শহীদ সাইফুল ইসলাম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২২ অক্টোবর ১৯৯২ | ৪৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

আওয়ামী বাকশালী ঘাতকচক্রের নিষ্ঠুর শিকার চট্টগ্রামের নাজিরহাটের শিবিরকর্মী সাইফুল ইসলাম। সাইফুলের হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম বর্বরতা ও পৈশাচিকতাকেও হার মানিয়ে দেয়। নরঘাতকরা প্রথমে তার হাত পা বিচ্ছিন্ন এবং পরে গুলি ও জবাই করে। এইভাবে আল্লাহর দ্বীনের এই কিশোর সৈনিককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সাইফুলকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়। আওয়ামী বাকশালীদের মানব খুনের এ আর এক নিকৃষ্টতম নজির। কাপুরুষোচিত এই হত্যাযজ্ঞ ঘটে ২২ শে অক্টোবর, ১৯৯২ সালে।

প্রাথমিক পরিচয়
চট্টগ্রাম নাজিরহাটে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলম সাহেবের সুপ্রিয় সন্তান সাইফুল ছিল পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে চতুর্থ । দুর্দান্ত সাহসী সাইফুল স্কুলজীবনে মুজিববাদী ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইসলামের শাশ্বত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৮৭ সালে দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ইসলমাী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন। ইসলাম ও মানবতার দুশমন আওয়ামী চক্র সাইফুলের শিবিরে যোগদানকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। ফলে এক হত্যা মামলায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়িয়ে দেয় স্কুলছাত্র সাইফুলকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক সাইফুলকে গ্রেফতার করে কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠ নিক্ষিপ্ত করা হয়। একে একে তিন বছরের ও অধিক সময় কাটিয়ে দিলেন কারাগারে। অবশেষে ১৯৯২ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান।

শাহাদাতের ঘটনা
মিথ্যা হত্যা মামলায় সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় বছরের (১৯৯২) শুরুতে বেকসুর খালাস পান। কারাগার থেকে বেরিয়েও আওয়ামী সন্ত্রাসের কারণে ফিরে যাননি প্রিয় জন্মস্থান নাজির হাটে। চট্টগ্রাম শহরের হালিশহরে এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে এক প্রকার নির্বাসন জীবনযাপন করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, শাহাদাতের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে নাজিরহাট গ্রামের বাড়ি গিয়ে মুজিবাদী সন্ত্রাসের শিকার।

২২ শে অক্টোবর ১৯৯২ সকাল ১১ টার দিকে সাইফুল নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রাম শহরে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে এক আত্মীয়য়ের সাথে সাক্ষাৎ করার মানসে সরকারহাট বাজারে নেমে পড়েন। কোস্টার থেকে নামার পরপরই সাইফুলের সাথে পূর্ব পরিচিত এক আওয়ামী লীগ কর্মী জনৈক হারুনের সাথে দেখা হয়। এই কুখ্যাত হারুন আত্মীয়তার সূত্র ধরে এক কুলিং কর্নারে নিয়ে সাইফুলকে চা নাস্তা করাতে থাকনে। এরই মাঝে হারুন সুকৌশলে ছাত্রলীগ কর্মী নূরুল আনছার ও শহীদ হোসেনকে কিলিংস্পট কাটিরহাটে পাঠিয়ে কুখ্যাত শাহ নেওয়াজ তৈয়ব গ্রুপকে এ খবর দেয়। এদিকে আপ্যায়নের পর হারুন সরলমনা সাইফুলকে পুরাতন স্কুল ও প্রাক্তন লজিং বাড়িতে বেড়িয়ে আসার প্রলোভন দেখিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন।

সে সাইফুলকে স্কুলে নিয়ে অতীতের বিভিন্ন ঘটনা বলে সময় কাটাতে থাকে। এ সময় হারুনের মস্তিষ্কে খুনের উন্মাদনা পেয়ে বসেছিল। হারুনের গতিবিধি টের পেয়ে সাইফুল অনেকটা জোরপূর্বক বিদায় নিয়ে একটি রিক্সায় চড়ে আত্মীয়ের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রিক্সা সরকারহাট থেকে দক্ষিণ দিকে স্থানীয় মইগ্যারহাট পৌঁছলে শাহনেওয়াজ সেকান্দর তৈয়ব। চক্র তিনটি টেক্সিযোগ এসে সাইফুলের রিকশার গতিরোধ করে। সন্ত্রাসীদের দেখে সাইফুল রিকশা থেকে লাফিয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ইটের আঘাতে মাথা ফেটে সাইফুল মাটিতে পড়ে যায়।

