এক নজরে
শহীদ বদিউজ্জামান মন্ডল
মৃত আব্বাস আলী
খোবেলা খানম
অক্টোবর ৮, ১৯৯১
গ্রাম : হোল্ডিং-১২০, তেলিহার, ডাকঘর, আমদই, ইউনিয়ন- কুসুম্বা, থানা : পাঁচবিবি, জেলা : জয়পুরহাট
সাথী
ফাজিল, ৩য় বর্ষ
ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল, কাকরাইল।
“বদিউজ্জমান পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো এক ব্যতিক্রমী মৃত্যু। রাত ৮টায় বগুড়াতে লাশবাহী গাড়ি পুলিশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। (এটাকে গ্রেফতার নাকি কিডন্যাপ বলা হবে) থানা সূত্রে জানা গেছে গত ৫ নভেম্বর জামায়াতের মিছিলে পুলিশের হামলা নিয়ে সদর থানার ওসি বাদি হয়ে মামলা করেন। যার নম্বর হচ্ছে ০৯। তারিখ ০৫.১১.১২। মোদ্দাকথা যে ঘটনায় তার মৃত্যু সে মামলায় সেই আসামি; ঘটনার আট মাস পরেও সে মামলা এখনও পেন্ডিং। এই মামলায় বদিউজ্জামানকে ১৩ নম্বর আসামি করা হয়েছিল। তার জন্য কি সত্যি হলো আনলাকি ১৩? অবশ্য ধৈর্যশীলরা আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালার অপেক্ষায় থাকেন।”
শহীদের পরিচিতি
শহীদ বদিউজ্জামান জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার তেলিহার গ্রামে ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আব্বাস মন্ডল ও মা খোবেলা খানমের সাত সন্তানের মধ্যে তিনি সবার ছোট এবং একমাত্র ছেলে। অন্য ছয় বোনেরই বিবাহ হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে ভাল ছাত্র হিসেবে তিনি সকলের নিকট পরিচিত ছিলেন। শহীদ বদিউজ্জামান তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন হাতিগাড়া ডিএসএস মাদ্রাসা থেকে। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক শেষ করে কোড়ই নুরুল হুদা কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ফাজিল শ্রেণীতে ভর্তি হন। শাহাদাতের আগ পর্যন্ত তিনি ফাজিল তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ২০০৪ সালে বাবা মারা গেছেন। মা খোবেলা খানম গৃহিণী। শহীদের বোন জামাইদের সহযোগিতায় তার সংসার কোন মতে চলে।
যেভাবে তিনি আল্লাহর ডাকে চলে গেলেন
দিনটি ছিল ৫ নভেম্বর ২০১২ সাল। অবৈধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে জয়পরহাটেও সেদিন বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। উক্ত মিছিলে সরকারি নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় ও লাঠিচার্জ করে। এর একপর্যায়ে বদিউজ্জামানের ডান চোখে রাবার বুলেটের আঘাত লাগে। এরপর পুলিশের বেপরোয়া লাঠির আঘাত মাথা ফেটে যায়। ঘটনা স্থল থেকে ২ কিলোমিটার দূরে জযপুরহাট হাসপাতালে তাকে আনা হয় ও পরে বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। মাথায় ৮-১০টি সেরাই ছিল। সেখানেও অবস্থার অবনতি হলে পরে তাকে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। তারপর কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে স্থনান্তর করা হয়। অবস্থার আরো খারাপ হলে তার একটি চোখ তুলে ফেলতে হয়। এখানেই ১০-১১-২০১২ তারিখের ঘটনার ৫ দিন পর ফজর নামাজের পরপরই তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।
১১ নভেম্বর ২০১২ তারিখ শহীদের জানায়ার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাবিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে প্রায় ৩০ হাজার লোকের বিশাল সেই জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা সানোয়ার হোসেন। জানাযা শেষে শহীদের নিজ বাড়িতেই দাফন করা হয়।
সামগ্রিক ঘটনার বিবরণ
বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে এবং বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে জয়পুরহাটেও সেদিন বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। উক্ত মিছিলে সরকারি নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় ও লাঠিচার্জ করে। সে মিছিলে ৫০ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক লোক আহত হন। তাদের একজন ছিলেন শহীদ মো: বদিউজ্জামান। শহীদ মো: বদিউজ্জামানের ডান চোখে রাবার বুলেটের আঘাত লাগে। এরপর পুলিশের বেপরোয়া লাঠির আঘাতে মাথা ফেটে যায়। তারপর তাকে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার আরো খারাপ হলে তার একটি চোখ তুলে ফেলতে হয়। এখানেই ১০-১১-২০১২ তারিখ ঘটনার ৫ দিন পর ফজর নামাজের পরপরই তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।
