে বুঝিয়েছেন তা জানতে চাইলেন। (রাবী বলেন) অতঃপর হারিম তাঁকে জবাবে লিখলেন, হে আমীরুল মুমিনিন! আল্লাহর কসম, এর দ্বারা আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আলিম ব্যক্তি সমাজের ইমাম হন এবং তাঁর ইলম অনুযায়ী মানুষের মাঝে কথা বলেন। এরপর তার আমলে যদি ফাসিকী প্রকাশ পায় তাহলে তা মানুষের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি করে এবং তারা ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়।’ (সুনানুদ দারিমী, হাদিস নং ৩০০; কানযুল ‘উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল, হাদিস নং ২৯৪০৭)
ইলম না থাকলে মানুষ সঠিক আমল করতে পারে না। আর সঠিক ইলম থাকলে আমল করাও সহজ হয়। তাই ইলম থাকা সত্ত্বেও আমল না করা বড় অপরাধ। যারা প্রকৃত আলিম তারাই সঠিক আমল করেন এবং আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভয় করেন। মহান আল্লাহ বলেন;
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاء .
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা আলিম, তারাই আল্ল¬াহকে ভয় করে।’ (সূরা ফাতির, আয়াত: ২৮)
আর মহান আল্লাহর কাছে তাঁরাই বেশি মর্যাদাবান যাঁরা তাঁকে বেশি ভয় করে। মহান আল্ল¬াহ বলেন;
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوباً وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ .
‘হে মানব সমাজ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্র বানিয়েছি। যাতে তোমরা একে অপরকে (ঐসব নামে) পারস্পরিক পরিচিতি লাভ করতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে তারাই বেশি মর্যাদাবান, যারা তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে। অবশ্যই আল্ল¬াহ সব কিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন।’ (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
অতএব সহিহ ইলম অর্জন করে প্রকৃত আলিম হওয়া যেমন জরুরি, নিজের ইলম অনুযায়ী আমল করাও তেমনি জরুরি। ইলম না থাকলেও যেমন হবে না, যতটুকু ইলম আছে সে অনুপাতে আমল না করলেও চলবে না। যার যার ইলম অনুযায়ী কে কতটুকু আমল করল তাও তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। সঠিক ইলম থাকলেই শুধু সঠিক নিয়ত করা যাবে। আর সঠিক নিয়ত করতে পারলেই সঠিক ফল পাওয়া যাবে।
হাদিসটির শিক্ষা
১. সকল কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজ ভাল নিয়তে করা জায়েয নয়। ছোট ও বড় সকল কাজের ব্যাপারেই সঠিক নিয়ত থাকতে হবে। হজ ও উমরা ব্যতীত অন্যান্য ইবাদাতে নিয়ত মুখে উচ্চারণ (তালাফ্ফুজ) করার প্রয়োজন নেই।
২. দ্বীন ও ঈমানের হেফাজতের জন্য প্রয়োজনে হিজরত করতে হবে। দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ঈমান রক্ষার্থে হিজরতের বিধান কেয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে।
৩. রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন (جَوَامِعُ الْكَلِم) ‘জাওয়ামিউল কালিম’। অর্থাৎ তিনি এমন শব্দ চয়নে কথা বলতেন যাতে অনেক অর্থের সমাহার থাকত। এটি তাঁর নবীয়ানা বৈশিষ্ট্য।
৪. দুনিয়ার স্বার্থে হিজরত করা বড় অপরাধ। মুমিনের যাবতীয় কাজ হবে মহান রবের সন্তুষ্টি ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর নির্দেশনার আলোকে।
৫. আল্লাহ তায়ালা অন্তরের খবরও জানেন। সেটা সার্বক্ষণিক খেয়াল করে মুমিনের সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া অপরিহার্য।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে আলোচ্য হাদীসের শিক্ষার আলোকে নিজেদের সামগ্রিক কাজে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদ (সা) এর নির্দেশনা অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর শাফায়াত অর্জনের লক্ষ্য বানাবার তাওফিক দান করুন। এই বিষয়গুলোর আলোকে বাস্তব জীবনে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুনিয়াবি কল্যাণ ও আখিরাতে নাজাতের পথকে সহজতর করুন। আমীন।
লেখক : প্রধান মুহাদ্দিস (সহকারী অধ্যাপক), বিজুল দারুল হুদা কামিল মাদরাসা, বিরামপুর, দিনাজপুর।
দারসুল হাদিস পড়তে ভিজিট করুন>>