সন্ত্রাসীরা পৈশাচিক উল্লাসের সাথে সাইফুলকে টেক্সিতে তুলে কিলিং স্পট কাটিরহাটে নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় অমানুষিক নির্যাতন নিপীড়ন। এরপর খুনের উদ্দেশ্যে সাইফুলকে নিয়ে যাওয়া হয় আরো অর্ধমাইল ভেতরে উদালিয়ার গভীর পাহাড়ে। এর মাঝে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ছুরি দিয়ে সমস্ত শরীর ক্ষত বিক্ষত করা হয়। অবিরাম রক্তের স্রোতে মাটি লাল হয়ে যায়। এই মর্মান্তিক দৃশ্যের পরও পাষাণের হৃদয়ে সামান্য ব্যথা অনুভূত হয়নি। এক সন্ত্রাসী কিরিচের আঘাতে ডান হাতের কনুই পর্যন্তম্পূর্ণ কেটে নেয়। সাইফুল আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান।

পাষন্ডদের উন্মাদনা আরো এজিদী রূপ ধারণ করে। আরেক সন্ত্রাসী কোপ দিয়ে বাম হাত কেটে নেয় এরপর নাভীর নিচ দিয়ে কিরিচ চলিয়ে দ্বিখন্ডি করা হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা সাইফুলকে। নরপিশাচের উন্মাদনা তখনো যেন কমেনি। মৃত সাইফুল গলায় জবাই করে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে আবু লাহাব আবু জেহেলে উত্তরসূরিরা। এত কিছু পরও রিভলবারে গুলি চালিয়ে উল্লাস করে মানব সভ্যতার দুশমনরা দুজন হত্যকারীকে পুলিশ গ্রেফতারে পর হত্যাযজ্ঞের এই লোমহর্ষক বর্ণনা প্রদান করে। সন্ত্রাসীরা নিকৃষ্টতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দেহের টুকরোগুলো পুটলি বেঁধে আরো গভীর অরণ্যে নিয়ে পুঁতে ফেলে। এরপর খুনিচিক্র মনিয়াপুকুর বাজারে উল্লাস করতে থাকে।
শিবিরকর্মী সাইফুলের এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরও পুলিশ প্রশাসন নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পরও পুলিশ ২জন ছাড়া চিহ্নিত খুনিদের গ্রেফতার করেনি। এমনকি শহীদের লাশটি পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারে নি কর্তব্যরত পুলিশ।

প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল
সাইফুলের এই মর্মান্তিক শাহাদাতের পর ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে । খুনিচক্রের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে ২৬শে অক্টোবর ১৯৯২ সোমবার বৃহত্তম চট্টগ্রামে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় ২৬ শে অক্টোবর বাদ আসর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে বিশাল প্রতিবাদসভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ও সেক্রেটারি জেনারেল জনাব হামিদ হোসাইন আজাদ সমাবেশে পুশি প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকার তীব্র নিন্দা এবঙ দুষ্কৃতকারীদের ফাঁসিদাবি করেন। জানায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান ২৭ অক্টোবর ১৯৯২ সালে এক বিবৃতিতে সাইফুল হত্যায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নিষ্ঠুর তামাসা দেখছেন। সরকারে ন্যক্কারজনক ভূমিকার কারণে একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

পিতা-মাতার আর্তনাদ
শহীদ সাইফুলের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পিতা-মাতা ভাইবোনের আর্তনাদ পরিবেশকে ভারী করে তুলেছে। পিতা মাতা পাগলের মতো এখনো শহীদ সাইফুলকে খুঁজে বেড়ান। মা বাবা বুঝতে রাজি না তাদের পরম আদবের সন্তান এই পৃথিবীতে আর নেই।


এক নজরে শহীদ মু. সাইফুল ইসলাম
নাম: শহীদ সাইফুল ইসলাম
পিতা : মরহুম ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলম
মাতা : শামছুন্নাহার
ঠিকানা : নাজির হাট, ফটিকছড়ি, চট্রগ্রাম
ভাইবোন : ৫ ভাই ৩ বোন
অবস্থান : ৩য়
শিক্ষাগত যোগ্যতা : দশম শ্রেণী
শাহাদাতের তারিখ : ২২ শে অক্টোবর ১৯৯২ বেলা ১ টা
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ
কবর যেখানে : লাশ পাওয়া যায়নি, হত্যার পর গুম করা হয়েছে
সাংগঠনিক মান : কর্মী
শাখা : চট্টগ্রাম মহানগরী।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ সাইফুল ইসলাম

পিতা

ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলম

মাতা

শামছুন্নাহার

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৫ ভাই ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

নাজিরহাট, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

দশম শ্রেনী,

শাহাদাতের স্থান

সরকারহাট