পরপর তার লাশ ঢাকা থেকে জয়পুরহাট পৌঁছানো, জানাজা দাফন ও মামলা ইত্যাদি নিয়ে যেসব নাটক মঞ্চ হয় তা জাতীয় পত্রিকায় বর্ণিত হয়েছে। ১২ নভেম্বর ২০১২ দৈনিক সংগ্রাম রিপোর্ট করে; জয়পুরহাটে শিবির নেতা শহীদ বদিউজ্জামানের জানায়ায় জনতার ঢল, জয়পুরহাট; গত ৫ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত শিবির নেতা বদিউজ্জামানের জানায়ার একাংশ সংগ্রাম জয়পুরহাট থেকে মাশরেকুল আলম : পাঁচবিবিতে শিবির নেতা শহীদ বদিউজ্জামানের নামাজে জানাযা শেষে পুলিশি প্রহরায় পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়েছে। তাকে শেষ বিদায় জানাতে নামাজে জানাযায় নেতৃবন্দসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে।
নামাজে জানাজায় জনতার ঢল
শনিবার সন্ধ্যায় লাশ জয়পুরহাটে পৌঁছলে পুলিশি হেফাজতে লাশ মর্গে রাখা হয়। সকালে লাশের ময়না তদন্ত করা হয়। সকালে জয়পুরহাট সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশি প্রহরায় নিহত বদিউজ্জামানের লাশ তার গ্রামের বাড়ি পাঁচবিবি উপজেলার তেলিহার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। পূর্ব ঘোষিত সময় অনুযায়ী হাবিবপুর স্কুল মাঠে সকাল সাড়ে ১১টায় তার নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার পূর্বে নিহত বদিউজ্জামানের গ্রাম তেলিহার ও জানাযার স্থানে হাবিবপুর স্কুল মাঠের চতুর্পাশের রাস্তায় পুলিশ সশস্ত্র অবস্থান নেয়। এতে জনমনে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আইন-শৃংঙ্খলা রক্ষায় এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন স্থানে থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষসহ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা জানাযায় শরিক হওয়ার জন্য তেলিহার গ্রাম ও হাবিবপুর স্কুল মাঠে জমায়েত হতে থাকেন। জানাযার নামাজে ইমামতি করেন জামায়াতকর্মী মাওলানা সানোয়ার হোসেন। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার হাবিবপুর স্কুল মাঠে নামাজে জানাজা শেষে ৫ নভেম্বর পুলিশ-জামায়াত সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত শিবির নেতা বদিউজ্জামানকে তেলিহার গ্রামে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে পুলিশি প্রহরায় দাফন করা হয়েছে।
লাশ ছিনিয়ে নেয় পুলিশ
ঢাকা থেকে জয়পুরহাটে আসার পথে বগুড়ার শেরপুরে নিহত বদিউজ্জামানের লাশবাহী মাইক্রোবাস পুলিশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বলে অভিযোগ করেছেন শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা ইয়াছিন আরাফাত। ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় এইচআরডি সম্পাদক ইয়াছিন আরাফাত বলেন, ৫ নভেম্বর আহত হয়ে বদিউজ্জামান জয়পুরহাট থেকে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হলেও গত ৫ দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কোন নেতা দাবি করেনি যে সে লীগের লোক। অথচ বগুড়া থেকে পুলিশের মাধ্যমে লাশ ছিনতাই করে তারা লাশ নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি করে বলে প্রমাণ করেছে। বদিউজ্জামানের জানাযায় আওয়ামী লীগের কোন নেতা উপস্থিত নেই কেন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, যদি বদিউজ্জামান তাদের কর্মী হতো তাহলে জানাযায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হতেন।
লাশ নিয়ে রাজনীতি
শহীদ বদিউজ্জামানের মা খোবেলা বেগম (৭৫) তার ছেলে শিবিরকর্মী নয় দাবি করে শিবির নেতা এরফান ও আমিনুরসহ অজ্ঞানামা অসংখ্য শিবিরকর্মীর নামে সদর থানায় শনিবার সন্ধ্যায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করিয়েছে। তবে এলাকাবাসী মনে করছেন, এটা আওয়ামী লীগের লাশ নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতিরই অংশ।
থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ নভেম্বর জামায়াতের মিছিলে পুলিশের হামলা নিয়ে সদর থানার ওসি (তদন্ত) খায়রুল বাশার বাদি হয়ে মামলা করেন। যার নং হচ্ছে ৪৭। তারিখ ৬.১১.১২। এই মামলায়ও বদিউজ্জামানকে ১৩ নং আসামি করা হয়েছিল।
শহীদ বদিউজ্জামানের বোন জেবউননেছা, মাদরাসার শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, মসজিদের ইমাম মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, কৃষক খাদেমুল, প্রতিবেশী মেরিনাসহ অসংখ্য বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বদিউজ্জামানের শিবির নেতা হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ দিয়েছেন। সন্তানহারা পাগলিনী মাকে ভুল বুঝিয়ে এ ধরনের মামলা করানো হয়েছে, বলে তারা মনে করেন। ছাত্রশিবির জেলা শাখার পক্ষ থেকে নিহত বদিউজ্জামানের ব্যবহৃত ডায়েরি, রিপোর্ট বই, বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি স্বাক্ষর, ওই দিন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিসহ নানা প্রমাণ দেখানো হয়।
স্বজনদের কান্না
‘সাত ভাই চম্পা’ বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের এক সেরা উপাখ্যান। সাত ভাইয়ের ভেতর একটি মাত্র বোন দিয়ে সে কাহিনী। অনেকটা সেই আদলেই বদিউজ্জামানদের পরিবারটি; তবে কিছুটা ভিন্ন্ এভাবে বলা যায় ‘ছয় বোন, জামান’। ছয় বোনের পর আদরের একমাত্র ভাই বদিউজ্জামান। তাই সবার কলিজার টুকরা ছিল সে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় তার ওপর সদর আরো বেড়ে যায় সবার। তিনি তার এলাকা তেলিহার উপশাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার জীবন দিয়ে হলেও সাঈদীর জীবন বাঁচাতে চাই’। ঘটনার দিন তার গায়ে জ্বর ছিল, তার পরও তিনি বলেছেন মিছিলে যাবো। স্বজনেরা তাদের শঙ্কার কথা বললে তিনি নিরুদ্বেগভাবে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে শহীদ হবো’। মা স্বপ্নযোগে ছেলেকে দেখেন, শহীদ বদিউজ্জামান সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি গায়ে বাসায় এসেছে, মাকে বলছে, অনেক লোকজন আসছে খাবার দাবার দাও।
বদিউজ্জামান পৃথিবীর ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী মৃত্যু। পাঁচদিন তিনি মৃত্যুর আলিঙ্গন করে শাহাদাত বরণ করেন। এ সময় কোন খোঁজ না নিলেও মৃত্যুর পরই তাকে আওয়ামী লীগের কর্মী বলে দাবি করা হয়। শুধু কি তাই ঢাকা থেকে ফেরার পথে বগুড়া শেরপুর হতেই পুলিশ পিছু ধাওয়া করে এবং রাত ৮টায় বগুড়াতে লাশবাহী গাড়ি পুলিশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। (এটাকে গ্রেফতার নাকি কিডনাপ বলা হবে)। পরিবারের অনুমতি বা উপস্থিতি ছাড়াই নিজেদের মতো করে পোস্টমর্টেম করে। ১২ ঘণ্টা পর পরিবারের কাছে লাশ ফেরত দেয়। শত শত পুলিশের উপস্থিতিতে জানায়াতে ৩০ হাজার মানুষ আসলেও লাশ দাবিদার আওয়ামী লীগের কেউ আসেনি। অবশ্য ধৈর্যশীলরা আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালার অপেক্ষায় থাকেন।
ব্যক্তিগত প্রোফাইল
নাম : শহীদ মো: বদিউজ্জামান
পেশা : ছাত্র (ফাজিল, ৩য় বর্ষ)
সাংগঠনিক মান : সাথী
জন্মতারিখ ও বয়স : ১৮.১০.১৯৯১, বয়স ২২ বছর
আহত হওয়ার তারিখ : ৫ নভেম্বর ২০১২, ডান চোখে রাবার বুলেট লেগেছে। মাথায় পুলিশের লাঠির আঘাত
শাহাদাতের তারিখ : ১০.১১.২০১২, ফজর নামাজের পর।
শাহাদাত স্থান : ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল, কাকরাইল।
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : হোল্ডিং-১২০, তেলিহার, ডাকঘর, আমদই, ইউনিয়ন- কুসুম্বা, থানা : পাঁচবিবি, জেলা : জয়পুরহাট
পিতা : মৃত আব্বাস আলী
মাতা : খোবেলা খানম
শহীদ বদিউজ্জামান মন্ডল
মৃত আব্বাস আলী
খোবেলা খানম
অক্টোবর ৮, ১৯৯১
গ্রাম : হোল্ডিং-১২০, তেলিহার, ডাকঘর, আমদই, ইউনিয়ন- কুসুম্বা, থানা : পাঁচবিবি, জেলা : জয়পুরহাট
সাথী
ফাজিল, ৩য় বর্ষ
ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল, কাকরাইল।